**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
পল্লীকবি জসীমউদ্দিন (১৯০৩-১৯৭৬)
এর লেখা সাহিত্য কর্মের মধ্যে নক্সী কাঁথার মাঠ কাব্য গ্রন্থ টি অন্যতম। ১৪ পর্বে বিভক্ত কাব্যটিতে গ্রামীন জীবনের এক অপরূপ চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রথমাঙ্কের বর্ণনীয় বিষয়— একটি মাঠ দিয়া বিভক্ত করা দুইটি পাশাপাশি গ্রাম, সেই মাঠটিই কালে “নক্সী-কাঁথার মাঠ” নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল । দুইটি গ্রাম দুইটি পাতার মতো জড়াজড়ি করিয়া আছে— ইহাদের মধ্যে ভাব ও অসদ্ভাব— কিছুরই অভাব নাই;—
“ও-গাঁর বধূ ঘট ভরিতে যে ঢেউ জলে জাগে,
কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয় এসেও লাগে।
এ-গাঁর চাষী নিঝুমরাতে বাঁশের বাঁশীর সুরে
ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে।""
এই ভাব -বনিময় সত্ত্বেও সময়ে সময়ে সুরটা বেসুরো হইয়া বাজে :—
“এ-গাঁর লোকে করতে পরখ ও-গাঁর লোকের বল
অনেক বারই লাল করেছে জঙ্গীত বিলের জল।"
দ্বিতীয় অঙ্কে কাব্যের নায়ক কিশোর রূপার চিত্র। রূপা চাষার ছেলে—তাহার বর্ণটি কালো। এই কালো রূপে সে সমস্ত গ্রামটি আলো করিয়া রাখিয়াছে। মুসলমান কবির চোখে এই কালো রংটি সকল রং-এর সেরা— এখানে ইনি বৈষ্ণব কবির মতো :
"কালোয় যে জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন,
তারি পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন।"
রূপা শুধু কালো রং ও কিশোর মূর্তি দিয়া সেই গ্রামটি মুগ্ধ করে নাই।
তৃতীয় অঙ্কে নায়িকা সাজুর কথা, কবি বলিতেছেন এই রূপসী কিশোরী “তুলসীতলার প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা," সে যেন “দেবদেউলের ধূপ" কিন্তু মন্দিরের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাইয়াও তিনি মুসলমানের গৃহের আঙ্গিনার কথা ভুলিয়া যান নাই।
সাজুর সম্বন্ধে লিখিয়াছেন,
“লাল মোরগের পাথার মত ওড়ে তাহার শাড়ী"।
সাজু হাঁড়ির উপর নানারূপ চিত্র আঁকিতে জানে, সিকায় ফুল তুলিতে তাহার হাত অতি নিপুণ,
“বিয়ের গানে ওরই সুরে সবারই সুর কাঁদে, সাজু গাঁয়ের লক্ষ্মী মেয়ে বলে কি লোক সাধে?"
