বাংলাদেশের কবিতা:-
বাংলাদেশের কবিতার বিষয়বস্তু আলোচনা
বাংলা কবিতার দিগ্বলয় :-
বাংলা কবিতার আধুনিকতায় উত্তরণ ঘটে, দুটি সজ্ঞান প্রয়াসের মধ্য দিয়ে। একদিকে ছিল রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে যাবার অঙ্গীকার অন্যদিকে পাশ্চাত্য কবিতার নতুন আঙ্গিক ও বিষয়বৈচ্যিকে আগ্রহ- করণের প্রয়াস। পাশ্চাত্যের নতুন আঙ্গিক নিয়ে, বিশেষ করে নন্দিত গদ্যরীতির কবিতা বা ফ্রিডম নিয়ে কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা রবীন্দ্রনাথ নিজেও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর লালিত বিশ্বাস ও মূল্যবোধের নোঙর কেটে তিনি বিশ্বব্যাপী এক সর্বগ্রাসী অবক্ষয়কে আবাহন করতে পারেন নি; তাঁর কবিতাও ভাব ও ফর্মের ন্যায় সত্যকে বিসর্জন দিয়ে অনুষঙ্গের বিষয় হতে পারে নি। তিরিশোত্তর কবিকূল তাঁর শব্দবৈভবকে অতিক্রম করতে পারেননি। আপাতঃ কাঠামোহীন, অসংলগ্ন ও দূরহে, আধুনিক কবিতার শব্দান যঙ্গের এক অভিনব যোজনাকে অননুকরণ করে বিষয়বৈচিত্র্য্যে বাংলা কবিতায় একটা নতুন মাত্রা এনেছেন।
পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের (তদানীন্তন পুর্ব বাংলার] কবিতায় তিনটি ধারা লক্ষণীয়। এদের প্রথমটিকে বলা যায় ঐতিহ্য-তাড়িত যার মধ্যে দশটি উপধারার পাশাপাশি অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এদের একটি মধ্যযুগ থেকে বাংলা কবিতায় যে ইসলামী ধারাটি প্রবহমান তারই উত্তরসূরী। নজরুলের পর ফররুখ এ ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। এ ধারার কবিদের মধ্যে রয়েছে একটি রোমান্টিক চেতনা, বাস্তবতা থেকে পলায়নের প্রবণতা। নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের গনজাগরণের মধ্য দিয়েই আসবে নতুন পৃথিবী, এমন একটা বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত এদের রচনা। অন্য উপধারাটিও ইসলামী কিন্তু প্রবলভাবে রাজনীতি আশ্রিত- পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোতে লালিত, বঞ্চিত এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত। পরাজি'ত রাষ্ট্রের কাঠামোতে অভিন্ন সংস্কৃতির প্রবক্তা এই গোষ্ঠীটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বিশ্বাসী বলেই অসহিষ্ণু, , বন্দে আলী মিয়া, রওশন ইজদানী এ উপধারার কবি। এদের তাত্ত্বিক উপস্থাপনার অসহিষ্ণুতম প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় উল্লেখ্য যে ইসলামী ধারার কবিরা চল্লিশের দশকে আত্মপ্রকাশ করলেও সৈয়দ আলী আহসান পরবর্তীকালে তাঁর প্রথম কাবা প্রয়াসকে আবীষ্কার করেছেন।
দ্বিতীয় ধারাটি রবীন্দ্রবলয়ে থেকেও আঙ্গিকে আধুনিকতায় আক্রান্ত প্রেম, নিসর্গ', নারী, দেশ ইত্যাদি বিষয়ের উপস্থাপনায় উদার এবং অবদমনমতে। বাংলাদেশের কবিতায় এরা আধনিকতার অগ্রদতে কিন্তু শব্দাবলী ও শব্দাননুষঙ্গের সাথে সামাজিক বাস্তবতার সমন্বয় সাধনে অননুৎসাহী। আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান এবং সানাউল হক এ ধারার প্রধান পুরুষরুপে চিহ্নিত।
