Hot Posts

6/recent/ticker-posts

প্রেমেন্দ্র মিএের ছোট গল্প

 

(প্রেমেন্দ্র মিত্র, 
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোট গল্প,
প্রমেন্দ্র মিত্রের গল্পের মূল্যায়ন,
premendro nath mitrer golpo..
বাংলা ছোটগল্প,  প্রেমেন্দ্র মিত্র) 
***বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

প্রেমেন্দ্র মিএ(১৯০৪-১৯৮৮
)

প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোট গল্প মুল্যায়ন--


১৯২৩ সনে প্রেমেন্দ্র মিত্রের বয়স মাত্র বিশ বছর ছুঁয়েছে। এই টগবগে তরুণ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যায়ন করেছেন। তিনি ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে পছন্দ করতেন না। মনের খেয়ালে একবার গেলেন ঢাকায় আবার মনের খেয়ালে ফিরে এলেন কলকাতায়। ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য উঠলেন মেসে। মেসের কতিপয় দিন তার জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দিল। হঠাৎ ফাঁকা ঘরে তাঁর হাতে পড়ল পুরনো কোনো বাসিন্দার নামে লেখা জীর্ণ শীর্ণ পোস্টকার্ড।- রে যায়। তিনি সেই পোস্টকার্ডে ● জীবনের হাহাকার। সারারাত - “কিছু যাদের নেই, যারা সেই গল্প হতে পারে না? খব বলে কাগজ সেলাম।” (গল্প লেখার থকা সংকলন, সম্পাদনা জ্যোতিপ্ৰসাদ বসু / বেঙ্গল পাবলিশার্স)

**ভাষা আন্দোলন এর গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিত্রের সাহিত্যে হাতে খড়ি হয়েছিল স্কুলে ছোট অবস্থায় কবিতা। যার কারনে শিক্ষকদের কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছিলেন। স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিল সাহিত্যিক কুমার সেনগুপ্ত। সাহিত্যচর্চার আসরে নিয়মিত যেতেন। সেই আসরে দেখছেন মার্জিত রুচিবান সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর 'সবুজপত্র' পত্রিকা। কিশোর বয়সে (১৪ বছর) লিখলেন 'পাক' উপন্যাস। এ উপন্যাসে নেই কোনো রোমান্টিক। উন্মাদনা, আছে রূঢ় বাস্তবতা। কলকাতার বস্তিবাসীদের জীবন নিয়ে লেখা এই ‘পকে' উপন্যাসটি সমাপ্ত হয়েছে ১৯২৬ সালে। এই উপন্যাসের নতুন সংস্কারণের ভূমিকা শ্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন—“স্কুলে যেতে লম্বা একটা আঁকাবাঁকা গলি পেরুতে হত। সেই গলির একটা বাকের পাশে মস্ত একটা নোংরা পুকুর। চারপাশে বেশির ভাগ নারকেল পাতা আর দু'একটা ভাঙা খোলায় ছাওয়া গরীবদের বস্তি ।...…... গলির পথে আসতে যাদের দেখেছি তাদের নিয়ে প্রথম উপন্যাস শুরু করলাম।” (নবপত্র-১৯৭৮)


প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প লেখার কাহিনিটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। সারারাত জেগে দুটো গল্প লেখার নেশায় ঘোরে সকাল পেরিয়ে একটু বেলা হবার আগেই মেসের এক বর্ডারের কাছ থেকে খাম জোগাড় করলেন। সেই গল্প দুটো বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা 'প্রবাসী' রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ঠিকানায় ভবানীপুর পোস্ট অফিসে গিয়ে টিকেট এঁটে ডাকে পাঠিয়ে দিলেন। আর 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের নামে ১৩৩০ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে এবং ১৩৩১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে বের হল। গল্পদুটোর প্রথমটির নাম ‘শুধু কেরানী’, দ্বিতীয়টির নাম “গোপনচারিণী।”


শুধু 'কেরানী' গল্পটি প্রকাশিত হবার পরেই “কল্লোল”-এর ১৩৩১ বৈশাখ সংখ্যায় সম্পাদকীয় মন্তব্যে লেখা হয়—


“প্রবাসী, চৈত্র ১৩৩০–শ্রী প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প— শুধু কেরানী। একটি কেরানি যুবক ও তাহার স্ত্রীকে লইয়া এই গল্প। এই দুইটি মানুষের প্রেম ও স্পৃহার মধ্যে কোনো আবিলতা নাই৷ স্ত্রীকে ভালবাসা জানাইবার জন্য স্বামীর নিত্য নূতন আয়োজন করিতে হয় নাই। স্ত্রীও, সে যে স্ত্রী বলিয়া স্বামীর দাসী। সে কথা কখনও সে মনে করে নাই। স্বামী পরিশ্রান্ত হইয়া গৃহে ফিরিলে তাঁহার সেবা ও সাহায্য করা

যে স্ত্রীর পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয় অথবা অপমানজনক নয় তাহা এই কেরানীর স্ত্রীর ব্যবহারে বেশ বুঝা গিয়াছে। উভয় পরস্পরকে এমন পরিষ্কারভাবে জানিত ও বুঝিয়া ছিল যে তাহাদের বিভু বুঝবার মত একটি মুহূর্ত আসে নাই। কোনো অভিনয় করিবার প্রয়োজন হয় নাই। এবং কালক্রমে ীকে মৃত্যুর পথে আসর হইতে দেখিয়া স্বামী তাহার নিবিড় প্রেমকে ঘটা করিয়া হা হুতাশ করিতে দেয় নাই। স্ত্রী স্বামীকে ছাড়িয়া যাইতে যে কতখানি কষ্ট পাইতে ছিল তাহা তাহার একটি কথার শেষ দিকে বেশ সুন্দরভাবে প্রকাশ করিয়াছে।” (পৃষ্ঠা ৭১)

ভাবগত ও আদর্শগত দিক থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র কল্লোলীয় লেখক। যদিও প্রথম দিকে তাঁর গল্প 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া তিনি 'বিজলি' পত্রিকাতেও গল্প লিখতেন। এই দুপত্রিকাতেই গল্প লিখে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। তারপরে 'কল্লোল' যোগদান করলেন। 'কল্লোল-এর সম্পাদক ছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ ও গোকুলচন্দ্র নাগ। কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভাঙন ও বিপর্যয়ের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের সময় রবীন্দ্রনাথ স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল ছিলেন। ছিলেন শরৎ, তারাশঙ্কর, মানিক, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ। প্রেমেন্দ্র মিত্র যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে যুগটা ছিল অস্থিরতার যুগ, অনিশ্চয়তার, হতাশার ও অসহায়তার। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হল। দেশীয় রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো একের পর এক জ্বলছিল যুবকদের ভেতর স্বদেশীয় আবেগ আবার উদ্যমহীনতায় নিভছিল কিছু পরেই। এ কারণেই যুবকরা গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছিল ভাগ্যের নির্দেশে। যখন বেকারত্ব চরম, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় দেশীয় অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রায় পঙ্গু, রবীন্দ্রনাথের স্থিতধী শিল্পপ্রাণ এক নির্দিষ্ট আদর্শের আলোয় বিভাসিত, তখন প্রকাশিত হয় 'কল্লোল' আর 'কল্লোলের লেখকরা'। লক্ষ্য-সমাজ স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

প্রেমেন্দ্র মিত্র এদের গোষ্ঠীতে অংশগ্রহণ করলেন। কিন্তু সে সময়ের যুবক প্রেমেন্দ্র মিত্র সরল বুদ্ধিপ্রাণ স্বভাব নিয়েও বিভ্রান্ত হয়েছেন। বিভ্রান্তি যুগের, সময়ের পরিবেশের সমস্ত রকম নৈরাজ্য ও নৈরাশ্যের মধ্যেও তিনি সৌন্দর্যের প্রতি অনুসন্ধিৎসু। সব্যসাচী লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার মতো গল্পেও যন্ত্রণা, প্রতিবাদ, অসহায়ত্ব আছে। আবার কবিতার যে জীবন-প্রেম, সুন্দরের জন্য গভীরতম আর্তি, গল্পেও তাও আছে। তিনি সমকালীন জীবনের দুঃখ, মায়ের চোখের অসহায় অশ্রু, গলিত কুণ্ঠ, লোভের নিষ্ঠুরতা, অপমানের ভীরুতা, লালসার জন্য বীভৎসতা, নারীর ব্যভিচার, কদাকার অহঙ্কার, উন্মাদক বিকলাঙ্গ। রুক্ষ-গলিত শব্দ এ সমস্ত দেখেছেন। কিন্তু এসব দেখেও তিনি কল্যাণকে অভিনন্দিত করতে চান। তাই তাঁর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, জীবন সম্পর্কে ভাব-ভাবনায় আছে সন্ধিৎসু মনের প্রবল।

না মিশালেই যায় সব তেে কল্যাণের সঙ্গে আনন্দ মেলে না, তাই এগিয়েও ভুল করতে পারি, পেছিয়ে ও পাল্লা যেমন বেখে কেমন তা ভেবে পাই না।"


কল্লোল যুগের লেখকদের থেকেই জন্ম নেয় প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গল্পকার। তাঁর গল্পে essence। কিন্তু প্রেমেন্দ্রের গল্পে সেই সাথে আবেগ সম্পূর্ণ বর্জিত হয়েছে। ভাবপ্রবণতা হয়েছে নির্দ্বিধায় পরিত্যক্ত। বুদ্ধি নির্ভরতা তাঁর ছোটগল্পে জীবনকে দেখার। জীবনব্যাখ্যার পক্ষে নিরাসক্ত অথচ শাণিত অস্ত্রের অধিকার এনে দিয়েছে। যুগযন্ত্রণাকে সর্বাংশে গ্রহণ করে নীলকণ্ঠী হতে চেয়েছেন গল্পে, বিশেষ হুগে অবস্থান করে তিনি যুগের নানান স্রোতের বৈপরীত্যে জীবনকে বুঝতে চেয়েছেন। আর আনন্দ-সুন্দরের সাথে কল্যাণের সমন্বয়কে করেছেন তাঁর শৈল্পিক শাস্তির আশ্রয়।


কল্লোলের লেখকদের মূল সুর ছিল সমস্ত রকম বৈপরীত্যের গভীরে সুন্দরের সন্ধান। 'এই অর্থে ইউরোপীয় রোমান্টিক কবিদের সাথে তাঁদের নগরজীবনের গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র। জীবনের জটিলতম মনস্তত্ত্ব, নাগরিক জীবনের নিষ্করুণ অর্থের বণ্টনবৈষম্য, সুস্থ দাম্পত্য প্রেমের জন্য বৈষম্যের বিষাক্ত বীজ বপনও চিত্র রচনা, মানব মানবীর সম্পর্কের ধূর্ত, বুদ্ধিপ্রাণ কৌশল—এসব তাঁর গল্পে আছে। লেখকের প্রথম গল্প 'শুধু কেরানী' বের হয় ১৩৩০ সালে 'প্রবাসী' পত্রিকায়। এরপর প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পগুলো মালায় গাঁথা বিভিন্ন রঙের ও ফুলের মতো সুবাস ছড়িয়েছে। তাঁর ‘তেলেনাগোতা আবিষ্কার, বিকৃত-ক্ষুধার ফাঁদে, পোনাঘাট পেরিয়ে, পুন্নাম, সংসার সীমান্তে, স্টোভে, শৃঙ্খল ইত্যাদি গল্প আমাদের বিস্মিত করে।

