Hot Posts

6/recent/ticker-posts

কঙ্কাবতী (বুদ্ধদেব বসু)


 ভূমিকা-----


যে কোনো মানুষের জীবনগঠনে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পারিবারিক জীবন, স্বদেশ ও বর্হিদেশের নানা ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বুদ্ধদেব বসুও (১৯০৮-১৯৭৪) এঁর ব্যতিক্রম নন। “তাঁর কবিতার বিষয় ও শিল্পপ্রকরণ বিবেচনার জন্য প্রয়োজন তাঁর চেতনালোকের আবেগ-সংবেদন, স্বভাব বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতা উপলব্ধির উৎস সন্ধান।"

(মাহবুব সাদিক/বুদ্ধদেব বসুর কবিতা : বিষয় ও করণ]


বুদ্ধদেব বসুর পিতৃকুল ও মাতৃকুলের আদি নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। তাঁর জন্মস্থান কুমিল্লা। পিতার নাম ভূদেবচন্দ্র বসু আর মাতার নাম বিনয়কুমারী। জন্মের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই তাঁর মা ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অল্পবয়সেই তিনি মাতৃস্নেহ হতে বঞ্চিত হন। বাঙালি সমাজের চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী তাঁর পিতা দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। স্বাভাবিকভাবেই বুদ্ধদেব বসুর দাদামহাশয় ও দিদিমার কাছে নোয়াখালিতে পালিত হন। মাতামহ স্বর্ণলতার কাছে তাঁকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন এবং বঙ্কিমের বই ও মাসিকপত্র পাঠ করে শোনাতেন। তাঁর দাদা মহাশয় ছিলেন অত্যন্ত ধীর স্থির ও নম্র স্বভাবের। বুদ্ধদেব বসুর জীবনে এর প্রভাব পড়েছিল । তিনি বাল্যকাল থেকেই নিভৃতচারী জীবনযাপন করতেন। একা একা থাকতে পছন্দ করতেন।


তিনি দাদার কাছে শার্লকহোমস, শেক্সপিয়র প্রমুখ ইংরেজি সাহিত্যের সাথে সম্পৃক্ত হন। তিনি অল্প বয়সেই [দশ বছর] ইংরেজি ভাষায় প্রথম কবিতা রচনা করেন—

Adieu, adieu, Deloney House dear,

We have you because the sea is near,

And the sea will swallow you, we fear,

Adieu, adieu.

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও অধ্যক্ষ রূপে যোগদান করেন। কিন্তু ১৯৬৩-তে বাধ্য হয়ে সেমিস্টারের ডাক আসলে বিভাগ হতে ছুটি নিতে গিয়ে শুরু হয় বিপত্তি ও চক্রান্ত। এ সম্পর্কে কবি-পত্নী বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য

"...কোনো কোনো অধ্যাপক উঠে পড়ে লাগলের বুদ্ধদেবের যাওয়া বানচাল করতে। মিটিং-এর পর মিটিং বিনা বেতনে ছ'মাসের ছুটি না মঞ্জুর করতে। স্তম্ভিত যুদ্ধদেব, স্তম্ভিত বিভাগ কান্ডকারখানা দেখে।...সহকর্মীদের এই অন্যায় ব্যবহার অসম্মানিত হয়ে পদত্যাগ করলেন তিনি।” (বৈদাধ্য/বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা, ১৯৯৯) বুদ্ধদেব বসুর পঠন-পাঠন ছিল বিচিত্র ধরনের। ডিকেন্স, টেনিসন, ব্রাউনিং

শেলি, রবীন্দ্রনাথ, হামসুন, ইবসেন, টিএস এলিয়েট, পোপ, সুইন বার্ন,

এজরাপাউন্ড, বোদলেয়ার, রিলকে, ডি. এইচ. লরেন্স প্রমুখ।

বুদ্ধদেব বসু প্রথম জীবনে সাহিত্যিক হিসেবে সত্যেনদত্ত বা কাজী নজরুল ইসলামকে ভরসা পাননি। মৈয়মনসিংহ গীতিকা দেশজ, কিন্তু আধুনিক মনের সাথে মিলল না। ভাওয়ালের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের “আমি তারে ভালবাসি অস্থি মাংসসহ”।

ঢাকা থেকে প্রায়ই তিনি কলকাতা যান। বিশেষত 'কল্লোল' পত্রিকার

আড্ডায়। সেখানে তিনি দেখা অনেক লেখক, বিদগ্ধজনের নিবিড় গোষ্ঠী সুখ

অনুভব করেন। জীবনানন্দ দাশকে দেখার সুযোগ পান। সুধীনদত্তের বাসায়

সাহিত্যে সম্মেলনে যোগদান এবং নিজের ভেতরে অস্বস্তিবোধ করা।

১৩৪২ সালে এজরা পাউন্ডের “The Poetry” পত্রিকা অবলম্বনে বুদ্ধদেব বসু এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবিতা পত্রিকা। পরবর্তীতে বুদ্ধদেব বসুর একক প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হতে থাকে 'কবিতা' পত্রিকাটি। এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক বাংলা কবিতা।

বুদ্ধদেব বসু আধুনিক বাংলা কবিতা প্রতিষ্ঠার জন্য আধুনিকতার বিরুদ্ধ ক্ষর সাথে আক্ষরিক এই আদর্শ দ্বারা কিছুদিন প্রভাবিত ছিলেন। এরপর এলেন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত- 'যার দুঃখবাদ' মনে হল নতুন রকম। অবশেষে এলেন মোহিতলাল মজুমদার-“যার শক্তি ঈষৎ পেশিনির্ভর হলেন জীবন দর্শনে বৈশিষ্ট্য ও গভীরতা আছে। শেষ পর্যন্ত মোহিতলালে আস্থা রাখতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য পাশ্চাত্যের কবি টি এস এলিয়ট, ইয়েটস, এজরা পাউন্ড ও ডি.এইচ. লরেন্সের দ্বারস্থ হলেন।