তৃতীয় ধারাটি আধনিকতায় আক্রান্ত তদানীন্তন পূর্বে পাকিস্তানের নতুন কবিতা। অভিব্যক্তিবাদ ও মার্কসবাদে উদ্বুদ্ধে এ ধারাটি সামাজিক বাস্তবতার শিল্পরূপে ধারণ করে তিরিশের কবির সঙ্গত অননুসারী। শামসরে রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজর রহমান, সৈয়দ শামসসুল হক, আল জিয়া হায়দার প্রমুখ কবির অবদানে পঞ্চাশের দশকে এ ধারাটি বহমান হয়েছে।
পঞ্চাশের দশকে পূর্বে বাংলার কবিতার বলা যায় শৈশবকাল। কবিতা তখনও মার্জিত, শহরে হয়ে উঠেনি। গ্রাম্যতার ছাপ তাতে স্পষ্ট। তব, যেটুকু নতুনত্ব তা এ প্রজন্মের কবিদের মধ্যেই লক্ষণীয়। পরবর্তীকালে ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় যে জোয়ার আসে তার স্থপতি এরাই। এদের মধ্যে দিয়েই ঘটেছিল বাংলাদেশের কবিতার আবদনিকতায় উত্তরণ।
পঞ্চাশের দশক বাংলাদেশের কবিতার শৈশবকাল। এ প্রজন্মের কবিকলে বিশেষ করে শামসর রাহমান কাব্যচর্চাকে নিয়েছিলেন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে। এদেরই মিলিত প্রয়াসের ফলে ষাটের দশকের গোড়াতেই বাংলাদেশের কবিতার নবাজি'ত শক্তির চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতার পটভূমি নির্মাণে তিনটি ঘটনার বিশেষ অবদান রয়েছে।
প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৯৫০ সালে। এ বছর 'নতুন কবিতা' নামে নবীন কবিদের একটি সংকলন প্রকাশিত হয় । আব্দুর রশীদ খান এবং আশরাফ সিদিকী সম্পাদিত এই সংকলনটিতে হাবিবর রহমান, মাফাখখারুল ইসলাম, মনোজ রায় চৌধুরী, চৌধুরী ওসমান, আশরাফ সিদিকী, আর রশীদ খান, মহারল ইসলাম, মোহাম্মদ মামনুন, জিল্লার রহমান সিদ্দিকী, শামসর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজর রহমান ও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সহ সর্ব মোট তের জন কবির লেখা স্থান পায়। এতে যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিরাজমান গভীর নৈরাশ্যের পটভূমিতে দু'টি প্রধান কাব্যধারা লক্ষণীয়। একটি ধর্ম এবং ঐতিহ্য কেন্দ্রিক, নৈতিক গণজাগরণের মাধ্যমে শদ্ধি ও সংস্কারে বিশ্বাসী। অন্যটি বামপন্হী ভাবধারায় পাঠ, ভাষা সচেতন, ভাবাল; তার বদলে বদ্ধিবৃত্তির প্রচ্ছায়ায় লালিত আঙ্গিকে আধনিক ও দর হতায় আক্রান্ত। ৩ শেষোক্ত ধারার কবিকুলেই পরবর্তী দশকের গোড়াতে বাংলা কবিতার শরীর নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঐতিহাসিক, কিন্তু বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও শিল্প- কলার বিবর্তনে তার গরেত্বে অপরিসীম। ভাষার প্রশ্নে রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে পর্বে বাংলার জনগণের যে দ্বন্দ্ব তারই প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী। সেদিন রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল জনগণের বিজয়—ধর্ম গোত্রবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালী সেদিন একটি ঐক্যের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মে- যকে। বাঙালীর সেই প্রথম আপন অন্তরে কোনো বিপুল শক্তিকে পরম বিস্ময়ে অনভব করা, সকল অবদমনের নিগড় ভাঙা এবং স্বাধীনতার সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর মখোমখি জানালাটি সশব্দে খুলে দেওয়া। আমাদের সাহিত্যে এর প্রভাব ছিল অবশ্যম্ভাবী। ‘শহীদ মিনার', ‘একুশে', 'বাংলা ভাষা', 'মা' এই চারটি অনভূতির বিচিত্র নান্দনিক রূপে আমাদের সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় অননুরণিত হয়েছে। তাছাড়া ষাটের দশকে রাজনৈতিক চেতনায় উদ্দীপ্ত যে তিনটি বিষয়বস্তুর শৈল্পিক উপস্থাপনা মানষের মনকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করেছিল তা হলো প্রতিবাদ, স্বদেশ এবং ভাষানরোগ। একুশে ফেব্রুয়ারীতেই এদের শিকড় প্রোথিত।