কল্লোলীয় জীবনচেতনা ও আঙ্গিকের প্রভাব রয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পাশ্চাত্যের সাহিত্য-চিত্রকলা-আধুনিক শিল্পের অমোঘ প্রভাব। এক মিশ্র অনুভূতিতেই প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর ছোটগল্পে নানা ধরনের নিরীক্ষা করেছেন। তিনি একাধারে কবি ও গল্পকার। কবির কবিত্ব, বিজ্ঞানীর নিরাসক্ত, গল্পকারের সহমর্মিতাবোধ, বিষয়ীর বুদ্ধির বিচারক-এসব দিয়েই প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোট গল্প সর্বশিল্প শ্রীধন্য। তাঁর গল্পের পোশাক ও প্রাণ। সচলতা ও আধ্যাত্মিকতা যে বিভাকে বিভাসিত করে সামগ্রিকভাবে, তাই তার অন্বিষ্ট—তা জীবনের আনন্দ, কল্যাণ সুন্দরের সাথে মিলিত গঙ্গাবারি।

'প্রবাসী' পত্রিকায় পাঠিয়ে ভেবেছিলেন যে নতুন লেখকের গল্প ছাপা হবে না। কিন্তু শুধু কেরানী গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। এ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯২৪ সনে। 'কল্লোল' পত্রিকায় এ গল্পটি সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। ভোলার মধু স্বপ্ন অকালে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় মেয়েটির অসুখে। মেয়েটির এমন এক কঠিন অসুখ হয় যার চিকিৎসা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। উৎকণ্ঠায় জর্জরিত স্বামীকে হারবার মেয়েটি আশ্বাস দেয় যে সে সেরে উঠেছে অথচ দুজনেই জানে যে এ আশ্বাস মিথ্যে করুণা ছলনা ছাড়া কিছু নয় এবং মেয়েটির মৃত্যুর আগে সে ছলনাটাও ভেঙে যায়। গল্পটি শুরু হয়েছে সংসার গড়ে তোলার জন্য মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক আকুলতাকে নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো তাহার সমস্ত স্বপ্নই তছনছ হয়ে যায়। ("তখন কালবৈশাখীর ঊনাও সমীরণ আকাশে নীড় ভাঙার মহোৎসব লেগেছে।


সংসার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে তারা পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল, তাদের উভয়ের পক্ষে ও অনুভূতি নতুন। ভাড়া বাঁচিয়ে হেঁটে এসে সেই পয়সা দিয়ে ফুল কেনে স্ত্রীর জন্য। এভাবে টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্যে দিয়ে গল্পকার বিনি সুতোর মালার মত পৌঁখে তুলেছেন প্রাত্যহিক দাম্পত্যজীবন, দম্পতিযুগলের প্রেম, বিশ্বাস, আনন্দ ও ভালবাসার চিত্র। ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই খণ্ডচিত্রগুলোই আবার নির্মাণ করেছে গল্পের অবয়ব।


“শুধু কেরানী” গল্পে প্রেমেন্দ্র মিত্র নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র অর্জন করেছেন। শুধু জীবিকার দিক থেকে নয়, অর্থনৈতিক অবলম্বনের ক্ষেত্রে গল্পের প্রধান চরিত্রটির একমাত্র কেরানি বৃত্তি ছাড়া আর্থিক অবলম্বন কিছুই নেই এবং এই সামান্য আর্থিক অবলম্বনই তার একমাত্র পরিচয়। এ গল্পে তাদের উভয়ের পক্ষেই এ অনুভূতি নতুন। তারা জগৎ সম্পর্কে সচেতন নয়। তাদের দুজনকেই দুজনের প্রয়োজন এবং এখানেই দাম্পত্য জীবনের সুরলতাটি লুকিয়ে আছে। প্রেমের কল্পনা এ গল্পের চরিত্রদের নেই বলেই প্রেম এখানে নির্ভেজাল এবং পবিত্র। এ প্রেম “আপনাতে আপনি পূর্ণ।” দায়িত্বের মধ্যে পূর্ণতা খুঁজেছে প্রেম। তাই “সকাল বেলা স্বামীকে খাইয়ে দিইয়ে, হাতে পানের ডিবোটি দিয়ে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মেয়েটি একটি দরজার আড়াল থেকে ঈষৎ মুখ বার করে সলজ্জ একটু করুণ হাসি হাসে। ছেলেটিও ফিরে আসে।” আর ছেলেটি ট্রামের একটি বিষয় লক্ষ করার মতো গল্পটিতে চরিত্রের কোনো নাম পরিচয় নেই। কেরানি বৃত্তি দ্বারা নির্ধারিত হয় তার সামাজিক অবস্থান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে স্বল্প শিক্ষিত বাঙালির সমাজের মানুষের পক্ষে কেরানি বৃত্তি দ্বারা অন্য কোনো পথ খোলা ছিল। এ কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে স্বল্প পরিশ্রমে নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ আর্থিক উপার্জনের জন্য কেরানি বৃত্তির পথ খুঁজে নিয়েছে। চরিত্রটি মানুষ হিসেবে এত নগণ্য যে সে জনতার ভিড়ে মিশে থাকে। অফিসের বাইরে গৃহমুখী গড়পড়তা বাঙালির মতই তার আসা যাওয়া। কেরানি বৃত্তি ছাড়া অন্য কোনো কর্ম নেই কিংবা অভিজ্ঞতা নেই। অরবিলাসের কথা নেই। আছে শুধু ছুটির দিনের খাবারের আে এটুকুই তার প্রাপ্তি। এদিক থেকে টাকরণের যৌকিকতা আছে।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা সংসৃষ্ট হয় নি তা নুষের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক অধঃপতন ঘটে। শেষ করে সাম্রাজ্যবাদের হিংস্রতার জন্য, ঔপনিবেশিক শাসিত দেশগুলোতে সামাজিক জীবনে অস্থিরতা। পারিবারিক ভান ও অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করেছিল। যেখানে মানুষের অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি সেখানে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে স্বস্থানে ধরে রাখা কঠিন। এই নৈতিক অধঃপতন ও মূল্যবোধহীনতায় দিগ্‌বিদিক শূন্য হয়ে পড়েছিল বিশেষত নিম্নবিত্ত বাঙালি সমাজ। এই মূল্যবোধহীনতা নৈতিক দ্বন্দ্ব ও সৃষ্টি করেছিল। নিম্নবিত্তের সেখানে অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কিছুই সম্ভব ছিল না। এ সময়কার চিত্ত পরিস্ফুটিত হয়েছে 'পুন্নাম' গল্পে।


"বেনামী বন্দর" গল্প গ্রন্থে 'পুন্নাম' গল্পটি রয়েছে। এ গল্পটিতে গল্পকার পৌরাণিক প্রসঙ্গকে প্রতীকের মধ্যে দিয়ে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। ‘পুন্নাম' নামকরণে রয়েছে নরকের প্রতি ইঙ্গিত। যেখানে পুত্রহীনতায় কষ্ট ভোগ করতে হয়, মৃত্যুর পর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেই নরকের দ্বার মুক্ত করে। জাহাজের ডেকের হিসাব সরকার ললিতের চার বছরের শিশুপুত্র সবসময় অসুস্থ থাকে। এই অসুস্থতার কারণে শিশুটি শারীরিক ও মানসিকভাবে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে। গল্পকারের ভাষায় বলা যায়— “প্যাকটির মতো সরু চারটে হাত পা নড় বড় করে, ফ্যাকাশে হলুদবরণ মুখে কাতর অবস্থায় অসহায় চোখ দুটি শুধু জ্বলজ্বল করে সে চোখে বিশ্বের সকল ক্লান্তি। সকল অবসান, সমস্ত বিরক্তি যেন মাখানো।”


এই চিত্রের মধ্যে সমগ্র তৃতীয় বিশ্ব তথা বাঙালির অসহায় দুরবস্থা ও বিধ্বস্ত তার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এই শিশুটির চিকিৎসার জন্য পিতামাতার চেষ্টার শেষ নেই। এই অসুস্থতার কারণে মুদি দোকানের ঋণ যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে চিকিৎসার ব্যয় ভার বহন করা। তারপর ও শিশুটির কান্না থামে না। সে চিৎকারে বেদনা নেই—“আছে শুধু যেন পৃথিবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।" এই বিদ্রোহ অকারণ এবং নিষ্ফল। আর তার অন্তরের অসীম বিদ্বেষ কান্নার আকারে উথলে ওঠে। কান্না নয়— “সে সৃষ্টির প্রতি অভিশাপ।”


এই শিশুটির অসুস্থতার কারণে শিশুটির মা ছবির চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে।” পরিশ্রমে দুর্ভাবনায় উনিশ বছরের মেয়ের মুখে পঞ্চাশ বছরের ক্লান্তি।” এক সময় ডাক্তার পরামর্শ দেয় শিশুটিকে চেঞ্জে নিয়ে যেতে। অবশেষে তারা চেঞ্জে যায় এবং শিশুটি সেরে ওঠে। কিন্তু মনের ব্যাধি সরে না। বেড়ানোর জায়গায় 

খোকার সাথে খেলতে আসে পাশের বাড়ির টুনু। টুলুপ্ত তাহার ভবিষ্যৎকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বলেছে “চুরি করেছি, জুয়াচুরি করেছি, লুকিয়ে জাহাজের খাটারি বিক্রি করেছি। অথচ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দাবী মেটাতে এই অন্যায়। তাহারি সন্তান ভবিষ্যতে রেষারেষি মারামারি করে এই পৃথিবীতে টিকে থাকবে। আর সহজ স্বাভাবিক সুন্দর তারা হারিয়ে যাবে। ললিতকে পুত্র খোকার অন্যায় এই পীড়া দিয়েছে। যে নরক পার করার দায়িত্ব ছিল সন্তানের জীবিত অবস্থাতেই তার বেদনাকারক অবস্থান পৌঁছে দিয়েছে নরক যন্ত্রণায় এই যন্ত্রণা নিতান্ত আত্মিক, তাই তা চিরকাল ধরে শুধু খোঁচা দেবে। তবুও যেখানে নক্ষত্রের আলোর নীচে সবুজ ধরিত্রীর মাঝে ললিত দাঁড়াল তখন তার মনে হয়েছে আজও আশা আছে। এই আশার মধ্য দিয়ে গল্পকার সদর্থক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। “পুন্নাম" গল্পটির এখানেই সার্থক।

