সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ : একটি শ্রদ্ধা নিবেদন
সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, লোকান্তরিত হবার পরেও যদি কাউকে গবান বলা যায় তো তিনি তাই, তাঁর সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল মৃত্যুর পর বেড়েই চলেছে এবং তিনি আমাদের মনোযোগ কাশ হারিনিভাবে দখল করে নিচ্ছেন; পাঠক তাঁকে ব্যবহার করছেন জীবিত | পৃথক জ্ঞানে, অথচ তাঁর জীবদ্দশায় তিনি জীবিত কি মতে এমন হয়ে জবাভাবিক ছিল না; যতদিন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বে'চে ছিলেন, তিনি ব্যবহারিক সব অর্থেই আমাদের থেকে দূরে ছিলেন- আমাদের হেরে বাস করেননি, আমাদের সমাজে বিয়ে করেননি, আমাদের পোষাক বা খাদার চি তিনি আপনার জন্যে আবশ্যিক বলে মনে করেননি, এমন কি যে বাংলা ভাষায় তিনি লিখেছেন এবং যে বাংলা ভাষার লেখক হিসেবেই তাঁকে দাঁড়াতে হবে মহাকালের সম্মুখে সেই বাংলা ভাষাকেও তিনি তাঁর বলবার কথাটি বলবার জনো একমাত্র ভাষা বলে মনে করেননি। কেবল একটি, এই একটি ব্যতিক্রম তাঁকে হস্তগত নিমজ্জিত হতে হয়েছে আমাদের এই দেশ, এই সমাজ, এই জীবন, এই অস্তিত্ব, এবং এই বিশেষ বদ্বীপটির নিজস্ব নিসর্গের ভেতরে- জার কথাটি কাকে অবলম্বন করে বলবেন, সেই অবলম্বনটি দ্বিধাহীন-ভাবে সনাক্ত করবার বেলায় । অকস্মাৎ মত্যু এসে তাঁকে ছিন্ন করে, দীর্ঘজীবন পেলেও সৈয়দ ফিল্লাহ যে দল হাতে বহন করা যায় না এমন গহর, ওজনের রচনা- সম্ভার রেখে যেতেন তা নয়, তাঁর প্রথম জীবনের লেখা থেকে শহর, করে শেষ লেখাটি পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি তাড়নায় প্রেরণার বিশ্বাসী ছিলেন না; লেখা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাছে পরি স্থাপত্য, ভাস্করের ভাস্কর্যের মতই পরিশ্রম সাপেক্ষ, ধীর- ভিতে জায়মান একটি নির্মাণ ছিল; অতএব তাঁর রচনার পরিমাণ অনিবার্য ভাবে সামান্য, সব সময়ই; এমন কি যে যুবাকালে নবীন
লেখক গোবৎসের মত কেবল আপনার শিঙের ধার পরীক্ষা করে দেখবার জন্যে অবিশ্রান্ত লিখে চলেন, তখনো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ব টি কি তিনটির বেশি গল্প লিখেছেন বলে আমরা প্রমাণ পাই : প্রায় তিরিশটি বছর কলমকে ব্যবহার করে তিনি আমাদের জা উপস্থিত করেছেন পচিশের কম ছোটগল্প, তিনটি উপন্যাস আর তি নাটক মার; হয়ত লিখেছেন আরো অনেক যা তিনি প্রকাশের উপরে বিবেচনা করেননি, লন্ডনে কারো কারো সাথে শহনেছি, সত্য নি জানি না, মৃত্যুকালে তিনি ইংরেজি ভাষায় একটি উপন্যাস শেষ করে ছিলেন, বাংলায় একটি উপন্যাস তার প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, গোটা তিনেক ছোটগল্প তৈরী হয়ে গিয়েছিল এবং কিছ, তৈলচিত্র-হ্যাঁ, তিনি ছবিও আঁকতেন, নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ নিজে করতেন, এমন কি প্রথম উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদের অসাধারণ প্রচ্ছদচিত্রটি তাঁরই আঁকা; তবও, এই অজানিত রচনাগুলোর অস্তিত্ব যদি থেকেও থাকে, বলতেই হবে, তাঁর সমগ্র রচনা পরিমাণে খবই সামান্য।