তৃতীয় ঘটনাটি এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত – ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজার সম্পাদনায় 'একুশে ফেব্রয়ারী' সংকলনটির প্রকাশ। শদ্ধ কাব্যসংকলন নয়, তব, এতে পরিসর ছিল বেশ বিস্তৃত। সর্ব মোট পনেরো জন কবির লেখা স্থান কবিতার পেয়েছিল এতে। প্রতিবাদ, মা রূপিনী স্বদেশের বন্দনা, ভাষান রাগ তিনটি অননুভ‚তিতে সিক্ত এ কবিভাগগুলির নির্মিত হয়েছে ষাটের দশকের কবিতার মূলে সরে। অবশ্য বিষয়বস্তু হিসাবে এগুলো নতুন নয় বাঙালী জাতির সমষ্টিগত চেতনাতেই এদের অবস্থান, জাতির এক সম্পন্ন ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার। মধ্যযুগের সৈয়দ সুলতান,আবদুল হাকিম প্রমথে মরমী কবির রচনায় ভাষান রাগ আশ্চর্য সুন্দর রূপে দাঁত। অন্যদিকে দেবতার স্বৈরাচারের বিরদ্ধে মানবের অহংবোধের উদ্ধত বিনীত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় প্রাচীন মঙ্গল কাব্যে। সতরাং বাংলাদেশের কবিতায় পরিলক্ষিত এই প্রবণতা এবং বিষয় বস্তু কেবলমাত্র সমীপবর্তী একুশ থেকে উৎসারিত, স্বান্ত, বা কালানা- ক্রমহীন এমন কথা বলা যায় না।
পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিকূল তিরিশের কবিদের বিশেষ করে বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে এবং জীবনানন্দের প্রভাব আত্মস্থ করবার প্রয়াস পেয়েছে। সংধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেন এবং সুভাস মুখোপাধ্যায়ের কবিতাও তাঁরা পাঠ করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। পঞ্চাশের দশকে এই শিক্ষানবিশীর কোন ফল পষ্টতঃ নান্দনিক অর্থে তাৎপর্য- পূর্ণে হয়ে উঠেনি। পঞ্চাশের দশকের শেষে বিরাজমান হতাশাই তার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এ প্রয়াসের ফসল ঘরে উঠলো ষাটের দশকের প্রারম্ভিক বছরগুলোতে। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হলো শামসর রাহমানের 'প্রথম গান : দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে'। লিরিকধর্মী রোমান্টিকতায় প্লটে এই প্রথম কাব্যগ্রন্হটিতে শামসর রাহমানের বাকপ্রতিমা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রায়শঃ দূরে হেতায় আক্রান্ত কিছু, মীথ সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষণীয়। জীবনানন্দের প্রভাব বিশেষভাবে অনভূত। কিন্তু বইটি অন্যকারণে উল্লেখযোগ্য। প্রথমতঃ কাব্যটি শামসর রাহমানের কবিতাকৃতির এক মেরু,তে দাঁড়িয়ে তাঁর এক অনন্য সত্তাকে ধারণ করে আছে যাকে তাঁর পরবর্তী আর কোন কাব্যেই খোজে পাওয়া যাবে না। তাঁর এ সত্তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই নতুন শামসর রাহমানের