(শ্রীকৃষ্ণকীর্তন,,
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এর আলোচনা।,
boishnob podaboli,
চন্ডীদাস সমস্যা
মধ্যযুগের কবিতা
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য কে আবিষ্কার করেন)
**রাধা চরিত্র
*কৃষ্ণ চরিত্র
বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
কাব্যের নাম প্রসঙ্গ---
১৩১৬ বঙ্গাব্দে(১৯০৯) বসন্তরন্জন রায় বাকুড়া জেলা থেকে বড়ু চন্ডীদাসের ভনিতায় একখানি পুথি আবিষ্কার করেন। এই পুঁথি ছালায় আকারে বর্তমানে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' নামে প্রচলিত। 'একরাশ পুঁথির সঙ্গে শ্রীষ্ণকীর্তন বন-বিষ্ণুপুরের সন্নিকট কিল্যা নিবাসী শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের অধিকারে ছিল।ইহারা আপনাদিগকে প্রভুপাদ শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র-বংশধর বলিয়া পরিচয়দেন। পুঁথিখানি বসন্তরঞ্জন রায়ের হাতে আসার সাত বছর পর ১৩২৩ বঙ্গাদে কলকাতা বঙ্গীয় সাহিতা পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। পুঁথির প্রথম দুখানি এবং শেষের অন্ততঃ একখানি পাতা পাওয়া যায়নি, মধ্যেও কয়েকখানি পাতা নষ্ট হয়ে অথবা হারিয়ে গেছে। অতএব স্বভাবতই বড়ু চণ্ডীদাসের এ গ্রন্থের নাম কী ছিল জানা যায়নি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' নামটি সম্পাদক প্রদত্ত। নামকরণ সম্পর্কে প্রথম সংস্করণের ভূমিকায়
বসন্তরঞ্জন রায় লেখেন— দীর্ঘকাল যাবৎ চণ্ডীদাস বিরচিত কৃষ্ণকীর্তন-এর অস্তিত্ব মাত্রশুনিয়া আসিতেছিলাম। এতোদিনে তাহার সমাধান হইয়া গেল। আমাদের ধারণা।আলোচ্য পুঁথিই কৃষ্ণকীর্তন এবং সেইহেতু উহার অনুকরণ নাম নির্দেশ করা হইল।"বসন্তবাবুর পূর্বে কৃষ্ণকীর্তনের অস্তিত্ব সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত ছিল তার মূল, কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। ১২৮০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় জগবন্ধু ভদ্র সম্পাদিত 'মহাজনপদাবলী' (১ম খণ্ড)— এই সঙ্কলন গ্রন্থের ভূমিকাতেই তিনি উল্লেখ করেন যে, চণ্ডীদাসের পদাবলী ছাড়াও 'কৃষ্ণকীর্তন' নামে একখানি গ্রন্থও ছিল ২ জগবন্ধু ভদ্রের এই কথায়প্রতিধ্বনি করেন ব্রজসুন্দর সান্যাল ১৩১১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত 'চণ্ডীদাস-রচিত' গ্রন্থে এবং ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য তাঁর চণ্ডিদাস প্রবন্ধে (নব্যভারত, ফাল্গুন ১৩০০)। কিন্তু জগবন্ধু ভদ্রের কথিত কৃষ্ণকীর্তন গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিই যে বসন্তবাবু আবিষ্কার করিয়াছিলেন এমনকোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পক্ষান্তরে ডঃ বিজন বিহারী ভট্টাচার্য এবং ডঃঅসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করতে চেয়েছেন গ্রন্থের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' না হয়ে শ্ৰীকৃষ্ণসন্দর্ভ হওয়া উচিত। তাঁরা বসন্তবাবুর আবিষ্কৃত পুঁথির মধ্যে এক টুকরো
তুলোট কাগজ পেয়েছেন যার মধ্যে লেখা ছিল—
শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্বের ৯৫ পচানব্বই পত্র হইতে একশত দশ পত্র পর্যন্ত একুনে ১৬ ষোল পত্র শ্রীকৃষ্ণপঞ্চাননে শ্রীশ্রীমহারাজার হুজুরকে লইয়া গেলেন পুনশ্চ আনিয়া দিবেন।
সন ১০৮৯) ২৬ আশ্বিন
তাং ২১ অগ্রহায়ণ
শ্ৰীকৃষ্ণপঞ্চানন কৃষ্ণসন্দৰ্ব্ব ।। ১৬ পত্র দাখিল হইল—
চিরকুটটি যদি তথাকথিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথি সম্পর্কিত হয় তবে নিঃসন্দেহে বড়ু চণ্ডীদাসের এ কাব্যের নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নয়, শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ। পুঁথিখানি যখন বনবিষ্ণুপুর রাজ-গ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল, তখন ঐ পুঁথির ১৬ খানি পাতা কোনো এক কৃষ্ণপঞ্চানন ধার নিয়ে প্রায় দু-মাস পর আবার তা ফেরত দেন। পরে পুঁথিটি রাজ-গ্রন্থাগার থেকে শ্রীনিবাস আচার্যের বংশধরদের হাতে পড়লে প্রথম পাতাগুলি, যেখানে গ্রন্থের নাম ছিল, হারিয়ে যায়। বলাই বাহুল্য, উঃ বন্দোপাধ্যায়ের এ সিদ্ধান্ত যুক্তি সম্মত। অন্ততঃ বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যের নাম যে কোনো অবস্থাতেই 'শ্রীকৃষ্ণকৰ্তীন' হ’তে পারেনা তা স্বতঃসিদ্ধ ।
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ নামও আমরা আপাতত গ্রহণের পক্ষপাতী নই। যে চিরকুটখানি পাণ্ডুলিপির মধ্যে পাওয়া গেছে সেখানি বসন্তবাবুর দৃষ্টি এড়াল কি করে—এমন একটি প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কেবল ঐ প্রশ্নের জন্যই আমরা যে শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ নামটি গ্রহণে অনিচ্ছুক তাও সম্পূর্ণ সত্য নয়। বস্তুত নানা বিষয় চিন্তা করে বর্তমানে বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যখানির কোনো নামই আমরা দিলাম না। 'বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য নাম দিয়েই গ্রন্থখানি প্রকাশিত করা গেল।
সম্পাদনা-প্রসঙ্গে-----
বসন্তরঞ্জন রায় সম্পাদিত শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তনে মোট পদসংখ্যা ৪১৮। সূচীপত্রে অবশ্য ৪১৫টি পদের উল্লেখ আছে, এর মধ্যে খণ্ডিত পদও ধরা হয়েছে। এমনকি, মাত্র এক চরণ পাওয়া গেছে এমন পদও সূচীপত্রে উল্লেখিত হয়েছে। সেই হিসেবে, অর্থাৎ একটি মাত্র চরণ পাওয়া গেছে এমন পদও যদি গণনার মধ্যে ধরা যায় তা হলে পদ সংখ্যা প্রকৃতই ৪১৮। আমরা যথাসম্ভব খণ্ডিত পদগুলি বাদ দিয়েছি এবং বংশী ও বিরহ খণ্ডের। সব কটি পদ রেখে তার সঙ্গে অন্যান্য খণ্ড থেকে ৯৮টি বাছাই করা পদ যোগ করে এই সঙ্কলন গ্রন্থটি তৈরি করেছি। এর মোট পদসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০৮। বড়ু চণ্ডীদাসের সমগ্র কাব্যের আহ্বান যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা পদ-সঙ্কলনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম। কাব্যমূল্য রয়েছে, কিংবা কাহিনীর প্রয়োজনে অপরিহার্য— এমন সদগুলি সযত্নে বাছাই করা হয়েছে এই গ্রন্থে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যে বসন্তবাৰু মূল পুঁথির পাঠ কয়েকটি স্থানে গ্রহণ করেননি, তৎস্থলে নিজস্ব পাঠ দিয়েছেন। যেমন, কয়েকটি স্থানে মূল পুঁথিতে আছে 'কাজন’ 'নাঞ্জন' ইত্যাদি। এসব স্থানে বসন্তবাবু কাজল, লাঞ্জন প্রভৃতি পাঠ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমরা এধরনের পাঠ সংশোধনের পক্ষপাতী নই। ল' বহুস্থানেই বাঙালীর উচ্চারণে 'ন' হয়ে যায়, তেমন ক্ষেত্রে পা করে ঐঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে যেমন ছিল তেমনি রেখে দিয়েছি। যমুনার সংখ্যক পদে (আমাদের সম্পাদিত গ্রন্থের মূলপুঁথির 'জলকেঠি' শব্দটিকে বসন্তবাবু ‘জলকেলি’ ক'রে নিয়েছেন। আমাদের মতে এর কোন প্রয়োজন ছিলনা। শব্দের পরিবর্তিত রূপ 'জলকেরি' 'কেলি' শব্দের 'প'-এর 'ব'-এ রূপান্তর লাভের ফলে এখানে 'কেরি' হয়নি। এ ধরনের কতকগুলি শব্দের ক্ষেত্রে আমরা যথার মূল পুঁথিকেই অনুসরণ করেছি।
জনুখণ্ডের ৬ সংখ্যক (আমাদের সম্পাদিত গ্রন্থের) পদের চতুর্থ চরণে ‘উন্নত' স্থলে আমরা পাঠ নিয়েছি 'তনুত'। বসন্তবাবুর গৃহীত ‘উন্নত' পাঠ সম্পর্কে ইদানীং আপত্তি উঠেছে এই ভাবে– “সম্পাদক পাঠ ধরেছেন ‘উন্নত বিশালে'। √ন্ন লিপির দিক থেকে অভিন্ন; সুতরাং 'তন্নত’-তে আপত্তি নেই। কিন্তু ‘উন্নত' অসম্ভব, অন্তত পুঁথিতে 'উ' নেই, 'ত' আছে।”৪
একটি প্রবন্ধে ডঃ বিজন বিহারী ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন, দানখণ্ডের নীল জলদ সম কুত্তলভারা’ (আমাদের সম্পাদিত গ্রন্থের ৭ম সংখ্যক) পদটির তৃতীয় ও চতুর্থ চরণের পাঠ হবে—
শিশত শোভএ তোর কামসিন্দুরা প্রভাত সমএ যেন উরি গেল সুরা।।
আপাততঃ বর্তমান সংস্করণে এ পাঠ আমরা গ্রহণ করিনি। কিছুটা সন্দেহের অবকাশ থাকায় বসন্ত বাবুর গৃহীত পাঠই রেখে দেওয়া গেল।রাধা বিরহ' খণ্ডের ‘হাথে চান্দ মানী বড়ায়ী (৬৫ সংখ্যক) পদটির দ্বাদশ চরণে মূল পুঁথির পাঠ ছিল ‘ডাল'। বসন্ত বাবুও প্রথম দুই সংস্করণে 'ভাল' পাঠই গ্রহণ করেছিলেন। পরে ৩য় সংস্করণে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র পরামর্শ অনুসারে তিনি ‘ডাল’ পাঠ কেটে ‘জল’ পাঠ গ্রহণ করেন। শহীদুল্লাহ সাহেব লিখেছিলেন “লিপিতে জল ও ডাল একরূপ। সুতরাং লিপিকরের ভুল সম্ভব। প্রকৃত পাঠ ‘জল'। লিপিকর মূলের 'যেহ’ স্থানে 'যেন' আধুনিক পাঠ দিয়াছেন। যেন কুহকীর ডাল তখনই পালাইল—এইরূপ উপমা কষ্টসাধ্য।”৬ কিন্তু উপমা কষ্টসাধ্য ব’লেই মূল পাঠের পরিবর্তে কল্পিত পাঠ সর্বত্র সমর্থনযোগ্য নয়। এখানে 'কুহকীর ড্রাল' কথাটা খুবই কষ্টকল্পিত মনে করা হ’ল কেন বুঝা গেলনা। কুহকী অর্থ যাদুকর, ঐন্দ্রজালিক প্রভৃতি। ঐন্দ্রজালিকের তৈরী ডাল অর্থ নিলে কোনো অস্পষ্টতাই থাকেনা। ডঃ বিজনবিহারী ভট্টাচার্য ঠিক এই ভাবেই চরণটির ব্যাখ্যা করেছেন—“ঐন্দ্রজালিকের তৈয়ারী গাছের ডাল যেমন মুহূর্তে অন্তর্হিত হয়। শ্রীকৃষ্ণ তেমনি আকস্মিক অন্তর নীহিত হইলেন। আমরা ড.ভট্টাচার্যের এই ব্যাক্ষার সঙ্গে একমত। তাই মুল পুথুর ডাল পাঠই আমরা গ্রহণ করেছি। ড।শহিদুল্লাহ অবশ্য আর একটি কথা বলেছেন -"টীকায় ঝালিয়া অর্থে " কুহকি লেখা হয়েছে। আমরা প্রত্যেকটি পদের ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে সুবিধার জন্য। মুল পুথিতে এই ক্রমিক সংখ্যা ছিলো না। তবে জন্ম খন্ডের
