Hot Posts

6/recent/ticker-posts

নরেন্দ্রনাথ মিএের ছোট গল্প আলোচনা

 

নরেন্দ্রনাথ মিএের ছোট গল্প আলোচনা ---
রস---

রস (১৩৫৪) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের মধ্যে অন্যতম। এটি এওটি প্রেমের গল্প। গল্পে প্রেম থাকলেও গল্পের পরিণতি যায়। গল্পের প্রধান চরিত্র তিনটি। এবং মোতালেফের সঙ্গে মাজুভূনের এবং ফুলবানুর প্রেম কাহিনির বিস্তার সামান্য। সামান্য বিস্তৃত প্রেমের কাহিনি গল্প প্রভাবকের এবং নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছে।

মোতালেফ শীতকালে খেজুরের গাছ কাটে। গাছ কেটে রসের যে ভাগ পায় তা থেকে গুড় তৈরি করে ঘটে বিক্রি করতে না পারলে গাছ কাটায় কোনো লাভ নেই। মোতালেফের বয়স পঁচিশ-ছাব্্বিশ । বিয়ে করেছিল; বউ বছরখানেক আগে মারা গেছে। বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিল। সুন্দর মেয়ে বিয়ে করতে গেলেই পণ দিতে হয় অনেক টাকা। এত টাকা তার সাধ্যে নেই। সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয় তার এলেম সেরে মেয়ে ফুলবানুকে। এলেম সেষ পাঁচকুড়ি টাকার কমে মেয়ে বিয়ে দেবে না। ফুলবানুর আর একবার বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি বলে স্বামীকে ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে এসেছে। এলেম সেখের অনেক টাকা দাবি করায় সে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিল। পথেই দেখা হয় ফুলবানুর সঙ্গে। ফুলবানু নিজেই দেখা করার ব্যবস্থা করেছে। সেখানে মোতালেফ-ফুলবানুর প্রথম প্রেমালাপ লক্ষ করা যায়। ফুলবানু মোতালেফের কাছে জানতে চায় বাবার কথায় সে রাগ করে চলে যাচ্ছে কিনা। মোতালেফ তার বাবার ব্যাপারে অধিক টাকা দাবি করার অভিযোগ এনে ফুলবানুকে ধামায় উঠে হাটে বাজারে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে রাগ করে চলে যাচ্ছিল –

মোতালেফের রাগ দেখে হাসল ফুলবানু, ক্যাবল ধামায় ক্যান, পালায় উ বসব। মুঠ ভইরা ভইরা সোনা জহরত ওজন কইরা দেবা পালায়। বোঝব ক্ষেমতা, বোঝব কেমন পুরুষ মাইনষের মুঠ।

মোতালেফ হন হন করে চলে যাচ্ছিল। ফুলবানু ফের ডাকল পেছন থেকে ও সোন্দর মিঞা, রাগ করলানি? শোন শোন মোতালেফ ফিরে তাকিয়ে বলল, 'কি শোনাবা?'

এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আরো একটু এগিয়ে এল ফুলবানু, 'শোনবা আবার কি. শোনবা মনের কথা। শোন, বা-জানের মাইয়া টাকা চায় না, সোনা দানাও চায় না, কেবল মান রাখতে চায় মনের মাইনষের। মাইনসের ত্যাজ দেখতে চায়, বুঝছ।”

শীতের মাস ক'টা ফুলবানুর কাছে সময় চেয়ে নেয় মোতালেফ। এলেম সেখের কথায় হতাশ চিত্তে ফিরে যাচ্ছিল মোতালেফ। কিন্তু ফুলবানুর কথায় মুগ্ধ হয়ে ফুলবানুকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে যায়। যে করেই হোক মোতালেফ ফুলবানুকে বিয়ে করবেই। পাঁচকুড়ি টাকা সংগ্রহের চেষ্টায় সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অনেকের কাছে ধার চেয়ে দেখল

টাকা মিলছে না। মনে মনে একটি দুরভিসন্ধি অটল মৃধার ে করবে সে। রাজেক মৃধার বিধবা স্ত্রী মাজুখাতুন ভালো গুড় তৈরি করতে পারে। ি ও মাজুখাতুনপর নিকট থেকে গুড় তৈরি করে নেওয়া যায় তাতে খরচ বেশি। মাজুখাতুনের বয়স প্রায় ত্রিশ। একটি মেয়ে ছিল বিয়ে হয়েছে তার। মোতালেফের কাটায় যে সুনাম অর্জন করেছিল তা রাজেক ঘৃধার কাছে গাছ কাটা শিখে। মাজুবাতুন নিজের বয়স এবং সৌন্দর্যের কথা বিবেচনা করে মোতালেফের বিয়ের প্রস্তাবে বিস্মিত


প্রস্তাব শুনে মাজুখাতুন প্রথমে অবাক হয়ে গেলে, তারপর একটু ধমকের সুরে বলল, রঙ্গ তামাসার আর মানুষ পাইলানা তুমি। ক্যান, কাঁচা বয়সের মাইয়া পোলার কি অভাব হইছে নাকি দেশে যে তাগো থুইয়া তুমি আসবা আমার দুয়ারে। মোতালেফ বলল, 'অভাব হবে ক্যান মাজুবিৰি। কম বয়সী মাইয়া পোলা অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু শত হইলেও, তারা কাঁচা রসের হাঁড়ি ।' কথার ভঙ্গিতে একটু কৌতুক বোধ করল মাজুখাতুন বলল, সাচাই নাকি। আর

আমি?

তোমার কথা আলাদা। তুমি হইলা নেশার কালে তাড়ি আর নাস্তার কালে গুড়!!

তোমার সাথে তাগো তুলনা? “ মাজুখাতুন মোতালেফের বিয়ের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বিয়ে করে। মোতালেফ গাছ কেটে রস আনে। মাজুখাতুন অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাজারের সেরা গুড় তৈরি করে। অন্য গুড়ের চেয়ে বেশি দরে সে গুড় বিক্রি হতে লাগল। মোতালেফ গাছ কাটে, গুড় বিক্রি। করে আর ফুলবানুর কথা ভাবে। গুড় বিক্রি করে কিছু টাকা হাতে জমা হতেই পাঁচকুড়ির অর্ধেক টাকা, রস এবং কিছু গুড় নিয়ে মোতালেফ চলে যায় ফুলবানুর বাড়িতে। এলেম সেখকে পনের টাকার অর্ধেক দিতে গেলে এলেম সেখ সতীনের ঘরে মেয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ কথা শুনে,

মোতালেফ মুচকে হাসল। বলল তার জন্যে ভাবেন ক্যান মেঞা সাব। গাছে রস যদ্দিন আছে, গায়ে শীত যদ্দিন আছে, মাঞ্জু খাতুনও তদ্দিন আছে আমার ঘরে। দখিনা বাতাস খেললে সব সাফ হইয়া যাবে উইড়া ॥

মোতালেফের যেমন কথা তেমন কাজ। গুড় তৈরির কাজ শেষ হতেই অপবাদ দিয়ে মাজুখাতুনকে তালাক দিয়ে ফুলবানুকে বিয়ে করে। মাজখাতুনের সঙ্গে রাজেক মৃধার বড় ভাইয়ের সম্পর্কের অপবাদ দেয় মোতালেফ। মাজুখাতুনের আবার বিয়ে হয়। বিয়ের ব্যবস্থা করে রাজেকের বড় ভাই ওয়াহেদ । বর নাদির শেখ । নাদির শেখের বয়স পঞ্চাশ-একান্ন বছর। স্ত্রী কলেরায় মারা গেছে। অনেকগুলে ছেলেমেয়ে রেখে গেছে। নাদির শেখের বয়স কিংবা মাতৃহীন এতগুলো সন্তান মাজুখাতুনের জন্য সমস্যা নয়।

মাজুখাতুন শুধু জানতে চায় নাদির শেখ মোতালেফের মতো পাজি কি না। ি যেকোনো কাউকেই মাজুখাতুন বিয়ে করতে সম্মত। মাজুবাতুন নাদির শেখকে বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করে।

মোতালেফ ফুলবানুর দাম্পত্যজীবন ভালোই কাটছিল। মোতালেফা ফুললবানু ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। ফুলবানুর জন্য হাট থেকে নিত্য নতুন জিনিস, খাবার নিয়ে আসে। সবার কাছে ফুলবানুর প্রশংসা করে বেড়ায়। ফুলবানুকে ডাকে ফুলজান করে। ফুলবানুকে অতিরিক্ত কোনো কাজ করতে দেয় না। ফুলবানুও মোতালে ভালোবাসায় মুগ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু বছর ঘুরে যখন আবার শীত এলো তখনি ছেদ পড়ল তাদের প্রীতির বন্ধনে। অন্যান্য বছরের তুলনায় মোতালেফ সে বছর অনেক খেজুর গাছ পেয়েছিল। মোতালেফ মনোযোগ সহকারে সেই গাছ থেকে রস নিয়ে আসে। ফুলবানুকে বলে শুড় বানাতে। ফুলবানু ভালো গুড় বানাতে পারে না। খারাপ শুড় হাটে বেঁচতে গেলে লোকে কিনতে চায় না। এক হাটে গত বছরের বিশ্বাস থেকে মোতালেফের গুড় কেউ কিনলেও পরের হাটে এসে সে গুড়ের বদনাম করে। মোতালেফ তার সুনাম রক্ষা করতে তৎপর হয়। ফুলবানুকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয় কিন্তু ভালো গুড় তাতেও হয় না। একদিন ফুলবানু রস জ্বাল করতে দিয়ে স্নানে গিয়েছিল আর সেই সময় মোতালেফ দেখে গুড় পুড়ে যাচ্ছে তখন ফুলবানুকে বেদম প্রহার করে। মোতালেফের এ আচরণের পর থেকে ফুলবানুর সঙ্গে তার একটি দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। মাজুখাতুনকে সে ছলনা করে ভুলিয়ে বিয়ে করেছিল। আবার সেই মাজুখাতুনকেই তার মনে পড়ে। মাজুখাতুনের প্রতি মোতালেফের সুপ্ত ভালোবাসা অনুভব করা যায়। রাতে বিছানায় শুয়ে মোতালেফ ফুলবানুকে গুড় জ্বাল করার ব্যাপারে কৌশলটা আবার শেখানোর চেষ্টা করে। ফুলবানু এতে খুব বিরক্ত হয়। তখন মাজুখাতুনের কথা স্মরণ করে মোতালেফ।