এই যে এত ভেবে কলম ব্যবহার করা, এই যে নিজের ভেতরে প্রস্তুত হতে হতে একটি দশক পেরিয়ে যাওয়া নীরবে তাঁর কাছে কিছু, নয়, তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাসের ভেতরে প্রকাশকালের ব্যবধান দশ বছরের অনেক বেশি এও এক স্বাতন্ত্র্য তাঁর, বাংলার অপরাপর বহু লেখক থেকে, যে, তিনি পাঠক মজাতে কলম ধরেননি, পাঠকের প্রশংসা তাঁকে অগ্রসর বা উন্নত করতে বিন্দুমাত্র পত্রয়োজন বলে তিনি মনে করেননি। তিনি জীবনকে একটি বিশেষ বিন্যাসে দেখতে পেয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে সেই বিন্যাসটি আর কারে। রচনায় নেই, তিনি জীবনের একটি অর্থ সংকেত লক্ষ্য করেছেন এবং তাঁর মনে হয়েছে সেই সংকেতটি আর কারো লেখায় তিনি পাননি, অতএব তাঁকে উদাম হতে হয়েছে এবং উপস্থিত করতে হয়েছে সেই আপন দৃষ্টিতে দেখ বিন্যাস ও সেই আপন শ্রুতিতে শোনা সংকেত, তিনি লিখেছেন; এক তিনি লিখেছেন, যেন তাঁর ধীর লয়ে প্রবাহিত গদ্যের গাম্ভীর্ষ অতীত-ভবিষ্যৎ আলিংগন করা ক্রিয়াপদের নিত্য ঘটমান রূপটি ে করে এই স্বগতোক্তিটি অবিরাম ফিসফিস করে উচ্চারিত হয়ে চলেে যে, এভাবেও তো জীবনের একটি অর্থ করা যায় – অর্থই বা কেন ? ে তো আরো পরের কথা, জীবনকেই আমরা এভাবেও দেখে নিতে পারি যে জীবনের অনেকখানিই আমরা দেখিনি, আমরা যেন বা 'চাঁদের অন ৰস্যা'র সেই সবক-শিক্ষক যে 'রক্তাক্ত মুরগী মাখে তামাটে শেয়াল দেখেছে, আর কিছু দেখেনি,সৈয়দ
ওয়ান জিন্নাহর এই শিক্ষকটির মত আমরাও যখন বাঁশবনে যুবতীর দেহ হঠাৎ দেখে উঠি, প্রায় উলংগ সেই অবিশ্বাস্য দেহ যা মতে এবং জ্যোছনার আলোছায়ায়, সেই শিক্ষকটির মত আমাদের সমস্ত কিছুই বিকট নীরব আর্তনাদ করে ভেংগে পড়কে বা না পড়নক, আমরা অন্তত এই আবিষ্কার করি, যে জীবন ও পরিপার্শ্বকে এমন করে আমরা জাগে কখনো দেখিনি যেমনটা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দেখেছেন; শহর, জীবন কেন ? নিসর্গ', যে নিসর্গ' আমরা জননীর মত স্নেহম ভারী অপর্ণা বলে জানতে অভ্যন্ত, সেই নিসর্গেও পালটে যায়, তার অন্তঃস্থলে আমরা সঞ্চরণ অনুভব করি, যেন বা সে জীবিত কিন্তু অপরিচিত, জননী তো দূরের কথা, শত্রু কি মিত্র-তা পর্যন্ত নির্ণীত নয়, অথচ এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে এই নিসর্গের সংগেই আমরা আবদ্ধ ; 'কাঁদো নদী কাঁদো'র খাঁকাল নদীটি পর্যন্ত মানষের মত নয়, মানষে যা এমন কি উপন্যাসের সমস্ত মাননুষের চেয়ে অভিমানষে হয়ে ওঠে এই