১৯৩১ সালে তিনি ঢাকা থেকে কলকাতায় স্থিতধী হন। কলকাতার ''কল্লোল' পত্রিকায় দেখা পান কবি, লেখক, বিদগ্ধজনের। জীবনানন্দ দাশের সাথে পরিচয় হয়। কলকাতাতেই তিনি শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অন্নদাশংকরের বক্তৃতা শোনেন।


আধুনিক কবিতাকে তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করেন। আধুনিকদের জন্য তাঁকে যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে তা নিম্নের উদ্ধৃতিতে ব্যক্ত


"আমার বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেলো, গত তিরিশ বছর ধরে বাংলা ভাষার কবিতার বিবর্তনে লিপ্ত আছি। স্বকীয় রচনার চেষ্টাতেই আমার তৃপ্তি ছিলো না, আমি অবিরাম যুদ্ধ করেছি আধুনিকতার শত্রুপক্ষের সঙ্গে, আমার সমকালীন কবিদের গুণকীর্তনে আমি ক্লান্তিহীন ছিলাম।"

[বুদ্ধদেব বসু, “সঙ্গ : নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ”]

কিশোর বয়সেই বুদ্ধদেব বসু কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মৰ্ম্মবাণী' প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে মাত্র ষোলো বয়স)। ১৯২৬ সালে 'কল্লোল' থেকে প্রকাশিত হয় “রজনী হলো উতলা"। আই এ পরীক্ষার পরই লিখে ফেলেন বিখ্যাত কবিতা “বন্দীর বন্দনা"। কবির স্বীকারোক্তি- “এতদিনে শূন্যে ঝুলে থাকার পর আমি পায়ের তলায় মাটি পেলাম এবার।” সম্পাদনা করলেন “প্রগতি" পত্রিকা অজিত দত্তের সহযোগিতায়। (১৯২৭)। ১৯৩৩ সালে যুগপৎ প্রকাশিত হল “বন্দীর বন্দনা” কাব্য ও “সাড়া উপন্যাস” 'কঙ্কাবতী' (১৯৩৭) প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা ভবন' তখন এর কবিতার সংখ্যা ছিল ২৫। ১৯৪৩ সালে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কবিতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে আটত্রিশে দাঁড়ায়। '১৯৫৭' সালে কলকাতার নাভানা প্রকাশনী থেকে বের হয় তৃতীয় সংস্করণ ‘কবিতার কলেবর বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়ায় ৪৩। ২২ শে শ্রাবণ (১৯৪২), বিদেশিনী (১৯৪২), দময়ন্তী (১৯৪৩), রূপান্তরে (১৯৪৪), দ্রৌপদীর শান্তি (১৯৪৮) এবং শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর (১৯৫৫)।

কবিতা তাঁর প্রাণের ও হৃদয়ের সামগ্রী। প্রবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য যে দিগদর্শী বাংলা সাহিত্যে তিনি যে নতুন গদ্য ভঙ্গি নির্মাণ করেছেন তা সত্যিই অপূর্ব। তবে বাংলায় কাব্যনাটক লিখে তিনি যে স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করলেন (এলিয়েট, ইয়েটস-এর অনুসরণে) তা অতুলনীয়। বুদ্ধদেব বসু সমগ্র জীবনে বই লিখেছেন ১৬২। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ ১৮টি।

অনুদিত কবিতা গ্রন্থ ৫টি উপন্যাস ৪৩টি। ছোটোগল্প ২১টি। ছোটোদের জন্য ২২টি কাব্য নাটক ১৬টি। প্রবন্ধগ্রন্থ ১২টি। এক জীবনে কী বিপুল পরিশ্রম করেছেন লেখার জন্য নিজেকে নিঃশোষিত করেছেন।


বুদ্ধদেব বসু নিন্দার মাঝেও সম্মান পেয়েছেন যথেষ্ট। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৬৬-তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎচন্দ্র বক্তৃতামালার বা হওয়া এবং "কবি রবীন্দ্রনাথ" বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া। ১৯৬৭ সালে “তপস্বী ও তরঙ্গিনী" কাব্যনাট্যের পেয়েছেন “সাহিত্য আকাদেমি” পুরস্কার। ১৯৭০-এ পদ্মভূষণ উপাধি পান। ১৯৭৪ সালে ‘স্বাগত বিদায়” কাব্যের জন্য পেয়েছেন মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার।


প্রেমচেতনা-----



বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী Erich Formm তাঁর The Art of loving গ্রন্থে প্রেমতত্ত্বের দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, আদম ইভের কাহিনীর মধ্যে আছে “পৃথকত্ব জনিত লজ্জাবোধ ও অপরাধবোধ।” যদি প্রেম জগৎ হয়, তবে লজ্জা বা অপরাধবোধ থাকে না। এরিক ফ্রম বিশ্বাস করেন ব্যক্তিত্বের পরিপকৃতা ছাড়া প্রেমরস অনুভব করা যায় না। স্রষ্টা বা শিল্পী মানুষের সাথে সাধারণ মানুষের মিলনেচ্ছা ও মিলন সুখের পার্থক্য তিনি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে,


-সৃজনকর্মের মিলনের মধ্যে এক ব্যক্তির সহিত অপর ব্যক্তির মিলনের স্পর্শ নাই। ২. মানুষের মধ্যে অপর ব্যক্তির সহিত প্রেমের মিলনে আবদ্ধ হওয়ার


আকাঙ্ক্ষা অপেক্ষা প্রবলতর আকাঙ্ক্ষা আর একটিও নাই। ইহাই আদিমতম


ক্ষুধা । (প্রেম: দার্শনিক বিচার/জিতেন্দ্রচন্দ্র মজুমদার)

তাঁর সিদ্ধান্ত : প্রেম মূলত এক প্রকার দেওয়া, পাওয়া যায় নরনারীর রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যায় এরিক ফ্রম দেওয়া নেওয়ার প্রসঙ্গটি দেখেছেন এভাবে “পুরুষের রতিকর্মের চূড়ান্ত প্রকাশ দানে...শুক্র দান না করিয়া থাকিতে

পারে না।।

বাংলা সাহিত্যে প্রেম মনস্তত্ত্বের প্রথম দাবিদার বৈষ্ণব কবিরা। যারা রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার মুখচ্ছেদে আপন মন ও হৃদয়কে ব্যক্ত করেছিলেন। রাই রামী সেখানে একাকার। যেজন্য রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করতে হয়েছিল

সত্য করে কহো মোরে যে ৰৈ কৰি

কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি?