“একদিকে ভালো গুড় তৈরি না হওয়ার কষ্ট অন্যদিকে মাজুখাতুনের স্মৃতি মোতালেফের মানোজগতে প্রভাব ফেলে। ফুলবানুর সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ হয়। মোতালেফ ফুলবানুকে প্রহার করার পর ফুলবানুর বাবা এসে মোতালেফ ফুলবানু দুজনকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ফুলবানুর কাছে মোতালেফের গুরুত্ব কমতে দেখে মোতালেফ ফুলবানুকে আর মাত্র দুমাস কষ্টের কথা বলে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। রূপের প্রতি আসক্তি কেটে যায় মোতালেষ্ণের । সে সংসারে গুড় তৈরিতে স্ত্রীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। তখন তার মধ্যে ফুলবানু, মাজুখাতুনের তুলনা চলতে থাকে। মাজুখাতুনের প্রতি মোতালেফের গভীর উপলব্ধি লক্ষ করা যায়। মোতালেফ মাজুখাতুনের শূন্যতা

তীব্রভাবে উপলব্ধি করে। একহাটে মোতালেফের সঙ্গে মাজুখাতুনের শেখের দেখা হয়। নিজের ওড়ের বদনাম মোতালেক নিজেই করে। তারপর একে শুড় নালির শেখকে বিনামূল্যে জোর করে দেয়। মাজুখাতুন নাদির শেখের বিনামূল্যে জুড় নিয়ে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়। এই ঘটনার কয়েকদিন পর মোতালেফ দুই হাঁড়ি ভালো রস নিয়ে উপস্থিত হয় নাদির শেখের বাড়িতে। মাজুখাতুনের নিকট ভালো শুড় কীভাবে। বানাতে হয় তাই শিখে নিতে। মাজুখাতুন মোতালেফের উপস্থিতি দেখে উচ্চবাচ্য আ করে। নাদির শেখকে বলে মোতালেফ যেন এক্ষণি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। মাজুখাতুন। মোতালেফকে শুনিয়ে শুনিয়ে উচ্চকণ্ঠে তিরস্কার করছিল


নরেন্দ্রনাথ মিত্র রস গল্পে মোতালেফের সঙ্গে মাজুখাতুনের বিচ্ছেদ দেখিয়েছেন। কিন্তু প্রেমের ধারাকে রেখেছেন সচল।মাজুখাতুন মোতালেফকে ভুলতে পারেনি। লেখকের বক্তব্যে তা অনুমান করা যায়। ছানের খোঁচায় নলের ভিতর দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রস'- এ উক্তির মধ্যে মোতালেফের জন্য কতখানি কাতর তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন মোতালেফ মাজুখাতুনকে দেখতে পায় অশ্রুসিক্ত অবস্থায় । দীর্ঘদিন পর মাজুখাতুন দেখতে পেয়েছে মোতালেফকে। মোতালেফের দুঃখের কথা শুনে মাজুখাতুন ব্যথিত হয়েছে। মোতালেফ তার ভালো গুড়ের সুনাম উদ্ধার করতে সমস্ত লজ্জা বিসর্জন দিয়ে মাজুখাতুনের শরণাপন্ন হয়েছে। মজুখাতুনের অশ্রুসিক্ত অবস্থা দেখে মোতালেক থমকে যায়। হুঁকা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে । নাদির শেখ হুকোঁর আগুন নিভলো কিনা জিজ্ঞাসা করতে মোতালেফ না মেঞাভাই, নেবে নাই উত্তরের মধ্য দিয়ে গল্পের সমাপ্তি। 'না মেঞাভাই নেবে নাই বাক্যটি গল্পটিকে প্রেমের গল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা দান করেছে। গল্পকারের ইঙ্গিতধর্মী এই বাক্যের মধ্যে মাজুখাতুন মোতালেফের প্রেমের অবিচ্ছেদ্য রূপটি ধরা পড়ে।

এই গল্পে দুটো প্রেমের কাহিনি। ফুলবানু মোতালেফের প্রেমের সম্পর্কে অনেকখানি অংশজুড়ে আছে রূপের মোহ। আর মাজুখাতুন এবং মোতালেফের প্রেমে জীবনের তাগিদ পরিলক্ষিত হয়। এ গল্পে মোতালেফের অস্তিত্বের সঙ্কট যথেষ্ট শক্তিশালী। ফুলবানুর সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতির নেপথ্যে মোতালেফের অস্তিত্বের সংকট নিহিত। ভালো গুড় যদি সে তৈরি করতে পারত তাহলে তার গত বছরের সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকত। তখন ফুলবানুর সঙ্গে মোতালেফের বিরোধের সূত্রপাত হতো না। একজন গাছি হয়ে মোতালেফ সব শ্রেণির মানুষের মুখে নিজের গুড়ের প্রশংসায় যে তৃপ্তি অনুভব করত সেই প্রশংসা তার আর নেই। মোতালেফের ভালো গুড়ের অস্তিত্ব রক্ষা করতে তাই মাজুখাতুনের দ্বারে গিয়ে উপস্থিত হয়। গল্পের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে মোতালেফের

অস্তিত্ব সংকট বিস্তৃতি লাভ করেছে। ত্রিমাত্রিক প্রেমে মোতালেফের মানসিক টানাপড়েনের সঙ্গে তার অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা গল্পটিকে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা দান করেছে।

পালঙ্ক -----


 পালঙ্ক (১৩৫৯) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সেরা গল্পের পর্যায়ের একটি গল্প। নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচিত গল্পগুলোর মধ্যে দেশবিভাগের নানান অনুষঙ্গ নিয়ে যে কয়েকটি গল্প আছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে পালঙ্ক। তবে পালঙ্ক গল্পের মূল সুর হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। গল্পকার দেশবিভাগের ফলে সৃষ্ট সমস্যা এবং অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে সূক্ষ্মভাবে সমন্বয় ঘটিয়েছেন মনস্তত্ত্বের গল্পটিতে কখনো দেশবিভাগ সৃষ্ট জটিলতা, কখনো অর্থনৈতিক সমস্যা আবার কখনো এ দুই সমস্যাই এক অভিন্নমাত্রায় বিকাশ লাভ করেছে । মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার প্রয়োগ ঘটেছে প্রতিটি মাত্রায়।


রাজমোহন রায় পালঙ্ক গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। দেশবিভাগের সময় আত্মীয়, স্বজন, ছেলের পরিবার সকলে কলকাতায় স্থায়ীভাবে চলে যায়। রাজমোহন রায় জন্মভূমির মায়া ছাড়তে পারেননি। তিনি জন্মভূমিকে ভালোবেসে পূর্ববঙ্গকে আঁকড়ে ধরে থাকেন । তিনি মানুষের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াতে ব্যথিত হয়েছেন; ছেলে সুরেনের দেশত্যাগে মর্মাহত হয়েছেন। ছেলে এবং পিতা দুজন দুই দেশের বাসিন্দা। রাজমোহন ছেলের স্মৃতিচারণ করতে করতে ভাবেন নিজের লাগানো দেবদারু গাছের কথা —

জোলো হাওয়া দিচ্ছে। বাড়ির দক্ষিণ সীমান্তে দেবদারু গাছটার পাতা সেই হাওয়ায় অল্প অল্প নড়ছে। কত বড় হয়েছে দেবদারু গাছটা! রাজমোহন নিজের হাতে পুঁতে ছিলেন এই গাছ। ঠিক সুরেনের বয়স গাছটার। সুরেনের মতোই গাছটা রাজমোহনের চোখের সামনে বেড়েছে। কিন্তু তার সম্মুখ থেকে সরে যায়নি। অনেক আপন, সে শত্রুরের চাইয়া, তুই আমার অনেক আপন দেবদারু । তোর হিন্দুস্তান পাকিস্তান নাই । লেখাপড়া শিইখা তুই পর হইয়া যাইস নাই। তুই আমার মতোই ভিটামাটি আকড়াইয়া রইছিস। তোর মতো আপন আমার কেউ না, সংসারে কেউ

না 

সুরেন কলকাতায় স্বল্প আয়ে সংসার ভালো চালাতে পারছিল না। চার সন্তানের খাবার সুবন্দোবস্ত হয়নি। মেঝেতে তারা ঘুমায়। রাজমোহন সংসারের কোনো জিনিস বিক্রি করে সুরেনের জন্য টাকা পাঠাতে রাজি নয়। সুরেনের স্ত্রী তাই বিয়ের সময় তার দাদুর দেওয়া পালঙ্কখানা বিক্রি করে টাকা চেয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে রামমোহনের কাছে।