যাত্রা শুরু। একথার সজ্ঞান স্বীকৃতিও যেন রয়েছে গ্রন্থের শিরোনামে। দ্বিতীয়তঃ এ গ্রন্থটির প্রকাশনার মধ্য দিয়েই যেন বইল পরিবর্তনের হাওয়া—ক্ষীণ, তব, নিষ্পন্দ নিরক্ষীয় বলয়ে যেন সেই প্রথম বায়ুর পরশ। ১৯৬১ সালে দু'টি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনার মধ্য দিয়ে এ হাওয়া যেন আরো বলীয়ান হলো। প্রকাশিত হলো আলা- উদ্দিন আল আজাদের 'মানচিত্র' এবং সৈয়দ শামসুল হকের 'একদা এক রাজ্যে'। আমাদের সাহিত্যের এ দুই কৃতি পুরুষ কাব্যলক্ষ্মীর নিরলস সাধনা করেননি সত্যি কিন্তু তাঁদের অবদান আামাদের প্রারম্ভিক কাব্যপ্রয়াসে অনস্বীকার্য। ততঃ চঞ্চল সৈয়দ শামস ল হক কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাসের পরিক্রমা শেষে তাঁর প্রতিভার অননুকূল ক্ষেত্র খুজে পেয়েছেন কাব্যনাট্যে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও 'ধানকন্যা'র আজাদ কিংবা 'মানচিত্রে'র আজাদ ক্রমশ অপসৃত হয়েছেন আমাদের সৃষ্টির সামনে থেকে।
১৯৬৩ সাল আমাদের কাব্যাঙ্গনের একটি উল্লেখযোগ্য বছর। চারটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় এ বছর শামসর রাহমানের 'রৌদ্র করোটিতে, আল মাহমুদের 'লোক-লোকান্তর', হাসান হাফিজর রহমানের "বিমূখে প্রান্তর' এবং জিয়া হায়দারের 'এক তারাতে কান্না' সব মিলিয়ে সে এক সমৃদ্ধ ফসল। শামসুর রাহমান ছাড়া বাকী তিনজনেরই কবিতা প্রধানতঃ নিসর্গ, নারী, প্রেম নিয়ে কিন্তু উপস্থাপনায় বিশেষত্ব লক্ষণীয়। হাসান হাফিজুর রহমান তার কবিতায় স্পন্দিত গদ্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আল মাহমুদ এদেশের মাটির গন্ধে ভরা একটি অনন্য শৈলী নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছেন। জিয়ার কবিতায় নির্মাণ- কুশলতার উৎকর্ষ' নেই কিন্তু তাঁর কবিতায় লোকজ উপকরণের ব্যবহার পরবর্তী অন্ততঃ দু'জন কবির মনোযোগ এবং শ্রমকে প্রভাবিত করেছে। শামসুর রাহমানের 'রৌদ্র করোটিতে'ই সর্ব প্রথম নগরকেন্দ্রিক জীবনের মানি, নিঃসঙ্গতা এবং স্ববিরোধ নতুন আঙ্গিক এবং বাকপাতিমার অভিষিক্ত হলো। কর্মে'র ন্যায়,নৃত্য ভাঙলো - অভীষ্ট ঐক্য খুজতে হলো শব্দ এবং ভাবের অনুসঙ্গে। কবিকন্ঠের উচ্চারণ পাঠকদের সচকিত করলো, সচকিত হলেন সম্ভবত 'প্রথম গানের' কবি নিজেও। কারণ এই পথেয় শামসর রাহমান তাঁর একটি নিজস্ব ভঙ্গি এবং স্বর খুঁজে পেলেন। তিরিশের কবিদের পালম্বিত ছায়া থাকলেও এ বাচন ভঙ্গি কবির নিজের এবং তাঁর সমকালীন বহু কবির সজ্ঞান অথবা নিজ্ঞান পেরেণার উৎস। রৌদ্র করোটিতেই বাংলাদেশের কবিতার পথম সার্থক আধুনিকতায় উত্তরণ। অবশ্য শামসর রাহমানের দুর্ভাগ্য দ্বিবিধঃ এক, তিরিশোত্তর কবিদের ভাষার পরিমন্ডলকে তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। দুই, 'রৌদ্র করোটিতে শামসর রাহমান যে বিশিষ্ট জ্বর এবং ভঙ্গিটি আয়ত্ত করেছিলেন তাকে তিনি পরবর্তী কোন কাব্য- গ্রন্থেই অতিক্রম করতে পারেননি। 