রবীন্দ্রনাথের দেহাতীত প্রেমকে তিরিশের কবিরা অস্বীকার করেছেন।তাঁরা দেখেছেন অন্যভাবে। জীবনানন্দ দাশ প্রথম পর্যায়ে রূপকথার নারীররূপকে এক স্বপ্নলোেক নির্মাণ করেছিলেন। অমিয় চক্রবর্তী শর্তহীন

নিষ্কামকর্মের প্রেমের অমরাবতীতে খুঁজেছেন তাঁর অতীন্দ্রিয় সত্তাকে। বুদ্ধদেব

বসুর কবিতার দেহজ প্রেমের রূপ অঙ্কন করেছেন। আধুনিক মানসসচেতনভাবে কোনো অধরা দেবীকে প্রার্থনা করে না। বাসনা মদির বাস্তবমানবীই তার কাম্য।

তিরিশের কবিরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন বিংশ শতাব্দির অন্যতম

সেরা কবি টি এস এলিয়ট দ্বারা। বুদ্ধদেব বসু ডি. এইচ. লরেন্সের যৌনচেতনা ও শারীরিক প্রেম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তিনি প্রেমের মূল প্রেরণা যৌন

লিপ্সাকে সগৌরব-স্বীকৃতি দিয়েছেন দেহবাদী সম্ভোগ সংরাগে ।রবীন্দ্র কাব্যের অশরীরী প্রেমকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জীবনানন্দ

দাশ প্রথম পর্যায়ে রূপকথার নারীর রূপকে এক স্বপ্ন লোক নির্মাণ করেছেন।

অমিয় চক্রবর্তী শর্তহীন নিষ্কাম প্রেমের অমরাবর্তীতে খুঁজেছেন অতীন্দ্রিয় সত্তাকে। বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে সেখানে বিমিশ্র চিন্তা ভাবনার পরিচয় আছে।

“বন্দীর বন্দনা” কাব্যে বুদ্ধদেব বসুর প্রেম চেতনার যথার্থ রূপ ফুটে

উঠেছে। এ কাব্যেই কবির রিরংসা ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন এভাবেবাসনার বসোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুদিত যৌবন,

দুর্দম বেদনার তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।

রক্তের আরক্তলাভে লক্ষবর্ষ উপবাসী শৃঙ্গারবাসনা

রমনীরণে পরাজয়-ভিক্ষা মাগে নিতি।

বুদ্ধদেব বসুর 'কঙ্কাবতী' কাব্য থেকেই প্রেমচেতনার পরিবর্তন ঘটেছে।প্রাচীন বাংলার লোক নায়িকা কঙ্কাবতীর প্রতি অন্তরঙ্গ আকর্ষণ বহন করে প্রত্ন

প্রজ্ঞায়। বুদ্ধদেব বসুর “কঙ্কাবতী” কাব্য পড়ে জীবনানন্দ দার্শ মুগ্ধ হয়েছেন।এ কাব্য সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন “...সময় ও মৃত্তিকার ভিতর বাসা বেঁধে

‘কঙ্কাবতী’ মৃত্তিকা ও সমরোক্তর কাব্য। ... বুদ্ধদেব বসুর কবিহৃদয়ের অভাবথেকে 'কঙ্কাবতী’র জন্য হয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন প্রধান

কবি। প্রধানদের ভিতর অন্যতম তাঁর 'কঙ্কাবতী' অবশ্যম্ভাবী পিপাসা জাগিয়ে গভীর পরিতৃপ্তি কুহক নিয়ে এসেছে। [কবিতা ঘোষ / ১৩৪৪)


"কঙ্কাবতী" শব্দটি বুদ্ধদেব বসু সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছেন “বন্দীর বন্দনা" কাব্যের ‘প্রেমিক কবিতায়। কঙ্কাবতী কাব্যের 'আরশি' 'সেরেনাদ’ 'কঙ্কাবতী', 'রূপকথা' এবং 'শেষের রাত্রি' কবিতায় কঙ্কাবতীর নাম ব্যবহৃত হয়েছে। এ কাব্যের 'আরশি' কবিতায় ব্যবহৃত 'আপেল', 'লাল’, ‘শুকনো’, ‘লালচুল' ইত্যাদি চুলের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় এ নায়িকার রূপ বিদেশাগত। “কঙ্কাবতী" কাব্য রচনাকালে তিনি অধ্যয়ন করে ছিলেন সুইনবার্ন, প্রি


র্যাফেলাইট, রবাট ব্রাউনিং প্রমুখ। রসেট, মরিস প্রভৃতি প্রি-র্যাফেলইটি চিত্রশিল্পী ও কবিরা রাফায়েল পূর্ববর্তী ভুবনে আশ্রয় নিয়েছেন যন্ত্রযুগের চাপ ও আধুনিক জীবনের কুশ্রীতা ভুলতে। বুদ্ধদেব বসুও তেমনি প্রাচ্য লোকপুরাণ ও প্রি-ব্র্যাফেলাইদের কাব্য ভুবনে আশ্রয় নিয়েছেন রোমান্টিক প্রেম কবিতার কঙ্কাবতীকে ।