টাকায় তারা সভানের জন্য বিছানার ব্যবস্থা করবে। সুরেনের স্ত্রী অসীমার প ও সেবা বা সংক্ষেপে লিখে দিয়েছে। রাজমোহনের আত্মাকে আঘাত করেছে অসীমার চিঠির বিষয়বস্তু। অসীমার বিয়ের কোনো কিছুই তার যায়নি শুধু পালন ছাড়া সেই পালজি করে আবার টাকা চেয়ে এতে করে ও হন। অসীমার চিঠি পাওয়া মাত্রই রাজমোহন বাড়ির কাজের লোক দিয়ে ঘর থেকে পালংখানা বের করেন। রাগে ক্ষোভে গর্জে ওঠেন বুদ্ধ রা ক্রেতা থাকলে তখনি পালঙ্ক করে মনিঅর্ডার করতে চান মজুর পালঙ্ক কিনতে চায়। পালঙ্কখানা দেখতে খুবই সুন্দর আগাগোড়া সেন কাঠ তৈরি। চারিদিকে চারটি পায়ায় বড় বড় বাঘের থাবা। হাত খানেক চড়া সুন্দর নক্সার কাজ। উপরে লতা, নিচে পতা। মাঝখানে সুদীর্ঘ ছোট ছোট সারি।

অন্ধরাগের বশে জিদ করে মকবুলের কাছে মাত্র পঞ্চাশ টাকায় পালঙ্কখানা রাজমোহ জলের দামে বিক্রি করে দেন। মকবুল এক টাকা এক টাকা করে জমানো পালঙ্ক কিনে নিয়ে বাড়ি যায়।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র পালঙ্কখানাকে ঘিরে আবর্তিত করেছেন গল্পের কাহিনি। সুরেনের "অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পালঙ্কখানা বিক্রি করতে বলেছে। মকবুলের চরম অর্থনৈতিক দুরাবস্থা সত্ত্বেও সে পালঙ্ক কেনে এবং শত চেষ্টা করেও আর তা উদ্ধার করা যাচ্ছিল না। উলঙ্কখানাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের শক্তি খর্ব হওয়ার ঘটনা জানা যায়। রাজমোহনের মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি হয় এ পালঙ্ককে ঘিরে। পালঙ্কখানা অসীমার দাদুর দেওয়া বটে, কিন্তু পালঙ্কখানার দিকে চেয়ে রাজমোহন প্রতিদিন একবার করে অন্তত ছেলে-বউ, নাতি-নাতনিদের কথা স্মরণ করেন। সেই পালঙ্ক বিক্রি করার কথা উঠলে রাজমোহনের মানসিক আঘাত পাওয়াটা স্বাভাবিক। রাজমোহনের রাগ দূর হবার পর বুঝতে পারেন পালঙ্কখানা বিক্রি করে তিনি ভালো কাজ করেননি। রাজমোহন সারাজীবন কোনো জিনিস বিক্রি করেননি, শুধু কিনেছেন। সেই রাজমোহন মাত্র পঞ্চাশ টাকায় পালঙ্কখানা বিক্রি করার পর অস্থিরতায় ভুগতে থাকেন। পালঙ্ক ফিরিয়ে পাওয়ার জন্য মকবুলকে ডেকে পাঠায়। মকবুল আর আসে না। অথচ মকবুল রাজমোহনের বাড়িতে সামান্য কাজের লোক মাত্র। রাজমোহন নিজেই যায় মকবুলের বাড়ি। পালঙ্কখানা ফেরত চায়, সে অনিচ্ছা পোষণ করে। পালঙ্ক বিক্রিতে রাজমোহনের মানসিক যন্ত্রণার অনেক কারণ আছে। প্রথমত, পালঙ্কের সাথে ছেলের স্মৃতি জড়িত , দ্বিতীয়ত রাজমোহনের পালঙ্ক বিক্রিতে মানসম্মানে আঘাত পড়েছে, তৃতীয়ত মাত্র পঞ্চাশ টাকায় পালঙ্কখানা বিক্রি করে বোকামির পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

তাই পালঙ্ক উদ্ধারে তৎপর হয়। রাহজমোহন  আর খেত পায় না। ওইনার লোক ছিল। রাজমোহন নিজের বাড়িতে সালিশের ব্যবস্থা করে। দেশবিভাগের আগে রাজমোহনের অনেক প্রভাব ছিল। দেশবিভাগের পর মুসর্দি অধ্যুষিত এলাকার দু বলে প্রত্যব আর খাটাতে পারে না। সালিশে মকবুল পালংক দিতে অস্বীকৃতি জানায়। নরেন্দ্রনাথ মিত্র সালিশের মাধ্যমে দেশবিভাগ পরবর্তী পূর্ববঙ্গের মুসলমান হিন্দুদের সহাবস্থানের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সালিশে গেদুমুলি রাজমোহনের আন্তরিকতার প্রশংসা করে পালঙ্ক ফেরত দিতে বললে মকবুল অস্বীকৃতি জানায়। মকবুলের কথা হচ্ছে সে টাকা দিয়ে পালঙ্ক কিনেছে, তাই পালঙ্ক সে দেবে না। রাজমোহন বলছিলেন। সামান্য পঞ্চাশ টাকা এ পালঙ্কের দাম হতে পারে না। শরৎশীল মকবুলকে পালঙ্ক ফেরত দিতে বলে নয়তো আরো একশ টাকা দেওয়ার কথা বলে। শরৎশীলের এ কথায় হিন্দুদের সমর্থন মিললেও মুসলমানেরা চুপচাপ থাকে। গেদুমুন্সি মকরুলকে বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বুঝে সিদ্ধান্ত জানাতে বলে। রাজমোহনের কথার অবাধ্য হওয়ার মতো কেউ ওখানে ছিল না। দেশবিভাগ রাজমোহনের শক্তি কমিয়ে দিয়েছে। মকবুলের সাহস কিংবা স্পর্ধা ছিল না। রাজমোহনের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু মুসলমানেরা একজোট হয়েছে। রাজমোহনের মৃত্যু হলে মুসলমানেরা তার বাড়ি-ঘর, সম্পত্তি সব দখল করবে এ অপেক্ষায় তারা আছে। কবুল পালঙ্ক কিনে নিয়ে যাওয়ার সময় ইয়াকুবকে তাই বলেছল টাকা দিয়ে পালঙ্ক না কিনলেও রাজমোহনের মৃত্যুর পর বিনামূল্যে দখল নিতে পারত। মুসলমানদের জোটের কথা বিবেচনা করে রাজমোহন কথা না বাড়ালেও পালঙ্ক উদ্ধারের চেষ্টা থেকে বিরত হলেন না,


জীবনে কিছুই বিক্রি করেননি রাজমোহন। শুধু একটা জিনিস ছাড়া। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল রাজমোহনের। কেন করলেন- কেন বিক্রি করলেন পালঙ্কখানা? হঠাৎ তাঁর এ কী মতিভ্রম হলো। জিনিসটা আর কি তিনি উদ্ধার করতে পারবেন না? এতজনের এত জায়গা-জমি তিনি উদ্ধার করে দিয়েছেন। আর ভুল করে বিক্রি করা নিজের জিনিসটা তিনি উদ্ধার করতে পারবেন না। নিশ্চয়ই। পারবেন। তাঁকে পারতেই হবে।”

রাজমোহনের বাড়ির পাশেই মকবুলের বাড়ি। রাজমোহন কীভাবে মকবুলকে অসুবিধায় ফেলতে পারে তা চিন্তা করে। কিন্তু অন্যায়ভাবে মকবুলকে বিপদে ফেলতেও রাজমোহনের ইচ্ছে হলো না। তবুও সামান্য যা করলেন তাতেও মকবুলের সংসার মরতে বসে। মকবুলের কাছ থেকে দুধ কিনতেন রাজমোহন। সেটা বন্ধ করলেন। গরিব মুসলমানদের পাড়ায় তেমন কোনো কাজ নেই। রাজমোহনের বাড়িতে কাজ করে তার সংসার কোনরকম চলত। রাজমোহন মকবুলকে আর কোনো কাজেও ডাকেন না। 

অভাবী মকবুলের অভাব তাকে ভাবে ঘিরে ধরে। সুহ ছেলে শুড়িয়ে যায়, মকবুলের ফতেমা বারবার রাজমোহনের পা নিয়ে আসতে বলে। রাজমোহনের কাছ থেকে মার কোনো সাধ প রাজমোহনকে ঘন করার সয়ে করে। কিন্তু তার সাহস হয় না। রাজমোহনের থেকে সুপারি, ডাব, নারিকেল চুরি করতে লাগল। রাজমোহন টাকা দিয়ে পাহারাদার নিযুক্ত করলেন। মকবুলের কষ্টের সীমা থাকে না,