'নিজের সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যেতে না পারলে বড়ো কিছু, করা যায় না' সমর সেনের এই উক্তিটি শামসর রাহমানের বেলায় পঃযোজ্য বলে মনে হয়। তব, আজ একথা অস্বীকার করা যায় না যে শামসর রাহমানকে ঘিরেই আমাদের আধনিক কবিতায় প্রাণ উদীপনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আমাদের কবিতার অঙ্গনে পরিবর্তনের এ হাওয়া বইতে শুরু, করলো ১৯০৯ সাল থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। ১৯৭৯ সালের কথা উল্লেখ করছি এ জন্যে যে সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের উদ্যোগে 'পুর্ব' পাকিস্তানের সমকালীন রচনা' শীর্ষক যে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় তাতে কবি-সমালোচক সিজার রহমান তাঁর প্রবন্ধে দাবী করেন "আঙ্গিকের উৎকর্যের বিবেচনায় পূর্বে বাংলার একজন গড়পড়তা কবি পশ্চিম বাংলার কবিতার চেয়ে অন্ততঃ তিরিশ বছর পিছিয়ে আছেন। একই প্রবন্ধে তিনি আরো বলেন, "Our poets mental background has to be sufficiently enriched if their poetry is to be at the fore of our literature and not in backwaters. At present the tribal stamp is too deep on it. We are awaiting the poet who will purify the dialect. একই সময়ের কবিদের সম্পর্কে একজন কবির এ মূল্যায়ন নিঃসন্দেহে পাণিধানযোগ্য। এ মূল্যায়নের আলোকে বিচার করলে মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৯৫০ সালে কাব্যাঙনে পরিলক্ষিত এ উদ্দীপনাকে আশাতীত সাফল্য হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। উপভাষাকে শুদ্ধিকরণ করবেন যে কবি তাঁর আবির্ভাব আজো হয়ত আমাদের মধ্যে হয়নি, কিন্তু আমাদের কবিদের অক্লান্ত পয়াসে তাঁর আগমনের পথটি সুগম হয়েছে এমন দাবী করার সময় আজ সমাগত।
৫০ দশকের কবি যাঁরা তাঁদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উদ্ভত। পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুকূল্যে যে বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব ভারই সহায়ক শক্তিরূপে একটি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী মধ্যবিত্তের মর্যাদায় আসীন হয় এবং শিক্ষা, চাকুরী ইত্যাদিতে বিপলে সংযোগসুবিধা লাভ করে। পঞ্চাশের দশকের কবিরা এই শ্রেণী থেকে উঠে এসেছেন বলেই বায়ান্ন এবং চুয়ান্নর ঘটনাবলী তাঁদের কবিতায় সহসা উচ্চকিত হয়েও যেন আপন গতি হারিয়ে ফেলে। একটা সহজ রোমান্টিকধর্মী মানবতাবাদের দিকে ধাবিত হন তাঁরা। আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, সানাউল হক, আবদল গণি হাজারী, হাবিবুর রহমান, আতাউর রহমান, সিকান্দর আবু জাফর এবং সেই সঙ্গে তাঁদের অন্য কবিকূল-শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, আলা- উদ্দিন আল আজাদ, ওমর আলী, শহীদ কাদরী এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর করি। এই পরিমণ্ডলে আজাদের 'মানচিত্র'ই একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম।
ষাটের দশকের গোড়াতে এদেশে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাণকর্তা কাপে আইয়বে এদেশে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিনে বলে দাবী করলেন তার ক্ষণভঙ্গরে চরিত্র ধীরে ধীরে উম্মোচিত হতে থাকে। এ স্বৈরশাসন বৈদেশিক সাহায্যের আনুকুল্যে নবজাত