“কঙ্কাবতী” কাব্যের প্রথম কবিতার নাম “কাল”। এই কবিতায় দেখা যায়


নায়িকার জন্য অপেক্ষা কাতর প্রেমিকের উদ্বেল-হৃদয় স্পন্দন অনুভব করা


যাবে। সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে নাগরিক পরিপ্রেক্ষিত বিধি এবং হাতের লেখার


মতো তুচ্ছ তথ্য ও প্রেমের কবিতায় গরীয়ান হয়ে উঠেছে


কাল-সে তো আজ নয়, কাল সে তো দেখা দেবে কাল। আজ তার সেই চিঠি রহিয়াছে-দেখিবো ড্রয়ারে, নিজ হাতে লেখা চিঠি-টানা টানা হাতের আখর, বড়ো বড়ো লেখাগুলি, কিন্তু চিঠিখানা ভারি ছোটো । বড়ো বড়ো রেখাগুলি এ উহার কানে কানে কয় কাল সে আসিবে!


'কোনো মেয়ের প্রতি' এবং 'অন্য কোনো মেয়ের প্রতি কবিতায় কিশোর প্রেমের সহজ সাধারণ আবেগ ও প্রেমিকা দেহের প্রতি আকর্ষণ রূপ পেয়েছে। একটি আবেগ উজ্জ্বল প্রেমের কবিতা “একখানা হাত” ঘরে ফেরার পথে একা কান্ত কবির চোখে, মধ্যরাতের ঘুমন্ত শহরের এক দু'তলার জানালায় ৷ ঝলসে উঠেছিল হিরের আংটি ও মনিবন্ধে রুলিসহ শাদা হাত। স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করতে থাকলো অনিন্দ্যসুন্দর হাত বাড়ি ফিরে নির্ঘুম কবি জ্বলতে থাকলেন অনির্দিষ্ট রোমান্টিক চেতনায়

বিছানায় শুয়ে আছি, ঘুম হারায়েছে

কখনো সে-হাত যদি ছুই, জানিবে না,


না জানি এখন কত রাত;


এ-ই সেই হাত


[একখানা হাত/কঙ্কাবতী]

কবি “কঙ্কাবতী” নামের অনুসরণ করেন “কঙ্কাবতী” নাম কবিতায়।

কঙ্কাবতীর নাম কবির মনে সাংগীতিক অনুসরণ তোলে। প্রাণে আনে প্রবল

ঝড়ের আবেগদোলা। তাঁর ঘুমের গহনে, স্বপ্নে, দিনের কর্ম-কর্ম কোলাহলে

সারাক্ষণ ঢেউ তোলে প্রিয় নাম কঙ্কারতী। মন্দিরের ঘন্টাধ্বনির মতো তার

নামের ঘন্টা বাজে মনোমন্দিরে। তার আবেগ-অনুসরণ ছড়িয়ে হাওয়ায়

হাওয়ায়। শব্দ ও বাক্যবন্ধের পৌনঃপুনিক, প্রয়োগ, চিত্র ও চিত্রকল্পের

পারস্পরিক অবলুপ্তি, পুনর্জাগরণ এবং কাব্যকলার সাংগীতিক প্রকাশরীতি

‘কঙ্কাবতী'কে মহিমান্বিত করেছে। রোমান্টিক প্রেম স্বপ্নের প্রবল আবেগে কবি

আপ্লুত করেন পাঠক হৃদয়

তোমার নামের শব্দ আমার কানে আর প্রাণে গানের মতো

মর্মের মাঝে মর্মরি বাজে, কঙ্কা, কঙ্কা, কঙ্কাবতী। (কঙ্কাবতী গো) চীন

আমার বুকের হৃদয়ের রোলে, রক্তের তোড়ে, কানে আর প্রাণে শুনি।

“কঙ্কাবতী” কাব্যের কয়েকটি কবিতায় আন্তর্জাতিক রোমান্টিক কাব্যের

উপকরণ রয়েছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আরশি’, ‘সেরেনাদ’, ‘কবিতা’উল্লেখযোগ্য। “সেরেনাদ” কবিতার পারিপার্শ্বিক আবহ বিদেশি ও এর প্রেমদর্শ

ও তাই। বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্যানুযায়ী এটি তার ব্রাউনিং এবং রসেটির

কাব্যম্ফল। টেনিসনের “The Ballad of Helen of Kirkonneu"-এর দ্বারা

প্রভাবিত। বুদ্ধদেব টেনিসনের প্রকরণ দ্বারা অনুপ্রাণিত

মেঘের মুখেতে মুখ রেখে চাঁদ পড়েছে ঢলে,

রজনীর নীড়ে ঘুমের পাখিরা উঠেছে জেগে, (সেরেনাদ/কঙ্কাবতী)কঙ্কাবতী!

টেনিসনের “The Ballad of Orana"-র পংক্তি এরকম Ere the light on dark was growing

Oriana

At midnight the cock was crowing

Oriana.

Winds were flowing, waters flowing.