সুপারি চিবিয়ে আর নারকেলের জল খেয়ে তো আর পেট ভরে না। মকবুল ফাঁপরে পড়ে গেল। বর্ষার এই সময়টাই সব বছরেই কষ্টে কাটে। কাজকর্ম থাকে। . রোজগার পত্রও থাকে না। ধান চাল তেল ডালের দাম আক্রন হয়। কিন্তু যেন কষ্টের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। পাটের খন্দ শেষ হয়েছে। এ আসেনি। এই সময় সকলেই বেকার। থৈ থৈ বর্ষা। সকলেরই ঘরে । হাড়িতে চাল নেই। সকলেরই কণ্ঠ। তার মধ্যে মকবুলের কণ্ঠ সবচেয়ে বেশি। দু চার টাকা যা সঞ্চয় করেছিল পালঙ্কের পিছনে গেছে। এখন একেবারে খালি পেট একেবারে খালি। পিঠের সঙ্গে তার দিনরাত ছেলেমেয়েগুলো দাপাদাপি করে, বউ-এর ঝগড়ার চোটে বাড়িতে টেকা যায় না।। নিজের ছেলেমেয়েদের খাদ্য নিজেই জোগাড় করে ফাতেমা। দুমুঠো ক্ষুদের সঙ্গে একরাশ শাপলা সিদ্ধ করে, কোনোদিন বা একঝাকা কচু । আঁচল দিয়ে খালের ঘাট

থেকে টাকির পোনা ধরে, চিংড়ি মাছ ধরে আনে।

মকবুল চরম অর্থসঙ্কটে বাধ্য হয়ে দুধের গাভি বিক্রি করে। ভাঙা ডিঙি ছিল তাও বিক্রি করে। নতুন ছই-ওয়ালা একটা নৌকা কেনে। সেই নৌকা থেকে ভালো আয় হয়। কোনো কোনদিন যাত্রীর অপেক্ষায় সারাবেলা কেটে যায় ৷ শূন্য হাতে বাড়ি ফেরে অনেক রাতে। একদিন শেষ ভরসা নৌকাখানা চুরি হয়ে যায়। তাঁর বাঁচতে হলে বেচতে হবে পালঙ্ক অথবা থাকার ঘরখানি। রাজমোহন পালঙ্কের কথা ভুলতে না পেরে একদিন নিজের চাকরকে দিয়ে ষাট টাকার বিনিময়ে পালঙ্ক ফেরত চেয়েছিল। তাতেও সে রাজি হয়নি। রাজমোহন নিজের কাসির অভিনয় করে মকবুলের বাড়িতে গিয়ে পালঙ্কখানা দেখে আসেন। বসাকপাতা চেয়ে রাজমোহন বসেন বারান্দায়

বসে ঝাপের ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে তাকালেন। ব্যথায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তাঁর পালঙ্ক তাঁর পালঙ্ক। কিন্তু কি দশাই না করে রেখেছে জিনিসটার! অমন সুন্দর সুন্দর নক্সা করা পায়াগুলোকে তেল মেখে চুন মুছে একেবারে নষ্ট করে ফেলেছে। আর উপরে সেই তেল-চিটচিটে চিতার ছেঁড়া কাঁথা আর বালিশগুলো। ছি ছি ছি! এত দামি জিনিস কি ওদের ঘরে মানায়। এসব জিনিসের যত্ন কি ওরা

জানবে। অসুস্থতার

অভিনয় করে প্রায় প্রতিদিন সক করে পালঙ্ক দেখতে

আসতে শুরু করলেন । 

। খবর পেলেন রাজমোহন- নৌকা হারানোর পর মকবুল এবার আতালন্দির

নিকট পালঙ্ক বিক্রি করবে । আতাজদ্দি সন্ধ্যার পর টাকা আর নৌকা নিয়ে এসে পালঙ্ক

তুলে নিয়ে যাবে।


নরেন্দ্রনাথ মিত্র পালঙ্কখানার জন্য রাঞ্জমোহন এবং মকবুশলের গভীর টানাপড়েন এ গল্পে

তুলে ধরেছেন। রাজমোহন অসুস্থ, রাতের বেলা ভালো চোখে দেখেন না। আকাশে

মেঘ। বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা হ্যারিকেন কোনো কিছুই না নিয়ে পাগলের মতো ছুটে যান

মকবুলকে ধরার জন্য। মকবুল তাঁর পালঙ্ক তাকে না দিয়ে বিক্রি করছে আতাজদ্দির

কাছে। এটা রাজমোহনের পক্ষে আর সহ্য করার মতো নয়। ধমকের সুরে মকবুলকে

ডেকে ঘর থেকে বের করে জানতে পারেন পালঙ্ক সে বিক্রি করেনি। আতাজদ্দি একশত

ষাট টাকা দাম করেছিল তবুও মকবুল পালঙ্কখানা তাকে দেয়নি। হঠাৎ করে মকবুলের

শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছিল। ফতেমা ক্ষুধার কষ্টে পালঙ্ক বিক্রির জন্য কান্নাকাটি

করেছে। তবুও মকবুল একটা রাতের জন্য পালঙ্কখানা ধরে রেখেছে। পরের দিন সেপালঙ্কখানা রাজমোহনকে ফেরত দেবে সেই কারণে। রাজমোহনের প্রতি মকবুল আবারআগের মতো আন্তরিক হয়। বৃষ্টিতে ভিজে রাজমোহনকে আসতে দেখে হাত ধরে ঘরেনিয়ে যায় মকবুল। তখন তার গায়ে জামা ছিল না, পায়ে সেন্ডেল ছিল না, চোখে চশমা

ছিল না, সামান্য একটু নেংটি পরানো গায়ে ভীষণ জ্বর। মকবুল রাজমোহনের জন্যপালঙ্ক রেখে দিয়েছে শুনে রাজমোহন বিস্মিত হয়,তারপর কেউ আর কোনো কথা বলল না। ফতেমা ঠিক তেমনি করে কেরোসিনের

ডিবাটা দুজনের সামনে ধরে রইল। আর সেই ধোঁয়া ওঠা ক্ষীণ দীপের আলোয়

মুহূর্তকাল দুই যুগের দুই পালঙ্ক প্রেমিক, দুই জাতের দুই পালঙ্ক প্রেমিক, ধলা আরকালো দুই রঙের দুই পালঙ্ক প্রেমিক অপলকে তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকেএরপরই মকবুল পালঙ্কখানা রাজমোহনকে খুলে দিতে ব্যস্ত হয়। রাজমোহন পালঙ্কনিতে অসম্মত হয়। পালঙ্কখানা রাজমোহনের শূন্য পড়ে থাকবে। কিন্তু মকবুলের কাছেপালঙ্কের ওপর তার দুটো সন্তান শুয়ে আছে। এই সৌন্দর্যে রাজমোহন মুগ্ধ হন এবংপালঙ্কখানা ফেরত নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।নরেন্দ্রনাথ মিত্র অনেক ছোটগল্পেই চরিত্রের মধ্যে স্ববিরোধী স্বভাব সৃষ্টিতে সিদ্ধ হস্ত।কোনো একটি সামান্য কার্য-কারণ যৌক্তিকভাবে এই স্ববিরোধী মনোভাব সৃষ্টিতেসহায়তা করে। পালঙ্ক গল্পের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ মিত্র অকস্মাৎ রাজমোহন এবং মকবুলেরমধ্যে একটি নতুন মনোভঙ্গির সন্ধান দিয়েছেন। সমস্ত গল্পজুড়ে পালঙ্কখানাকে ঘিরে যে

আলোড়ন সে আলোড়ন গল্পের পরিণতিতে এসে একেবারেই ভিমিত হয়ে যায়। মকবুল

হচ্ছে একজন সামান্য দিনমজুর। রাজমোহন যে ধলাকর্তা নামে পরিচিত তার সঙ্গে যে

বৈরিতায় নেমেছিল তার শেষ হচ্ছে শান্ত মধুর রসের মাধ্যমে। নরেন্দ্রনাথ মিত্র যে

সমাজের শুভদিকটাকে গল্পে রূপায়িত করতে ভালোবাসেন পালঙ্ক গল্পটি তার সাক্ষরবহন করে।।

শাল-----

শাল

শাল (১৩৫৬) বিধবা প্রেমের গল্প হলেও এটি দাম্পত্য জীবনের আখ্যায়িকা ৷ গল্পটির তিনটি অংশ। প্রথম অংশে আছে বিথীকার প্রথম বৈবাহিক জীবন। যা এ গল্পে প্রাসঙ্গিকভাবে খুব অল্প সময়ে এলেও গল্পের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। দ্বিতীয় অংশে বিধবা বিথীকার সঙ্গে অনিমেষের প্রণয় সম্পর্কিত নানান মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। পরিচয়ের সূচনালগ্নে এমনকি আরো কিছুদিন পর্যন্ত অনিমেষের কাছে বিথীকার বিধবা সমাচার অজ্ঞাত ছিল। এরই মধ্যে অনিমেষ বিথীকাকে ভালোবাসতে শুরু