ইহার পর কয়েক অঙ্কে শ্যামল কিশোর নায়ক ও কিশোরী গৌরী সাজুর প্রেমের লুকোচুরি খেলা;- এখানে যৌবনের উদ্দাম ফূর্তি, করস্পর্শে অঙ্গে বিদ্যুৎ বহিয়া যাওয়া, রূপের ফাঁদে প্রেমিককে পাড়িয়া ফেলিয়া তাহার জীবন-মরণ সমস্যার সৃষ্টি করা— এসকল দুরন্ত অভিনয়ের কিছুই নাই। কিশোর-কিশোরী এখানে আদতেই খেলায়াড় নহে— ইহারা ভালবাসার পাঠ নূতন শিখিতেছে। সাজু মেঘের পূজার মাঙন চাহিতে চলিয়াছে— সঙ্গে চারজন খেলার সাথী। রূপার মা তাহাদিগকে একসের ধান দিলেন। কিন্তু হঠাৎ সাজুকে দেখিয়া পরম উদ্যমে রূপা "আসিয়া বলিল: "এই দিলে মা থাকবে না আর মান," এবং আরও পাঁচ সের দিয়া তরুণ হৃদয়ের অনুরাগের উৎসাহ ও আবেগ দেখাইল। রূপা বাঁশ কাটিতে গিয়াছে,
সেখানে আবার সাজুকে দেখিতে পাইল; প্রাণে গুলক, তাহা ঢাকিতে পারিতেছে না, দেখিবার ইচ্ছা প্রবল, কিন্তু সজ্জায় সাহস করিয়া চক্ষু মেলিতে পারিতেছে না। কিশোর বয়সের এই সম্প্রতিত লাজুকতার চিত্র কবি এমন নিপুণ তুলিতে আঁকিয়াছেন তাহার সমালোচনার চেষ্টা বৃথা মনে হয় কেবল বলিতে ইচ্ছা করে "কি সুন্দর!” সাজুর মা রূপাকে আদর করিয়া খাওয়াইতেছেন— রূপা যাহা গায় তাহারই প্রশংসা করিতেছে। সেই প্রশংসা শুনিয়া সাজুর মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিতেছে— কারণ সে-ই ত রান্না করিয়াছে। তার পরে শত হলে ও ছুতোয় রূপা কতবার সাজুদের বাড়ীতে যাইতেছে। সেই সকল ছলনা প্রায় ধরা পড়িয়া যাইতেছে। এক দিন সে হঠাৎ তথায় উপস্থিত হওয়াতে সাজুর মা জিজ্ঞাসা করিল–
“অসময়ে এসেছ কেন বাবা?"
সে বলিল,
“খালাম্মা, তোমার জ্বর হয়েছে শুনেছি, তাই তোমার খাবার জন্য আধাসের গজা কিনে এনেছি।”
“কই, আমার তো জ্বর হয়নি! আর জ্বর হলে কি গজা খায় কেউ?"
সাজুর মায়ের এই উক্তিতে বালকের অসতর্ক চাতুরী ধরা পড়িয়া গেল, সে লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। এরূপ লুকোচুরি খেলা অনেক আছে—
“এমনি করিয়া দিনে দিন যেতে দুইটি তরুণ হিয়া, এ উহারে নিল বরণ করিয়া বিনি-সূতি মালা দিয়া।"
কিন্তু এবার দুজনেই কিশোর বয়সের সীমা অতিক্রম করিয়া যৌবনের অকূল সমুদ্রে পড়িয়াছে। তখন যাহা সরল ও অনাবিল ছিল, তাহা জটিল সমস্যায় দাঁড়াইল। কৈশোরের উচ্ছল লীলা খেলা সংযমের বাধা মানিয়া চলিল— তথাপি বেল ফুলের ন্যায় অতি নির্মল দুইটি প্রাণের কথা লইয়া দুষ্ট প্রতিবেশীরা নির্মমভাবে টানাহেঁচড়া করিতে ছাড়িল না, তাহারা কলঙ্ক রটাইতে শুরু কলিল, অকর্মা সংবাদবাহী বুড়ীদের গ্রাম্য অবসর পূরণের বেশ একটা সুযোগ জুটিয়া গেল।
“টুনীর ফুপু হাতে ডলতে তামাক পাতা, এমন সময় ওই গাঁ হতে আসল খেঁদির মাতা, ক’জনকে আর থামিয়ে রাখে??""