বুদ্ধদেব বসুর ‘কঙ্কাবতী’ কাব্যের ‘কবিতা’ কবিতাটির রসোেস্টর “টুল্লু টাউন” এর অনুকরণে লিখিত হয়েছে। রসেটির কবিতাটি গ্রিক মহাকাব্য “ইলিয়াড” বর্ণিত হেলেন প্যারিসের প্রেমের পটভূমিতে রচিত। হেলেনের শারীরিক সৌন্দর্য “ইলিয়াড” মহাকাব্যে বিধৃত হেলেন প্যারিসের প্রেম-স্মৃতি ও ট্রয় ধ্বংস রসেটির মনে যে দোলা সৃষ্টি করেছিলো তাই তাঁর “ট্রয়-টাউন” কবিতার উপজীব্য। রসোটি শুধু হেলেনের দেহ সৌন্দর্য ও তার প্রেমের অনুরণন 'বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় রসেটির লেখার নব মাত্রা সংযোজন করেছেন।

তিনি তাঁর প্রেমিকার সাথে একত্রে বসে “ট্রয়-টাউন” পাঠ করেছেন এবং মূল কবিতার আবেগ-দোলা ও রোমান্টিক স্বপ্নাবেশ ফুটিয়ে তুলেছেন। এ কবিতায় বুদ্ধদেব বসু যুক্ত করেছেন নিজস্ব প্রেম ঘুম ফেলে দিয়ে তুমি চলে এসো, খুলে ফেল চুল, এলোচুল তব হালকা হাওয়ায় উড়বে আকুল শুকনো বাতাস, ঠান্ড্রা বাতাস ছুটবে যখন ৷ হেলেন রচেছে অর্ঘ্য নিজের বুকের ছাঁচে সোনার বাটি সে-মনের বাসনা সব পুরুষের+ -চুরমার হলো ট্রয়! (কবিতা)

বুদ্ধদেব বসুর নায়িকারা বেদনা-বিধুর ও মবির্ড নয়। নায়িকার দেহ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে কবিতায় এনেছেন ইন্দ্রিয়ঘনত্ব ৷

প্রকৃতি চেতনা--


প্রকৃতির সাথে মানবমনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকার কারণেই সংবেদনশীল কবি প্রতিভা প্রকৃতিকে তার মনোভাবের বাহন করে তোলে। কবিতায় নির্মাণ করে প্রকৃতির বহুবর্ণিল গতিশীল রূপ। কবির মনোভাব সঞ্জীবিত প্রকৃতি চিত্র আধুনিক সাহিত্যে বিচিত্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতিতে কখনো আরোপিত হয়েছে 'মানবত্ব, কখনো তা রূপকাশ্রয়ী ও অনুভূতিপ্রবণ, কখনো তাকে দেখা হয়েছে ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে।


প্রকৃতির বহুবর্ণিলময় বিচিত্ররূপ অবলোকন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আর তিরিশের পঞ্চপান্ডব কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় প্রকৃতির বিশিষ্ট ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বুদ্ধদেব বসুর প্রকৃতি চেতনার মধ্যে নোয়াখালি অঞ্চলের স্মৃতি তাঁর মানসপটে ছাপ রেখেছে সবুজ নিসর্গ


“আছে রৌদ্রের জীব প্রজাপতি অনেক অন্ধকারে ঝলমলে সবুজ


জোনাকির ঝাঁক। আছে লোকপুরাণের কঙ্কাবতী এখানে শাশ্বত শান্তি ও প্রেমের


প্রতিরূপক৷” সমকালীন রাজনীতি-উন্মুক্ত বিশ্ব ও অশান্ত দৈশিক পটভূমি


অতিক্রম করে কবি এই শাশ্বতীর কাছে যেতে চান


তোমার কালো চুল ছড়ায়ে দিলে দূর নীল দিগন্তের প্রান্তে, মত্ত বিপ্লবী অপলাপ পার হয়ে দাঁড়ালে শাশ্বতী আর্দ্র-উজ্জ্বল তীব্র থরোথরো-ভাদ্রের সৌম্য সীমান্তে আশ্বিন এনে দিলে কঙ্কা!


শান্তি;

[কালো চুল]


“কঙ্কাবতী”র “শেষের রাত্রি' তে বৈরী সময় অতিরঞ্জমনের ইচ্ছা এবং ‘কালো চুল’-এ বৈরী বিশ্ব অতিক্রম করে শাশ্বত শান্তি প্রত্যাশা একই রোমান্টিক আবেগ প্রবণতার পরিচয় বহন করে। বুদ্ধদেব বসু প্রেমের কবিতায় শরীর-মনের দ্বন্দ্ব মীমাংসিত আকাশ জোড়া ঝিমঝিম জ্যোৎস্না আর শীতের জ্যোৎস্নায় ঘন কুয়াশার আস্তরণ, যাতে চেনা জিনিস রহস্যময় হয়ে ওঠে।”

বুদ্ধদেব বসু-র প্রকৃতি ব্যক্তিগত অনুভবের সূত্রে প্রকৃতির রূপান্তর সাধিত হয়। তাঁর চৈতন্য ও মনোভাবের রূপান্তরের সাথে প্রকৃতিতে আরোপিত হয় রূপান্তরিত সত্তা

আমার মুখের তিমিরে পড়েছে তোমার আলো,

রাঙাভাঙা চাঁদ এল কোন বাকি আকাশ কালো

রাতের বাতাস কী কথা যে কয় পাতার কানে রাতের সেই কথা জানে, সে-কথা জানে,

কঙ্কা জাগো!

হাওয়ার বেহালা কী কথা বলেছে অঝোর গানে, সে-কথা কে জানে? কে জানে সে কথা? বুঝেছে ভালো?

কঙ্কা গো!


চাঁদ ঘরে আসে; তোমার আঁখিতে জ্যোছনা জ্বলে।

কঙ্কা, জাগো। কঙ্কা গো [সেরেনাদ/কঙ্কাবতী]

এ কবিতায় চিত্রি রাতের বাতাস, নক্ষত্র পুঞ্জ, হাওয়ার বেহালা প্রত্যেককেই মনে হেয় জীবন্ত ও গতিশীল। প্রকৃতি নিজে এরকম গতিশীল নেয়। এই জীবনসত্তা ও গতিশীলতা কবি আরোপিত এবং তাঁর চৈতন্য ও অভিপ্রায় সহযোগে তা চমৎকারিত্ব পায়। রিচাডর্স বলেছেন

The mind of the poet creates a nature into which his own feelings, his aspirations and apprehansions are projected."