করেছে। পরে আনতে পারলেও পূর্বশীরনের দুর্ঘটনা প্রেমের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। নরেন্দ্রনাথ মিত্র বিধবা জেনেও যেমন প্রেমপূর্বক বিয়ের বাগস্থ ছে তেমনি প্রেমের পর জানাজানি হলেও বিধবা সমস্যাকে প্রকট করে দেখাননি। তবে বাবা মা না থাকলেও অনিমেষের দুর সম্পর্কের কান্ডা প্রথমে এ বিয়েতে মত দেননি। এই অমতের আড়ালে নরেন্দ্রনাথ মিত্র সমাজের অমতকেই এ গল্পে হাজির করেছেন।। সমাজের প্রচলিত রীতির ঊর্ধ্বে তিনি স্থান দিয়েছেন নীতির। সমাজের মধ্যে থেকে সমাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে গিয়ে অনিমেষের দোলাচল মনোবৃত্তির প্রকাশ লক্ষ করা যায়। গল্পের  তৃতীয় অংশে বিথীকা এবং অনিমেষকে আমরা দাম্পত্য সঙ্গী হিসেবে পাই। ঘরে ততদিনে একটি সন্তানও এসেছে। বিথীকা সর্বদাই তার পূর্বজীবন সম্পর্কে সংযত থেকেছে। চেষ্টা করেছে মন থেকে মুলোৎপাটন করতে। সচেতনভাবে এড়িয়ে যেত পূর্বের সবকিছু। অনিমেষও বিথীকার পূর্বজীবন সম্পর্কে যথাসম্ভব নিরাস থেকেছে। অনিমেষ সর্বদাই ভালোবাসার একাগ্রতা চেয়েছে। বিথীকার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা তাদের দাম্পত্য জীবনে ন্যূনতম সুখের প্রতিকূলতা সৃষ্টি করুক তা ছিল তাদের প্রত্যাশাবিরুদ্ধ। কখনো কখনো অনিমেষের হৃদয় বিথীকার পূর্বজীবন সম্পর্কে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও সে তা নিয়ন্ত্রণ করেছে বুদ্ধি দিয়ে। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তার রচনার প্রায় ক্ষেত্রেই হৃদয়বৃত্তির প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু আপোসের প্রশ্নে কখনো কখনো তিনি বুদ্ধিবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছেন বিশ্বাল গল্পে অনিমেষ শীতের এক রাতে বিথীকার পূর্বস্বামী বিজয়ের কেনা একটি শাল গায়ে দিয়ে অফিসে গিয়েছিল। সকালে দেখা গেল অনিমেষের সিগারেটের আগুনে শালের এক কোনায় সামান্য ফুটো হয়েছে। এতে করে বিথীকা সামান্য রুক্ষ ব্যবহার করেছিল। শালটি তার পূর্বস্বামীর বলেই যে বিথীকা রুক্ষ ব্যবহার করেছে তাও নয়। একটি দামি জিনিস যদি অনিমেষের হতো তাতেও সে একই আচরণ করতে পারত। কিন্তু অনিমেষের কাছে এর ভিন্ন ব্যাখ্যা। হতে পারে এই ভিন্ন ব্যাখ্যাই যথার্থ। পূর্বস্বামীর শাল ফুটো হওয়া দেখে বিথীকা ভাবনার পথ ধরে কিছুক্ষণ

বিচরণ করতে পারে তার স্মৃতিতে। এই অবস্থায় লেখকের অভিব্যক্তি সিগারেটে পোড়া শালের ছোট একটি ছিদ্র। কিন্তু তার ভিতর দিয়ে দুজনের কাছে

কি দুটি অদৃষ্ট পূর্ব জগতই না উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

মাত্র একবার এক পলকের জন্য দুজনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু একটা পলকে যেন একটি যুগের ব্যাপ্তি, যুগান্তরের ঝড়।”

অনিমেষ বিথীকা উভয়েই তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রত্যাশাবিরুদ্ধ ঘটনাটুকু ভুলে আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে এসেছে। হৃদয় আর বুদ্ধির দ্বিমাত্রিকতায় নির্মিত হয়েছে অনিমেষ চরিত্রটি। কারণ সে হৃদয়বৃত্তি দিয়ে যেমন বিথীকাকে ভালোবেসেছে তেমনি সে বিধীকার পূর্বজীবন সম্পর্কে কখনো কখনো জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ফলে সবকিছু র ইচ্ছা সত্বেও তা থেকে দুরে থাকেন!।।.

 সেতার-----

অবহেলিত নারী, সেতার (১৩৫২) গল্পের উপজীব্য। অবহেলিত নারী সমাজের প্রতিনিধি হচ্ছে নীলিমা। এটি একটি পরিবারের গল্প। নীলিমা সেই পরিবারের গৃহবধূ। সুবিমলের স্ত্রী। পরিবারে সুবিমলের ছোট স্কুলপড়ুয়া ছয়টি ভাই-বোন আছে। সুবিমলের মা আছেন। আছেন একমাত্র কর্তাব্যক্তি সুবিমলের পিতা। সুবিমল উপার্জনক্ষম ছিল। যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে এখন হাসপাতালে শয্যাশায়ী। সুবিমলের পিতার আয়ে সংসার চালিয়ে সুবিমলের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা অসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুবিমলের স্ত্রী নীলিমা স্বামীর চিকিৎসার কথা ভেবে টিউশনি করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। সুবিমলের আন্তরিক সম্মতি নেই। অবস্থা বিবেচনা করে সম্মত হয়। শ্বশুর-শাশুড়ির ক্ষেত্রেও তাই। আন্তরিকতা না থাকলেও অবস্থার প্রেক্ষিতে নিষেধ করতে পারেনি। নীলিমা প্রথমে গানের টিউশনি করত। পরে অর্থের চাহিদা অধিক হওয়ায় সেতার বাজানো শিখে নিয়ে সেতারের টিউশনিও করত। নীলিমা একজন নারী। সমাজে তার চাল-চলন হবে নারীসুলভ। তার চাকুরি, টিউশনি করাটা যেন অসামাজিক। সে গৃহকর্মে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। নরেন্দ্রনাথ মিত্র অনগ্রসর নারী সমাজের বেদনাকে এ গল্পে চিত্রিত করেছেন। নারী শুধু পুরুষদের মতের উপর নির্ভর করে চলবে। পুরুষদের সুবিধা তৈরির কাজে নারীরা ব্যবহৃত হবে। নারীদের জন্য প্রতিকূল সমাজের দৃশ্যই এ গল্পে অবলোকন করা যায়। নীলিমার প্রয়োজনের সময় টিউশনিতে যেতে কোনো বাধা বিপত্তি নেই। সে সেতারের টিউশনি করে উপার্জন করে নিয়ে এলে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সেতার বাজিয়ে কোথাও অনুষ্ঠান করবে এটাতে আপত্তি আছে। দীর্ঘদিন সুবিমল অসুস্থ থেকে যেদিন বাড়ি ফিরে এল সেদিন নীলিমার চেয়ে আর কেউ

বেশি আনন্দিত হয়নি। সুবিমলের বাড়ি ফিরে আসার আনন্দের সঙ্গে আরো ব আনন্দের মুহূর্ত তার জন্য সেদিনই অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু সে আনন্দ থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হয়। গানের টিউশনি আর সেতারের টিউশনি করতে করতে সে সেতারের এক হয়ে উঠেছিল। সুবিমলের বাড়ি ফিরার দিনে একটি বড় অনুষ্ঠানে সেতার বাজাবে সে আননেন্স সে বার বার আবেগে আপুত হয়ে যে সময়ে সে অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য প্রতি নিচ্ছিল সেই মুহূর্তে আসে বাধা। নীলিমা কোথায়।। যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল সে প্রসঙ্গে সুবিমলের উক্তি


তবে কি জলসা-টলসা গোছের কিছু না কি? তারও আর দরকার নেই। তার এতক্ষণে নিশ্চয়ই জেনেছে মীলিমা বাঈজীর ভূতপূর্ব স্বামী ফিরে এসেছে যমের দুয়ার থেকে, যমের হাত থেকে যমদণ্ড কেড়ে নিয়ে আজ কেবল একটিমাত্র জলসা হবে, কেবল তোমাতে আমাতে। তুমি গীত সরস্বতী আর আমি গুণমুগ্ধ নারায়ণ। ধরো, এই নাও। বলে নিজেই সুবিমল সেতারটা স্ত্রীর হাতে তুলে দিল। তারপর সুবিনল হেসে দোর দিল ভিজিয়ে ।১৯


নীলিমা একজন নারী বলে তার মতের কোনো মূল্য নেই। সুবিমল পুরুষ তারই শুধু মূল্যায়ন। নীলিমা একজন নারী বলে যেখানে সে স্ত্রী সেখানে তার ভালোলাগা না লাগার প্রশ্ন অবান্তর। নীলিমার যেদিন শিল্পী হিসেবে বড় খ্যাতি অর্জনের সুযোগ সেদিন স্বামী বিমলের সামান্য আপত্তির কারণে তা পণ্ড হয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্র কাছ থেকে দেখা সমাজকে সহজে স্থান দিয়েছেন তাঁর সেতার গল্পে। গল্পকার এ গল্পের মাধ্যমে নারী সমাজের সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন।

হেডমাস্টার --

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটগল্পের প্রতিনিধিত্বকারী গল্পের একটি হচ্ছে হেডমাস্টার (১৩৫৬)। গল্পের প্রধান চরিত্র এম.ই স্কুলের হেডমাস্টার কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার। গল্পের কাহিনি নির্মিত হয়েছে কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারকে আশ্রয় করে। কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের আর্থনীতিক অবস্থা জানা যায়।


আজ অন্যান্য মহান পেশার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতার পেশাও অন্য চেহারা নিয়েে এখন টিপিক্যাল মাস্টারমশাই হওয়ার প্রবণতাও দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। সর্ব বাণিজ্যিক বাতাবরণে যে পেশাদার মনোভাব এখন সর্বত্র কিয়ে বসেছে তাতে নরেন্দ্ররথের হেডমাস্টারকে এক লুপ্ত প্রজাতির প্রতিনিধি বলে মনে হতে পারে ৪