বুর্জোয়া গোষ্ঠীর স্বার্থ'কে সংসংহত করে। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সরকারী এবং বেসরকারী খাতে পাজি বিনিয়োগের হার ছিল ৭০০% ভাগের উদ্ধে"। এতে একদিকে যেমন শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হলো, অন্যদিকে তেমনি নগর জীবনের সংবিধাদির সম্প্রসারণ ঘটলো। শহর, হলো রাতারাতি বিত্তবান হবার এক অশভে এবং অসম প্রতিযোগিতা। এ আমলের এ বিশালকার উপর কাঠামোর অন্তরেই পাকিয়ে ছিল ধনংসের বীজ। নতুন বর্জোয়া শ্রেণীর অধিকাংশ ছিল অবাঙালী যারা পূর্বে পাকিস্তানকে তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসাবে ব্যবহার করতে পরে, করে। রাতি সাহায্যের সিংহভাগ বিনিয়োগ করা হয় তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রথমে করাচী ও পরে ইসলামাবাদ এ পাটি রাজধানী নির্মিতি হয় এ অর্থে । উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সংযোগ সংবিধায় বৈষম্য এমনই বৃদ্ধি পায় যে ষাটের দশকের গোড়াতেই বাঙালীর মোহমুক্তি ঘটে এবং অসন্তোষের গঞ্জেরণ ধ্বনিত হতে থাকে। এ রাজনৈতিক পট ভূমিতে সমাজও বদলাতে শহর, করলো প্রবল বেগে। নবাজি'ত সম্পদে বলীয়ান নতুন ধনিক শ্রেণীর সঙ্গে পরেনো মূল্যেবোধের ঘটলো অনিবার্য' সংঘাত। স্ববিরোধগুলোর পদভারে সমাজের বুকে হলো প্রকম্পিত। বিবেক যাদের গজদতসম সেই উঠতি বিত্তবানদের কাছে মঙ্গল-অমঙ্গল ও সন্দের অসন্দেরের ব্যবধান হয়ে এল ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। কিন্তু এই অর্থতে করে ক্ষতবিক্ষত হলেন তাঁরাই যাঁরা মননে ও অনভূতিতে সংবেদনশীল।
এমন একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতেই যাটে দশকের কবিদের আবির্ভাব। সংখ্যায় বিপলে এই কবিকলের কেউ কেউ অগ্রে গমনের মধ্য পেলেন হয়ত কিন্তু মহীরহের মর্যাদার অভিষিক্ত হলেন না কেউই। ফলে, বলা যায় এদের সম্মিলিত কণ্ঠই ষাটের দশককে দিল তার আপন বৈশিষ্ট্য। এদের প্রত্যেকেই আপন ব্যক্তিত্বের সংযমটিকে দিয়ে ষাটের দশককে করে তুললেন আমাদের কাব্যের সবচেয়ে তাৎপর্য পূর্ণে কাল। রফিক আজাদ, নির্মলেন্দ, গ্রহণ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ হুমায়ন করি, আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, আসাদ চৌধুরী, ान হাসান, মোহাম্মদ নরলে হুদা, মহাদেব সাহা, বেলাল চৌধুরী, আব কারনার, ফরহাদ মজহার, কবি রহমান, শিকদার আমিনাল হক, হারিয়ে সিরাজী, স হ খান ও জাহিল হক র্যাটের দশকের প্রধান কবিকণ্ঠ।
-ষাটের দশকের কবিতার পরিসর ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যময় বলেই তাকে কোন সহ সাধারণ সংজ্ঞার সীমানায় ধরে রাখা কঠিন। সময়ে অভিঘাতে দ, কোষ, হতাশার আকান্ত কবিচৈতন্য কখনো 'বিপদ', অন্ধকারে আত্মহননের নেশায় ধাবমান, কখনো নিকেতহীন, ঠিকানার খোঁজে সাদরে বপ্নলোক গড়তে ব্যস্ত, নিত্যদিনের দোক্ত জীবন থেকে কখনো পলায়নপর, কখনো বা নিঃসঙ্গ নগরচেতনায় আত্মগ্লানিকে ধারণ করে বদ্ধির আলোকে দীর্ঘ । ষাটের দশকের এই দঃখবোধ এবং বিপন্ন অস্তিত্বের শিল্পরূপ দিলেন সে কবিকলে যাঁদের পুরোভাগে ছিলেন রফিক আজাদ। আমেরিকান বিট কবিদের মতই প্রথাসিদ্ধ নৈতিকতার বিরদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও এ'রা নিজেদের ঠিক কবিদের সমগোত্রীয় মনে করতেন না। কারণ সমকালের সমস্ত আত্ম- গ্লানিকে ধারণ করেও এরা 'সৌন্দর্যে সমর্পিত-সৌদর্যই এদের কাছে একমাত্র সত্য।