সৌন্দর্য দেখে ললিতের মনে অকারণ পীড়া জন্ম নেয়। গল্পকারের ভাষায় “এই সুশ্রী সুন্দর মধুরকণ্ঠী ছেলেটির সঙ্গে নিজের ছেলের তুলনা করে হঠাৎ ললিত মনে মনে অকারণে অত্যন্ত পীড়া অনুভব করে। এরপরই ললিতের শিশুপুত্র টুনুকে অত্যাচার করে; পরে অবশ্য আপোষ করে নেয়। একদিন দেখা গেল খেলার সময় খোকা টুনুকে চিমটি কাটে। টুনুকে খেতে দেওয়া হয়েছিল থোকা দুমড়ে মুচড়ে কেড়ে নেয়। একপর্যায়ে টুনু অসুস্থ হয়ে মাঝ রাতে মৃত্যুবরণ করে। টুনুর মৃত্যু হলে ললিত বলেছে তার অন্তরের কথা বলেছে সে কিভাবে অন্যায় করে। আমরা জানি যে নীতি মানুষের জন্য মানুষ তৈরি করেছে তাকেই আইন বলে। সেই নীতি লঙ্ঘন করলে মানুষকে অপরাধী বলা হয়, তার শাস্তি হয়। মানুষ সবুজ ধরিত্রীতে বেঁচে থাকার জন্য বহু বিচিত্র পরিস্থিতিতে নানা কাজ করে এবং করতে বাধ্য হয়। আইনের দৃষ্টিতে দেখলে তা অপরাধ কিন্তু পরিস্থিতির কথা চিন্তা করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য নয়। সম অপরাধ করলেও কারো শাস্তি হয়, আবার কারো শাস্তি হয় না। সব খুনের ফাঁসি হয় না, কোনো কোনো খুনের জন্য ফাঁসি হয়। নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত এ ব্যাপারে গ্রহণ করা যায় না। এই অনির্দিষ্টতাই মানুষের পৃথিবীর চিরনবীনতা। এমন অসামান্য গল্পই লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র যার নাম 'পুনাম'। ললিত নামের অতিমধ্যবিত্ত মানুষটি পুত্রের চিকিৎসা ও হাওয়া বদলের প্রয়োজনে লুকিয়ে জাহাজের মাল বিক্রি করেছিল যা নৈতিক দৃষ্টিতে অপরাধ। এবং নিঃসন্দেহে তা দুর্নীতি। কিন্তু তাকে অপরাধী ভাবতে মন সরে না আমাদের। আমরা অনেকেই এই ধরনের কাজ করি না সাহসের অভাবে কিংবা সুযোগের অভাবে। কিন্তু করবার প্রবৃত্তি হল দুর্নীতি। ললিত নিজের অপরাধ নিজের কাছে অস্বীকার করেনি। ললিত নিজের অপরাধ নিজের কাছে অস্বীকার করেনি। তাই যখন স্বার্থপর, নিষ্ঠুর এবং কটুভাষী পুত্র ক্রমে। সুস্থ হয়ে ওঠে আর প্রতিবেশির মিষ্ট, নরম, সুন্দর ছেলেটি মারা যায়, তখন তার মনেহয় এই 'পাপের পৃথিবী' বলেই এটা ঘটল যে পাপ ছড়িয়ে গেছে ধরিত্রীর বুকে সে নিজেও তারই শরিক। ছেলে ভালো হয়ে ওঠে কিন্তু গলিত বিষণ্ণ হয়ে যায় ছেলেকে বাঁচাবার জন্যই সে অন্যায় করেছে। তবু যেন পুত্রহীনতার অভিশাপ থেকে তার মুক্তি নেই গল্পের 'পুন্নাম' নামটিতে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। নিঃসন্তান মানুষ পরলোকে অর্পনের জল না পেলে যে নরকে যায় তারই নাম পুন্নাম। ললিত হয়তো নিজেকে সেই নরকগামী মনে করেছে পুত্র থাকতেন। ললিত নৈতিক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে না। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে তার স্থান।


রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছেন “যা বিশ্বাস্য তাই শাস্ত্র, যা শাস্ত্র তা বিশ্বাস্য নয়।” আসলে যা মানুষের কল্যাণে তাই প্রকৃত শাস্ত্র। রেনেসাঁস-উত্তর সময়ে শাস্ত্রের সাথে মানবনীতির সংঘর্ষ। আবার এমন অনেক নীতি আছে যা মানবনীতি, শাস্ত্র নীতি নয়। কিন্তু মানুষের জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যখন সে এই নীতি ও মেনে চলতে পারে না। কাজেই মানবনীতির সাথে মানবনীতির একটা সংঘাতও জটিল করে তোলে নৈতিকতার প্রশ্নটিকে। প্রেমেন্দ্র মিত্র এই বহুবিধ নীতির প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর গল্পে। তিনি মানুষের পক্ষে। যেখানে শাস্ত্রনীতির সাথে মানবনীতির সংঘাত সেখানে পক্ষ সমর্থন নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যেমন : ‘সাগরসঙ্গম’ গল্পটি। এ গল্পটি 'পুতুল ও প্রতিমা' গল্প গ্রন্থের (১৯৩২) অন্তর্ভুক্ত। এ গল্পে দেখা যায় একদল মানুষ আর একদল মানুষের কাছে ঘৃণ্য। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র কুলীন বিধবা দ্রাক্ষায়নী। বিধবা দ্রাক্ষায়নী ছিলেন কুসংস্কারে বিশ্বাসী। সে অনেকটা বাতিকগ্রস্তের মানুষ। সাগরযাত্রাতেও তিনি কৃচ্ছসাধনা শুরু করেছিলেন নৌকাতেই— নৌকায় যেখানে “কোনো রকম পা খুটিয়া বসিয়া থাকা যায়। কিন্তু ঘাড়টা পর্যন্ত সোজা করিবার উপায় নাই', মাথা তুলিলেই নৌকার ছইয়ে ঠেকিয়া যায়। সেখানে মোটা মানুষ দ্রাক্ষায়নীর পায়ে বতে, অসুবিধা অনেক- "কিন্তু সে অসুবিধার কথা তাহার এখন মনেই নাই।” বর্তমানে যে কারণে তিনি তীর্থযাত্রায় অশুচিতা বোধ করেছেন তা হল একজন বারবণিতা তাদের সাথে তীর্থযাত্রী হয়েছেন। এদের সাথে যাত্রা করতে পুণ্যফল পাওয়া যাবে না। একা ব্রাহ্মণ-গৃহিনী দ্রাক্ষায়নী কোনো লক্ষ্মণকে নানা কথা শুনিয়েছেন। তিনি মুখরা এবং ভয়হীনা। এর কারণও আছে—“পাড়ার ডাকসাইটে তেজী মেয়ে মানুষ, বালিকা রয়েছে বিধবা হইবার পর লোকে তাঁহার অনুকরণীয় নিষ্ঠা ও ধর্মাচরণের জন্য শ্রদ্ধা যতখানি করিতে তাহার প্রচন্ড মুখের ধার করে তাহার চেয়ে অনেক বেশি।” এ কারণে অন্যেরা ভয়ে কিছু না বললে ও দ্রাক্ষায়নীর কাছে লক্ষ্মণ রেহায় পায় না।

পূর্বেই বলেছি একদল দেহজীবনী বা বারবণিতার আছে তীর্থগামী হতে গিয়েই তাঁর মনে অশ্রু লাগছে। দেহজীবীদের ঘৃণা করতে হবে- এটা আমাদের ধর্মীয় ও শাস্ত্রনীতি। কিন্তু ঘটনাচক্রে হল নৌকাডুবি। পানিতে ভেসে যায় সকলে। বেঁচে যানশুধু সায়নী আর বেঁচে যায় ঐ দেহজীবীনীদের বালিকা মেয়ে বাতাসী। দুটি

মানুষের নিঃসঙ্গ অসহায়তায় শাস্ত্র ভেসে যায়। দ্রাক্ষায়নী মেয়েটির মা হয়ে ওঠেন।

রাজামীর মৃত্যু হলে স্বোচ্ছা সেবকদের কাছে তার পরিচয় দেন নিজের মেয়ে বলেই।

গল্পটিতে একটি সবল মানবিক নীতিকে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট একটি গল্প রূপে তুলেছেন

প্রেমেন্দ্র মিত্র। প্রকৃতপক্ষে ওই সংস্কারও রুচির নিরেট নির্দেশের উপরি জয়ী হয়েছে

লাক্ষয়ানীর অকপট মাতৃহৃদয়।

"সংসার সীমান্ত" গল্পটি "নিশীথ নারী" গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এ গল্পের দুটো

প্রধান চরিত্র অঘোর দাস ও পতিত কাহিনি। এ গল্পে আছে তথাকথিত সমাজবিরোধী

ঘৃণ্য পেশার সাথে জড়িত দুজন মানুষ। লেখক গল্পের শুরুতেই লিখেছেন— “মনে

হয় যে দুটি মানুষকে লইয়া এই গল্পের আয়োজন, তাহাদের কথা লিখিবার অধিকার

আমার নেই। যাহাদের জন্য লিখিতেছি তাহারাই শুধু যে নিজেদের কঠিন

উদাসীন্যের দ্বারা ইহাদের অপমান করিতে পারে তাহা নয়। এই দুইটি জীবনের

গভীর মর্ম বুঝিবার মত দরদ আমারও আছে কিনা সন্দেহ হয়।” দরিদ্র, নির্যাতিত,

অবহেলিত দুজন মানুষ অঘোর ও রজনী। দারিদ্র্যের চরম অবস্থায় পতিতা রজনী

দিনযাপন করে। তার যৌবন ও নারীত্ব সৌন্দর্য হারিয়ে কালিমা লিপ্ত। এ গল্পে

প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অদ্ভূতভাবে দেখিয়েছেন আইন কখনো কখনো কীভাবে মানবিকতার

বিরোধী হয়ে যায়। এক দেহজীবনী ভেবেছিল ঘর বাঁধলে মনের মানুষের সাথেদুজনে উপার্জন করবে সৎপথে। এক চোর [অঘোর দাস] ভেবেছিল চুরি করবে না,

কিন্তু দেহজীবনীর বৃত্তিত্যাগের মূল্য স্বরূপ যে টাকা ধরে দিতে হবে সেই কয়েকটি

টাকার জন্যই শেষ চুরি। রজনীর কাছে অঘোর দাস জানিয়েছে “এই শেষ বার,ব্যাসতারপর চুরি বিদ্যে খতম।” একদিন প্রকাণ্ড তোরঙ্গ এনে রজনীর সামনে হাজির

করেছে, যেখানে সংসারের জিনিসপত্র সব মজুত। ভাবী সংসার সম্বন্ধে উভয়ের মধ্যে

মধুর আলাপ চলেছে— “দিদিকে কারা নাকি ধরে নিয়ে গেছে।" একদিন দিদির

খোঁজ পাওয়া গেছে। কিন্তু দিদি আর আসেনি। যে শহরে মানুষ নিজেকেই হারিয়ে

ফেলে। সেই শহরে হারিয়ে যাওয়া দিদিকে খুঁজে পেয়েছে রতন। তার সজাগ

শিশুমন দিয়ে সে জেনেছিল দিদি থাকে শহরে। রূপকথার চেয়ে অদ্ভুত সেই শহর।”

সেই শহর যা আদৌ কল্পনার মত অদ্ভুত নয়। তা জটিল বিকৃত। সেখানে রতনের

অনুভূতি, সদিচ্ছা খুঁজে পেয়ে যায় দিদিকে। এখানেই সচেতনভাবে লেখকমূল্যবোধ ও চেতনাবোধই জয়যুক্ত করেছেন। যে মহানগরে জন অরণ্যে হারিয়ে যায়