নদী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চোখে, এবং তখনি আমরা বুঝতে পারি, এমন করে আর কেউ দেখেননি বলেই তাঁকে কলম ধরতে হয়েছে, আর এই দেখাটিকে ভাগ করে নিতে হয়েছে তাঁকে তাঁর ভাষার তাঁর মানষের সংগে বুদ্ধদেব বসরে সেই কথাটি মনে পড়ে যায়, সব লেখকই বাধ্যতা- মূলকভাবে দেশপ্রেমিক, কারণ তাঁকে ভাষায় লিখতে হয়, সে ভাষা এক বিশেষ গোষ্ঠীর এবং যেহেতু বিশেষ একটি ভাষায় তাঁকে লিখতে হচ্ছে, সেই গোষ্ঠীর কথাই তাঁকে লিখতে হয়, এ ভিন্ন আর কোন উপায় নেই তাঁর; প্যারিসে বসেও তাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে লিখতে হয় বাংলার এবং বাংলার গরিষ্ঠ মাননুষ যেখানে বাস করে সেই গ্রামের পটভূমিতে সাধারণ মানুষের কথা ।
বলবার কথা থাকে বলেই লেখক লেখেন; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মত সচেতন ও সতর্ক লেখক তো বারবার পরীক্ষা করে দেখেন—তাঁর বলবার কথাটি বলবার প্রয়োজন আদৌ আছে কিনা, তাই তিনি দুই রচনার মাঝখানে এত সময় নেন ভারতে; সেই বলবার কথাটি কি সেদ ওয়ালীউল্লাহর ? যদি তিনি জীবিত থাকতেন, যদি তিনি সক্রিয় থাকতেন এখনো, তাহলে আমরা এ বিষয়ে শেষ কথা কিছ, বলতে পারতাম না, কারণ, মানষে যদি সত্যিকার অর্থে বেচে থাকে, সময় ও পরিপার্শ্বের প্রতি চোখ রেখে যদি তিনি অগ্রসর হন, তাঁর ভেতরে চিস্তার বিবর্তন ঘটতে বাধ্য, তাঁর দৃষ্টিকোণ 'অস্থির' হতে বাধ্য এবং তাঁর সিদ্ধান্ত ও পরিবর্তিত হতে বাধ্য; অতএব আমাদের অপেক্ষা করতে হত এই লেখকের ভেতরের মূল কথাটি করতলের ওপরে তুলে আনবার জন্যে। এখন সে অপেক্ষার প্রয়োজন নেই, তিনি লোকান্তরিত, তাঁর রচনাসভার সম্পণে, এবং অপ্রকাশিত রচনা কিহ থেকে থাল দীর্ঘ ষোল বছরেও তা অনাবিস্কৃত; অতএব এখনি সম্ভব তাঁর অন্ত: স্থলে অমানের যাত্রা এবং তর্কাতীত মানচিত্রটি আঁকা কিবা না; কারণ, সরলীউল্লাহ সেই গ্রেণীর লেখক, সেই মাপের স্রষ্ট। সেই জাতের নির্মাতা যাঁদের রচনার আলো আমাদের ওপরে যেমন পড়ে, আমাদের বদলে দেয়, তেমনি আমাদের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের আলোও তাঁর রচনার ওপর পড়ে এবং নতুন রূপ নেয়, ইতোপর্বে অনেক অাবিষ্কৃত বাঁক ও গন্তব্য চোখে পড়ে। অতএব, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সম্পূর্ণ রচনাসম্ভার হাতে নিয়েও শেষ কথা বল। বিপজ্জনক, কেবল নিশ্চিত এটকু যে তিনি জীবনের মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে আমাদের বাধ্য করেন; আমরা তাঁর লেখা পছন্দ করতে পারি বা না-পারি, কিন্তু সেই প্রশ্ন থেকে আর আমরা রেহাই পাই ন৷ যদি একবার 'লালসাল ‘চাঁদের অমাবস্যা', 'কাঁদো নদী কাঁদো', 'বহিপীর', ‘তরংগ ভংগ', 'সড়ংগ' কি' দহই তাঁর' এমন কি প্রথম বই, 'নয়নচারা' হাতে নিয়েছি ও পরে। না হলেও কিছুদুরে পড়েছি।