সবদেশের মাটি মানুষের উপলব্ধি ষাটের দশকের কবিতার অপর একটি প্রধান সরে। বহু বিচিত্ররূপে এর প্রকাশ ঘটলো এ দশকের কবিদের রচনায়। কেউ গাইলেন শ্যামল মাটির গান, কারো কন্ঠে শোনা গেল প্রতিরোধের দৃপ্ত শপথ, স্বৈরাচারের বরপকে রংপকে কাহিনীতে উন্মোচিত করলেন কেউ আর কেউ বা জনতার সাথে এক হয়ে ধারণ করলেন 'হৃদয়ের মত এক আগ্নেয়াস্ত্র'।
আগেই বলেছি ষাটের দশকের কবিতা বৈচিত্র্যময়। এ সাধারণ প্রবণতাগগুলোকে ধারণ করেও কোন কোন কাজ রাতন্ত্র্যে উজ্জল । আসাদ চৌধুরী এবং মহম্মদ নরলে হাদা কাব্যে প্রচুর লোকজ উপা- দান ব্যবহার করেছেন। আব্দুল মান্নান সৈয়দে লক্ষ্য করা গেছে অধিবাস্তববাদ যা তাঁর কাব্যকে দিয়েছে অনন্যতা আবদুল হাসান নি যজ্ঞ, ভগ্নিটি তাঁর ক্ষণস্থায়ী কারাজীবনে অক্ষরে রেখেছেন।] আব কায়সার এবং মনজরে মংলাতেও এক ধরনের কীরতা লক্ষণীয়।
সত্তরের দশকের গোড়াতে এটি প্রবল রাজনৈতিক ও সামাজিক স্লোত একসাথে মিশে আমাদের কবিতার বলিষ্ঠতম ধাপটিকে বেগবান করেছে। একদিকে উনসত্তরের গণ-আন্নে এসে পড়েছে সত্তরের দোরগোড়ার অন্যদিকে এর প্রাবল্যকে চিত্তে সংহত করার আগেই বেজে উঠেছে মরিছের দামামা। এতদিনের প্রতিবাদী কন্ঠে বেজে উঠলো প্রতিরোধের গর্জন। কবিতা কথা কইলো যুদ্ধে এবং সদ্ধান্তের ভাষায় বেয়োনেট হলে। ফলের পাপড়ি' স্টেনগানের আওয়াজ হলো 'জলে সরে'১০। আমাদের কবিতার এ পর্বটি ক্ষনস্থায়ী হলেও অগ্রজ-অনজে সকল কবির অবদানে সমৃদ্ধ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতায় রয়েছে মোহভঙ্গের বেদনা এবং হতাশা। লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যখন মাননুষের জীবনের অর্থবহ হয়ে উঠলো না তখন বেদনাহত কবিচৈতন্য প্রত্যক্ষ করলো এক বিরাট ধনংসকে। আত্মগ্লানি, অপরাধবোধ থেকে জন্ম নিল একটা বিরাট 'না'। এরপর বঙ্গবন্ধ, হত্যার পরবর্তীকালে সামরিক শাসন যখন জাঁকিয়ে বসলো তখন একটা সার্বিক নিশানাহীনতা এই হতাশাকে করলো আরো পঞ্জীতে। নবীন কবিদের মধ্যে রাজনীতির সংক্রমণ ঘটলো, নাদনিক অনভেঃ তিসঞ্জাত কবিতার বদলে রচিত হলো রাজনীতির কবিতা। এদের কবিতায় মোহভঙ্গের পরেটি ধ্বনিত হলেও ষাটের দশকের শৈল্পিক উৎকর্ষ থাকলো না-থাকলো না কবি কল্পনার সংযম বিস্তার। এ দশকের কবিদের মধ্যে দাউদ হানাদার, সমগ্রে গুপ্তে, অসীম সাহা, হেলাল হাফিজ, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, মাসদের জামান, রপ্তে মহম্মদ শহীদ, কামাল চৌধুরী, মোহন রায়হানের নাম উল্লেখযোগ্য
ষাটের দশকে আমাদের কবিতার যে আলোকচ্ছটা লক্ষ্য করে আমরা উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম সত্তরে এসে তা স্তিমিত হয়েছে। আশিতে এসে সে উদ্দীপনা প্রায় অন্তহিত বলা যায়। তবে আশার কথা এই যে নতুন জোয়ার এসেছে নাটকে। বিশেষ করে কাব্যনাট্য একটি শক্তি- শালী এবং জনপ্রিয় মাধ্যমরূপে নিজের আসনটাকু সদেড়ে ে নিচ্ছে। আশির দশকে কবিতায় যখন আকাল তখন কাব্যনাট্যের দিকেই সম্ভবতঃ আমরা সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থাকবো।
***মোহাম্মদ হারুন-উর রশিদ***
0 মন্তব্যসমূহ