মানুষের ইচ্ছা, সেখানে সদিচ্ছা শৈশব ফিরে পাওয়ার আকৃতি নিয়ে রতন শেষ পর্যন্ত

জয়ী হয়েছে। মহানগরে তাই সে হারিয়ে যায় নি। তার চিহ্ন মুছে যায় নি। “রতন

খুঁজে পেয়েছে তার দিদি চপলাকে” রতন পেয়েছে দিদিকে একটি বাড়ির দরজায় চোর পক্ষে বাড়ি যাওয়া স বলে এখানে তোমাঠন রাগ করে। পরে বুঝতে পারে বারাঙ্গন হয়ে গৃহে প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পটি বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্ত মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। আগেই বলেছি দিদি চপলা রতনের কাছে মায়ের মতন। দিদি শ্বশুর বাড়ি গেলেও সে ছিল কাছাকাছি গ্রামে চরিত্রটির নাম চপলা, তার অনুসন্ধান এতই পথেই শেষ হয়। সেখানে যে পথে শহর থেকে গ্রামে সে ফিরিয়ে নেবে তার হারিয়ে যাওয়া দিদিকে। সেখানেও "বিস্মৃতির মত গাঢ় সন্ধ্যা নেমেছে।" তবু আশা আছে শহরমুখী জীবনযাত্রা আবার গ্রামের কাছাকাছি যাবে, যেদিন অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হয়ে এবং নতুন প্রজদুই এদের মনন ঘটাবে। রতন এদেরই প্রতীক, এই নতুন প্রজনের যে অংশীদার। সেই কিশোরের উত্তাপ হৃদয়ে সঞ্চিত করে শহরে দিদিকে খুঁজতে এসেছে রতন। ছেলেবেলায় মা হারা দিদিই রতনের মা। বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি গেলেও দিদির কাছে আসে মাঝেই পারিয়ে চলে গিয়েছে রতন। এরপর একদিন রজন শুনলো দিদিকে পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা গেছে তারপর একদিন সে শুনতে পেল দিদিকে কারা নাকি ধরে নিয়ে গেছে। এই ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি গল্পকার বিস্তারিত বলেননি। মেয়েটিকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল না কেউ অপহরণ করেছে, কিংবা কেউ ভুলিয়ে তাকে বাড়ির বার করেছিল; অথবা নিজেই স্বেচ্ছায় বের হয়ে গিয়েছিল ঘর ছেড়ে। তবে এটুকু স্পষ্ট হয় ঘটনাটা ঘটেছিল গ্রামেই। শহরে নয়। মানুষের বিপদ হয়। মানুষের উপর পীড়ন হয় কিন্তু তার জন্য গ্রাম বা শহরের বিশেষ কোন ভূমিকা নেই। যে কোনো স্থানেই ঘটতে পারে। কিন্তু তারপর সেই গ্রাম সেই মেয়েটির আর ফিরে আসবার পথ নেই। তার জায়গায় কোথাও নেই। না আছে শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ি কিংবা স্বামীর ঘর। একমাত্র ছোট ভাই রতন ছাড়া। রতন দিদিকে খুঁজে পেয়ে তাকে আদর করে খাওয়ায় এবং ফিরে আসার পয়সা দিয়ে দেয়। কিন্তু সে নিজে ফিরে যেতে পারে না। তার যাবার কোনো উপায় নেই।

“মহানগর" গল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে “মহানগর গ্রন্থ হতে" এ গল্পে ঔপনিবেশিক শাসন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব সময়ের অর্থনৈতিক অধঃপতনের চিত্র বিধৃত হয়েছে। আর্থিক অনটনের কাছে মনুষ্যত্ব গুরুত্বহীন। মহানগরের যন্ত্রের নির্মোঘ যেমন সত্যি, তেমনি মানুষের অদম্য উৎসাহের জেগে থাকাও সত্যি। মহানগরের দুটি চিত্র এখানে উপস্থাপিত হয়েছে- প্রথমত, মহানগরের পথে যন্ত্রের নির্মোঘ ঊর্ধ্বমুখ যান্ত্রিক যন্ত্রের শব্দনাথ, জটিলতা ইত্যাদি এবং দ্বিতীয়ত, মহানগর প্রশস্ত আলোকোজ্জ্বল মানুষের বুদ্ধি, মানুষের অদম্য উৎসাহের মত।”দ্বিতীয় চিত্রটিই এখানে বেশি সম্পর্কিত। এখান থেকেই শুরু হয় রতন নামে যে লেখকদের শেখায়, গ্রাম সরল-শুল্ক, আর নগরের চরিত্রে কেবল শোষণ, আগ্রাসন, প্রতারণা সে জাতীয় লেখ এবং বড় লেখক নন। প্রেমেন্দ্রে মিত্রের লেখক এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নেই। তিনি গ্রাম বা শহরকে নির্দিষ্টভাবে ভালো কিংবা কাছে শহর এবং গ্রাম স্বমহিমায় উদ্ভাসিত ছিল। কোনোটির সাথে তিনি ভালো বা মন্দের ছাপ অবিচ্ছিন্ন করে দেননি। তাঁর কাছে মনে হয়েছে নগরই মানবজীবনের বৈচিত্র ও বিস্তারকে ধারণ করবার উপযুক্ত ক্ষেত্র। “মহানগর" গল্পটিতে আছে এই উপলব্ধি প্রকাশ গ্লানির প্রগাঢ় অন্ধকারে যাহাদের অতীতলুপ্ত হইয়া গিয়াছে বর্তমান যাহাদের ক্রেদপছিল, তাহারাও ঘর বাঁধিতে চায়।" পৃথিবীর ভাগ্যবান নরনারীদের জীবনলীলায় অনুকরণ করিতে তাহাদেরও সাধ হয়। কিন্তু সাধ ও সাধ্যের ব্যবধান ঘোচে না। অঘোর দাস চুরি করিতে গিয়ে ধরা পড়ে। আর এতে তার শাস্তি হয় বলে আদালতকে দোষ দেওয়া যায় না। কাউকেই দোষ দিতে না পারা পাঠক 'সংসার সীমান্তে" গল্পের এই সামাজিক সুনীতির বৃত্তবহির্ভূত দুটি মানুষের জন্য একফোটা অশ্রুপাত করে। এই ছিল প্রেমেন্দ্র মিত্রের নীতিবোধ।

১৯১৩ সালে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞান তত্ত্ব বের হওয়ার পর মনস্তত্ত্ব বিষয়ক আলোচনার সূত্রপাত। “মনস্তত্ত্বসম্মত” গল্প বলতে এখানে নির্দিষ্ট করা হয়েছে মানুষের অন্ধসংস্কার জটিল অবদমিত ইচ্ছা যৌন চেতনা, ঈর্ষা, রিরংসা, হীনমন্যতা ইত্যাদি বিষয়ক । আধুনিক সাহিত্যের এই বিষয় অনেক গল্পকারের মতো প্রেমেন্দ্র মিত্র ও প্রভাবিত হয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী গল্পকার জগদীশগুপ্ত। তাঁর গল্পে মানুষের অর্থলোভ, যৌনলোভ এবং ক্ষমতা লোভ সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানীদের মতো যে নিরাসক্তি ভঙ্গির বিশ্লেষণধর্মী যে পরিচয় পাওয়া যায় তা প্রেমেন্দ্রের স্বাভাবিক ভঙ্গি ছিল না।নিরাসক্ত ডিসেকশন এর মনোভঙ্গি তাঁর নিজস্বতা ছিল না। তাঁর মনস্তত্ত্বধর্মী এ ধরনের গল্প হচ্ছে "পোনাঘাট পেরিয়ে" এ গল্পটি পুতুল ও প্রতিমা" গল্পগ্রন্থের অন্ত ভুক্ত। এখানে বোধ হয় কিছুটা জগদীশগুপ্তের প্রভাব রয়েছে। এ গল্পের প্রধান চরিত্র বলাই। গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃদ্ধ সরকার মশাই এর জামাতা বলাই। কিন্তু প্রচলিত সমাজবিধি ও নিয়মের সে তোয়াক্কা করে না। সামাজিক আবেদন কোথাও তাকে বিদ্রোহী করে তোলে। অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে নিজেই কিভাবে অন্যায় করে ফেলছে নেশার মত্ততায় নিজেই তা জানে নি। এসব বিষয় নিয়েই আলোচ্য গল্পটি বিশ্লেষিত। বলাই এর সামাজিক, মানসিক অবদমন, রিরংসা ও ক্রোধ মানবিক মনস্তত্ত্বকেই গভীরভাবে বিশ্লেষিত করে তুলেছে। কোনো আয়-উপার্জন নেই বলে শ্বশুর বাড়ির লোক স্ত্রী কোনো মূল্য দেয় না। তাকে করে ছুটি নামের এই গরিব মেয়ের সম্পর্কে তার ম ে soft আছে। সেই মুটকিকে এলাকার লোকড়াবাবু। শেষ পর্যন্ত বলাইয়ের মনের ভেতরে প্রতিশোধের আ ছিল গৌড়াবাবুর নতুন গোলায় কেরোসিন কেলে আগুন ধরিয়ে দিল সে। কিন্তু নেশাখোর বলাই দৃষ্টি স্থির রাখতে পারেনি। ভুল করে খৌড়াবাবুর গোলার পাশে এক গরিব মানুষের গোলায় আগুন লাগ দিয়েছিল। এই গল্পের পরিণামে ভাগ্যের নির্মম বিরূপতার নিষ্ঠুরতম আঘাতের চিত্রকে সর্বাধিক গভীরতায় চিত্রিত করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। কিন্তু গল্পের ও পরিণামে দুই পথচারী মানুষকে নিয়ে এসেছেন লেখক। কিন্তু এই গল্পের পরিণামে দুই পথচারী মানুষকে নিয়ে এসেছেন লেখক। যারা গরিব মানুষের গোলাটি পুড়ে যাওয়ার খুবই সহানুভূতিবোধ করছে- “আহা, গরীব বেচারা গো, সর্বস্ব দিয়ে গোলাটি


“ধূলিধূসর" (১৯৩৮) গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “শৃঙ্খল" গল্পটি। এটি দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি বিষয়ক গল্প। এ গল্পে দাম্পত্য বা স্বামী-স্ত্রীর ভয়ানক ও শোচনীয় রূপ ব্যক্ত হয়েছে। হতাশা অবিশ্বাস ও ঘৃণা নিয়ে ও যে স্বামী স্ত্রী সংসার করা যায় সেই বাস্তবচিত্রের তীব্র, তাহার চেয়ে গভীর উন্মাদনাময় বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণার শৃঙ্খলে তাহারা পরস্পরের সহিত আবদ্ধ। সে-শৃঙ্খল তাহারা ছিড়িলে আর বাঁচিবার সম্পর্ক কী রহিল। জীবনের কী আশ্রয়? পরস্পরের জন্য তাহার বাঁচিয়া থাকিতে চায়।” কোনো বিশেষ স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের এই পরিণতি যেমন মর্মান্তিক তেমনি ভয়ংকর এবং ওই সম্পর্কের সম্পর্ক উপলব্ধি নিঃসন্দেহে একটা দুঃসাহসী মনস্তাত্ত্বিক সাফল্য, জীবনের অতলে অবতরণের দুঃসাহস যদি বা কোনো তত্ত্বজিজ্ঞাসুর হয় তবু কোনো দম্পতির জীবনের এই অন্তগূঢ় স্বরূপকে আক্রোশে ও আচরণে পরিস্ফুট করার জন্য চাই অসাধারণ শিল্প প্রতিভা এবং তা প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছিল। এ যুগের সর্বগ্রাসী শূন্যতা থেকে ও যে গ্রাস করে নিচ্ছে সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ছবিটি এ গল্পের আকর্ষণীয় বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর অভ্যাস শয়ন-বৃত্তান্ত। পরদিন সকালে নিঃশব্দে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়া, তারপর আহার কার্য সমাপ্ত করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার মধ্যে যে হাহাকার ফুটে উঠেছে তা পাঠককে প্রবলভাবে ধাক্কা দেয়। আধুনিক দম্পতি বছরের পর বছর এক সাথে বসবাস করার ফলে পরস্পর পরস্পরের কাছে যেমন অচেনা মনে হয়। কিভাবে ভালো বাসাহীন আত্মা শরীরে নিঃশেষ হয়ে যায় তার অসামান্য দলিল চিত্র এই 'শৃঙ্খল'। গল্পের শেষে  তুপতি বিনতির দাম্পত্য সম্পর্ককে প্রেমেন্দ্র মিত্র অঙ্কিত করেছেন এভাবে “তাহারা পরস্পরকে আর বুঝি ছাড়িতে পারিবে না। প্রেম নয়, তাহার জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র অস্তিত্বের সংকট, সংকট মোচনের জন্য সমস্ত রকম তৎপরতার • আঁকতে উনূস। অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, বন্টনের বৈষম্য, দারিদ্র্য ে হণে বাধা, অভ্যস্ত নুরে ও চরম অসহায় ও আত্মিক সংকটে "ম ভাড়া দেয়, "কৃত ক্ষুধার " গল্পের মূল বারবণিতা নায়িকাটি তার


“বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে" গল্পে বিগত যৌবনা এক গরিব বারধানতা বা গণিকার গল্প। কিন্তু সে গণিকা শরত্চন্দ্রীয় ভাবনার অনুগ নয়, তার মধ্যে মধ্যবিত্ত সংস্কারের বাঁচার অনিশ্চিয়তার প্রলেপ নেই, আছে ফরাসি ন্যাচারিলিজমের স্পষ্ট স্বাক্ষর। সংশয়, হতাশা, অনিশ্চয়তা, যন্ত্রণা— এসব ছিল কল্লোলীয় তরুণদের আদর্শ। এসব বিষয়কে প্রেমেন্দ্র মিত্র নিরাবেগ বৃদ্ধি দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করেছেন। তাঁর এই জীবন ব্যবচ্ছেদ শুধু মধ্যবিত্তের জীবন-সীমানায় স্থির থাকেন নি, একেবারে নিম্নশ্রেণির মানুষদের কদর্য জীবন ও এঁকেছেন।

**বাংলা বিভিন্ন নাটকের আলোচনা জানতে এখানে ক্লিক করুন 

ফরাসি ন্যাচারালিজমকে প্রেমেন্দ্র মিত্র যেমন আত্মীয়তায় গ্রহণ করেছেন এ গল্পে। তেমনি দেশীয় প্রেক্ষিতে রেখে সর্বকালীন মানব-ভাবনার তার স্বভাবে মাটির মধ্যেকার বিশুদ্ধ বাঁচার সারকে সম্মিলিত করেছেন। তাই "বিকৃত ক্ষুধার গল্পে” চরম হতাশার মধ্যেও আছে জীবনের ব্যাপ্ত, মমত্ব ও মমতাবোধ।

**সাহিত্যের ইতিহাস এখানে আছে


গল্পের চরিত্র পরিকল্পনায় নায়িকা বেগুন তার সমস্ত ছোট ও পার্শ্বচরিত্রকে একেবারে স্নান করে দিয়েছে। বারবনিতাকে লেখক নির্মোহ ও নিরাবেগ দৃষ্টি দিয়ে চিত্রিত করেছেন। বারবণিতা বেগুন বিগত যৌবনেও খরিদ্দার পাওয়ার জন্য অস্বাভাবিক সাজ গোজে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে চিত্রের কারুণ্য, অসহায়তা, যন্ত্রণা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয় বেগুনকে এক অসাধারণ দেহোপজীবনী করে তোলে। তার কন্ঠস্বর যেন তার পেশার অমর সম্পদ। তার নানা ধরনের সাজসোজ, অঙ্গভঙ্গি কাস্টমারের কাছে আশ্চর্য লাগে। বেগুন চরিত্র পরিকল্পনার মূলে লেখকের এই বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিটি শিল্প সার্থক।


সন্ধ্যা বেলায় সাজসজ্জার প্রস্তুতির মধ্যে বেগুনের সামগ্রিক রূপ পাঠকের সামনে ফুটে উঠে। সে বিগত যৌবনা, কপর্দকহীন। বাড়িউলীর দয়ায় তার বিগত দু মাসের অসহায় আশ্রয় লাভ ও জীবন ধারণ। ভাল খাবার না খাওয়ার ফলে তার দেহ দিনদিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়। তার ওপর বুকের মধ্যে চাপা শারীরিক অসুস্থতাজনিত ব্যথা। সন্ধ্যা বেলায় যে কোনো খন্দের পাওয়ার ক্ষীণ আশা ও সে মনে মনে পোষণ করে। যৌবন থাকলে পতিতালয়ের মাসির সুনজরে থাকা যায়। শশী চরিত্রটি এ তার বাড়িউলার অত্যন্ত পছন্দের তার উপস্থিতি দিয়ে লেখক বেগুনের জীবন অস্তিত্বের দীনতাটুকু আরো তীব্রভাবে এঁকেছেন। সমালোচক বীরেন্দ্র দত্ত যথার্থই বলেছেন “বেগুনের দারিদ্রোর চিত্র ও চরিত্র আঁকতে বসে প্রেমেন্দ্র মিত্র যে বাস্তবতার পরিচয়, যে নিরাসক চিত্ততার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের পর তা এই লেখকের কলমেই তুলনারাহিত হয়ে দেখা দেয়।"


প্রথম দেখা সেই বীভৎস কদর্যমুখের খদ্দেরের কাছে ফিরে আসা এবং শেষে তার কদর্যকহীন অবস্থা দেখে ও তাকে দুঃখে, যন্ত্রণায়, অনুশোচনায় অসহায়তায় ও চরম হতাশায় রাতের সাথী হিসেবে বেছে নেওয়ার মধ্যে আছে নিয়তি নির্দিষ্ট ভাগ্য। সবশেষে বেছে নেওয়া খদ্দেরটি যেন বেগুনের এমন অসহায় পতিতা জীবন অবস্থার সম্মান। তাকে যে অচেনা কেউ পছন্দ করে। এমন খদ্দের গ্রহণ করে তার পেশার জীবনকে সচল করার প্রত্যয় আগে পতিত সমাজে। কিন্তু এই ব্যবস্থা গ্রহণের গভীরে আছে কপর্দকহীনতার জীবনকে বেঁচে থাকার উপযোগী শক্তিহীনতা। বেগুনের ক্লেদান্ত জীবন ভাগ্যের সকরুন পরিণতি সমগ্র মানব ভাগ্যেরই স্বাভাবিক স্বরূপ।


অন্যান্য চরিত্রগুলোর মধ্যে আছে বাড়িউলী, শমী, নামহীন তিনটি বেগুনের খরিদ্দার। এরা সকলেই বেগুনের জীবনভাষা ও চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং পরিণামী জীবন যন্ত্রণার স্বরূপকে স্থায়ী রূপ দিয়ে প্রয়োজনহীন হয়ে পড়েছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের এমন চরিত্র পরিকল্পনা অসামান্য ছোটগল্প-শিল্পের অনুসারী। লেখকের সংযম, পরিমিতিবোধ, নিরাসক্তি, নিরাবেগ, সার্থক ছোটগল্পের আঙ্গিক ভাবনাই “বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে গল্পের চরিত্রচিত্রণকে শিল্পের মহত্ত্ব দান করেছে।


প্রেমেন্দ্র মিত্রের অতিবিখ্যাত গল্প “তেলেনাপোতা" গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে কুড়িয়ে ছড়িয়ে (১৯৪৬) গল্প গ্রন্থে। এ গল্পের কাহিনী সামান্য। গল্পের নায়ক সবান্ধব শহর থেকে অনেক দূরে এক বন্ধুর গ্রামের আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছেন। রাতের অন্ধকারে চাঁদের আলোয় গ্রামের পুরোনো বড়ো বড়ো থামওয়ালা অর্ধভগ্ন বাড়িগুলো সৃষ্টি করেছে রূপকথার আমেজ। মনে হয়েছে এই সব ভগ্ন প্রাসাদে কোনো এক প্রকোষ্ঠে বন্দিনী রাজকুমারীকে দেখা যাবে। কিন্তু দিনের আলোয় মোহভঙ্গ হয়েছে সকালে গ্রামের জীর্ন পরিবেশে নায়ক দেখেছেন বন্ধুর দূর সম্পর্কিত বোন। শীর্ণ শরীর যামিনীকে। যামিনীর অন্ধ মা বেঁচে আছেন এক করুণ আশা নিয়ে। আত্মীয় পুত্র শহুরে নিরঞ্জন তাঁকে কথা দিয়েছিল যামিনীকে বিয়ে করবে। বৃদ্ধার আজও বিশ্বাস নিরঞ্জন ফিরে আসবে। নায়কের সবান্ধবে আগমনে পাগল হয়ে ওঠেন বৃদ্ধা তাঁর ধারণা নিরঞ্জন এসেছে। অসুস্থ, অবুঝ মাকে শান্ত করবার জন্য নায়কের বন্ধু অর্থাৎ যামিনীর দাদাকে অসহায় যামিনী ডাকতে আসে। বন্ধুটি ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে

এনীর মার কাছে যান যামিনীর করুণ মুখ বৃদ্ধার শেষ আশা নায়ককে বিচলিত করে। তিনি নি যামিনীকে গ্রহণ করতেই এসেছেন। আসার। য় আসেন যে, তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু শহরে। ফিরে ম্যালেরিয়ার আঘাতে দুর্বল মানুষটির দুর্বল প্রতিজ্ঞা ধুয়ে মুছে যায়।

গল্পে গ্রাম ও শহরের প্রতি প্রতীক্ষায় গ্রামবাসিনী যামিনী বেশি প্রতারিত হয়েছে। সীমানুষের দ্বারা গরীবকে কৃত্রিমতার দ্বারা হয়তো বা এখানে কিছু। আক্রান্ত দেখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। এই গল্পে তিনি কল্পিত নায়কের কথা ভেবেছেন যে আবার যামিনীকে ফিরে আসার আশ্বাস শোনাবে। যামিনীর অন্ধ মা-কে যখন কথা দিয়েছিলেন তিনি “আমি তোমায় কথা দিচ্ছি মাসিমা। আমার কথায় নড়চড় হবে না।" কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তার উল্টো। গল্পের শেষে নায়ক যখন তেলেনাপোতাকে স্বপ্নে ভাবেন যামিনীকে দুর্বল মনের কল্পনা তখন পাঠকের তো বটেই—কি মনে হয় না—"সৃষ্টির মূলেই সে নির্বিকার নির্মমতা।”

গল্পের শেষে নায়কের মনে হবে তেলেনাপোতা বলে কোথাও কিছু সত্যি নেই। গভীর কঠিন যার মুখ আর দৃষ্টি যার সুদৃঢ় ও করুণ। ধ্বংস পুরীর ছোঁয়ার মতো সেই মেয়েটি হয়তো আপনার কোনো দুর্বল মুহূর্তের অবাস্তব কুয়াশাময় কল্পনামাত্র।

একবার ক্ষণিকের জন্যে আবিষ্কৃত হয়ে তেলেনাপোতা আবার চিরন্তন রাত্রির অতলতায় নিমগ্ন হয়ে যাবে। তেলেনাপোতা ও যামিনীর স্মৃতিকে স্বপ্ন বা মিথ্যা মনে করেছেন যে মুহূর্তে সেই মুহূর্তে নায়কের নিজের কাছে মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে তাঁর শপথ, তাঁর মূল্যবোধ। এই ভাবের ঘরে চুরি। নিজের প্রতি অসততা অস্তিত্ব ঘিরে জাগিয়ে তুলছে বিপুল প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ।