প্রমাণ দেপদের শেষে চারটি সংঙ্গ্যা দেওয়া
লাদেশের সুতি শুনী পদটির শেষে ছ
তোর মুখে ঠেস পপটির শেষে
মহাবীর পদটির শেষে ৫ সংখ্যাটি আছে, এবং জন্মধ
শেষ সংস্কৃত শ্লোকের পরে ৯ সংখ্যাটি আছে। এই সংখ্যাগুলিকে কোনো
সমালোচপদগুলির ক্রমনির্দেশক সংখ্যা বলে মনে করেছেন। কিন্তু এই কাট
মধ্যে কোথাও পদগুলির ক্রমনির্দেশক কোনো চিহ্ন বা সংখ্যা নেই। আমাদের
কমিক সংখ্যাগুলি মূলপুঁথি বহির্ভূত।
গ্রন্থের কাল নির্নয়--
নাভাবে বড়ু চন্ডীদাস কাব্যের কাল নির্ণয় চেষ্টা করেছেন
পুতির মধ্যে একা নিজে চিরকুট পাওয়া গেছে তাতে সন 1089 পাওয়া গিয়েছে। বঙ্গাব্দ কেননা শকাব্দ হলে পাওয়া যাবে 1867 খ্রিস্টাব্দে এবং বিক্রমাব্দ হলে পাওয়া যাবে 1032 খ্রিস্টাব্দ অসম্ভ। লিপি পরীক্ষা করে বলেন ১385 খ্রিস্টাব্দের পূর্বে কোন এক সময় হচ্ছে এর লিপিকাল। ডক্টর নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে চৌদ্দশ 66 খ্রিস্টাব্দে পূর্বে কোন এক সময়ে এটি কোন লিখিত হয়েছিল। বঙ খ্রিস্টাব্দে তাহলে বোঝা যাচ্ছে 682 খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপুরের রাজা ছিল তার আগেই কোনো এক সময়ে এটি লিখিত হয়েছিল এই শোন নিঃসন্দেহে বিষ্ণুপুরের রাজগ্রন্থাগারে। পূর্বে কোনো এক সময়ে এটি অনুলিখিত হয়েছিল ১৬ রাধাগোবিন্দ বসাক অনুমান করেন এর লিপিকাদ হচ্ছে ১৪৫০-১৫০০ খ্র মধ্যে (১৭ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রাধাগোবিন্দ বসাকের এ মত সমর্থন করেন। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যা নিধি বললেন, এর লিপিকাল ১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়। সবচেয়ে কড়া মন্তব্য করলেন সুকুমার সেন, তিনি জানালেন "শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের লিপিকাল অষ্টাদশ শতাঙ্গের শেষার্ধ।”
উপরের মন্তব্য কয়টির মধ্যে সুকুমার সেনের মতের সংঙ্গে চিরকুটের তারিখ মেলে না। সুকুমার সেনের মত মানতে হ'লে চিরকুটখানি জাল ব'লে উপেক্ষা করতে হয় ৷ কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ এটিকে জাল প্রমাণ করতে পারেননি। তাছাড়া অধিকাংশ পণ্ডিতই যেখানে পুঁথির লিপিকাল সম্পর্কে ষোড়শ শতাব্দের এদিকে আসেননি তখন আমাদের মনে হয় চিরকুটখানি অবিশ্বাস ক'রে পুঁথির লিপিকাল অষ্টাদশ শতাব্দের দিকে টেনে আনা যক্তিযুক্ত হবেনা। সুকুমার সেনের মতটি, চিরকুট সত্য হ'লে অর্থহীন হয়ে।
সুকুমার সেন এর লিপিকে (অর্বাচীন বললেও এর ভাষার প্রাচীনত্ব কিন্তু স্বীকার করেছেন। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মধ্যকালীন বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীন রূপটি যতটা অবিকৃত আছে এতটা আর কোন পুরানো গ্রন্থে পাইনা। চর্যাপদাবলীর পরেই বাঙ্গালা ভাষার পুরানো নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বহুল লভ্য। একথা মোটামুটি ঠিক।" ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথির ভাষাকে পঞ্চদশ শতাব্দের পূর্ববর্তী বলে মত। প্রকাশ করেছেন। ডঃ চট্টোপাধ্যায়ের মতের প্রতিবাদ যে হয়নি এমন নয়, কিন্তু সে প্রতিবাদ একটুও ধোপে টেকেনি এবং এ পর্যন্ত ডঃ চট্টোপাধ্যায়ের মতই সুপ্রতিষ্ঠিত প্রচলিত মত ।
গ্রন্থের কাল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রসের বিচারও খুব অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। এর মধ্যে যে আদি রসের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় সেটা সকল পণ্ডিতের মতেই চৈতন্যদেব-প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্ম এবং তজ্জাত আধ্যাত্মিক রুচির একান্ত বিরোধী। অতএব গ্রন্থখানিকে চৈতন্যপূর্বযুগের না ব'লে উপায় থাকে না। অবশ্য চৈতন্যদেবের দুই শতাব্দ পর।
অষ্টা দেশ শতাব্দী দিকে আধ্যাত্মিক রুচির অবনতি লক্ষ্য করা যায় কিন্তু কেউ এমনকি সুকুমার সেন ও গ্রন্থখানি কে অত পরবর্তীকালে বলে কল্পনা করতে পারেননি। অতঃপর দেখতে হবে কোনো প্রাচীনতম গ্রন্থ চন্ডীদাসের এ কাব্যের উল্লেখ পাওয়া যায় কিনা চৈতন্যচরিতামৃত একাধিক স্থানে চৈতন্যদেব কর্তিক চন্ডীদাসের পদ পাওয়া যায়।
১.বিদ্যাপতি ও জয়দেব চন্ডীদাসের গী,
আস্বাদয়ে রামানন্দ সরূপ সহিত।
২" ".চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি রায়ের নাটক গীতি কর্ণামৃত শ্রী গীতা গোবিন্দ.,,
স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রি দিনে গায়ে শুনে পরম আনন্দ। ""
স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, চৈতন্যদেবের পূর্ববর্তীকালের কবি হচ্ছেন চণ্ডীদাস যার কবিখ্যাতি জয়দেব-বিদ্যাপতির সঙ্গে একত্রে কীর্তিতে হ'ত। হয়ত প্রশ্ন উঠবে, এই চন্দ্রদাসই- যে বড়ু চণ্ডীদাস তার প্রমাণ কি? সাক্ষাৎ প্রমাণ কিছু নেই তা ঠিক, তবে বড়ু চণ্ডীদাস ছাড়া এমন কোনো চণ্ডীদাস কি পাওয়া যায় যাকে নিঃসংশয়ে চৈতন্যপূর্ব যুগে প্রতিষ্ঠিত করা যায়? দ্বিজ চণ্ডীদাস স্বতন্ত্র কবি কি না সেই বিষয়েই সংশয় রয়ে গেছে। আর দীন চণ্ডীদাস যে চৈতন্য পরবর্তীকালের কবি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই তো এ পর্যন্ত জাগেনি। অতএব অন্য প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত বড়ু চণ্ডীদাসকেই আমরা চৈতন্যচরিতামৃতে উল্লেখিত কবি ব'লে মনে করব ।
অবশ্য একটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের দিতে হবে। চৈতন্যদেবের মতো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি কি করে বড়ু চণ্ডীদাসের অশ্লীল রুচির কাব্য উপভোগ করতে পারেন। অশ্লীল, কুরুচি প্রভৃতি শব্দ এক এক যুগে এক এক প্রকার অর্থ বহন করে। এক যুগের অশ্লীলতা যে অন্য যুগের স্বাভাবিক ব্যাপার-এ কথা বুঝার জন্য কোনো প্রমাণ উত্থাপনের প্রয়োজন করে না। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যের কোনো কোনো অংশ আজকের দৃষ্টিতে একটু অশ্লীল মনে হবে এ কথা সত্য। কিন্তু সত্যকার কাব্য-রসিকের কাছে যে পরম প্রিয় হবে তাও সত্য। ধর্মের দৃষ্টিতে চৈতন্যদেব অবতার হ’তে পারেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁকে একজন পরম কাব্যরসিক ব্যক্তি বলতে আপত্তি কোথায়? বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য।
বা তথাপি তত্র মুরুব্যাপারদীলা বিশৌ বেরাতোধসি বেডসীতরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে।।।
বঙ্গানুবাদ – যে আমার কুমারীত্ব হরণ করেছিল, সেই (আজ) আমার বর সেই চৈত্র-রাত্রি, সেই বিকশিত মালতীর সুরভি, সেই নদ-কাননের মদ মদ বায়ু, আমিও সে-ই আছি; তথাপি (প্রাক্-বিবাহাবস্থায়) সেই রেবা নদীতটের বেতসী- তলে যে সমস্ত সুরত্যাপার লীলা-বিধি-তার জন্যই আমার চিত্র উৎকণ্ঠিত হচ্ছে।
স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, এটি একজন অসতী নারীর উক্তি। 'কবীন্দ্র বচন-সমুচ্চয়ে এটি অসতীব্রজ্যা' (৫০৮ সংখ্যক) এবং 'সমুক্তিবর্ণামৃতে এটি (অসতী) (৩ নং) পর্যায়ে অসতী-প্রমের অন্যান্য পদের পাশে স্থান পেয়েছে। ২৩ এমন একটি অসতী প্রেমের পদেও আধ্যাত্মিকতা আরোপ করে নিতে কোনোই অসুবিধা হয়নি চৈতন্যদেবের। সুতরাং তাঁর পক্ষে বড়ু চণ্ডীদাসের পদেও আধ্যাত্মিকতা আরোপ করে নিতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয় ।