অযাচিত নিন্দা ও উপদেশে সন্ত্রস্ত হইয়া রূপার মা তাঁহার ছেলের সঙ্গে সাজুর বিবাহ স্থির করিয়া পাড়া পড়শীর শাণিত জিহ্বা ভোঁতা করিয়া দিলেন। এই বিবাহের ঘটকালী হইতে বাসর রজনীর শেষ পর্যন্ত কবি যে দৃশ্যপট আঁকিয়াছেন, তাহা বঙ্গীয় কৃষক গৃহের একখানি নিখুঁত সামাজিক চিত্র। দুখাই ঘটক বিবাহের প্রস্তাব লইয়া সাজুর মায়ের কাছে বলিতেছেন :
“দুখাই ঘটক নেচে চলে তাহার দাড়ী
বুড়ো বটের শিকড় যেন চলছে নাড়ি নাড়ি।""
বিবাহের আসরের বর্ণনা খুব একটা জমকালো রকমের—
“বিয়ের কুটুম এসেছে আজ সাজুর মায়ের বাড়ী
কাছারি ঘর শুমশুমাওম লোক হয়েছে ভারি।""
তারপরে মিঞারা কত কেচ্ছা শুনাইয়া সমবেত লোকদের মন-হরণ করিতেছেন,— হানিফের কথা, জয়গুন বিবির কথা শুনিয়া লোকেরা মাতিয়া গিয়াছে,— হানিফের যুদ্ধ-বর্ণনায় খুব বাহাদুরী—
“কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেন কলার বাগ,
মেষের পালে পড়েছে যেন সুন্দরবনি বাঘ।”
এদিকে আবার—
“উঠান ‘পরে হল্লা করে পাড়ার ছেলেমেয়ে, রঙীন বসন উড়ছে তাদের নধর তনু হেয়ে।"
পরের অঙ্কে রূপা ও সাজুর গৃহস্থালী। এইখানে বাঙ্গালী চাষীজীবনের সুখ-দুঃখ ও জীবনের মূল সূত্রটি অতি স্পষ্ট রেখায় আঁকা হইয়াছে। আমরা দেখিতেছি সাজু স্বামীর পায়ের টিপ্ পরিয়া কত আহলাদে অবিশ্রান্ত গৃহকর্ম করিতেছে; অর্ধরাত্রি পর্যন্ত ধানের মলন চলিতেছে— নবীনা কৃষাণী
“ঢেঁকির পাড়েতে মুখর করিছে একলা সারাটি বাড়ী ।”
কোন কোন দিন হেমন্তের জ্যোৎস্নায় সাজু,
“ঘুমায়ে পড়িছে ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান।"
একাদশ অঙ্কে জমি লইয়া দাঙ্গা-হাঙ্গামা। রূপা চাষার ছেলে কিন্তু বাঙ্গালী সন্তান। তার প্রাণের প্রেম ও হাতের লাঠি উভয়ই অতুলনীয়। তাহার হাতে বাঁশের বাঁশী ও বাঁশের লাঠি এ দুইই অনিবার্য। একদিকে সে ফুলসম মৃদু মৃদু হিল্লোলে প্রেমের গান গাইতেছে, অপর দিকে ঝগড়ার স্থলে সে দুর্দান্ত পশুর মত। দুই দলে বিবাদ বাঁধিয়াছে—তরুণ রূপা এক দলের নেতা। মত্তহস্তী যেরূপ শত দলের বেষ্টনী হইতে নিজেকে মুক্ত করিয়া অনায়াসে চলিয়া যায়, রূপা এক মুহূর্তে কোমল আলিঙ্গন হইতে নিজেকে বিমুক্ত করিয়া নির্মম উৎসাহে বন-ভূমির দিকে চলি য়াছে :
“আলী আলী আলী আলী রূপার যেন কণ্ঠ ফাটি ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজে, কাঁপছে আকাশ কাঁপছে মাটি। ""
বর্ণনাগুলি এরূপ জীবন্ত মনে হয় যেন আমরা রণক্ষেত্রের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি এবং দুই দলের উন্মুক্ত বীরমূর্তি প্রত্যক্ষ করিতেছি।
রূপা খুনের দায়ে গড়িয়া পুলিশের হাত হইতে নিস্তার পাওয়ার জন্য পলাইয়াগিয়াছে।
“ঘরের মেঝেতে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী কাঁথা, সিনাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা। পাতায় পাতায় খস খস করে, শুনে কান খাড়া করে,
যারে চায় সেত আসে নাক শুধু ভুল করে করে মরে।
তবু যদি পাতা খানিক না নড়ে ভাল লাগে নাক তার, আলো হাতে লয়ে দূর পানে চায় বার বার খুলে যার।"