'নদী কাদো'র একটি চরিত্র সকিনা খাতুন, সে 'ঘাটে নৌকা এসে ভিড়লে যাত্রী যেমন সহসা জীবন্ত হয়ে উঠে আপন পথে চলতে শর্তে, করে তেমনি সহসা এবং সহজেই সে সাংসারিক লিপ্ত হয়ে পড়ে।' এই সাংসারিক জীবনে লিপ্ত হয়ে পড়বার পরে কিনা খাতুনের কি হয়? সারাদিনের কাজের পরে যখন ে ী হবে এখন আমাদের উদ্ধতি " বিছানায় আশ্রয় দেবামার ঘামটা কট করে এসে যায়। প্রথমে সহসা সমস্ত দেহে যে অবসাদ বোধ করে সে অবসাদের সংগে মিশে ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে ওঠে, দৈনন্দিন সাংসারিক কথা বা স্কুলের চটিচটি কথা হালকা মেঘের মত তার মনের সীমানায় কয়েক মুহুর্তে উড়ে বেড়ায়, কোথাও ছায়া না ফেলে, তারপর সে সব কথা কখন সপ্নের প্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়, আবার স্বপ্ন গভীর নিদট্রায় অন্তহিতি হলে নিদার নিরাকার বিণ্নতির মধ্যে নিশ্চিহ। হয়ে যায়। কেবল চিৎ কখনো মনে আসতে ইয়ং দেরী হলে অদৃশ্যে নিশাচর পাখির মত রাতের অন্ধকার থেকে উড়ে এসে অন্যান্য কথা মনে নিঃশব্দে ডানা ঝাপটায় : জীবন-মৃত্যুর কথা, বেহেস্ত-দোজখের কথা, সূর্য- চন্দ্র-নক্ষত্রের কথা, মানষের কথা, সে সব সে ভাবেই কেবল, কোন উত্তর সন্ধান করে উন্মুক্ত মাঠের শেষে দিগন্তের গ্রাম্যবধ, যেমন অনকটে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে তেমনি তার মনও আন্তে আস্তে চোখ মেলে সে-সব রহস্যময় কথাগুলির বিষয়ে ভাবে মনে এ বা বহলতা বোধ না করে, যেন যে- বৌধ্য দিগরে দিকে তাকায় সেখানে যদি ভয়ের বা বিহ্বলতার কিছু থেকে থাকে তা তাকে স্পর্শ করবে না : সে সব বিষয়ে কোন কারণে রাত জীবের মতই সে নিরাপদ বোধ করে। সে কখনো কোনো প্রভাব বোধ করে না, কি কামনাও করে না। তার ইশৎ কৌতহল
যখন শেষ হয় তখন সে রাতের আওয়াজ শোনে। কোথাও ইদংরের সাবধানী সরণ, রাতপাখির ডাক, কাঠের ক্ষীণ আকস্মিক আর্তনাদ। সে-সব আওয়াজ শনতে-শনেতে কোন কোনদিন তার মনে ন জাগে, মৃত্যুর পরে যে জীবন সে জীবনের না জানি কি রকম আওয়াজ।”
এই উদ্ধৃতির একটি জায়গা আমরা আবার স্মরণ করি - সকিনা তার মাথার ভেতরে যেসব কথার ওড়াউড়ি অনুভব করে, তার ভেতরে। বেহেস্ত দোজখ নয়, মাননুষের কথাও আছে, এবং বাক্যের শেষ কথাটাই যদি লালরেথ কথা হয়, লোকের অভিপ্রায়ে সবচরে গুরত্বপূর্ণ কথা, তো, শেষ কথাটি হচ্ছে, 'মাননুষের কথা।" 'চাঁদের অমাবস্যা'য় একটি আশ্চর্য' বাক্য আছে, সমগ্র সৈয়দ ওয়ালী