চৈতন্য-জীবনীগ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্য গ্রন্থেও চণ্ডীদাসের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। ১৫৫৪-৫৫ খ্রীষ্টাব্দে সনাতন গোস্বামী ভাগবতের একটি টীকা রচনা করেন এই টীকা গ্রন্থের নাম বৈষ্ণবতোষণী” সেখানে কাব্য-কলা' শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। সনাতন গোস্বামী লিখেছেন–“কাব্যশব্দেন পরমবৈচিত্রী: তাসাংসূচিতাশ্চ গীতগোবিন্দাদি-প্রসিদ্ধাস্তথা শ্রীচণ্ডীদাসন্দাদি-দর্শিত দানখণ্ড নৌকাখত্তাদি প্রকারাশ্চ জ্ঞেয়াঃ।”২৪ চণ্ডীদাসের দানখণ্ড ও নৌকাখণ্ডের উল্লেখ করা হয়েছে এখানে। এই চণ্ডীদাস বড়ু চণ্ডীদাস, কেননা দান খণ্ড ও নৌকাখণ্ডের আদি কবি হিসেবে অন্য কোনো চীদাসের নাম এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন, সংস্কৃত-কাব্যের সংস্কৃত টীকায় বাংলা কাব্যের উদাহরণ টিকাকার দিতে পারেননা, অতএব হয়ত অন্য কোনো চণ্ডীদাস সংস্কৃতে ঐ দানলীলা ও নৌকালীলা অবলম্বনে কোনো গ্রন্থ রচনা ক'রে থাকবেন। এ প্রসঙ্গের জবাবে অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় অতি চমৎকারভাবেই বলেছেন—“অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না! প্রত্যক্ষতঃ দেখা যাইতেছে যে, বড়ু চণ্ডীদাস-রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের দুইটি প্রসিদ্ধ খুণ্ডের নাম—দানখণ্ড ও নৌকাখণ্ড; সুতরাং প্রত্যক্ষ ত্যাগ করিয়া সম্পূর্ণ অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া কল্পিত চণ্ডীদাসের অনুমান-সাপেক্ষ সংস্কৃতকাব্য লইয়া আলোচনা চালাইবার পক্ষে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই । যতদিন পর্যন্ত তেমন কোন প্রমাণ না পাওয়া যাইতেছে, ততদিন সনাতনের শ্রীচণ্ডীদাস ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ু চণ্ডীদাসকে এক ও অভিন্ন বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে। তাহলে এ পর্যন্ত আলোচনায় যা পাওয়া যাচ্ছে তা হল -
১.পথের মধ্যে প্রাপ্ত চিরকূট অনুসারে পুথুখানি ১682 খ্রিস্টাব্দে বন বিষ্ণুপুরের গ্রন্থাগারে ছিল।
২.লিপি পরীক্ষায় বিভিন্ন পন্ডিততের মত পার্থক্য ১৩৮৫ খ্রী থেকে১৫৫০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
(৩) পুঁথির মধ্যে প্রাপ্ত চিত্রকুট অনুসারে পুথিখানি (১৯৮২) ব্রষ্টাব্দে বনবিষ্ণুপুরের ] (4) বিভিন্ন পণ্ডিতের মত পার্থক্য ১৩৮৫ থেকে ১৫৫০ । (সুকুমার সেনের মত এখানে গ্রহণ করা হয়নি। গ্রহণ করার
পথে বাধা তোমায় তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে)। (গ) কাব্যের ভাষা পণ্ডিতের মতে মোটামুটিভাবে পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্ববর্তী।
(ঘ) রসের বিস্তারে চৈতনা পূর্ববর্তী
(৪) চৈতন্য চরিতামৃত থেকে জানা যায় চৈতন্যদেব তাঁর পূর্ববর্তী যুগের
সে গীত আাদন করতেন।
(5) ১৫৫৪-৫৫ খ্রীষ্টাব্দে রচিত বৈষ্ণবতোষণী' টীকা অনুসারে বড়ু চণ্ডীদাস
চৈতন্য-পূর্ব যুগের কবি ।
দেখা যাচ্ছে, একটি স্থানে সব মতেরই মিল রয়েছে যে, চণ্ডীদাস চৈতন্য-পূর্ব যুগের কবি। চৈতন্যদেবের জন্ম ১৪৮৬ খ্রীঃ তার পূর্বেই বড়ু চণ্ডীদাসের কবিখ্যাতি সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জনশ্রুতি অনুসারে চণ্ডীদাসের জন্ম, পূর্বেই লক্ষ্য করেছি ১৩২৫ খ্রীঃ থেকে ১৪১৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে। আমাদের মনে হয়, জনশ্রুতিমূলক এই সম্ভাব্য জন্যুকাল একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। বড়ু চণ্ডীদাসের জন্ম চতুর্দশ শতাব্দের মাঝামাঝি কোনো সময়ে, এবং তাঁর সুবিখ্যাত সুবৃহৎ কাব্য তিনি রচনা করেছিলেন ঐ শতাব্দেরই শেষ দিকে এ অনুমান আমাদের মনে হয় খুব অযৌক্তিক নয় । লিপি ও ভাষাবিচার যাঁরা করেছেন তাঁদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের অনুমান সঙ্গতিপূর্ণ। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবও এ গ্রন্থখানি ১৩৪০-১৪৪০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে রচিত ব'লে মনে করেন।
১৩৪২ খ্রীষ্টাব্দে সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের অধীনে বাংলা দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ঐ সময় সকল দিক থেকেই বাঙালীর সামাজিক জীবনে যে প্রবল প্রাণের সাড়া লাগে কোনো মহৎ প্রতিভার আবির্ভাবের পক্ষে তা সম্পূর্ণ অনুকূল ছিল। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই সময় আপন মাতৃভাষাতে সাহিত্য চর্চায় ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করেন। রাজনৈতিক মুক্তি মানসমুক্তিকে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশের প্রাচীন হিন্দু রাজারা মাতৃভাষাতে সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ দেখাননি, রাজসভা কবিদের তাঁরা সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে বলতেন। ২৬ কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্বাধীন মুসলিম নরপতিগণের প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও দেশপ্রেম ছিল অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ যে মুক্ত উদার অসাম্প্রদায়িক আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছিল সেই আবহাওয়াতে বাংলা সাহিত্যের চর্চা গভীর ও ব্যাপক হয় । আমাদের ধারণা; সেই উদার আবহাওয়াতেই বড়ু চণ্ডীদাসের জন্ম হয়েছিল।
চণ্ডীদাস সমস্যা----
চণ্ডীদাসের কবিখ্যাতি খুবই প্রাচীন বৈষ্ণবতোষণী' টীকায় এবং 'চৈতন্যচরিতামৃতে' চণ্ডীদাসের উল্লেখ পাই। চৈতন্যদেব চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদন করতেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, “শ্রীচৈতন্যদেবের তিরোধানের প্রায় দেড় শত বৎসর পর্যন্ত, খ্রীষ্টিয় সপ্তদশ শতকের শেষ পাদ পর্যন্ত যতগুলি পদ সংগ্রহ সঙ্কলিত হইয়াছিল, সেগুলির একটিতেও চণ্ডীদাসের একটিও পদ ধরা হয় নাই; এমনকি অষ্টাদশ শতকের 'সঙ্কীর্তনামৃত' নামক একখানি পদসংগ্রহ-গ্রন্থে চণ্ডীদাসের কোনও পদ নাই। কিন্তু অষ্টাদশ শতক হইতে যত এদিকে আসা যায় অর্বাচীন পদ-সংগ্রহ গ্রন্থে চণ্ডীদাসের ভণিতাযুক্ত পদ মিলিতেছে, ও দেখা যায় ক্রমশঃ এইরূপ পদের সংখ্যা বাড়িতেছে (২৭
অর্থাৎ চৈতন্যদেব কর্তৃক চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদিত হওয়া সত্বেও চণ্ডীদাস বহুদিন পর্যন্ত বৈষ্ণবসমাজে অনাদৃত ছিলেন। এবং বৈষ্ণব সমাজেই শুধু নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী সাহিত্য পাঠকের কাছেও চণ্ডীদাস খুব বহুল পরিচিত কবি ছিলেন না। ঐ শতাব্দের শেষ দিকে শিক্ষিত বাঙালী পাঠকের কাছে চণ্ডীদাস প্রথম পরিচিত হতে থাকেন। তারপর ক্রমেই চণ্ডীদাস সম্পর্কে এতো বিচ্ছিন্ন পদ, পুঁথি ও তথ্যাদি পাওয়া যেতে থাকে যে, বর্তমানে চণ্ডীদাস সমস্যা এক অসাধারণ জটিল রূপ ধারণ করেছে।
চণ্ডীদাসের নামের আগে বড়ু, দ্বিজ, দীন, আদি এই কটি বিশেষণ যুক্ত হ'তে দেখা যায়। এর মধ্যে 'আদি চণ্ডীদাস' ভণিতায় পাওয়া যায় মাত্র দুটি পদ, অতএব কোনো যুক্তির অবতারণা না করেও 'আদি চণ্ডীদাস' নামে যে পৃথক কোনো কবি ছিলেন না সে কথা স্পষ্ট বুঝা যায়। আদি চণ্ডীদাসের একটি পদ আবার 'দ্বিজ চণ্ডীদাস' ভণিতায়ও পাওয়া যায়। ২৮ বস্তুতঃ বড়ু, দ্বিজ, দীন- এই তিনটি বিশেষণ নিয়েই যতো গণ্ডগোল। তাছাড়া, কোনো বিশেষণ যুক্ত নেই, কেবলি 'চণ্ডীদাস' ভণিতায় যে সব বিচ্ছিন্ন পদ পাওয়া যায় সেগুলিও যে একজন চণ্ডীদাসের রচনা তাও নিঃসংশয়ে বলা যায় না।
বিচ্ছিন্ন পদ ছাড়া রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক পালাগানের যে পুঁথিগুলি পাওয়া গেছে তা হচ্ছে- (১) চণ্ডীদাসের চতুর্দশ পদাবলী – নগেন্দ্র নাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব ১৪টি পদের এই পুঁথি বিষ্ণুপুর অঞ্চল থেকে আবিষ্কার করেন। এতে সহজিয়া তত্ত্বের ব্যাখ্যা এবং রামী-চণ্ডীদাস ঘটিত কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে ।২৯
(২) রাসলীলা—নীলরতন মুখোপাধ্যায় ১৩০৫ বঙ্গাব্দের দিকে চণ্ডীদাসের রাসলীলা বিষয়ক ৭১টি পদের একটি পুঁথি পান। পদগুলির ভাব ভাষা খুব দুর্বল ॥
(৩) রাধার কলঙ্ক ডঞ্জন। এটিও চণ্ডীদাসের ভণিতায় প্রাপ্ত একটি পালাগানের পুথি। আবিষ্কার করেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ।
(8)টর আবিষ্কারক ব্যোমকেশ মুস্তকী। মোট পদ সংখ্যা ৬৩।
তার মধ্যে ১৪টি পনে পাওয়া যায় 'দীন চীদ'। 'বড়ু' বা '' যুক্ত ভণিতা একটিও
(৫) শ্রীকৃষ্ণকীর্তন - বড়ু চণ্ডীদাসের ভণিতায় প্রাপ্ত। (৬) মনীন্দ্রমোহন বসু কর্তৃক আবিষ্কৃত দীন চণ্ডীদাসের ভণিতা-যুক্ত দুটি
(৭) ১২০২টি পদ সম্বলিত দীন চণ্ডীদাসের ভণিতাযুক্ত পালাগানের পুঁথি ৷৩৪ এই পুঁথিগুলির মধ্যে ৪, ৬ ও ৭ নম্বরে উল্লেখিত পুঁথিগুলি যে একই কবির, অর্থাৎ দীন চণ্ডীদাসের, সে কথা বুঝতে কোনো অসুবিধার কারণ নেই। ভাব, ভাষা ও রচনা রীতির বিচারে ২ ও ৩ নম্বরে উল্লেখিত পুঁথি দুখানিও দীন চণ্ডীদাসের বলেই মনে হয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' নামে প্রকাশিত গ্রন্থটি বড়ু চণ্ডীদাসের ভণিতাযুক্ত। বড়ু চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস যে এক ব্যক্তি হ'তে পারেন না সে সম্পর্কে অধিকাংশ পণ্ডিতই একমত। তাছাড়াও প্রশ্ন হচ্ছে, সহজিয়া তত্ত্ব-মূলক ১৪টি পদের (এ ধরনের আরো বিচ্ছিন্ন পদ চট্টদাসের ভণিতায় পাওয়া যাচ্ছে) পুঁথিখানি কোন চণ্ডীদাসের?