ইহা গ্রাম্য ভাষায় জয়দেবের “পততি পতত্রে, বিগলিত গাত্রে"র অনুবাদ। সেই রাত্রে আকাশের গায়ে যখন শুকতারা ডুবু ডুবু শেষ রজনীর চাপা নিশ্বাস অতি ধীরে বাঙ্গলার কুটীরে বহিতেছে, চোখে পলক নাই, সাজু বসিয়া আছে। এমন সময় রূপা চোরের মতন ঘরে ঢুকিল। সুন্দরী গৃহিণীকে নিঃসহায় ভাবে ঘরে একেলা ফেলিয়া যাইতে যে মর্মান্তিক কষ্ট তাহা অতি অল্প কথায় রূপা ব্যক্ত করিতেছে। রূপার মা মারা গিয়াছেন, সাজু সেই শূন্য ঘর একলাটি কিরূপে আগলাইয়া থাকিবে? আজ শেষ, আর দেখা হইবে না— এই আলিঙ্গন শেষ আলিঙ্গন। রূপা অকূলে ঝাঁপ দিবে। সাজুর কণ্ঠ জড়াইয়া ধরিয়া অশ্রু-চক্ষে বলিল :
“মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে পাথর ভাসায় জলে, তোমারে আজিকে সঁপিয়া দিলাম তাহার চরণ তলে।"
ইহার পর শেষাঙ্ক। কত বৎসর ধরিয়া সাজু একখানি কাঁথার উপর গৃহসন্নিহিত মাঠটির ছবি নক্সা করিয়া সুতায় বুনট করিতেছিল। সে যেদিন এই নক্সী কাঁথা সেলাই করিতে আরম্ভ করে, তখন
"স্বামী বসে তার বাঁশী বাজায়েছে— সেলাই করেছে সে যে, শুনগুন করে গান কতু রাঙা ঠোঁটেতে উঠেছে বেজে।”
এই কাঁথা তৈরী করার সঙ্গে তাহার কত মধুর স্মৃতি জড়িত! সে সকল দিন চলিয়া গিয়াছে। এবার কোমল হস্তে সে নক্সার শেষ রেখাটি টার্নিল
“খুব ধরে ধরে আঁকিল সে সাজু রূপার বিদায় ছবি, খানিক যাইয়া ফিরে ফিরে আসা আঁকিল সে তার সবি।”
কাঁথা আঁকার পালা এবার শেষ। কাঁথাখানি মেলিয়া সাজু নিজের বিছানার উপর ছড়াইয়া দিল— সেই শয্যাই তাহার মৃত্যুশয্যা, যখন চিরনিদ্রার ভারে চোখ দুটি মুদিয়া আসিতে লাগিল, তখন সে পার্শ্ববর্তিনী সোনা-মাকে বলিল :--
“সোনা মা আমার! সত্যিই যদি তোরে দিয়ে যাই ফাঁকি;
এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর 'পরে,
ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে!
সাজুর মৃত্যুর পর বহুদিন চলিয়া গিয়াছে রূপাকে গ্রামের সকলে ভুলিয়া
গিয়াছে—
“বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা
গভীর রাতের কালে,
- শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী
বেদনার তালে তালে।
প্রভাতে সকলে আসিয়া দেখিল
সেই কবরের গায়,
রোগপাণ্ডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়!
""সারা গায়ে তার জড়ায়ে রয়েছে
সেই সে নক্সী-কাঁথা,
আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া
গায় এ করুণ গাথা।"""
নক্সী-কাঁথার মাঠে এমন অনেক কথা আছে, যাহা বাঙ্গলার আর কোন কবি এভাবে লিখিতে পারিতেন কি না সন্দেহ। গ্রামের মেয়েরা মেঘকে আবাহন করিতেছে। এই সকল মেঘ যে কতরূপে, কত লীলায় আকাশে বিচরণ করে তাহা এদশের কৃষকেরা লাঙ্গল ঘাড়ে ফেলিয়া ঊর্ধ্বমুখে লক্ষ করিয়া তাহাদের নামকরণ করিয়া গিয়াছে, পল্লীবালিকারা তাহাই আবৃত্তি করে। শিক্ষিত পাঠক পুষ্কর, আবর্ত প্রভৃতি মেঘের ভুবনবিদিত নাম অবশ্য জানেন, কালিদাসের কৃপায় তাহা মুখস্থ আছে, কিন্তু বাঙ্গলার চাষীরা মেঘকে আদর করিয়া যে কত নাম দিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই।
গ্রামের মুসলমান মেয়েরা এখনও বোধ হয় এই ভাবের একটা ছড়া থাকে। কবি তাহা আধুনিক ছন্দে সাজাইয়াছেন। বাঙ্গলাদেশে বাঁশের যত প্রকার শ্রেণীভেদ আছে তাহারও একটি তালিকা পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু ইহাকে বোধ হয় তালিকা বলা ঠিক হইবে না, নীরস শুষ্ক কথাগুলি কবির হাতে পড়িয়া বেশ কা ও সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে !
নগী-কাঁথার মাঠের কবি দেশের পুরাতন রত্ন-ভাণ্ডারকে নূতন ভাবে উজ্জ্বল করিয়াছেন, সঙ্গে সঙ্গে অনাগত রাজ্যের বার্তা বহিয়া আনিয়াছেন। 'রাখালী' নামক কাব্যে ইহার প্রতিভার যে পরিচয় পাইয়াছিলাম, নক্সী-কাঁথার মাঠে তাহার পূর্ণ বিকাশ দেখিতে পাইতেছি। বহু দিন হইল শরৎচন্দ্রের বিশ্ববিশ্রুত প্রতিভার পরিচয় পাইয়া আমি ভারতবর্ষে তাঁহার প্রথম অভিনন্দন জানাইয়াছিলাম, আজ নক্সী-কাঁথার মাঠের কবিকেও আমি কিঞ্চিৎ দ্বিধার সহিত সম্বর্ধনা জানাইতেছি। বাঙ্গলা সাহিত্যে কাব্যের পাঠ একরূপ উঠিয়া গিয়াছে। কণিকাতে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন একটা মহাকাব্য রচনার তাঁহার সাধ ছিল, কিন্তু তাঁহার মর্মের কথা শত সুরে বাজিয়া উঠিল এবং মহাকাব্যের স্থান গীতিকবিতা অধিকার করিয়া বসিল। কবি হয়ত ইহা পরিহাস করিয়াই বলিয়াছিলেন, কিন্তু কবির এই উক্তির পর বাঙ্গলার উদীয়মান কবিরা কবিতায় উপাখ্যান রচনা ছাড়িয়া দিলেন। রবীন্দ্রনাথের কথা ও কাহিনীর ধরনে মাঝে মাঝে ছোট ছোট কাব্যোপখ্যান পাওয়া যায় সত্য, কিন্তু অধুনা কাব্যের বাজার overline 75 মন্দা। জসীম উদ্দীনের এই বইখানি ছোট হইলেও ইহা একখানি কাব্য। ইহার উপাদান বাঙ্গালীর চিরাভ্যস্ত, গীতিকবিতার কতকগুলি সুর ও ছন্দ, কিন্তু নানা সুর একত্র করিয়া একটা বড় রাগিণী সৃষ্টি করার শিল্পশক্তি ইঁহার আছে। নানা কুসুমের মালার মতই খণ্ডকবিতা লিখিয়া একটা অখণ্ড রূপ দেওয়ার বিলক্ষণ শক্তি ইনি দেখাইয়াছেন, ইহাতে মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের ক্ষমতা ও প্রচুর সৌন্দর্যের সমাবেশ দেখা যায়। অবনীন্দ্র বাবু এই কাব্যের ভূমিকায় কতকটা দ্বিধার সঙ্গে পুস্তকখানির প্রশংসা করিয়াছেন, সেই দ্বিধার ভাব আমারও আছে, যেহেতু এক সময় যাহা বলিতাম ও লিখিতাম তাহার উপর আমার প্রচুর আস্থা ছিল, কিন্তু এখন প্রতিক্ষণে মনে হয়, বাঙ্গলার নব আশা আকাঙ্ক্ষাদৃপ্ত তরুণের নূতন জগৎ ঠিক আমার কথায় সায় নাও দিতে পারেন, হয়ত যে যুগ আসিয়াছে, আমরা তাহার পশ্চাতে পড়িয়া গেছি। তরুণের সঙ্গে প্রাচীনের পা ফেলিয়া সমান তালে চলা শক্ত! তবে আমি আমার মনের কথা লিখিয়াছি, মনের শৈশব নাই, যৌবন ও বার্ধক্য নাই। মনের কথা বলিলে তাহার সম-মর্মী শ্রোতা হয়ত জুটিয়া যাইতে পারে।
****তথ্যসংগ্রহ***
দীনেশচন্দ্র সেন (নকশীকাঁথার মাঠ) নামাঙ্কিত কাব্য সমালোচনা।
0 মন্তব্যসমূহ