কবিই প্রকৃতির নিয়ন্তা, তাঁর ব্যাকুলতা ও অনুভবের প্রকাশই তিনি প্রকৃতিতে পরিস্ফুট দেখতে চান। কারণ জালের ভিত্তিরূপে-বস্তু ও প্রকৃতি বর্জিত হয়েছে আধুনিক বাদীদের কাছে। আধুনিকবাদী কবির কাছে আত্মজ্ঞানই মুখ্য।"কঙ্কাবতী" কাব্যে বুদ্ধদেব বসুর চৈতন্য যে রকম লোকপুরাণের

নায়িকা কঙ্কাবতীকে অবলম্বন করে রোমান্টিক প্রেম স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে।' তেমনি তাঁর প্রকৃতি দৃষ্টি প্রকাশ দিয়েছে অতিরোমান্টিকতা। 'কুদ্ধাবতী' কবিতায় বিধৃত প্কৃতি বুদ্ধদেব বসুর রোমান্টিক প্রেম

স্প্নের আদর্শ স্পন্দমান। (অন্ধকারের অন্তর-ভরা পছন্দ-শিহর স্পন্দমান)

অন্ধকারের অন্তর থেকে তরঙ্গ রোল ইতস্তত কেঁপে ফুটে ওঠে, ফেটে বেজে যায়, ঢেউয়ের মুখের ফেনার মতো।


অজস্র গুণবাচক শব্দের বিন্যাস বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য সঙ্গতি বুদ্ধদেব বসুর ‘কঙ্কাবতী' কাব্যে রয়েছে। কোথাও কোথাও এর অতিব্যবহার ও ঘটেছে। যেমন—

আরশির মুখ কঠিন, ঠান্ডা, নিরেট, ফাকা। এখানে কোনো নতুন অর্থব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়নি। বিশেষণের চেতনা ও নম্রতা সঞ্চারী গুণ অসামান্য। কখনো কখনো বিপ্রতীপ উপমান-উপমেয় ব্যবহার করে কবি অর্থব্যঞ্জনার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন।

বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় বিভিন্ন অনুষঙ্গ

পোশাক --

আঁচল হাওয়ায় নড়ে, আঁচলে ঢেলেছে ওরা একটু আতর হাওয়া তাই

জ্বলেছে নতুন চাঁদ, ঝিলমিল করে ওঠে পালা কাপড়


হাওয়ায় হঠাৎ যায় সরে। [মেয়েরা/কঙ্কাবতী]

স্তন-- 

১. হেলেনের বুক নিখুঁত, নিটোল, নরম, শাদা

২. হেলেনের বুকে দুটি পাকা ফল ভরেছে রসে, ৩. টেনে নাও আমায় তুমি ফুটফুটে নরম বুকে (গান)

দাত--

ছোটো শাদা দাঁত আলোর মতন

নিমেষ তরে

ঝুলকি মিলায় আঁধার ঘরে।

(একটি স্বপ্ন/কঙ্কাবতী)

চোখ--

কালো বিদ্যুৎ জ্বলে চক্ষে তোমার

হে বিদেশিনী,

কালো বিদ্যুৎ জ্বলে চক্ষে তোমার

সবুজ সমুদ্রের মৃত্যু আঁধার, নিশীথ-মুহূর্তের স্বপ্ন-াথার

লাল বিদ্যুৎ জ্বলে রক্তে আমার

হে বিদেশিনী ।

[শোনো বিদেশিনীর প্রতি/কঙ্কাবতী]

ঠোঁট ---

 মুখে মুখ রাখিই যদি এমন আর দোষ কী? মনেরে যায় না ছোঁয়া, কেমনে চাখবো তারে। দুটি ঠোঁট, ফুরফুরে ঠোঁট, টুকটুক রঙিন হলো ঠোকরাই পাখির মতো, খুটখুট চার কিনারে।

চুল --

: (ক) তোমার সে চুল জড়ানো সুতোর মতন, নিশীথের মেঘের মতন (চুল) (খ) রাত্রির মতো তোমার চুল হৃদয়ে তাহার স্বপ্ন দেখি। (রূপকথা) (গ) কঙ্কাবতী সে চুল এলো করে দিয়েছে

আহা-লাল চুল, রেশমি-নরম, লাল যে চুল (আরশি) বুদ্ধদেব বসু তাঁর “কঙ্কাবতী” কাব্যে ভারতীয় পুরাণের বায়ুর অনুষঙ্গ এনেছেন।

প্রথমে ফুলের গন্ধ-বায়ু তারে করিছে লেহন,

অপর চুলের গন্ধ-বাতাস কি এখনো বহিছে? (কাল) বাতাসে সুরভি ভাসে, আর মোর গায়ে, রজনীর চোখে ঘুম আসিছে জড়ায়ে। (চেহারা)

(গ) নভেল পড়ছিলাম, দমকা হাওয়ায় নিভে গেলো হঠাৎ আলোটা (চুম্বন)

বুদ্ধদেব বসু তাঁর “কঙ্কাবতী” কাব্যে অগ্নিকে শক্তি ও জ্যোতি উভয় অর্থে ব্যবহার করেছেন।

ক. বু মনে প্রেম ছিল, মোহ ছিলো, কী ছিলো জানি না, কী আগুন পোড়ে প্রাণে, ক্ষণমাত্র নাই অবসর। (সুখান্বেষী

ঘরে জ্বলবে মোমের আলো এক কিনারে আর জ্বলবেন সন্ধ্যাতারা আকাশ-পারে, আর জ্বলবে স্বপ্ন তব আঁথির টারে, (আমন্ত্রণ রমাকে)

অলঙ্কার ---

উপমাই কবিত্ব বলেছিলেন তিরিশের সেরা না যুদ্ধশেষের মতে, উপমাকে দিয়ে ভাষায় প্রকাশ শক্তি খর্ব হয়।