তাহলে চণ্ডীদাস সমস্যার রূপটি দাঁড়াচ্ছে মোটামুটি এ রকম ঃ
চনডীদাস----
১.রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক পালাগানের লেখক
২.রাধাকৃষ্ণ বিষয়বিচ্ছিন্ন পদের লেখক। দ্বিজ, দীন, বড়ু, আদি প্রভৃতি নানা বিশেষণ-যুক্ত চণ্ডীদাসের ভণিতায় বিচ্ছিন্ন পদাবলী পাওয়া যাচ্ছে। এই পদাবলী দু'ভাগে বিভক্ত।
1.সাধারণ ভাবমূলক
2.সহজিয়া ভাবমূলক
প্রশ্ন এই, সবটা মিলিয়ে কি চণ্ডীদাস একজন? না একাধিক? স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, একাধিক হ'লে সংখ্যাটা দুই, তিন অথবা চার পর্যন্ত যেতে পারে । প্রথমেই আমাদের বক্তব্য, বড়ু চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস দুজন স্বতন্ত্র কবি ।
(১) ভাষা বিচারে দেখা গেছে, বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যের ভাষায় চতুর্দশ শতাব্দের বহু রুপ রয়েছে।
২.বড়ুচব্ডীদাস পলরথম শ্রেণির কবি আর দীন চন্ভাডীদাস তৃতীয় শ্রেণির কবি।দীন চণ্ডীদাস এর পদাবলী সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দোপাদ্ধায় এর অভিমত “পৌরাণিক ঘটনার রসহীন বর্ণনা ভাষার শ্লথ-শিথিল , কে রে পাদপুরণের জন্য অহেতুক বাক্যাবলীর বারংবার প্রয়োগ, অসংযত পরিমিতিহীন বহুভাষিতা, একই বিষয়ে ক্লান্তিকর পৌনঃপুনিক পুনরাবৃত্তি, ভাব-সংহতি ও রস-গাঢ়তার অভাব- এ সমস্ত দোষই তাঁহার রচনায় সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি যায়। এই শিশু সুলভ কাকলীর কবি যে মহাকবি চন্ডীদাসের সরল, মর্মস্পর্শী, ভাবঘন পদগুলির রচয়িতা হইতে পারেন ইহা যেন আমাদের ধারণারও অগম্য। "৩৫
(৩) বিষয়বস্তু পরিকল্পনায় দুজন কবির মধ্যে পার্থক্য প্রচুর বড়ু চণ্ডীদাসে রাধা ও চন্দ্রাবলী অভিন্ন, রাধা সেখানে সাগর গোয়ালার কন্যা, মায়ে নাম পদুমা৷ সখীদের সঙ্গে সে দধি-দুধের পসরা সাজিয়ে নিয়ে বেচতে যায়। কিন্তু দী চণ্ডীদাসে রাধা ও চন্দ্রাবলী পৃথক; চন্দ্রাবলী রাধার সখী, প্রতিনায়িকা! এখানে রা ‘বৃষভাণু’ বা ‘বৃদ্ভানু’ রাজার কন্যা, মায়ের নাম কলাবতী বা কীর্তিদা
বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে কৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল কংসাসুর বধের উদ্দেশে এখানে পুরাণের অনুসরণ করেছেন কবি। পুরাণমতে অসুরধ্বংস করবার জন্যই নার কৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু দীন চণ্ডীদাস বলেছেন—
বৃন্দাবন রস
রস আস্বাদিতে
জন্মিল গোলক হরি ।
বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে মানবীয় ভাবের সঙ্গে ঐশ্বর্যভাবে প্রাধান্য আছে; চণ্ডীদাস মুখ্যতঃ মাধুর্যময় ব্রজলীলার কবি; সেখানে মানবীয় ভাবটি উপেক্ষিত।
(৪) ‘দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর ভেবে যে মাধুর্য চতুর্বিধ এই তত্ত্ব বৈষ্ণবগণ কর্তৃক সর্বপ্রথম বঙ্গদেশে প্রচারিত হইয়াছিল । ....... চৈতন্য-প প্রেমমূলক মাধুর্যভাবের উপাসনার ধারণা প্রবর্তিত হইয়াছে। .... দীন চণ্ডীদাস বাৎল। প্রকরণে নন্দবিদায় প্রভৃতি পালাতে বাৎসল্যভাব, ‘রাখালবিলাপে” সখ্যভাব।
দাসেই প্রত্যক্ষ করা যায়, বহু চা পূর্ববর্তী কবি বলে তাঁর কাব্যে এ সব প্রভাব পড়েনি।
(2) দাসের পার্থক্য আরো স্পষ্ট। বড়ু চণ্ডীদাসের দীন চণ্ডীদামে নেই। (৬) রাধা কৃষ্ণের কারো কোনো সখাসখীর নাম নেই। কিন্তু চৈতন্য পরবর্তীকালের ব'লে দীন চণ্ডীদাসের কাব্যে তাদের অনেক নাম পাওয়া।
(৭) বড়ু চণ্ডীদাস বাসলীদেবীর উপাসক ছিলেন, কিন্তু দীন চণ্ডীদাসের কাব্যে। কোখাও বাসলীর উল্লেখ নেই। (৮) সবশেষে বলা যায়, আনুমানিক কাল নির্ণয় করতে গেলে দেখা যাবে, বড়ু চট্রীদাস চৈতন্য পূর্বে কালের এবং দীন চণ্ডীদাস চৈতন্য পরবর্তীকালের কবি।
অতএব বড়ু চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস যে দুজন পৃথক কবি সে বিষয়ে সন্দেহের
অবকাশ খুব কম। যাঁরা চণ্ডীদাস একজন ছিলেন মনে করেন তাঁদের মধ্যে, যে কোনো
সতর্ক পাঠকই লক্ষ্য করবেন, যুক্তি অপেক্ষা হৃদয়াবেগ বেশি। বড়ু চণ্ডীদাস ও দীন
চণ্ডীদাসকে একজন কবি মনে করার পেছনে সত্যকার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন ।
উন্নত আধ্যাত্মিক ভাবমণ্ডিত ও সুন্দর রসোত্তীর্ণ কতকগুলি বিচ্ছিন্ন পদ বড়ু, দ্বিজ প্রভৃতি নানা ভণিতায় পাওয়া যায়—সবচেয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে এই পদ কয়টি নিয়ে৷ মনীন্দ্র মোহন বসু মনে করেছিলেন পদগুলি দীন চণ্ডীদাসের, শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় তাঁকে সমর্থন করেন। কিন্তু অনেক সমালোচকই অত্যন্ত সার্থকভাবেই এ কথার প্রতিবাদ করেছেন। কেননা ঐ পদাবলীর চণ্ডীদাস একজন প্রথম শ্রেণীর প্রতিভাসম্পন্ন কবি। কিন্তু দীন চণ্ডীদাস সত্যই স্বল্পক্ষমতাসম্পন্ন একজন তৃতীয় শ্রেণীর কবি। এ সম্পর্কে সতীশচন্দ্র রায়ের মন্তব্য আমরা সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করি—
“আমাদিগের বিবেচনায় কৃষ্ণকীর্তনের প্রবল শক্তিশালী কিন্তু উন্নত আধ্যাত্মিকতার লেশশূন্য কবি চণ্ডীদাস বরং কোন অচিন্তনীয় সাধনার বলে পদাবলীর শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক কবি চণ্ডীদাসে পরিণত হইতে পারেন, কিন্তু দীন চণ্ডীদাসের পক্ষে উহা সম্পূর্ণ অসম্ভব বটে।”৩৭ হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বৈষ্ণব সাহিত্যে একজন সুদক্ষ পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনিও বিচ্ছিন্ন পদাবলীর কবি চণ্ডিদাস ও দীন চণ্ডীদাসকে এক ভাবতে পারেননি। বরং নানা প্রমাণ সহযোগে ঐ সব বিচ্ছিন্ন পদাবলীর চণ্ডীদাস যে বড়ু চণ্ডীদাস হলেও হ’তে পারেন,
কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন মুপ্যাে এই চেষ্টা অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সতীশ চন্দ্র রায় অবশ্য বলেছেন "আমরা চণ্ডীদাসের প্রচলিত পদাবলীর ভাষা, ভাব ও আখ্যানবস্তুর সহিত কোনরূপেই বড়ু চণ্ডীদাসের মিঃস কৃষ্ণকীর্তনের সামঞ্জস্য সাধন করিতে সমর্থ হই নাই সামঞ্জস্য সাধন করা দুরূহ বটে, তবে অসম্ভব নয়। সব বাদ দিলেও একটি কথা মনে রাখা যায় যে, ঐ পদাবলী এবং কৃষ্ণকীর্তন-উভয়ই উন্নত শ্রেণীর কবি প্রতিভার বলেই শুধু রচনা করা সম্ভব। এবং উভয়ই, অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, চৈতন্য পূর্ব যুগের সৃষ্টি। এখন, এ কথা যদি মানতে হয় যে, বিচ্ছিন্ন পদাবলীর কবি চণ্ডীদাস এবং বড়ু চণ্ডীদাস দুজন পৃথক কবি তাহ'লে এই সিদ্ধান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, চৈতন্যপূর্ব যুগে দুজন মহাকবি চণ্ডীদাসের আবির্ভাব হয়েছিল। অত্যন্ত কাছাকাছি সময়ে একই নামে দুজন মহাকবির আবির্ভাব, অসম্ভব ঘটনা না হ'লেও, অত্যন্ত বেশি বিরল, প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি, একটা ঘটনা বটে। শহীদুল্লাহ্ সাহেবের এ মন্তব্য ঠিক যে, বড়ু চণ্ডীদাস যে বিচ্ছিন্ন পদাবলী রচনা করেছিলেন তার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি ॥৪০ সুস্পষ্ট প্রমাণ খুঁজতে গেলে এ ক্ষেত্রে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌছানো সত্যই অসম্ভব। তবে, চণ্ডীদাসের নামে প্রচলিত উন্নত শ্রেণীর মাত্র ৪০/৫০টি পদের জন্য পৃথক কোনো কবির অস্তিত্ব যদি স্বীকার না ক'রে তাঁকে বড়ু বা দীন যে- কোনো একজনের সঙ্গে একীভূত করে দেওয়াটা সঙ্গত বিবেচিত হয় তাহলে আমরা বড়ুচণ্ডীদাসের পক্ষপাতী অর্থাৎ বড়ু চণ্ডীদাসই জীবনের পরবর্তী অংশে সাধনা বলে 'দ্বিজ' হয়েছিলেন এবং বৃদ্ধ বয়সে আখ্যায়িকা কাব্য লেখার পরিশ্রম সইতে না পেরে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পদ রচনা করেছিলেন। সাধারণভাবে, মধ্যযুগের কবি-মানসে কোনো পরিবর্তন সহজলভ্য ব্যাপার নয়, কিন্তু চণ্ডীদাসের মতো প্রতিভাবান কোনো কবির কাছে আমরা তা নিশ্চয়ই আশা করতে পারি।