গল্পে কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের চরিত্র, তার সততা এবং স্থান-কাল: পাত্রভেদে অভিন্ন আচরণ করার পরিণতি গল্পে দেখানো হয়েছে। একজন শিক্ষক দীর্ঘদিন শিক্ষকতার পেশায় থাকার পর সে আর তার আচরণ বদলাতে পারে না। কৃষ্ণগ্রসর সরকার তার প্রমাণ। সমাজের অনিয়মকে মেনে না নিলে পদে পদে অসুবিধায় পড়তে হয়। কারণ অনিয়মের উপর ভর করেই চলছে সব কিছু। কৃষ্ণপ্ৰসন্ন সরকারকেও তাই প্রতিনিয়ত অসৎ না হওয়ার দায়ে খেসারত দিতে হয়েছে। কৃষ্ণ প্রসন্ন সরকার সাতাশ বছর এম.ই স্কুলে হেডমাস্টারের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্কুলের মাইনে যা পেত তা দিয়ে সংসার চলত না। স্কুলের সেক্রেটারি নিত্য নারায়ণ চৌধুরী দেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে যান।

কৃষ্ণ প্রসন্ন সরকারের বাড়তি আয়ের পণ বন্ধ হয়। তখন বাধ্য হয়ে তাকে চলে আসতে হয় কলকাতায়। সপরিবারে কলকাতায় এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। চাকুরির সন্ধান করতে করতে একদিন তার একসময়ের ছাত্র নিরূপম এর অফিসে এসে উপস্থিত হন। নিরূপম নদী ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা। জেনারেল ম্যানেজারকে বলে ব্যাংককেই একটি চাকুরির ব্যবস্থা করলেন নিরূপম নন্দী নিরূপম নদী আবার শিক্ষকতা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কৃষ্ণন্ন সরকার প্রতিবাদ করেছিলেন,

না নিরূপম, আর মাস্টারি নয়। না খেয়ে মরবো, তবু মাস্টার আর জীবনে করব না। কেরানিগিরি থেকে কুলিগিরি যা বল করতে রাজি আছি। কিন্তু মাস্টারি আর নয়। সাতাশ বছর ধরে মাস্টারি করার সুখ তো দেখলাৃ না

প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হলেও কৃষ্ণপ্রসন্ন মাস্টারি ছাড়তে পারলেন না। অফিসে গিয়েই তার দায়িত্বশীল কর্মকর্তার নামান ভূল ধরতে শুরু করলেন। ইংরেজি শুদ্ধ করে দেন। আদি উঠভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন। ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ পরিমল বাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের খবরদারি করর কারণে অতিষ্ট হয়ে নিরূপম নন্দীর কাছে অভিযোগ করলেন পরিমল বাবু। এরকম অ্যাসিসট্যান্ট তার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে একাই রাত জেগে কাজ করবেন। তবুও তার দরকার নেই। নিরূপম নন্দী পরিমল বাবুর কাজের প্রশংসা করে কলিগ হিসেবে কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিলে উল্টো তিনিও প্রতিবাদ করলেন

কলিগ, তাই বলে স্থানকাশ পানে নেই। অশীল অশ্রাব্য আলোচনায় ছেলের বয়সী ছাত্রের বয়সী সব ছোকরাদের মাথা চিবিয়ে খেতে হবে ফের যদি পরিমল বাবুর মুখে আমি এই সব কুৎসিত কথা শুনি, আমি থাপ্পড় মেরে দাত ভেঙে দেব।

হাতাহাতি হয়ে যাবে আমার সঙ্গে।

নিরূপম নন্দী উপায় না দেখে কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের চাঞ্চুরি বিল ডিপার্টমেন্টে বদলি করলেন। পরিমল বাবু শ্বাস ছেড়ে বাঁচলেন। আর যেন কখনো কোনো মাস্টারকে না পাঠান নিরুপম নন্দী সে জন্য অনুরোধ করলেন। মাস্টারের সঙ্গে থাকলে নাকি পাগল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিল ডিপার্টমেন্ট থেকেও পাঁচ-ছয়দিনের মাথায় কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের নামে অভিযোগ এল। বিল ডিপার্টমেন্টের লোকজন একজনের নামে আরেকজনের কাছে ক্লিক লাগায়। তাই এসবের ব্যাপারে তার ঘোরতর আপত্তি। মাস দুয়েকের মধ্যে নিরূপম নন্দী তাকে আরো একাধিক জায়গায় বদলি করেও সর্বত্রই তার নামে অসংখ্য অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত তাকে অফিসের বেয়ারাদের সর্দার বানিয়ে দেন। কিন্তু তাতে করেও তার উপর সকলের ক্ষোভ। অকারণে কর্মকর্তারা

বেয়ারাকে ডেকে পান, সিগারেট আনিয়ে নেন। কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার তা করতে দেবেন না। কারণ পান, বিড়ি এনে দেওয়া বেয়ারার কাজ নয়। এরই মধ্যে অফিসে একজনকে অশ্রাব্য কথা বলার দায়ে তিনি চড়ও মেরেছিলেন। রূঢ়ভাষী বলে কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের একটি পরিচিতি তৈরি হয় অফিসে। সারাজীবন করেছেন শিক্ষকতা। অন্যায়ের সঙ্গে কখনো আপোস করেন নি। ব্যাংকের চাকুরি করতে এসেও সেই মাস্টারি যেন কিছুতেই ছাড়তে পারছেন না। সকলকে সংশোধনের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কেউ তার কথা মানতে রাজী নন। কারণ তিনি নিজেকে শিক্ষক ভাবলেও বাকিরা নিজেদেরকে তার ছাত্র ভাবতে পারেন না। একদিন অফিস শেষ করে রাত প্রায় আটটার দিকে নিরূপম নন্দী বের হওয়ার সময় লক্ষ করলেন বেয়ারাদেরকে নিয়ে বসেছেন কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার। তাদের কারো হাতে বই কারো হাতে খাতা পেন্সিল, শ্রেট। কুপ্রসন্ন সরকার তাদেরকে পড়াচ্ছেন। নিরূপম নন্দীকে দেখে কুষ্ণপ্রসন্ন সরকার স্তব্ধ হয়ে যান ক্ষণকাল। এর পরেই তার একসময়ের ছাত্র নিরূপম নন্দীর কাছে অনুরোধ করেন নিরূপম নন্দী যেন অফিসের জেনারেল ম্যানেজার আর স্ত্রীর কাছে এ কথা গোপন রাখে। কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার স্ত্রীকে যেমন ভয় করে তেমনি জেনারেল ম্যানেজারকেও। কারণ জেনারেল ম্যানেজার তাকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র হেডমাস্টার গল্পে একজন শিক্ষককে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। হেডমাস্টার গল্পে হেডমাস্টারের আড়ালে তার আর্থনীতিক দুরবস্থার কথাও উঠে এসেছে। তবে শেষ পর্যন্ত একজন শিক্ষকের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আপোসহীন, নীতিবান হিসেবে হেডমাস্টারকে এ গল্পে পাওয়া যায়। কিন্তু অফিসের রীতিনীতি মেনে নেওয়ার প্রশ্নে তাকে যে ভূমিকায় পাই তাতে করে তাকে অফিসের জন্য উপযোগী বলা যায় না। বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র এর বদলে সবার আমি মাস্টার এই ভূমিকায় পাওয়া যায়। সুনিপুণ কারিগরের মতো দরদ দিয়ে নরেন্দ্রনাথ মিত্র হেডমাস্টার চরিত্রকে অঙ্কন করেছেন।

চাঁদ মিঞা -----


জমিদার শ্রেণির জঘন্য আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি চাঁদ মিঞা (১৩৫২) গল্পের মূল বিষয়। গল্পটি উপস্থাপিত হয়েছে কথক মসিয়রের জবানিতে। মসিয়রের বাবার আপন চাচা ছিলেন নশরৎ আলী মৃধা। নশরৎ আলী মৃধা পাঁচ-সাত গাঁয়ের জমিদার । প্রচণ্ড দাপট ছিল তার। ন্যায়-অন্যায় সব কাজ তার কাছে সমান। তার প্রতিপক্ষ হবে এরকম কেউ ছিল না। নশরৎ আলী নিজের সকল চাহিদা পূর্ণ করতে পারেনি। তার একটি চাহিদা অপূর্ণ আছে। সন্তানের চাহিদা। সন্তান লাভের আশায় সে আট নয়টি বিয়ে করেছে। সন্তান হয়নি। আস্থা নিজের উপরে আছে। তার বিশ্বাস স্ত্রীদের দোখের কারণে তার সন্তান হয় না। নশরহু আলী সম্পর্কে মসিয়রের ভাষ্য,

মীরপুর এবং শেপাশের পাঁচ-সাত খানা গায়ের জমিদার ছিলেন নশর আলী মৃধা লোক পঙ্কর পাইক পেয়াদা কিছুরই অভাব ছিল না। অভাব ছিল কেবল

সন্তানের। পীরের দরগায় সিন্নি দিয়ে দরবেশের কাছে নানারকম গাছগাছড়া তাবিজ কবজ জড়ো করেও ছেলে তো ভালো, একটা কানা মেয়ের মুখ পর্যন্ত মৃধা সাহেব দেখতে পারেননি। কিন্তু অদ্ভুত তাঁর জেদ। বলতেন খোদার সঙ্গে আমার জেহাদ। ছেলে যতদিন না হবে ততদিন কেবল বিবির পর বিবি এনে ঘর ভরে দেখি ছেলে না হয়ে যায় কোথায়। আমি জানি আমার নিজের কোনো দোষ নেই ছেলে হয় না তা কেবল এই বিবিদের দোষ।