পরস্পর আলাদা বস্তু বা প্রাণীর মধ্যে লুকানো শাশ্বত সম্পর্ক আবিষ্কার জুলাই উপমার লক্ষ্য। আচরণের অন্তরঙ্গ মুহুর্তে কবি আবিষ্কার করেন আপাহ দূরবর্তী তক্ক সমূহের মধ্যে সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্য। তিরিশের কবিদের মধ্যেই বুদ্ধদেব বসুর কবিতা শরীরের অপরিহার্য অঙ্গরূপে উপমা-উৎপেক্ষা নির্মাণ


কঙ্কা, আমার স্বপ্নের, পরের বন্যার মতো তোমার চুল। সোনার ঢেউয়ের মতো কেশরাশি উঠিছে উচ্ছ্বসি (কখনো)


৩. তোমার সে চুল জড়ানো সুতোর মত। নিশীথের মেঘের মতো


(রাত্রির মতো তোমার চুল (রূপকথা)

উৎপ্রেক্ষা ---

রজনীর নীড়ে ঘুমের পাখিরা উঠেছে জেগে


(সেরেনাদ/কঙ্কাবতী) সমাসোক্তি : গোধূলি রয়েছে শুয়ে পশ্চিমের বালিশে। (কখনো/কঙ্কাবতী) 

রূপক : মাঝরাতে দেখি আকাশের বুকে ঝকমকে তারা আলোর পোকা


(কঙ্কাবতী/কঙ্কাবতী)

অন্যাসক্ত--

বিশাল সাগর পার হয়ে এসে বাতাস পাগল জানালার কাছে চীৎকার করে আবোল তাবোল


বকতে থাকবে-আমরা কবিতা পড়বো যখন।


সারা পৃথিবীতে ঘুরে-ঘুরে যাবে বাতাস পাগল [কবিতা/কঙ্কাবতী]

চিত্রকল্প--


 বিখ্যাত ইংরেজ কবি এজরা পাউন্ডের মতে অজস্র বাজে কবিতা লেখার চেয়ে একটি সার্থক চিত্রকল্প বা ইমেজ রচনা করার মধ্যে কবির কৃতিত্ব বোঝা যায়। রবীন্দ্র গর্বের কবিরা উপমা-উৎপেক্ষা রচনাতে সিদ্ধি অর্জ করেছেন। তিরিশের কবিরা চিত্রকল্প রচনাতে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। "বন্দীর বন্দনা" ও কঙ্কাবতী কাব্যে বুদ্ধদেব বসু চিত্রকল্পের বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। এসব কাব্যে চিত্রল বর্ণনা আছে, টুকরো টুকরো ছবি আছে, কিন্তু ঘনীভূত চিত্রকল্পে যে ত্রিবিধ গুণধর্মের প্রকাশ ঘটে-অপূর্বর্তা প্রগাঢ়তা ও আবেগকল্পনা এখানে তার দেখা পাওয়া যায় না।


“কঙ্কাবতী" কাব্যে চিত্রময়তা থাকলেও চিত্রকল্প অত্যন্ত কম। তবে এ কাব্যেই প্রথম তিনি চিত্রকল্প রচনা করেছেন । নারীর রূপ বর্ণনায় চিত্রময়তা


হেলেনের বুকে দুটি পাকা ফল ভরেছে রসে (কবিতা)


২. তব শরীর-অন্ধকারে বিজলি-লতা, নীল শাড়িতে মেঘের ঘন তমিস্রতা; (আমন্ত্রণ; রমাকে)


৩ দুটি ঠোঁট-ফুরফুরে ঠোঁট, টুকটুক-রঙিন হল (গান) ৪. তোমার লালচে চুল এলোমেলো, শুকনো, নরম


তাই ভালোবাসি (প্রেমিক) কখনো কখনো উপমার পর উপমা সাজিয়ে তিনি সৃজন করেছেন চিত্রকল্প : (ক) এসেছিল যত রূপকথা- রাত ঝরেছে হলদে পাতার মতো, পাতার মত পীত স্মৃতিগুলি যেন এলোমেলো প্রেতের মতো। রাতের আঁধারে সাপের মতন আঁকাবাকা কত (শেষের রাত্রি) (খ) আকাশ ঘুমায় মাথা রেখে কালো মেঘের কোলে কঙ্কাবতী।


মেঘের মুখেতে মুখ রেখে চাঁদ পড়েছে ঢলে কঙ্কাবতী। (সেরিনাদ) অন্ধকার : বুদ্ধদেব বসুর প্রায় সব কাব্যেই অন্ধকার শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। 'অন্ধকার' শব্দটি কামনা, বাসনা, জৈবতা, অন্ধ যৌবন, পাশব বৃত্তি, পাপ বোধ ইত্যাদি প্রতীকী অর্থমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। “কঙ্কাবতী”র কিছুই প্রেমের মতো নয়' 'বিবাহ', এবং 'শেষের রাত্রি' কবিতায় অন্ধকার কামনা বাসনা এবং প্রেমের প্রতীকরূপে রূপায়িত।

(১) অদৃষ্টের অন্তহীন অন্ধকার জ্বলে প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ-সম চুম্বনের বেড়া


ওষ্ঠাধারে আজন্মের অঙ্গীকার জ্বলে। (বিবাহ) (২) তোমারই চুলের মতো ঘন কালো অন্ধকার... -


তোমারই আঁখির তারকার মতো অন্ধকার; তবু চলে এসো মোর হাতে হাত দাও তোমার কঙ্কা, শঙ্কা করো না। (শেষের রাত্রি)


চাঁদ : অন্ধকারের মতোই 'চঁাদ' কিংবা 'জ্যোৎস্না' বিভিন্ন প্রতীকী অর্থমাত্রায় সমৃদ্ধ। চঁাদ কখনো ব্যবহৃত হয়েছে বাসনা-কামনা, যৌবন ও নৈঃসঙ্গ্যের প্রতীকরূপে কখনো স্তন বা নাবিকের প্রতীক হিসেবে।