এবার রাগাত্মিকা পদাবলীর সহজিয়া চণ্ডীদাসের প্রসঙ্গে আসা যাক। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, নগেন্দ্রনাথ বসু ১৪টি রাগাত্মিকা পদাবলীর একটি পুঁথি পেয়েছেন। এ ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে অনেক রাগাত্মিকা পদের ভণিতায় চণ্ডীদাসের নাম পাওয়া যায়, এ সব পদে রামীঘটিত কাহিনীর উল্লেখও রয়েছে। তাছাড়াও, চণ্ডীদাস ও রামীকে জড়িয়ে প্রচুর উপকাথাও কিংবদন্তি এবং নানা গল্প বীরভূম বাঁকুড়া অঞ্চলে এবং সহজিয়াদের বিভিন্ন পুঁথি-পত্রে ছড়িয়ে আছে। এই সহজিয়া চণ্ডীদাস কি স্বতন্ত্র কবি? না, তিনি বড়ু বা দীন বা দ্বিজ কোনো একজনের পরিবর্তিত রূপ মাত্র? ঐ কবিদের একজন কেউ কি পরবর্তী জীবনে সহজিয়াদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে রাগাত্মিকা পদগুলি রচনা করেছিলেন? সঠিক কিছুই বলা যায় না। কেবল এটুকু সিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সহজিয়া চণ্ডীদাস কেউ থাকলে অবশ্যই তিনি চৈতন্য-পরবর্তী যুগের কবি। কারণ বৈষ্ণব সহজিয়া মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চৈতন্য-পরবর্তী যুগে। 'পূর্ব-চৈতন্যযুগের চণ্ডীদাস সহজিয়া পদ লিখিতে পারিতেন না, কারণ, সে যুগে পীরিতি-সাধনার উৎপত্তি হয় নাই ।”৪১ মনীন্দ্ৰ মোহন বসুও লিখেছেন— “রামী যদি কাহারও থাকিয়া থাকে তবে তাহা এই দীন বা দ্বিজ চণ্ডীদাসের, বড়ু চণ্ডীদাসের নহে।”৪২ অনেকে মনে করেন, যেমন
- পালা গানের পুথির মধ্যে কোথা
সঙ্গে রামীকে বাড়িত করা ঠি
উপনি পরামী, সত্য হ'লে, বিশেষ
হয়েছিলেন, অথবা সহজিয়া
রেছিলেন সুইে
এটি রামীকে লাভ করার পূর্বের কোনো রচনায় বাদীর
থাকতে পারে। সুবৃহৎ পালাগানের পুঁথিটি তাঁর জীবনে রামীর আবির্ভাবের।
এতোই সর? মনীন্দ্র মোহন বসু দেখিয়েছেন' 'দীন চণ্ডীদাসের
গুলি পদে সহজিয়া ধর্ম-তত্ত্বের বিবৃতি রহিয়াছে। "৪৩ অতএব
সয়াসকে যদি কারো সঙ্গে মেলানো সম্ভব হয় তবে তিনি দীন চণ্ডীদাসএ কথাও একেবারে উপেক্ষা করবার মতো নয় যে, সহজিয়া চণ্ডীদাস মূলতঃই
সহজিয়া মতকে সমাজে শ্রদ্ধেয় ক'রে তুলবার জন্য সহজিয়ারা তাদের
ধর্মমত ও আচার-অনুষ্ঠানমূলক পদ রচনা ক'রে চণ্ডীদাস, রূপ গোস্বামী, স্বরূপ দামোদর,
কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রভৃতি মহাজনদের নামে চালিয়ে দিতেন। বিমানবিহারী মজুমদারঠিক এই যুক্তিতেই সহজিয়া চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। অসিতকুমারবন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন “১৭শ ১৮শ শতাব্দীর অনেক বৈষ্ণব সহজিয়া কবি
চণ্ডীদাসের নামটি নিজ নামের সঙ্গে যোগ করিতেন। ৪৪ কথাটি সত্য । এইভাবেই
বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সহজিয়া কবি তাঁদের সম্প্রদায়গত সুবিধা অনুযায়ী পদ রচনা ক'রে।
চজীদাসের নামে চালাতে চালাতে আজ স্বতন্ত্র একজন চন্ডীদাসকে যেন অবশ্যম্ভাবী ক'রে
তুলেছেন। ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার চমৎকার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা
লিপিবদ্ধ করেছেন—“চণ্ডীদাস নামটি যে সহজিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে গুরু পরম্পরাক্রমেচলিয়া আসিতেছে, তাহা আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। পঞ্চাশ বছর পূর্বে, আমরা যখন
স্কুলের তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি, তখন নবদ্বীপের বনচারির ডাঙ্গায় এক চণ্ডীদাস ও
রজকিনী দেখিতে যাইতাম। তাঁহারা পাশাপাশি যোগাসনে বসিয়া থাকিতেন। আর
তাঁহাদের সামনে একটি কুকুরও স্থির হইয়া থাকিত। এই চণ্ডীদাস পদ রচনাও
করিতেন। আমরা চারি আনা দিয়া তাঁহার পদের বইও কিনিয়াছিলাম।”৪৫ ডঃমজুমদারের উক্তি সত্য হ'লে (এবং সত্য ব’লেই আমরা মনে করি) সহজিয়াদের মধ্যেচণ্ডীদাস কোনো বিশেষ একজন ব্যক্তি নয়, উপাধি। এবং অনেকেই ঐ উপাধি লাভক'রে চণ্ডীদাস হতেন ও পদ রচনা করতেন। কিন্তু ডঃ মজুমদারের এই সিদ্ধান্ত, আমাদের ধারণায় সত্যের কাছাকাছিপৌঁছালেও, এখনো পর্যন্ত সর্ববাদী—মত বলে গৃহীত হয়নি। তাঁদের আপত্তি মোটামুটিএই ধরনের-“সহজিয়ারা নিজেদের দল পুষ্ট করিবার জন্যই একজন সহজিয়া চণ্ডীদাসখাড়া করিয়াছিলেন, এ ধারণা একেবারে অসম্ভব না হইলেও পুরাপুরি সত্য কি নাসন্দেহের বিষয়। একজন কাল্পনিক কবিকে লইয়া এত উপকথা প্রবাদ সৃষ্টি হইতে পারেনা।
পরিশেষে এই ব'লে যে পূর্বযুগে বড়ু [5] [চৈতনা-- বিষয়ে আমাদের কোনোই সংশয় নেই। তবে বিয়ি সমাজ সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মতো যথেষ্ট উপাদান এখনো মেলেনি। বড়ো তোর এতটুকু বলা যায়, আমার মনে হয়েছে বড়ু চণ্ডীস এবং বিচ্ছিন্ন পদাবলীর হ'লেও হ'তে পারেন, কিন্তু দীদাসের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন পদাবলীর চণ্ডীদাসের অভিন্নতা কল্পনাই করা যায় না। আর সহলিয়া চণ্ডীদাস, খুবই সম্ভব যে, কোনো একজন বিশেষ।
সবশেষে এ কথা ব’লে প্রসঙ্গ শেষ করা যেতে পারে যে, চণ্ডীদাস সম্পর্কিত সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া এখন পর্যন্ত সব নয়। বিশেষ করে চণ্ডীদাস ভণিতায় একটিও কোনো গৌরচন্দ্রিকার পদ পাওয়া যায়নি কেন—এ প্রশ্নের উত্তর কেউই দিতে পারেননি। চৈতন্য-পূর্ব চণ্ডীদাস সম্পর্কে এ প্রশ্নের কী জবাব মিলবে? আরো নতুন তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত কোনো কথা স্থির করে বলা যায় না।
বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যের ভাষা ও ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য---
বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যের (শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের) ভাষা প্রসঙ্গে ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য হচ্ছে-"..... The next great landmark in the study of Bengali, after Caryas, is the S'rikrsnakirtana of Candidasa. This work, from point of view of language, is of unique character in Middle Bengali literature... ... The Sri Krsnakirtan belongs to what may be called the Early Middle Bengali stage; and its importance in the study of Bengali in the absence of other genuine texts, is as great as that of the works of Layamon Orm and Chaucer in English. '89
বড়ু চণ্ডীদাসের ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলি হচ্ছে সংক্ষেপে— (১) শব্দের অন্ত্য অ-কার উচ্চারিত হ'ত।
(২) শব্দের আদিতে অ-কার থাকলে তা বহু ক্ষেত্রে আ-কারে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন—আসুর, আতিশয়, আকারণ, আঞ্চল ইত্যাদি।
(৩) তদ্ভব শব্দের আদ্য অ-কার ক্ষেত্রে বজায় ছিল। যেমন- কপুর (< কর্পূর)।
(৪) ই-ঈ বা ঊ-ঊ অবিচারিতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বানানে হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বরের কোনো পার্থক্য বজায় থাকেনি। যেমন—চারি-চারী, কালি-কালী (কল্য অর্থে), করিউ করিউ, উচিত-ঊচিত ।
(৫) ক্রিয়া পদের আদি ই-কার বহু ক্ষেত্রে এ-কার হয়ে গেছে। যেমন— দেওঁ (দিই)।
(৬) কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদি উ-কার ও-কারে পরিণত হয়েছে। যেমন-বুে
(1)র। যেমন পো
(৮) স্বস্থা প্রভৃতির পর প্রভৃতির ব্যবহার।।
(৯) রে কোনো নিয়ম রক্ষিত হয়নি।
(লোপপ্রবণতা, যেমন- কাহ>কান, তে>তেন।
(11)কলে তার সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ববর্তী কোনো
ক্ষেত্রে মহাপ্রাণ হয়ে গেছে। যেমন- তৰহে ততো, একহো> এখো।