জমিদার নশরৎ আলী ঘোড়দৌড় উপভোগ করতে ভালোবাসতেন। মাঝে মধ্যে ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করতেন। একটু দূরের গ্রামে আতাজদ্দি মিঞার চমৎকার একটা ঘোড়া আছে। সে ঘোড়াটিকে ঘোড়দৌড়ে নিয়ে আসত না। নিয়ে এলে নশরত আলী ঘোড়াটিকে কেড়ে নিতে পারে এই ভয়ে। সংবাদ পেয়ে নশরৎ আলী ছুটলেন। আতাজদ্দি মিঞার বাড়িতে। পৃথিমধ্যে আঠার-উনিশ বছরের বিধবা রাবেয়াকে দেখে তার আবারো বিয়ের সাধ উদিত হয়। একচ্ছত্র আধিপত্যের বলে সে বিধবা সুন্দরী রাবেয়াকে ঘরের বউ করে আনে। কিন্তু রাবেয়ার মুখে কোনো হাসি নেই। নশরৎ আলী রাবেয়ার চোখের জল দেখতে পায়। মাত্র কয়েকদিন আগে জোয়ান স্বামীকে হারিয়ে বৃদ্ধ জমিদারের ঘরে সে কোনো আনন্দ পায় না। রাবেয়ার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সকলে বাস্ত হয়ে ওঠে। নশরৎ আলীর সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়ার নাম  দরিয়ার সওয়ারের নাম চাঁদ মিঞা। এই চাঁদ মিঞা দরিয়া দিয়ে খেলা দেখাচ্ছিল, এমন সময় রাবেয়া একবার হেসেছিল। চাঁদ মিঞা ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে গেলে রাবেয়া নিজ হাতে চুন আর হলুদ গরম করে ব্যথা পাওয়ার স্থানে লাগানোর জন্য পাঠিয়ে দেয়। নশরৎ আলীর সেজো বিবি মেহেরজান এসে এই ঘবর পৌঁছে দেয় স্বামীর কাছে। নশরৎ আলী রাবেয়ার মুখে হাসি আসার সংবাদে আনন্দিত হলেও চুন-হলুদ গরম করে পাঠানোর কথায় ক্ষুণ্ণ হয়। চাঁদ মিঞার শরীরের গঠন রূপ-লাবণ্য অসাধারণ। তার সৌন্দর্যের কাছে পরাক্রমশালী নশরৎ আলী তুচ্ছ। বার্ধক্য স্থান করে নিয়েছে নশরৎ আলীর শরীরে। রাবেয়া চাঁদ মিঞার প্রতি অনুরক্ত কিনা প্রমাণ করার জন্য ঘোড়দৌড়ের ব্যবস্থা করে। চাঁদ মিঞাও সেখানে একজন প্রতিযোগী। নশরৎ আলী ঘোড়দৌড়ে উপলব্ধি করতে পারল চাঁদ মিঞার প্রতি রাবেয়ার অকুণ্ঠ আগ্রহ। নশরৎ আলীর পৈশাচিক মনোবৃত্তি জেগে ওঠে। চাঁদ মিঞার অপরূপ সৌন্দর্যের ঈর্ষায় দগ্ধীভূত হয় সে। নশরৎ আলী ভাবে,

মেয়েদের মতো পুরুষের রূপ আর যৌবন তো কেবল তার দেহেই নয়, তার সামর্থ্যে, তার খ্যাতিতে, তার ঐশ্বর্যে - তা তো নশরৎ আলীর এখনো আছে। কিন্তু আশ্চর্য, তার সম্পদ রাবেয়ার চোখ ঝলসে দেয়নি, রাবেয়ার চোখকে মুগ্ধ

করেছে তাঁরই একজন দীনাতিদীন অনুচরের দেহসৌষ্ঠব। এর চেয়ে বিস্মধ্যের আর কি হতে পারে। সেই দিনেই নশরৎ আলী বেদম প্রহারে ক্ষত-বিক্ষত করে চাঁদ মার শরীর মুখমণ্ডে


এই পরিমাণ আঘাত করেছে যে তা আর মানুষের মুখ বলে চেনা যায় না। প্রহার শেষে লুকিয়ে কয়ে রাখে। কেউ তার সন্ধান জানে না। অনেকেই তখন অনু ঈদ মিঞা আর বেছে নেই। আকস্মিকভাবে চাঁদ মিঞার অনুপস্থিতিতে রাবেয়া বিষন্ন হয়। রাবেয়া তাকে দেখে শিউরে ওঠে। ক্ষতবিক্ষত চেহারাসম্পন্ন চাঁদ মিঞার ঘরের চাবি রাবেয়ার হাতে তুলে দিয়ে রাবেয়াকে স্বাধীনতা দেয়। রাবেয়ার বাবা ফি হিসেবে গাছ-গাছড়া দিয়ে চিকিৎসার কাজ করত। বিয়ের সময় কিছু গাছ-গাছড়া নিয়েছিল রাবেয়াকে। এ দিয়ে যেকোনো রোগ ভালো হয়। রাতের অন্ধক জ্বলিয়ে তালা খুলে চুপিসারে গাছ গাছড়া নিয়ে চাঁদ মিঞার কক্ষে প্রবেশ করে রাবেয়া। চাদ মিঞা সন্দেহ করত রাবেয়াকে। রাবেয়া হয়তো নশরকে দিয়ে চাদ মিঞাকে এই পরিণতিতে নিয়ে এসেছে। রাবেয়া অবিশ্বাস দূর করার জন্য নিজের হাতের আংটি খুলে চাঁদ মিঞার আঙ্গুলে পড়িয়ে দিলে চাঁদ মিঞা বিস্ময়ে আনন্দে নির্বাক হয়ে দেহ এবং মনের সমস্ত জ্বালা ভুলে যায়। এমন সময় নশরৎ আলী এসে রাবেয়াকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। নশরৎ আলী পরদিন রাবেয়ার মৃত্যুকে হার্টফেলজনিত কারণে মৃত্যু বলে উল্লেখ করে। আইনি জটিলতা যাতে না হয় ক্ষমতা বলে সে ব্যবস্থাও করে। পরবর্তীতে এই চাঁদ মিজ্ঞার সঙ্গে নশরৎ আলীর প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কের বদলে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে নশরৎ আলীকে নিয়ে চাঁদ মিঞা রাবেয়ার কবরের পাশে যেত প্রতিদিন।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র চাঁদ মিঞা গল্পে তাঁর নিজের সময়ের দুইপুরুষ পূর্বের সময় নিয়ে কাহিনি নির্মাণ করেছেন। ব্রিটিশশাসিত এই ভূখণ্ডে জমিদারি প্রথা চালু ছিল। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদাররা জমির মালিক হয়ে সাধারণ মানুষের উপর সুদীর্ঘকাল নানারকম অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। এই নির্যাতনের। ধারাবাহিকতা অটুট ছিল জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত। চাঁদ মিঞা গল্পের কথক মসিয়রের বাবার চাচা নশরতের নির্যাতনের কাহিনি লেখকের সময়ের যদি মাত্র দুইপুরুষ আগেরও হয় তবু এর ঘটনা ঐতিহাসিক সত্য। জমিদারদের বহুবিবাহ আধিপত্যের নেতিবাচক দিক সামান্য কারণে গুরুতর শান্তি এর সবই ইতিহাস স্বীকৃত। চাঁদ মিঞা গল্পের নশরৎ আলীর মধ্যে শোষক শ্রেণির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং চাঁদ। মিঞার মধ্যে শোষিতের নির্মম পরিণতি লক্ষ করা যায়। আতাজদ্দি মিঞা জমিদারের কেড়ে নেওয়ার ভয়ে ঘোড়দৌড়ে সুন্দর ঘোড়া থাকা সত্ত্বেও নিয়ে আসে না, রাবেয়ারমাত্র সাতদিন আগে স্বামী মারা গেলেও বৃদ্ধ জমিদারের সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য হওয়া,

স্ত্রীরা স্বামীর অনিয়ম সত্ত্বেও প্রতিবাদ না করা এমনকি মানুষকে মেরে ফেলার পরও

কোনো সমস্যা না হওয়া এ সবই সম্ভব হয়েছিল জমিদারি প্রথার কারণে। নরেন্দ্রনাথমিত্র চাঁদ মিঞা গল্পের কাহিনি বুননে সেই ইতিহাসকে তুলে এনেছেন।।