দৃষ্টান্ত


১. জ্বলেছে নতুন চাঁদ, ঝিলমিল করে ওঠে পালা কাপড় হাওয়ায় হঠাৎ যায় সরে ।


[মেয়েরা/কঙ্কাবতী]


২. বুকের রেখায় চাঁদের কণা.. পূর্ণিমা-চঁাদ বুকের পরে । [রূপকথা]

বিদ্যুৎ : 'বিদ্যুৎ' শব্দটি বুদ্ধদেব বসু নানা অনুষঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি কখনো প্রেম-চাপল্যে, মিলন অনুষঙ্গে, কখনো কামনার দীপ্ত সংস্পর্শে ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে। “কঙ্কাবতী" 'ভবিষ্যৎবানী’ ‘সন্ধ্যায় শান্তি

' প্রভৃতি কবিতায় বিদ্যুৎ অনুষঙ্গে ব্যবহৃত ৷ 

দৃষ্টান্ত : কালো বিদ্যুৎ জ্বলে চক্ষে তোমার

লাল বিদ্যুৎ জ্বলে রক্তে আমার

হে বিদেশিনী ।

[কোনো বিদেশিনীর প্রতি/কঙ্কাবতী]

বুদ্ধদেব বসু শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তৎসম শব্দ বর্জন করেছেন। সাধু ক্রিয়াপদ বর্জন, কথ্য বা বাকরীতির অনুসরণ। কাব্য প্রচলিত ক্রিয়াপদ (যেমন : ফুটতি, হতেছে, চলিছে) বর্জন। প্রাচীন অব্যয়পদ বর্জন করেছেন। তবে যে সব তৎসম শব্দ ব্যবহার করলে রচনার সংহতি ও দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায় সেগুলো গ্রহণ করেছেন। তবে 'কঙ্কাবতী' কাব্যে কাব্যিক শব্দ, সাধু ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন। কথা ক্রিয়াপদ ও কথ্যরীতির মিশ্রনের দু একটি দৃষ্টান্ত নিম্নে প্রদর্শিত হলো (ক) হলদে শাড়িটা—না, না, হলদে আলোয়


যাবে নাকো দেখ ওর রং লাল? না বড্ড চড়া! নীল, তা ও না, খয়েরিটা মানাবে বরং।

['বেহায়া/কঙ্কাবতী]

(খ) জ্বলেছে নতুন চাঁদ, ঝিলমিল করে ওঠে পালা কাপড়, হাওয়ায় হঠাৎ যায় সরে।।

[মেয়েরা/কঙ্কাবতী]

(গ) কালো চোেখ তার পড়েছিলো মোর মুখের পরে,

ক্ষনেক তরে,

কে যে সে, সে-কথা করো না।

 ছন্দ ----

‘কঙ্কাবতী’ কাব্যে কবি মাঝে মাঝে দ্বিরুক্তবাচক শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন : ‘লাল পেড়ে শাড়ি পরে আসে যদি হাসিতে হাসিতে' (সুখান্বেষী) কিংবা “পেয়ালা ফুরিয়ে আসে, মুহূর্তে মুহূর্তে কেউ যায়; (মধ্যবর্তী)।

এই কাব্যে কখনো তিনি শব্দের পৌনঃপুনিক ব্যবহার বিশেষ ভাবমন্ডল তৈরি করেছেন

আঁকাবাঁকা মেঘ, একা বাঁকা চাঁদ, বাঁকারেখা চঁাঁদ জলের নিচে আঁকাবাঁকা জল, একা বাঁকা চাঁদ, আকাশ ফাঁকা (কঙ্কাবতী)

“কঙ্কাবতী” কাব্যে বুদ্ধদেব বসু বেশির ভাগ কবিতা মুক্তক অক্ষরবৃত্ত

রচনা করেছেন। এ কাব্যে কথ্য শব্দের ব্যবহারের ফলে সঞ্চারিত হয়েছে।

স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাভাবিকত্ব, সমর্থ বাক্যম্পন্দের ব্যবহারে প্রাণ পেয়েছে করিব অস্ত

গর্ত আবেগ।


এ কাব্যে তিনি অক্ষরবৃত্তে দীর্ঘ পংক্তি রচনা করেছেন। পংক্তিটির মাত্রা

সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি বৈচিত্র্য সৃজন করেছেন। এই মাঝে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ও

স্বরবৃত্তছন্দের প্রয়োগ করেছেন।

অক্ষরবৃত্ত : মোরে ক্ষমা করো প্রেম! তোমারে করেছি উপহাস,

তীব্র বিদ্রূপের তীর করিয়াছি তোমারে সন্ধান,


উড়ায়ে দিয়েছি ঊর্ধ্বে-বিদ্রোহের যুদ্ধের নিশান;

খর-তরবারি-সম ঝলসিত তীক্ষ্ণ অবিশ্বাস। [ক্ষমাপ্রার্থনা]


মাত্রাবৃত্ত : আঁধার ধরনী, যামিনী নিঝুম, আকাশ কালো

তিমির ভেঙেছে রাঙা ভাঙা চাঁদ- তামার আলো ।

[সেরেনাদ]


সহায়ক গ্রন্থ



১. আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়- দীপ্তি ত্রিপাঠী

২. আধুনিক কবিতার দিগ্বিলয়-অশ্রুকুমার সিকদার


৩. বুদ্ধদেব বসুর কবিতা : বিষয় ও প্রকরণ- মাহবুব সাদিক


৪. কালের পুতুল: বুদ্ধদেব বসু

৫. আধুনিক বাংলা কবিতা প্রাসঙ্গিক ও পরিপ্রেক্ষিত : ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