(২) প্রভৃতির ব্যবহারে যথেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যায়।
বছমন, মগ, পুনী, পুর্ণী, শলিল, সামু, যে, জান, যান ইত্যাদি।
(১৩) ক্রিয়ার সঙ্গে 'আছ' ধাতু যোগে নতুন যৌগিক ক্রিয়াপদ গঠিত হ'তে দেখা
এক্ষেত্রে আছ' ধাতুর আদিম্বর লোপ পায়। যেমন আছে,
ফুটিল+আছে=ফুটিলছে ইত্যাদি।
(১৪) বিসর্গ ব্যবহৃত হতে দেখা যায় না।
(১৫) 'গণ' 'সব' প্রভৃতি শব্দ যোগে বহু বচনের পদ গঠিত হয়েছে। সর্ব নামের
সঙ্গে 'রা' যোগে বচনের পদ গঠিত হতে দেখা যায়- আহ্মারা, তোহ্মারা।
(১৬) কর্তা অনুসারে ক্রিয়াপদেরও লিঙ্গ পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। যেমন—
বড়ায়ি লইআ রাহী গেলী সেই থানে।
(১৭) কর্তৃবাচ্যে 'ইল' অন্তক অতীতের এবং 'ইব' অস্তক ভবিষ্যতের প
নিষ্পাদন। যেমন—গাইল চণ্ডীদাস, কংস হৈল সচকীত, কংসে তাক সবই মারিব, এহি
দুই কেশ হৈবে বসুলের ঘরে।
(১৮) ষোড়শমাত্রিক পাদাকুলক-চতুষ্পদী থেকে চতুর্দশাক্ষর পয়ারের উদ্ভব হ'তে
দেখা যায়। যেমন
সব দেবে মেলি সভা পাতিল আকাশ।
কংসের কারণে হএ সৃষ্টির বিনাশে।।
(১৯) নিমিত্তাৰ্থে 'ক' বিভক্তির প্রয়োগ। যথা— পাণিকে আইস, কর ঘরকে গমন।
(২০) বিভক্তির ব্যবহারঃ
(ক) বিশেষ্য পদের সঙ্গে
কর্তৃ কারকে–এ, য়, এ, ঞে এবং শূন্য বিভক্তি।
কর্ম কারকে–এ, ক, কে এবং শূন্য বিভক্তি।
করণ কারকে–এ, ঞ, ত হে এবং শূন্য বিভক্তি।
সম্প্রদান কারকে–ক, কে, রে এবং শূন্য বিভক্তি।
অপাদান কারকে–ক, ত, তে ।
সম্বন্ধ পদে-র, এর, আর
অধিকরণ কারকে- এ, এত, এতে, ক, খ।
(খ) সর্বনাম পদের সঙ্গে
কারকে-এ, (বহুবচনে) শূন্যবিভক্তি এবং রা
করণ কারকে। সম্প্রদান কারকে-এ,
ক, কে, ত, তে, অপাদান কারকে-ক, ত, তে, রে
সম্বন্ধ পদে-ক, র
অধিকরণ কারকে-এ, ত, তা তে।
স্মরণ রাখতে হবে, বিভক্তির সঙ্গে প্রায়ই চন্দ্রবিন্দু যুক্ত হয়ে যেত । (২১) সর্বনাম পদের কয়েকটি রূপের উদাহরণ
কর্তৃকারকে আহ্মা, আখি, মো, মৌ, মোই, মৌএ, মোঞ, মোঞি, মোে মোয়ে, তো, তোঁ, তোএ, তৌএ তোঞি, তোঞ, তোহ্মে, তুমি, তেহেঁ, তেহোঁ, সে, কে, কেহো, এহি, সক্ষে, আহ্মারা, তোহ্মারা ইত্যাদি।
কর্মকারকে—আহ্মা, আহ্মাক, আহ্মাকে, আহ্মাত আহ্মারে, আহ্মাতে, মোক, মোকে, মোত, মোর, মোহোরে, তোক, তোতে, তোরে তোহ্মারে, তোহ্মাক, তোহ্মাত, তাএ, তাক, তাকে, তাহাক ।
করণ কারকে–তে তেঁ, তেওঁ।
সম্প্রদান কারকে-কাএ, মোক, তাকে, তোরে।
অপাদান কারকে—আহ্মাক, আহ্মাত, আহ্মাতে, তোহ্মাতে, তোরে, তোহ্মাথো।
সম্বন্ধ পদে—আহ্মাক, আহ্মাত, আহ্মার আহ্মারে, মোক, মোত, মোর, মোরে, মোহোর, তোর, তোত, তোতে, তোহোর, তোহ্মাক, তোহ্মাত, তোহ্মাতে, তোহ্মার, তাহাক, তাহার, তাহারে, তাক, তাত, তার।
অধিকরণ কারকে আহ্মাত, মোতে, তোহ্মাতে, তোত, তোতে, তাএ, তাতে,
তাহাত ।
(২২) ধাতুরূপ ঃ–
বর্তমান সামান্য বর্তমান অনুজ্ঞা
অতীত কাল
কর্ ধাতু
*মধ্যম পুরুষ
করসি, করহ।
কর, করহ।
উত্তম পুরুষ
করো, করি ।
করিউ।
প্রথম পুরুষ
করে, করএ, করত্তি।
করউ,করু।
কইলোঁ, করিলোঁ কইলি, কইলে, কইল, কইলে, কৈল, কৈলো, কৈল, কৈলী, কৈল, করিল করিলে করিলান্ত করিলি, করিলে । করী।
র, রে।
ভবিষ্যৎ সামান্য করিব, করিবোঁ। করিবেহে। করিবে, করিবে, করিবেক। করি, করিহলি।
বর্তমান সামান্য যাই, যা
বর্তমান অনুজ্ঞা যাইউ, লাইউ। নিত্যবৃত্ত অতীত যাইতো
সামান্য জাইবো।
ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা
যাত্র, জাএ, জাইএ।
জাঁও জাই, জাইএ। যাউক, জাউ ।
যাইবো, যাইবে, জাইবে জাএব
জাইবি জাইহ।
(২৩) ক্রিয়ার অসমাপিকা রূপ–করিঞা, করিলে, করিতেঁ, করিবাক, হআঁ, হচ্ছি হইজ, হয়িতে, হৈলে, হয়িলে, তৈলে, জাই, যাইতে জাইতে, জাইবারে, যাইবাক ইত্যাদি। (২৪) ক্রিয়াপদের শেষে অকারণ 'র' প্রত্যয়ের উদাহরণ কহিআর (অর্থ—কহ)
গেলিয় (অর্থ–গেল), আছের (অর্থ–আছে)।
(২৫) আরবী-ফারসী শব্দের ব্যবহার-বাকী, কুল, সংনাহা, কামান রঙ্গে মজদুর
মজুরী, মজুরিয়া মজিল, কুত প্রভৃতি
ভবিষ্যৎ সামান্য করিব, করিবোঁ। করিবেহে। করিবে, করিবে, করিবেক। করি, করিহলি।
বর্তমান সামান্য যাই, যা
বর্তমান অনুজ্ঞা যাইউ, লাইউ। নিত্যবৃত্ত অতীত যাইতো
সামান্য জাইবো।
ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা
যাত্র, জাএ, জাইএ।
জাঁও জাই, জাইএ। যাউক, জাউ ।
যাইবো, যাইবে, জাইবে জাএব
জাইবি জাইহ।
(২৩) ক্রিয়ার অসমাপিকা রূপ–করিঞা, করিলে, করিতেঁ, করিবাক, হআঁ, হচ্ছি হইজ, হয়িতে, হৈলে, হয়িলে, তৈলে, জাই, যাইতে জাইতে, জাইবারে, যাইবাক ইত্যাদি। (২৪) ক্রিয়াপদের শেষে অকারণ 'র' প্রত্যয়ের উদাহরণ কহিআর (অর্থ—কহ)
গেলিয় (অর্থ–গেল), আছের (অর্থ–আছে)।
(২৫) আরবী-ফারসী শব্দের ব্যবহার-বাকী, কুল, সংনাহা, কামান রঙ্গে মজদুর
মজুরী, মজুরিয়া মজিল, কুত প্রভৃতি।
কাব্যের নায়ক নায়িক------
বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য চরিত্র তিনটি—কৃষ্ণ, রাধা এবং বড়াই। কৃষ্ণ এই কাব্যের আখ্যায়িকার নায়ক, রাধা, নায়িকা। কাব্যের মধ্যে চরিত্র দুটি প্রকৃতই মানব-মানবীর ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বৈষ্ণব সমাজে রাধা-কৃষ্ণ দেব দেবীরূপে পূজিত হয়ে থাকেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, দেবতা হিসেবে কৃষ্ণের যে প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, রাধার তা নেই। মহাভারতে এবং প্রাচীন পুরাণগুলিতে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সেখানে শ্রীকৃষ্ণের জীবন-লীলা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে কিন্তু রাধার নামোল্লেখ পর্যন্ত নেই। এমন কি কৃষ্ণের পত্নীদের মধ্যেও এমন একটি নাম মেলেনা যার সঙ্গে রাধা নামের অন্তত অর্থগত কিছু সাদৃশ্যও খুঁজে পাওয়া যায়। এমন নয় যে পুরাণগুলিতে কেবলি শ্রীকৃষ্ণের জীবনের ঐশ্বর্যময় দিকটিই অঙ্কিত হয়েছে যেখানে রাধার কোনো ভূমিকা ছিল না। কেবল মহাভারত সম্পর্কে বলা যায়, সেখানে কৃষ্ণের যে ভূমিকা ছিল তাতে রাধার প্রসঙ্গ উত্থাপনের বিশেষ কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু এ কথা সব পুরাণ সম্পর্কে খাটেনা। অনেক পুরাণে রাসলীলার বর্ণনা প্রসঙ্গেও রাধার নাম উল্লেখিত হয়নি। তবে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন পুরাণগুলিতে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায় ।
ভাগবত-পুরাণে রাধার কোনো স্পষ্ট উল্লেখ নেই, অথচ সেখানে কৃষ্ণের ব্রজলীলার বর্ণনা পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। বৈষ্ণবগণ
বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য চরিত্র তিনটি—কৃষ্ণ, রাধা এবং বড়াই। কৃষ্ণ এই কাব্যের আখ্যায়িকার নায়ক, রাধা, নায়িকা। কাব্যের মধ্যে চরিত্র দুটি প্রকৃতই মানব-মানবীর ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বৈষ্ণব সমাজে রাধা-কৃষ্ণ দেব দেবীরূপে পূজিত হয়ে থাকেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, দেবতা হিসেবে কৃষ্ণের যে প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, রাধার তা নেই। মহাভারতে এবং প্রাচীন পুরাণগুলিতে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সেখানে শ্রীকৃষ্ণের জীবন-লীলা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে কিন্তু রাধার নামোল্লেখ পর্যন্ত নেই। এমন কি কৃষ্ণের পত্নীদের মধ্যেও এমন একটি নাম মেলেনা যার সঙ্গে রাধা নামের অন্তত অর্থগত কিছু সাদৃশ্যও খুঁজে পাওয়া যায়। এমন নয় যে পুরাণগুলিতে কেবলি শ্রীকৃষ্ণের জীবনের ঐশ্বর্যময় দিকটিই অঙ্কিত হয়েছে যেখানে রাধার কোনো ভূমিকা ছিল না। কেবল মহাভারত সম্পর্কে বলা যায়, সেখানে কৃষ্ণের যে ভূমিকা ছিল তাতে রাধার প্রসঙ্গ উত্থাপনের বিশেষ কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু এ কথা সব পুরাণ সম্পর্কে খাটেনা। অনেক পুরাণে রাসলীলার বর্ণনা প্রসঙ্গেও রাধার নাম উল্লেখিত হয়নি। তবে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন পুরাণগুলিতে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায় ।