বিকল্প ------

বিকল্প নরেন্দ্রনাথ মিএের অনবদ্য এক প্রেমের গল্প। 

সুধার বিয়ে না হওয়া সত্ত্বেও বিধবা বেশ গ্রহণের করুণ কাহিনি নিয়ে রচিত করেছেন। কোন কাহিনিতে এক নতুন মাত্রা কীভাবে যোগ করা যায় তার সুন্দর নিদর্শন প্রতিটি গল্পেই অসামান্য নৈপুণ্যে উপস্থাপন করেন তিনি। বিকল্প' গল্পটি এই নিদর্শনের প্রতিমা। মাতৃহীন পরিবারে সুধা এবং হাবুল দুই ভাইবোন পিতা হরগোবিন্দের কাছে পরম আদরে বেড়ে ওঠে। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত এই দুই সন্তানের প্রতি প্রতিনিয়ত সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন হরগোবিন্দ। অভাব অনটনের সংসার বলে খুব হিসেব করে চলতেন তিনি। সুধাকে একজন যোগ্য ছেলের কাছে পাত্রস্থ করার চিন্তা তার সর্বদাই। স্ত্রী মারা গেছে। হরগোবিন্দ ভাবতেন সুধা তার মায়ের মতো দেখতে। কর্মনিষ্ঠায় আর আচারনিষ্ঠাতেও সে তার মায়ের মতো। আর্থনীতিক টানাপড়েনের মধ্যেও হরগোবিন্দ মেয়ের জন্য স্বর্ণালংকার নিয়ে আসে। অনটন থাকলেও পরিবারের সুখের অভাব ছিল না। মেয়ের সঙ্গে তার পিতা-কন্যা সম্পর্কের বাইরে একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সুধা এবং হাবুলকে সে অপরিসীম ভালোবাসায় মাতৃশূন্যতার বেদনাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। তাদের থাকার জন্য ছিল একটি মাত্র ঘর। হাবুলের লেখাপড়ার জন্য একজন টিউটর ঠিক করা হয়। হাবুলের টিউটর ইন্দুভূষণের সঙ্গে সুধা গভীর প্রণয়ে আবদ্ধ হয়। প্রতিবেশীরা এই নিয়ে কটু কথা বলতে ছাড়ে না। ইন্দুভূষণ এই সময় সুধাকে নানান রকম গল্প উপন্যাস পড়তে অভ্যস্ত করে তোলে। পিতা হরগোবিন্দের কানে প্রতিবেশী মারফত সুধা এবং ইন্দুভূষণের প্রেম সম্পর্কিত কিছু কথা এলে সে

মেয়েকে সতর্ক করে দেয়। কিরে ধর্ম হরগোবিন্দ ইন্দুভূষণকে শাস্তি দিতে পাড়ার কয়েকটি ছেলেকে নিয়ে বেদম প্রহার করে। থেকে সে মৃত্যুর কোলে পড়ি। সুধার কানে এই মতো জীবনযাপন করে। প্রেমিকের পিতা হাবিন্দের সঙ্গে সার্বক্ষণিক নীরবতা পালন করতে থাকে সুধা। কিছু করলেই শুধু দে শেলের মতো বিদ্ধ করে। তাদের কথোপকথনের ধরনটা এরকম


একদিন হরগোবিন্দের চোখে পড়ল, সুধা বেশ সব ছেড়ে নিয়েছে। কলেে শাড়ি পরে। হাতে দুগাছি চুড়ি ছাড়া আর কোথাও কোন গয়না নেই। সোনার গয়নাও নয়, ফুলের পয়নাও নয়। আর একদিন খাওয়ার সময় লক্ষ করলেন, লুধ্য শুধু ডাল তরকারি দিয়ে খেয়ে উঠছে। মাছ-মাংস ছুঁয়েও দেখছে না। সব বাপ ভার ভাইকে দিয়ে দিচ্ছে ।


হরগোবিন্দ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললেন, মাছ দেশি নে কেন সুধা? সুধা বললে খেতে ইচ্ছে করে না।”


হরগোবিন্দ বললেন, "কিন্তু কেন ইচ্ছে করে না শুনি? তুই কি বিধবা? তোদের কি


বিয়ে হয়েছিল?" সুধা বলল, "খাপড়া বিয়েটাই কি সব?””

হরগোবিন্দ বললেন, “ছি ছি ছি! বাপের সামনে এ কথা বলতে তোর লজ্জা লাগলো না

সুধা নির্বিকারভাবে বলল, 'তুমি শুনতে চাইলে তাই বললাম।

তোমারও তো লজ্জা হয়নি বাবা ।"

হরগোবিন্দ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, 'তোর সব কথা মিথ্যে সুধা। কেবল জেদ করে এসব কথা বলছিস। এমনি করে আমার ওপর শোধ নিতে চাচ্ছি। কিন্তু তুই আমাকে দিনরাত পুড়িয়ে মারছিস কেন? তোর যদি সন্দেহ হয়ে থাকে, তুই এর চেয়ে থানা পুলিশ কর, আইন-আদালত কর, সে অনেক ভালো। একটু যেন হাসি ফুটল সুধার মুখে। সুধা বলল, “সে সব যারা করতে পারত তেমন

আত্মীয়স্বজন তাঁর কেউ নেই। থাকার মধ্যে আছি আমি। কিন্তু আমি যে তোমার

মেয়ে তুমি খুন করে এলে তোমার সেই হাত আমি আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেব। সে

হাতে শিকল পরাব কেন? আমি যে তোমার মেয়ে

শেষপর্যন্ত আর সুধাকে বিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। সুধা বাধার সঙ্গে ইন্দুভূষণের মৃত্যুর

পর আর কখনোই স্বাভাবিক আচরণ করে না। হরগোবিন্দ হতাশ হয়ে এক সহকর্মীর কাছে হাবুলের জন্য একজন প্রাইভেট টিউটর খোঁজে। চরম হতাশার অন্ধকারে প্রাইভেট টিউটর ইন্দুভূষণের বদলে যদি আর এক প্রাইভেট টিউটরকে সুধা পছন্দ করে এতটুকুই শুধু আশা। এই গল্পে গোবিন্দ এক অর্থবহ চরিত্র। তার দুঃখের সঙ্গে পাঠকও

সমব্যথী। সঞ্চানের কাছে পিতৃস্নেরের কোনো খাদ ছিল না। সন্তানের সুখের জন্য নিজের সূধ স্বাচ্ছন্দ্যকে ত্যাগ করেছিলেন তিনি। ইন্দুভূষণকে মেরে ফেলার কুমন্ত্রণা তিনি দেননি। শাস্তি দেওয়ার চাই শুধু করেছিলেন। ইন্দুভূষণের অন্যা মৃত্যুতে শোকাভিভূত সুধার মানসপরিবর্তনে ব্যর্থ হয়ে তার যে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে তাতে করে হরগোবিন্দকে অপরাধী বলা চলে না। ক্ষুধা চরিত্রটি গল্পের চরম করুণ রস ধারণ করে আছে। মেয়ে হওয়ার কল্যাণে দুর্ঘটনাক্রমে পিতার খুনি হওয়ার পাপের প্রায়শ্চিত করেছে সুধ্য, 'বিকল্প'র মধ্যে পিতা হরগোবিন্দ ও কন্যা সুধার যে ক্রমশ চরম সংঘর্ষ ও সংকটের প্রতিচিত্রণ তার মধ্যে দুই চরিত্রই সমান মাপে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। হরগোবিন্দ এবং সুধা উভয়ের ত্যাগে গল্পটি মহৎ গল্পের পর্যায়ে উন্নীত।

একটি নাগরিক প্রেমের উপাক্ষান,,।।।



দুজন নারী-পুরুষের ভালোবাসা এবং মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার গল্প 'একটি নাগরিক প্রেমের উপাখ্যান', সুরজিত এবং বিপাশা এই দুই মানুষের প্রেমের কাহিনী, হয়তো প্রেম কথাটা বলাও সমীচিন হবে না, কারণ বিপাশা এখনো যেহেতু সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, আসলে সুরজিতকে বিয়ে করবে কি না, দুজন যে দু'মেরুর বাসিন্দা, ধনী বাপের দুলালী বিপাশা অনেক ছেলেবন্ধুর সান্নিধ্যে বেড়ে উঠলেও কী কারণে গরিবের ছেলে সুরজিতকে ভালোবেসে ফেলে, যদিও সেটা কতোখানি ভালোবাসা ছিলো তাও চিন্তার বিষয়। এমনই একটা টানাপোড়েনের গল্প, যা পাঠকের মনকে অনেক ভাবনার খোরাক জোগাবে। যে বিপাশা বিলাস-ব্যসনে বড় হয়েছে, ধনী বাপের মেয়ে সে, কীভাবে পারবে একজন মাস্টারের সংসারে, যে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে উঠে এসেছে যেমন সত্য, কিন্তু মন তার এতোটুকু বদল হয়নি, যার স্বপ্ন নেই আশা নেই, তাকে কীভাবে আজীবন ভালোবাসবে, তাকে নিয়ে সংসার করবে, দোটানাপোড়েনে গল্পটি অন্য একটা রূপে পরিণত হয়েছে বোঝা যায়। জটিল এবং মনস্তাত্ত্বিক এই গল্পটি 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় (দোল সংখ্যা ১৩৭১ বাং) প্রকাশিত হয়।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র নেহাৎই সাধারণ মানুষের দিনযাপনের ভেতর থেকে মুক্তোর মতো গল্প আহরণ করতেন, বাস্তুচ্যুত গরিব মানুষেরা কলকাতা শহরে বাঁচার জন্য কীভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই করে চলছে সেই চিত্র অংকন করেছেন, দারিদ্র্যের মধ্যে একটু ভালো থাকার চেষ্টা, বেঁচে থাকার আপ্রাণ সংগ্রাম। বাস্তববাদী মানুষকে তিনি চিনেছেন, দেখেছেন চেনা গোষ্ঠীকে, যাবতীয় উপলব্ধি থেকে নরেন্দ্রনাথ তুলে এনেছেন সময়-মানুষ-প্রকৃতি এবং তার ইতিহাসকে, দৃশ্যের ভেতরের দৃশ্য বাঙালি পাঠককে গভীরভাবে দেখান, তাই তিনি আজো স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছেন এবং থাকবেন আরো অনেক অনেক কাল অবধি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