রাতের তেলেনাপোতা নায়কের মনে জাগিয়েছিল রূপকথার রোমান্স-দিনের প্রখরতায় দেখেছেন সেই স্বপ্নের জরাজীর্ণ, নিরাবরণ বাস্তবরূপ। আবার শপথ ভঙ্গের বাস্তব অপরাধবোধ থেকে পালিয়ে তেলেনাপোতাকে স্বপ্নময় রোমান্সের জগৎ মিথ্যা কল্পনা বলে ভাবতে শুরু করেছেন নায়ক গল্পের শেষে 

এ গল্পের নায়িকা যামিনী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। মধ্যবিত্ত জীবনের ব্যথা-বেদনা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর দ্বারা যামিনীর শরীরে পূর্ণ প্রতিভাত। অথচ সে যেন রক্তমাংসের রমণী নয়। সে যেন চেনা পৃথিবীর বাইরে এক অনুভূতিহীন গ্রহান্তরে বাস করেন। অদ্ভুতভাবে এক সুররিয়ালিস্টিক ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। এ গল্পে কোথাও মহাযুদ্ধের ছায়াপথ নেই, কোলাহল নেই, ভাবালুতা নেই, অথচ গল্পটি হঠাৎ যেন কোথায় মাটিকে স্পর্শ করেছে। তেলেনাপোতা স্মৃতি নয়, স্বপ্ন নয়, 

বাঙর ও নয়। গল্পের স্টেটমেন্ট ধর্মী কথন ভঙ্গিমা গল্পটিকে ঋজুতা দিয়েছে। এমন


গল্পটি শুরু হয়েছে রসিকতার সুরে বিদ্রুপের ব্যঞ্জনাময় “শনি ও মঙ্গলের মঙ্গল হবে বোধ হয় যোগাযোগ হলে তেলেনা পোতা আপনারা ও একদিন আবিষ্কার করতে পারেন। শনি ও মঙ্গল দুটি গ্রহকেই জ্যোতিষশাস্ত্রে একটু ভয়ের নজরে দেখা এবং সে দুটির সংযোগ ঘটলেই তেলেনাপোতা আবিষ্কার সম্ভব। অর্থাৎ এই আবিষ্কার যে নায়কের পক্ষে বিপর্যয়কারী তবে পরিহাসের ছলে তা জানিয়ে দিলেন


গল্পটি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে লেখক এক ধরনের মোহাচ্ছন্নতা সঞ্চারিত করেছেন। ফলে কাহিনীর সুর মোটামুটি একই পর্দায় বাঁধা আছে- তা-কে স্তরে স্তরে উঁচু পর্দায় উন্নীত করতে চেষ্টা করেনি লেখক: কারণ স্বর বাড়লে মোহমুগ্ধতা কেটে যাবে। গল্প শুরু রসিকতায় ঢং– তারপর মোহাচ্ছন্নভাবে পাঠক নিজের অজান্তেই নেমে পড়েছেন এক রহস্যময় পরিক্রমায় লেখক যাদুকরের যতো পাঠককে সম্মোহিত করে পরিক্রমা করতে বাধ্য হয়েছেন এবং পরিক্রমার শেষে “বাইরের আলো হাওয়ায় পাঠককে দাঁড় করিয়ে সম্মোহনের জাদু নিচ্ছেন সরিয়ে– পাঠককে একাধারে তাঁর বিবেক ও বাস্তবের মুখোমুখি করে দিচ্ছেন। অর্থাৎ গল্পটির নাটকীয় বৈপরীত্য, নাটকীয় অভিঘাত প্রকট হচ্ছে পরিণতিতে।

শিল্পরূপ__-----

ছোটগল্পের শিল্পরূপ বিষয়ে যিনি সর্বপ্রথম দিকনিদর্শন দিয়েছিলেন তিনি হলেন এডগার অ্যালেন পো। প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন তাঁর অনুরাগী। এডলার অ্যালেন পো “ন্যাথানিয়াল হর্থন”-এর গল্প সংকলনের সমালোচনায় ছোটগল্পের পরিসীমা ও একক উপলব্ধির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তেমন কোনো নির্দেশনা দিতে পারেননি। পাশ্চাত্য ছোটগল্প সম্পর্কে ব্যান্ডার ম্যাথিউজ “ফিলসফি অভ আ শট স্টোরি" প্রবন্ধে ছোটগল্প সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হয়েছে। পরবর্তীকালে যত আলোচনা হয়েছে তাঁরা কেউ তাঁর ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি। আর বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প সমপর্কে চমৎকার আলোচনা করেছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় “সাহিত্যে ছোটগল্প"। ছোটগল্প সম্পর্কে ম্যাথিউজ সহ গুরুত্বপূর্ণ যে সব আলোচক যে সব শর্তগুলো উল্লেখ করেছেন প্রেমেন্দ্রি মিত্রের লেখায় পুরোপুরি তা পরিণত হয়েছে।

ছোটগল্পের ক্ষেত্রে Single impression বা ঐক্য প্রতীতি অত্যন্ত প্রয়োজন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় একে বলেছেন 'ঐক্য-সংকট'। আধুনিক সভ্যতায় মানুষের 

ব্যক্তিত্ব বিকাশের মারি হয়েছে ছোটগল্পের। প্রেমেন্দ্র মিত্রের -ছোটগল্পগুলো এতই উপলব্ধি প্রধান যে প্রায়শই একটি বাক্যে তা বলে দেওয়া যায়। যেমন “পোনাঘাট পেরিয়ে গল্পের নিহিত অনুভবটি হল দরিদ্র অক্ষনের ঈর্ষায় শোচনীয় পরিনাম। “মহানগর" গল্পে বারাঙ্গনা রূপে চিহ্নিত হতভাগ্য নারীর সাথে সমাজের সম্পূর্ব প্রতিষ্ঠিত।


ছোটগল্পে বাহুলা বর্জন করতে হবে। উপন্যাসের মত ছোটগল্প বিবৃতিধর্মী থাকতে পারবে না। ম্যাথিউজ ছোটগল্প সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন– ছোটগল্প ছোট পরিসীমায় হলেও এর মধ্যে আখ্যানের গতি থাকবে এবং থাকবে বিকাশ। অর্থাৎ কাহিনিটি একটিই বিন্দু থেকে শুরু হয়ে আর একটি পরিণতি বিন্দুতে উপনীত হবে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে এই লক্ষণটি অসাধারণ (দক্ষতার শিল্পিত হয়ে উঠেছে। এই বিকাশ শক্তিতেই তাঁর ছোট গল্পগুলোর শিল্পতু নিহিত। “মহানগর" গল্পে সমাজ পরিত্যক্ত। বার রমনী হতে বাধ্য হওয়া দিদিকে রেখে ফিরে যাবার সময় বালক রঙন সহসা ফিরে এসেছিলেন বড় হয়ে আমি তোমায় নিয়ে যাব। কারো কথা শুনব না।" রতনের এই বড় হয়ে ওঠাতেই গল্পের সার্থকতা।


"তেলেনাপোতা আবিষ্কার" গল্পে আছে এক পরিণামমুখী গতি। গাঁয়ের কিশোরীর প্রতারিত হওয়া গল্পটিকে বেশ সুশৃঙ্খলভাবেই উপস্থিত করেছেন লেখক। শেষকালে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আত্মকেন্দ্রিক ও সদাব্যস্ত নগর মানসিকতায় গ্রামের প্রতীক্ষামান মেয়েটির জন্য কোনো সাধারণ সেজন্য অবশিষ্ট থাকে না।

আমরা জানি ছোটগল্পে উপন্যাসের মত অধিক চরিত্র নির্মিত করা নিষ্প্রয়োজন। যেখানে উপলব্ধি একটি মাত্র একটিই সংকট সেখানে অধিক চরিত্র নিষ্প্রয়োজন। সাধারণত দেখা যায় ছোটগল্পে তিনটি চরিত্র খুব সামস্যপূর্ণ বিন্যাস তৈরি করতে পারে। যেখানে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার গল্প লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র সেখানে এই তিন চরিত্রের বিন্যাস হয়ে ওঠে অনিবার্য শিল্পরীতির তাঁর ভস্মশেষ, স্টোভ। 'সংসার সীমান্তে' ইত্যাদি গল্পগুলো এই বিন্যাসের নিদর্শন। যেখানে প্রেমেন্দ্র মিত্র দুটি চরিত্রকে গল্পে বিন্যস্ত করেছেন যেখানে চরিত্র দুটো গভীরভাবে পরস্পর-সাপেক্ষ হয় সংঘাতের অথবা প্রীতির বন্ধনে। প্রথম বিন্যাসের দৃষ্টান্ত ‘শৃঙ্খল’, দ্বিতীয় বিন্যাসের দৃষ্টান্ত তার প্রথম গল্প শুধু কেরানী"।

প্রেমেন্দ্রের গল্পে বিবৃতির ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতি ও দেখা যায়। তাঁর গল্পের প্রধানত রীতি হল লেখকের উক্তিতে কথিত আখ্যান। তাঁর অধিকাংশ গল্পই এই শৈলীতে রূপায়িত। তবে কিছুটা বৈচিত্র্য নিয়ে আসেন কখনো কখনো শ্রোতাকে সরাসরি সম্বোধন করে। কিছুটা মধ্যম পুরুষের নৈকটা ব্যবহার করে। যেন গল্পের ঘটনাগুলো 

সরাসরি ঘটছে পাঠকের সামনে। পাঠককে আপনি সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে একটা প্রার্থিত দূরত্ব ও রচনা করেছেন তিনি। "তেলেনাপোতা আবিষ্কার" "মহানগর" গল্পের প্রথমাংশে এই পদ্ধতি সুন্দর ব্যবহার আছে। গল্পের আখ্যান যেন সরাসরি সামনে ঘটছে না, আখ্যানটি যেন পাঠকের সামনে বিবৃত হচ্ছে অন্য কারোর দ্বারা। এই বর্ণন প্রক্রিয়া প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রিয় শৈলী।

ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাব ও সংলাপের ভাষাকেই গ্রহণ করেছেন। সেই ভাষাকাঠামোর মধ্যেই সুখ দুঃখ। কঠিন বাস্তবতার বিভিন্ন পর্যায়, আবার সংকেত, সৌন্দর্য ও জীবনদর্শন সব কিছুই তিনি প্রকাশ করতে পেরেছেন। “সংসার সীমান্তে" গল্পে এক দেহজীবনীর একটি ঘরের বর্ণনা লক্ষণীয়- “দুধারে দুই টিনের পার্টিশনের মধ্যবর্তী খানিকটা অপরিসর মাত্র মেঝেতে কোনো কালে বোধ হয় সিমেন্ট দেওয়া হইয়াছিল। এখন তাহার চিহ্নও নাই।”

“পুন্নাম” গল্পের শেষে নক্ষত্রখচিত বিশাল আকাশ ও সর্বংসহা ধরিত্রীর যে বিস্ত রিকে লেখক ভাষায় বর্ণনা করেছেন তা অতুলনীয়

“বিশাল আকাশ নক্ষত্রের আলোয় যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে। তারই তলায় তার মনে হল, এই মৌন সবসহা যে যুগ যুগান্তর ধরে বারবার আশাহত, ব্যর্থ হয়ে ও আজও প্রতীক্ষার ধৈর্য হারায়নি ।"