ভাগবত-পুরাণে রাধার কোনো স্পষ্ট উল্লেখ নেই, অথচ সেখানে কৃষ্ণের ব্রজলীলার বর্ণনা পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। বৈষ্ণবগণ এই পুরান খানিকে তাদের সর্বাপেক্ষা
গ্রামাণ্য গ্রন্থ বলৈ সমাদর করে থাকে। এতে বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি মাত্র পদে ‘অনুয়ারাধিতঃ' শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে। বৈষ্ণবাচার্যগণ এই শব্দটির মধ্যে 'রাধা' নামের ইঙ্গিত আছে বলে মনে করেন। কিন্তু ঐ একটি শব্দই, আর কোথাও রাধার কোনো অস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাবে না।
বিষ্ণু পুরাণেও ঠিক ভাবগতের অনুরূপ রাস বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে কৃষ্ণের এক 'কৃতপুণ্যা মদালসা' প্রধানা গোপীর উল্লেখ আছে, কিন্তু তার নাম রাধা নয়। রাধা নামের কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই বিষ্ণুপুরাণে পদ্মপুরানের বহুস্থানে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত মনে করেন, পদ্মপুরাণে রাধা-সম্পর্কিত শ্লোকগুলি প্রক্ষিপ্ত পরবর্তী কালের যোজনা ॥৪৮ মৎস্যপুরাণের একটি মাত্র শ্লোকার্ধে যে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায় সেটিও ডঃ দাসগুপ্ত দেখিয়েছেন, সন্দেহের অতীত নয়; প্রামাণ্য ব'লে তা গ্রহণ করা চলে না কিছুতেই। এই প্রসঙ্গে উ: দাশগুপ্ত আরো বলেছেন—'এইরূপে বায়ু-পুরাণ, বরাহ-পুরাণ, নারদীয় পুরাণ, আদি পুরাণ প্রভৃতি পুরাণে একটি আধটি করিয়া শ্লোকে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায়; এইরূপ একটি আধটি শ্লোকের উল্লেখকে অবলম্বন করিয়া কোন কথা বলা শক্ত, ইহার কোন্টি প্রক্ষিপ্ত কোন্টি খাঁটি সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হইবার কোনও উপায় নাই ॥৪৯
রাধাকৃষ্ণলীলার বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে। কিন্তু বাংলাদেশের বৈষ্ণবাচার্যগণ কোথাও তাঁদের মত প্রতিষ্ঠার জন্য এই পুরাণের উল্লেখ করেননি। এই পুরাণখানি কোনো পণ্ডিতের কাছেই প্রামাণ্য ব'লে গৃহীত হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্রও লিখেছেন—“রাধাকে প্রথমে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেখিতে পাই। উইল্স্ন সাহেব বলেন যে, ইহা পুরাণগণের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বলিয়াই বোধ হয় ।৫০ ইহার রচনা প্রণালী আজিকালিকার ভট্টাচার্যদিগের রচনার মত। ইহাতে ষষ্ঠী মনসারও কথা আছে।.... আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বিলোপপ্রাপ্ত হইয়াছে।”৫১ মূল ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধার উল্লেখ ছিল কিনা সন্দেহের বিষয়।
মোট কথা, কৃষ্ণ পৌরাণিক চরিত্র, কিন্তু রাধা নন। কাব্যের নায়িকা হিসেবে এ দেশীয় সাহিত্যে রাধার উল্লেখ বেশ প্রাচীনকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এই কাব্যের রাধাই পরবর্তীকালে ধর্মে ও দর্শনে গৃহীত হয়েছে। রাধার দেবী-মহিমার রূপান্তর একেবারে সুসম্পূর্ণ রূপ লাভ করেছে চৈতন্য দেব প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মে। শশিভূষণ দাশগুপ্ত যথার্থই মন্তব্য করেছেন—“সমস্ত জিনিস পর্যালোচনা করিয়া আমাদের মনে হয়, বৈষ্ণব ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যে শ্রীরাধার আবির্ভাব ও ক্রমবিকাশ মূলতঃ ভারতবর্ষের সাহিত্যকে আশ্রয় করিয়া।”৫২
সাহিত্যের মধ্যে রাধার উল্লেখ প্রথম পাই—গাথাসপ্তশতী'তে (গাহা-সত্তসঈ)। সাতবাহন নরপতি হাল একটি সঙ্কলন প্রস্তুত করেন, সেই সঙ্কলন গ্রন্থই গাথা সপ্তশতী। 'গাথা-সপ্তশতী'র সঙ্কলন কাল নিয়ে মতভেদ আছে। বিভিন্ন পণ্ডিতের মতামত খ্রীষ্টীয় ১ম শতক থেকে ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ॥৫৩ একটি পদে সুস্পষ্টরূপে রাধার উল্লেখ পাওয়া যায়।—“ হে কৃষ্ণ তুমি তোমার মুখমারুতের দ্বারা রাধিকার চক্ষু হইতে ধূলি
সংস্কৃত সাহিত্যে অষ্টম শত্যঙ্গের পুরবর্তী কবি ভট্টনারায়ণের 'বেণীসংহার' নাটকের [] [] প্রসঙ্গে ধাকৃষ্ণের উল্ল রয়েছে। নরম শতাদের তাঁর 'ন্যালোকে' গ্রন্থে সে উদাহরণস্বরূপ উদ্ধৃত করেছের দু-একটি কৃষক আনুমানিক দশম শতাদের 'কীন্দ্রবচনসমুয়' সীলা বিষয়ক কয়েকটি কবিতা পাওয়া
এইভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে পুরাণাদিতে যেখানে রাধার নাম বিশেষ পাওয়া যায় না, সাহিত্যে সেখানে রাধা নামের ছড়াছড়ি। মনে রাখা প্রয়োজন যে, সাহিত্যের এই রাধা তখনও পুরোপুরি দেবী মহিমায় প্রতিষ্ঠাতা নন। কবিরা রাধা কৃষ্ণকে গ্রহণ করিতেন তাঁদের প্রেম কবিতার নায়ক হিসাবে, "রাধা-কৃষ্ণ তাঁহাদের নিকটে প্রেম কবিতার আলম্বন-বিভাব মাত্র, তাহার অধিক আর তেমন কিছু নহে। *৫৫ চৈতন্যপূর্বযুগের কবি বড়ু চন্ডীদাসও এই ধারার কবি এবং রাধা-কৃষ্ণ তাঁর কাছে এমনি প্রেম কবিতার আলম্বন বিভাব মাত্র'
বড়ু চন্ডীদাস ও বৈষ্ণব পদাবলী --
বড়ু চণ্ডীদাস চৈতন্যপূর্ব যুগের কবি। সুতরাং বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব পরিমন্ডলের বাইরে কেবলি সাহিত্যিক প্রেরণা থেকেই বড়ু চণ্ডীদাসের কবিতার জন্ম। পক্ষান্তরে চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের সাধন সঙ্গীতরূপে বৈষ্ণব পদাবলীর উদ্ভব। একটির পেছনে রয়েছে কবি ধর্মের ক্রিয়া, অন্যটিতে শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রভাব। বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধাভাব ও রাধাবাদের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। ষডু গোস্বামী-রচিত বৈষ্ণব দর্শনেরই কাব্যরূপ যেন বৈষ্ণব পদাবলী। কিন্তু কোনো প্রকারের দর্শন চিন্তা বড়ু চট্টদাসের কাব্যকে নিয়ন্ত্রিত করেনি।
বড়ু চন্ডীদাসের রাধা ও কৃষ্ণকে প্রকৃতই গ্রামীণ বাঙালী নরনারী বলে চেনা যায়। কিন্তু পদাবলীর রাধাকৃষ্ণ দেবদেবী। তাঁদের ক্রিয়াকলাপ সবই দেবতার লীলা। তাই পদাবলীতে রাধা প্রথমাবধিই কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর, তাঁর চরিত্রের কোনো বিবর্তন নেই। কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাসের রাধার মধ্যে প্রথমে প্রবল কৃষ্ণ বিরাগ দেখা যায়। পরে চরিত্রটি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণের অনুরাগিণী হয়ে পড়ে। পদাবলীর মধ্যে আধ্যাত্মিকতা বেশি, বড়ু চণ্ডীদাসে প্রাধান্য বাস্তবতার। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধার যেখানে শেষ পদাবলীর রাধার সেখানে আরস্ত। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ও পদাবলীর রাধাকে যথাক্রমে বৈষ্ণব কাব্যের পূর্ব-রাধা ও উত্তর-রাধা বলা চলিতে পারে। ৫৬
‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ ও ‘উজ্জ্বলনীলমণি'-তে কাব্যের যে আদর্শ স্থাপিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলী সেই আদর্শে রচিত। কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাস পূর্ববর্তী যুগের কবি ব’লে স্বাভাবিকভাবেই এ সব অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রভাবমুক্ত। পদাবলী বৈচিত্র্যহীন, কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাসের চরিত্রের উত্থান-পতন থাকায় তা
বৈচিত্র্যপূর্ণ। বড়ু চণ্ডীদাসের প্রত্যেকটি চরিত্র আপন আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। ঘটনা সংঘাত সৃষ্টি করে বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর কাব্যকে নাটকীয় গুণমণ্ডিত করেছেন। কিন্তু পদাবলীর মধ্যে কোনো সংঘাত সৃষ্টির অবকাশ নেই। সেখানে কোনো স্বাভাবিক মানব চরিত্রই নেই। সবই দেব দেবীর লীলাখেলা মাত্র আধ্যাত্মিকতার কুয়াশামণ্ডিত।