বর্ণনার ভাষার শিক্ষিত মার্জিত মধ্যবিত্তের মার্জিত শালীনতা বজায় রেখে ও সংলাপের ভাষায় কতটা খোলাখুলি অমর্জিত ভাষণ ও ভঙ্গি প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রকাশ করতে পারতেন তারও অনেক উদাহরণ আছে “পোনাঘাট পেরিয়ে” বা “ভবিষ্যতের ভার" গল্পের সংলাপ দেখলে উপলব্ধি করা যায়।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পের প্রায়ই অন্ধকার প্রসঙ্গ লক্ষ করা যায়। যে অন্ধকার হয়তো মানুষের নিয়তি। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় বাংলা কবিতায়। অন্ধকার প্রসঙ্গ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। যে অন্ধকারের হাত থেকে মানুষের রক্ষা নেই। যে অন্ধকার সম্ভবত অস্পষ্ট চেতনার এক রহস্যময় প্রতীক। “পোল পার হইয়া মহিম লাবণ্যকে লইয়া কোথায় গিয়াছে আমি জানি না। আমার কল্পনার অন্ধকারে তাহারা বিলীন হইয়া গিয়াছে।"

“তেলেনাপোতা" গল্পের অন্যতম প্রধান সম্পদ এর ভাষা আগাগোড়া নিচু স্বরে লেখক পাঠকের সাথে সম্মোহনের ভঙ্গিতে কথা বলেছেন। চরম উৎকণ্ঠার মুহূর্তেও সে ঊচ্চ হয়নি বরং আরো ফাঁকে নেমে গেছে, আরো চাপা, রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠেছে। দেখা যাক চরম উৎকণ্ঠার মুহূর্তট "আপনাদের পদ শব্দ শুনে সেই কঙ্কালের মধ্যে ও যেন চাঞ্চল্য দেখা দেবে?

" এ... এবার তো আর অমন করে পালাবি না?” মনি কি যেন বলতে যাবে, তাকে বাধা দিয়ে আপনি আকস্মাৎ বলবেন। “না মাসিমা, আর পালাবি না।" মনি কি যেন বলতে যাবে, তাকে বাধা দিয়ে আপনি অকস্মাৎ বলবেন, “না মাসিমা, আর পালাব না।

সাধুগুঙ্গির ভারি পদ-সমন্বিত ভাষা ও চলিত, প্রাণবন্ত সংলাপকে ভারি সুন্দর মিলিয়েছেন লেখক এই গল্পে। সাধুভঙ্গির গম্ভীর ভাষায় চারটি উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে (১) পরিস্থিতি কতখানি 'সিরিয়াস' বা গম্ভীর তা বোঝাতে পেরেছেন লেখক (২) হাস্যরস সৃষ্টিতে গভীর ভাষা বিশেষ উপযোগী (3) Uncanny feelings জাগাতে ও এই গান্ধীর্ষ প্রয়োজন ছিল (৪) রোমান্সের ঐশ্বর্য পরিস্ফুটনে সহায়তা করেছে এই

দৃষ্টান্ত: "... তক্তাপোতে ছিন্ন কন্থাজড়িত একটি শীর্ণ কঙ্কালসার মূর্তি শুয়ে আছে।" কিংবা "... মনির বিমূঢ়তা ও আর একটি স্থানুর মতো মেয়ের মুখে স্তম্ভিত বিস্ময় আপনি যেন অনুভব করতে পারবেন।”

আবার চলিত বাক্‌ভঙ্গি ও শব্দ প্রয়োগে সংলাপগুলো জীবন্ত— আমার পেট হয়েছে বলে বলছি না, এমন মেয়ে হয় না। শোকে তাপে বুড়ো হয়ে মাথার ঠিক নেই, রাতদিন খিটখিট করে মেয়েটাকে যে কত যন্ত্রণা দিই, তা কি আমি জানি না।

ছোটগল্পের ক্ষেত্রে প্রতীক, ব্যঞ্জনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রায় সবগল্পই ব্যঞ্জন্যধর্মী ও গভীর ইঙ্গিতবহ। প্রেম, প্রতিহিংসা, যৌনতা, সমাজ ও জীবনের যন্ত্রণা প্রতি ক্ষেত্রে প্রতীক ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলো বাস্ত বসম্পৃক্ত আর কতগুলো কল্পনা সৌন্দর্যমন্ডিত। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে পাখির নীড় (শুধু কেরানী), ভাঙাবন্দর (মহানগর), ট্রেন (যাত্রাপথ) ইত্যাদি।

“তেলেনাপোতা” গল্পটিতে লেখক ও বন্ধুদের শহরের বাইরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ও অবসর যাপন মাছ ধরা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ বিষয় গল্পটিতে উঠে এসেছে। এই গল্পের ‘পোতা’ শব্দটিতে রয়ে গেছে ঘর বা ভিত্‌-এর ইঙ্গিত। আর আশ্চর্যের সরোবরে মাছ ধরার প্রসঙ্গ। এর পরেই আসে যামিনী ও মনির কথা। তাদের বর্ণনা প্রসঙ্গে যে চিত্রকল্পটির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ —

“খানিক বাদে পরস্পরের মুখ আর ঘনায়মান অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না। ...তখন হঠাৎ সেই সাদা জলের নালা যেখানে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছি, সেখান থেকে অপরূপ একটি শ্রুতিবিস্ময়কর আওয়াজ পাবেন। মনে হবে বোবা জঙ্গল থেকে কে যেন অমানুষিক এক কান্না নিংড়ে নিংড়ে বার করছে।” 

"আপনাদের পদ শব্দ শুনে সেই কঙ্কালের মধ্যে ও যেন চাঞ্চল্য দেখা দেবে?


" এ... এবার তো আর অমন করে পালাবি না?” মনি কি যেন বলতে যাবে, তাকে বাধা দিয়ে আপনি আকস্মাৎ বলবেন। “না মাসিমা, আর পালাবি না।" মনি কি যেন বলতে যাবে, তাকে বাধা দিয়ে আপনি অকস্মাৎ বলবেন, “না মাসিমা, আর পালাব না।


***বাংলা কাব্যগ্রন্থের আলোচনা জানতে ক্লিক করুন 


সাধুগুঙ্গির ভারি পদ-সমন্বিত ভাষা ও চলিত, প্রাণবন্ত সংলাপকে ভারি সুন্দর মিলিয়েছেন লেখক এই গল্পে। সাধুভঙ্গির গম্ভীর ভাষায় চারটি উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে (১) পরিস্থিতি কতখানি 'সিরিয়াস' বা গম্ভীর তা বোঝাতে পেরেছেন লেখক (২) হাস্যরস সৃষ্টিতে গভীর ভাষা বিশেষ উপযোগী (3) Uncanny feelings জাগাতে ও এই গান্ধীর্ষ প্রয়োজন ছিল (৪) রোমান্সের ঐশ্বর্য পরিস্ফুটনে সহায়তা করেছে এই

দৃষ্টান্ত: "... তক্তাপোতে ছিন্ন কন্থাজড়িত একটি শীর্ণ কঙ্কালসার মূর্তি শুয়ে আছে।" কিংবা "... মনির বিমূঢ়তা ও আর একটি স্থানুর মতো মেয়ের মুখে স্তম্ভিত বিস্ময় আপনি যেন অনুভব করতে পারবেন।”

আবার চলিত বাক্‌ভঙ্গি ও শব্দ প্রয়োগে সংলাপগুলো জীবন্ত— আমার পেট হয়েছে বলে বলছি না, এমন মেয়ে হয় না। শোকে তাপে বুড়ো হয়ে মাথার ঠিক নেই, রাতদিন খিটখিট করে মেয়েটাকে যে কত যন্ত্রণা দিই, তা কি আমি জানি না।


**মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 


ছোটগল্পের ক্ষেত্রে প্রতীক, ব্যঞ্জনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রায় সবগল্পই ব্যঞ্জন্যধর্মী ও গভীর ইঙ্গিতবহ। প্রেম, প্রতিহিংসা, যৌনতা, সমাজ ও জীবনের যন্ত্রণা প্রতি ক্ষেত্রে প্রতীক ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলো বাস্ত বসম্পৃক্ত আর কতগুলো কল্পনা সৌন্দর্যমন্ডিত। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে পাখির নীড় (শুধু কেরানী), ভাঙাবন্দর (মহানগর), ট্রেন (যাত্রাপথ) ইত্যাদি।

“তেলেনাপোতা” গল্পটিতে লেখক ও বন্ধুদের শহরের বাইরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ও অবসর যাপন মাছ ধরা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ বিষয় গল্পটিতে উঠে এসেছে। এই গল্পের ‘পোতা’ শব্দটিতে রয়ে গেছে ঘর বা ভিত্‌-এর ইঙ্গিত। আর আশ্চর্যের সরোবরে মাছ ধরার প্রসঙ্গ। এর পরেই আসে যামিনী ও মনির কথা। তাদের বর্ণনা প্রসঙ্গে যে চিত্রকল্পটির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ —

“খানিক বাদে পরস্পরের মুখ আর ঘনায়মান অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না। ...তখন হঠাৎ সেই সাদা জলের নালা যেখানে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছি, সেখান থেকে অপরূপ একটি শ্রুতিবিস্ময়কর আওয়াজ পাবেন। মনে হবে বোবা জঙ্গল থেকে কে যেন অমানুষিক এক কান্না নিংড়ে নিংড়ে বার করছে।” 

দ্বিতীয় চিত্রকল্পের বর্ণনা “তবু কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণ চাদের আলোয় সমস্ত কেমন অপরূপ মোহময় মনে হবে। মনে হবে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকলে এই মৃত্যু সুষুপ্তি মগ্ন মায়াপুরীর কোন গোপন প্রকোষ্ঠে বন্দিনী রাজকুমারী সোনার কাঠি পাশে নিয়ে যুগান্তের গায় তন্দ্রায় অচেতন তা যেন আপনি টের পাবেন।”


“পোনাঘাট” পেরিয়ে গল্পটির নাটিকীয় মুহূর্ত—“কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, খোঁড়াবাবু পারল। খোঁড়াবাবুর দয়ালু যা এ দুর্নাম পটিতে নেই। কিন্তু বোঝা গেল না।"


“সংসার সীমান্ত" গল্পটি সংলাপ নির্ভর। সংলাপের মধ্যে দিয়ে চরিত্র ও ঘটনা বিশ্লেষিত হয়ে উঠেছে। সংলাপগুলো কখনো চরিত্র, চরিত্রগত দ্বন্দ্ব। কখনো বিষয়কে ব্যাখ্যা করেছে এবং এই সংলাপ মূলত রীতি হয়েছে গল্পের দুই মূখ্য চরিত্র রজনী ও অঘোর দাসের মধ্যে। দৃষ্টান্ত: “রজনী ঝঙ্কার দিয়ে বলে, না, পারি না। উনুনের ছাই রাঁধতে পারি, সখ কত? ঘায়ে পুঁজ শুকাচ্ছে না আর। অম্বল খাবে।” সমস্ত গল্পটি রচিত হয়েছে সাধুরীতিতে। কিন্তু ওখানে তার সাবলীলতা রক্ষিত


সংলাপে ব্যবহৃত হয়েছে গ্রাম্য সৌখিন ভাষা। যেমন—


১. “দেখেছিস এ হল ডাঙ্গায় জুতো, আর জলে নামলেই নৌকা।" ২. “এতগুলো করে টাকা কি মাগনা দিলাম। "


নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারের চলমান জীবনের এক টুকরো কাহিনী “পুন্নাম”, অসুস্থ সন্ত ানের চিকিৎসার জন্য ডাকের কর্মী ললিতের অর্থ সংস্থান ও তার বিবেকের দংশন নিয়ে এক ট্র্যাজিক রূপ গল্পটিতে উদ্ঘাটিত হয়েছে। সংলাপ “দেখুন, এমন করে একটা মানুষকে পৃথিবীতে নিজের সুখের জন্য এনে


যায়। তার প্রতি কর্তব্য করে না। তাদের জেল হওয়া উচিত- ঠিক বলুন জেল হওয়া


উচিত না।”


গল্পের দ্বিতীয় পর্বে টুনু ও খোকার মধ্যেকার সংলাপ। বিভিন্ন দৃশ্য সৃজন। টুনুর


বক্তব্য গল্পটিকে গতিশীলতা দিয়েছে।


দৃষ্টান্ত : 'দৃশ্য-১– ললিত খোকার কান ধরে জিজ্ঞাসা করেছে— 'কেন ওর মাথা মাটিতে ঠুকে দিচ্ছিলে? বানাড়া না করে থাকতে পার না।” টুনু বলেছে—'না ঝাগড়া হয় নি। ও ঘোড়া খেলতে বললে কিনা—আমার তো লাগেনি।”


দৃশ্য-২-“টুনুর সমস্ত সাধ্য সাধনা, মিনতি অনুরোধ, অগ্রাহ্য করে খোকা ক্রুদ্ধ মুখে গুম হয়ে বসে থাকে। তারপর হঠাৎ অকারণ প্রাণপণ শক্তিতে টুনুকে চিমটি কেটে দৌড়ে পালিয়ে যায়।” “বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে “গল্পটির পটভূমি নির্মিত হয়েছে দুভাবে প্রথমত পতিতা


পল্লিতে ও দ্বিতীয় রাস্তায় আলোকজ্জ্বল এগজিবিশনে। গল্পের সূচনাতে আছে—“প্রদীপের

অস্পষ্ট আলোকে একটি বিগত যৌবন রোগা লম্বা স্ত্রীলোক, সিল্কের একটা শাড়ি সেলাই। করছিল।"


আবার কতগুলি দৃশ্য সজ্জার মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ ও তুলে ধরেছেন লেখক। যেমন-বাড়িউলী তার বিপুল বাতগ্রস্ত দেহ নিয়ে অতিকষ্টে এক পায়ের উপর দিয়ে বেঁকে আর একপা তুলে by চৌকাঠটা ডিঙ্গিয়ে ঘরে ঢুকে বললে, “সে ছৌড়াতো আজও এলো না রে বেগুন-সে এবার ভেগেছে।”


লেখক এ গল্পে দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে গল্পের বিষয়কে আরো তীব্র করে তুলেছেন। ফলে গল্পে চমক বা নাটকীয়তার অভাব নেই। সিল্কের শাড়ির সাথে বেগুনের তুলনা। উজ্জ্বলতা ও সৌন্দর্য হারিয়ে প্রৌঢ়ত্বে


উপনীত উভয়েই। চিত্রকল্প গল্পটিতে গুরুত্ব পূর্ণ স্থান পায়—যেমন “তার অন্তরের


কোন ভাবই মুখের বিকৃত ভগ্ন আয়নায় প্রতিফলিত হবার নয়।” এ গল্পে লেখক ভূপতি ও বিনতির দম্পতির বিবাহ স্পৃহা মুহূতে Flash back রীতির প্রয়োগ করেছেন “বিবাহ হইয়াছিল নিতান্ত সাধারণ ভাবেই। ভালো ছেলে খুঁজিবার দুঃসাহস বিনতির বাপ মায়ের ছিল না, বাড়িঘর আত্মীয় স্বজন না থাক, উপার্জন কম ও স্বাস্থ্যবান বলিয়া ভূপতিকে কন্যাসন্তান করিতে পারিয়া তারা নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন ।...ছেলেটি অবশ্য কেমন একটু।” এটি কেমন একটু’র সম্ভাবনী মুহূর্ত থেকেই গল্পটি অন্যদিকে বাঁক নেয়। কাহিনিতে বারবার এসেছে নাটকীয় চমক।


গল্পের ভাষায় প্রায়ই উৎপ্রেক্ষা, উপমা ব্যবহার রচনাটিকে গভীরতর করেছে। দৃষ্টান্ত : “তাহাদের মধ্যে যেন অসীম মহাদেশের ব্যবধান। এতে ব্যবধান বিষয়টি গভীরতর হয়েছে। ভূপতির আপাত শীতলতা, মানসিক অভিব্যক্তি, বিশেষ ক্রুরতা বোঝাতে ও শব্দ ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যেমন : “ভূপতি নিঃশব্দে হাসিতেছে।” শৃঙ্খল গল্পে কতিপয় আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার সহনীয় দা-দেইজী, 'বকুনি’ ‘পৌন' চিত্রকল্পের অসাধারণ ব্যবহার—" শুভ্র শয্যার সঙ্গে একেবারে যেন মিশাইয়া বিনতির দেহ পড়িয়া আছে। গল্প পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা শীর্ণ মুখটুকু চাদরের মতো বিবর্ণ।"

“মহানগর" গল্পটি প্রাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্বের এক অসামান্য গল্প। গল্পের সূচনা থেকেই শিল্পগত যে বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে তা হল এর বর্ণনা গুণ। গল্পকার গল্পের শুরুতে মহানগরের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে মহানগরের যুগপৎ সুন্দর ও অন্ধকারময় ফুটে উঠেছে। মহানগরের সাথে মানবাত্মার চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে তা তিনি বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে

“আমার সঙ্গে চলো মহানগরে— যে মহানগর ছড়িয়ে আছে আকাশের তলায় পৃথিবীর ক্ষতের মতো। আবার যে মহানগর উঠেছে মিনারে মন্দিরচূড়ায় আর অভ্রভেদী প্রাসাদ শিখরে তারাদের দিকে প্রার্থনার মতো।"

গল্পটিতে উপমা ও চিত্রকল্পের মধ্যে দিয়ে মহানগরের তুলনা। পরিবেশগত তীব্র দূষণ যান্ত্রিকতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়


"সন্ধ্যা নামে বিস্মৃতির মত" রতনের প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিষণ্ণতা সন্ধ্যার রূপকল্পে তাৎপর্য পায়।


"রূপকথার চেয়ে অদ্ভুত শহর"-রূপকথার উপমা ও বৈচিত্র্যকে মনে করিয়ে দেয়। ৩. “বিশাল দুর্বোধ চিত্র”— স্মরণীয় হয়ে ওঠে মহানগরের চরিত্রগত জটিলতায়।


এ গল্পে প্লটের দৃশ্যসজ্জা গভীর ও ইঙ্গিতবাহী ক্রমশ তেমনি নাটকীয়তা, চিত্রকল্পের গভীরতা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এবং বর্ণনা কৌশলে পাঠককে মুগ্ধ করে।


দৃষ্টান্ত :


মাঝিরা নৌকার খোল থেকে জল ছেঁচে ফেলেছে”-আত্মরক্ষার ইঙ্গিত।

২. মহানগরের ওপর সন্ধ্যা নামে বিস্মৃতি গায়—রতনের বিষাদ বোঝাতে প্রযুক্ত। ৩- “মেঘলা আকাশে একটু আলো থাকতেই আলো এসেছে ম্লান হয়েছে।” রতনের দিদির মলিনতা বোঝাতে ব্যবহৃত।

“বিকৃতক্ষুধার ফাঁদে” গল্পে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভাষা কাবিতৃহীন, শুষ্ক, নিরাবেগ, নিরাসক্ত। আগাগোড়া ব্যঙ্গ এর তাৎপর্য নির্ভর মর্মমূলে অন্তঃশীল। বর্ণনায় আছে বুকের গভীরে খা মায়ার প্রচ্ছন্ন প্রয়াস। বেগুনের সমস্ত রকম আচার-আচরণের ভার্যচিত্রে আছে সেই তীব্র কশায় ব্যঙ্গ। সংলাপ বিশেষ এক পল্লীর বিশিষ্টতাকে এতটুকু কৃত্রিমতা বিনষ্ট করেনি। লক্ষ্য করার বড় দিক ভাষার বুদ্ধি ও মনন এমনভাবে ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে যা লেখকের বড় বাস্তবজীবন ছবির গল্পের অন্যতম সম্পদ। বিষয়ানুগ গদ্য ব্যবহারে প্রেমেন্দ্র মিত্রের শিল্পী মন সুনন্দিত হবার যোগ্য। রবীন্দ্রনাথের গদ্যের পরিমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করে ও তিনি নিজাব রীতির ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কবিতার মতোই ছোটগল্পের ভাষায় চিত্রকল্পের প্রয়োগ স্বাভাবিক রীতি হয়ে ওঠে। অনুভূতিকে যে কোনো ভাষা চিত্রে যথার্থ ফুটিয়ে তোলাই চিত্রকল্প।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের শৈলীর বিশিষ্ট পদ্ধতি হলো সমগ্র গল্পটিকে একটি সাধারণ প্রন্ধকের নির্মিতিতে ধারণ করা। সেখানে গল্পের কোনো নির্দিষ্ট অংশের ভাষা চিত্রের প্রতি মনোযোগ বা অভিনিবেশ রাখার প্রয়োজন হয় না; সেখানে সমগ্র গল্পটির কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব বা সংলাপটি কোনো একটি নির্দিষ্ট বস্তু বা প্রাণী বা পরিবেশ প্রতীকের মধ্যে সংহত হয়ে দেখা দেয়। "শৃঙ্খল "শুধু কেরানী' 'সাপ' গল্পের ঝড় ও পাখির বাসা এমনকি “সাগর সঙ্গম” গল্পের পরিবেশটি ও এভাবে প্রতীকায়িত হয়ে ওঠে। নদী যেখানে মিশেছে সাগর সেখানেই সংকীর্ণ লোকাচারে বিশ্বাস কূল ছাপিয়ে মিশে গেল উদার মানবতাবোধের সীমাহীন ব্যপ্তিতে।

রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের একজন পরিপূর্ণ গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর গল্পের বিষয়ভাবনা ও শিল্পরীতিতে যে ধরনের বৈচিত্র্য দেখা যায়। তা তাঁর সমকালে খুব কম লেখকেরই লেখায় দেখা যায়। সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকের ক্ষেত্রে গল্পেই

প্রেমেন্দ্রের প্রতিভার স্ফূরণ ঘটেছে সর্বাধিক। 

***আমাদের  অন্যান্য বিষয়ে জানতে ক্লিক করুনঃ-

#কাব্যগ্রন্থ আলোচনা জানতে এখানে ক্লিক করুন 

#বিভিন্ন উপন্যাসের আলোচনা জানতে এখানে ক্লিক করুন 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

7 মন্তব্যসমূহ

  1. বাংলা কথাসাহিত্যের একজন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক,নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের জুড়ি ভাড়।

    উত্তরমুছুন
  2. কৃতজ্ঞতা ❤️ এভাবেই আরও তথ্যবহুল অনেক কিছু জানতে পারবো আশা করি। ধন্যবাদ ।

    উত্তরমুছুন