আঙ্গিকের ক্ষেত্রে দুই-ই অবশ্যই একপ্রকার গীতিকাব্য, প্রায় একই প্রকার ছন্দ রীতি উভয় ক্ষেত্রেই অনুসৃত হয়েছে। গীত হওয়ার জন্যই এগুলি রচিত-বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য সাধারণভাবে সকল প্রকার শ্রোতার জন্য গ্রামের বারোয়ারি আসৱে নৃত্য-গীত অভিনয় সহযোগে পরিবেশিত হ'ত, পক্ষান্তরে বৈষ্ণব পদাবলী কীর্তনের আসরে গীত
বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে আদিরসের প্রাধান্য। বাৎসায়নের কামসূত্র এবং সংস্কৃত ও
প্রাকৃত আদিরসাত্মক পদাবলীর প্রভাব বড়ু চণ্ডীদাসের মধ্যে ব্যাপক। পক্ষান্তরে বৈষ্ণব
পদাবলীতে প্রাধান্য পেয়েছে মধুর ও শাস্তরস
বস্তুতঃ বৈষ্ণব পদাবলী কোনো একখানি গ্রন্থ নয়, তা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন কতকগুলি পদ মাত্র। বিভিন্ন কবি বিভিন্ন সময়ে এগুলি বিচ্ছিন্নভাবে রচনা করেছিলেন। পরে বিভিন্ন পদসংগ্রহকর্তা এগুলিকে এমনভাবে সাজিয়ে একত্র করেছেন যাতে একটি কাহিনীধারা বজায় থাকে। কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য মূলতঃই একখানি কাহিনীকাব্য । পদাবলীতে রাধার পূর্বরাগের পদ সর্বপ্রথম স্থান পেয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে রাধার কোনো পূর্বরাগই নেই। তবে সেখানে কৃষ্ণের পূর্বরাগ আছে। কৃষ্ণের পূর্বরাগ পদাবলীতেও আছে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে চন্দ্রবালী রাধারই অন্য নাম মাত্র। কিন্তু পদাবলীতে চন্দ্রাবলী রাধার সখী, প্রতিনায়িকা৷ পদাবলীতে রাধার সখীদের নাম পাওয়া যায়, কৃষ্ণের সখাদের নামও উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাসে কোনো নামোল্লেখ নেই। বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা সাগর গোয়ালার কন্যা, মায়ের নাম পদুমিনী। পদাবলীতে রাধা বৃষভাণুবা বৃকভানু রাজার কন্যা, কলাবতী বা কীর্তিদা তার জননী।
বড়ু চন্ডীদাসের কাব্যে কৃষ্ণের আবির্ভাবের একমাত্র কারণ কংসবধ। কিন্তু পদাবলীতে বৃন্দাবন-রস আস্বাদনের জন্যই কৃষ্ণ মর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বড়ু চণ্ডীদাস দেখিয়েছেন, কাব্যের শেষ দিকে কৃষ্ণ যে রাধাকে পরিত্যাগ ক'রে মথুরা গেলেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য কংসবধ ।
দানলীলা নৌকালীলা, কালিয়দময়, বস্ত্রহরণ, জলকেলি প্রভৃতি ঘটনা বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যেই শুধু নয়, পদাবলীতেও আছে। কিন্তু কোনো স্থানেই পদাবলীতে বড়ু চন্ডীদাসের বাস্তবতা আরোপিত হয়নি, একটা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে পদকর্তাগণ ঐগুলি রচনা করেছেন।
বিরহখন্ড এসে মনে হয় বড়ু চণ্ডীদাসের সঙ্গে পদকর্তাগণের প্রভেদ প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। বড়ু চণ্ডীদাস-বিদ্বেষী পরম বৈষ্ণবও এই অংশে স্বস্তি বোধ করেন। তবু বলা
যায়, বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা পদাবলীরে রাধার মতো একাত্তরূপে ভাবস
তার মধ্যে মানবীয় ভাবটি একেবারে আধ্যাত্মিকতার মধ্যে লীন হয়ে যায়।
পদাবলীতে আধ্যাত্মিক ভাব-পরিকল্পনার একটা আতিশয্য আছে, কিন্তু
আধ্যাত্মিকতার আতিশয্য বড়ু চণ্ডীদাসকে কখনো বাস্তব বিমুখ ক'রে তোলেনি।
সবশেষে, ভাষাগত পার্থক্য নির্দেশ করতে হয়। বড়ু চণ্ডীদাসের ভাষায় ব
সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগের ব্যাকরণগত রূপটি ধরা পড়ে, কিন্তু পদাবলী ভাষা
মধ্যযুগের।
বড়ু চণ্ডীদাস ও চসার-------
ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বড়ু চণ্ডীদাস প্রসঙ্গে ইংরাজ কবি চসারের উল্লেখ
করেছেন। আমরা এখানে তাই বড়ু চণ্ডীদাস ও চসারকে পাশাপাশি নিয়ে দেখতে চাই।
বড়ু চণ্ডীদাস চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের কোনো সময়ে তাঁর কাব্য রচনা
করেছিলেন। ইংরেজী সাহিত্যেও তখন মধ্যযুগ এবং জেফরি চসারের (১৩৪০?
১৪০০) আধিপত্য । সেদিক থেকে মধ্যযুগের ইংরেজী সাহিত্যে চসার এবং বাংলার ব
চণ্ডীদাস সমসাময়িক কবি। চসারের পূর্বে ইংরেজী সাহিত্য তেমন উন্নত ছিল না; চ
মহাকবি ছিলেন। ইংরেজী ছাড়া ফরাসী, ইতালীয় ল্যাটিন ভাষায় তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন।
সেজন্যে তিনি তাঁর কাব্য সাধনার মধ্যেমে এমন এক মিশ্র ভাষা ও উন্নত ইংরেজী
ভাষার সৃষ্টি করেছিলেন যা মধ্যযুগ অতিক্রম করে আধুনিকতর রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
এ কারণে মহাকবি চসারকেই আধুনিক ইংরেজী কবিতার জনক বলা হয়।
Trollus And Criseyde' এবং 'Canterbury Tales' নামক তাঁর
কাব্যগ্রন্থগুলোতে তিনি যে সূক্ষ্ম অন্তদৃষ্টি, মানব জীবন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান,
রহস্যপ্রিয়তা ও রসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা মধ্যযুগের সাহিত্যে দুর্লভ। এ গ্রন্থ দু'ট
তার প্রতিভার সরস মৌলিকতার পরিচয় বহন করছে। বিশেষত তাঁর 'Canterbury
Tales' এ কিঞ্চিদধিক ত্রিশজন যাত্রীর পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাবভঙ্গী, চরিত্র ও
ব্যবহারগত পার্থক্যের যে সূক্ষ্ম বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তাতে মধ্যযুগের ইংলন্ডের সমাহ
যেন ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যস্ত হয়ে আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
বড়ু চণ্ডদাস এ যাবৎ আবিষ্কৃত বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের আদি এবং শ্রেষ্ঠ কবি।
তাঁর কাব্যে অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি চসারের মতো নেই তা ঠিক কিন্তু ভাব-গভীরতায় তিনি
ন্যূন নন। তাছাড়া তিনি গ্রাম্য গোপ বালক বালিকা জাতীয় এক শ্রেণীর মানুষের
অকৃত্রিম কামনা বাসনার যে বলিষ্ঠ রূপ বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে পেরেছেন তা তাঁ
দুর্লভ কবি শক্তির পরিচয় বহন করছে। এ যেন আদিম কালের সুস্থ সবল দেহবাদী
মানুষের বলিষ্ঠ কামনার উদগ্র প্রকাশ। যে কবি ভাষায় বড়ু চণ্ডীদাস এ কামনাও দেহ
চেতনার আবেগ ও রাধার 'Flirtation' প্রকাশ করেছেন তা একটা কাসিক গম্ভীর্ষ
মনোহারিত্ব রয়েছে। চর্যা ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মাঝখানে আমরা আর কোনো সাহিত্যিক
নিদর্শন পাইনি। এ-ভাষা বড়ু চণ্ডীদাসের নিজস্ব সৃষ্টি। তবু বাংলা ভাষা তাঁর পূর্বেই
সৃষ্টিধর্মী কবি ভাষা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়ে থাকবে তাঁর কাব্যে ব্যবহৃত ভাষা থেকে সে কথা মনে করার হেতু রয়েছে। হুডু চণ্ডীদাসের ভাষাশিল্পীর দক্ষতা ও রাধাকৃষ্ণ প্রভৃতি চরিত্র সৃষ্টির শিল্প কুশলতা থেকে মনে হয় তাঁর কালের বাংলা কাব্য ও চসারের কালের ইংরেজী কাব্যে খুব একটা
ব্যবধান ও তারতম্য ছিল না। প্রকাশভঙ্গীর অকৃত্রিমতা বলিষ্ঠতায় বোধ হয় বড়ু চণ্ডীদাস
চসারকেও ক্ষেত্র বিশেষে অতিক্রম করে গিয়ে থাকবেন।
শেষ কথা
বড়ু চণ্ডীদাস মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন কবি। এই কবির কাব্য যে কোনো প্রকার ধর্মীয় প্রেরণাজাত নয়, সে কথা পূর্বেই বলেছি। সাধারণ মানব মানবীর প্রেমলীলাই তাঁর কাব্যের মুখ্য উপজীব্য বিষয়। কিন্তু তার কাব্যের ভাষাগত দুর্বোধ্যতা অতিক্রম করে সাধারণ পাঠকের পক্ষে এর রসাস্বাদন করা সম্ভব নয়। আমরা তাই প্রত্যেকটি পদের আধুনিক গদ্য রূপান্তর দিয়ে দিলাম । গদ্য-রূপান্তর যথাসম্ভব মূলানুসারী করা হয়েছে। সাধারণ পাঠকের কাছে, আশা করি, বড়ু চণ্ডীদাস অতঃপর জনপ্রিয় হবে।
0 মন্তব্যসমূহ