উল্লাহর এর তুল্য বাক্য নেই; “বাঁশঝাড়ে একটি নারী অর্থহীনভাবে জীবন দিয়েছে। আর বিশ্বাস, মানুষের জীবন এত মংলাহীন নয়।" এ বিশ্বাস যদিও যবেক-শিক্ষকের বিশ্বাস বলে বর্ণিত, যে ঐ মায়াদেহটি আবিষ্কার করেছে, এ বিশ্বাস স্বয়ং লেখকেরই, মাননুষের জীবন মূলা- হীন নয় বলেই ওয়ালীউল্লাহ 'লালসাল'-র মত উপন্যাস কল্পনা করতে পারেন, যেখানে মাজারকে ব্যবসার পরিণত করা হয়। এবং সেই মাজারের পাশে এরই রচয়িতা যে মজিদের এক যুগ ধরে বনবাস সে নিজেই চমকে ওঠে— 'কার কবর এটা ?' যেন 'নিজেকে সে বিস্ময়কর ভাবে নিঃসঙ্গ বোধ করে।' যে মজিদ গ্রামবাসীকে শিক্ষা দেয়, 'পৃথিবীতে যাই ঘটকে, জন্ম-মৃত্যু-শোক-দুঃখ যার অর্থ অনেক সময় খুঁজে পাওয়া ভার হয়ে ওঠে সব খোদা ভালোর জন্যেই করেন।” – সেই মজিদই মাজাররংপে ঈশ্বরভীতির যে দৃশ্যেরূপে নিজে রচনা করেছে, মাজারটি দেখে চমকে ওঠে; কারণ, মজিদের রচয়িতা ওয়ালীউল্লাহ সহজাত তাঁর এই জ্ঞানটি গোপন রাখেন যে, 'মানুষের জীবন এত মূল্যহীন নয়।'
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসের শেষে এর একটি চরিত্র তবারক ভাইঞার একটি কথা আমাদের মনে করিয়ে দেন, যে, ‘নদী যদি কে‘দে থাকে তবে নিজের দঃেখে নয়, কুমারডাঙার অসহায় অধিবাসীদের দঃখেই কেদেছিল।'; আমরা বাস্তব দেখে উঠি, নদী তো আর সত্যি সত্যি কাঁদে না, মান, ষের কল্পনা নদীর এই কুশন, ওয়ালীউল্লাহ তাই এ রংপকের ভেতর দিয়ে বলতে চান, শেষ সাঁতা কথাটি, যে, মানষেই মাননুষের দুঃখে কাঁদে, বাঁকাল নদী যে কুমরডাঙার মাননুষের জন্যে কাঁপে তা মানুষের এবং সমাজবদ্ধ মানষের কম্পনের কোরাস। ওয়ালীউল্লাহ যেন উপন্যাসটির শেষ বাক্য, যা এই উপন্যাসের নাম সরবরাহ করেছে, লেখেন- 'কাঁদে৷ নদী,কাদো-যেন একটি মিনতি তিনি করেন, মাননুষ তুমি মাননুষের জন্যে কাঁদো। মাননুষের জন্যে, মাননুষের জীবনের জন্যে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর
কলম- আমাদের সদেহ থাকে না, যখন বড় স্পষ্ট করে তিনি বলেন; বহিপীর' নাটকে পীর সাহেবের উচ্চারণে, “এক এক সময় ভাবি, সব ছাড়িয়া ফেলিয়া সত্যিই চলিয়া যাই যে দিকে চোখ যায়, গাহ। গহরে অরণ্য পর্বতে ও ইরান তুরান কালিস্তান-এ যেখানেই নিরিবিলি একাকী খোদার এবাদত করা যায়। কিন্তু উহা স্বপ্ন, পীরেরও স্বপ্ন থাকে। আসলে আমি ইহাই ভাবি যে, সমস্ত ত্যাগ করিলে এবাদত হয় না, কারণ সমস্ত ত্যাগ করিলে মানবে আর মানষে থাকে না, অনানষে পরিণত হয়। শুনোতার মধ্যে শূন্যতাই সম্ভব; সেখানে রহের মাতি মিলে না। তাহা হইলে খোদা কেবল আসমানই সংষ্টি করিতেন, জমিন করিতেন না।"
আমি কে? আমি কোথায় ? আমি কেন? এবং সমাজবদ্ধ যখন আমি, তখন প্রশ্ন, আমি কিভাবে ? -এই মৌলিক প্রশ্নগুলো মানবের এবং তার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার ভাষা, যে ভাষা না হলে মানব হত না, সেই ভাষায় যারা কাজ করেন, মানবের বিবেক, সেই লেখকদের। উত্তর পাওয়া না-পাওয়া বড় কথা নয়, প্রশ্নগুলোর অস্তিত্ব অনভব করাই বড়, তার সন্ধান করাটাই আসল; এসবের উত্তর যুগে যুগে শতকে শতকে কবি, নবী ও বিজ্ঞানীরা জে আসছেন, কেউ কিছ, উপস্থিত করেছেন, কেউ বিভ্রান্ত করেছেন, কেউ শধে, সবল আঙ্গলে বাড়িয়ে আমাদের স্বয়ং চলতে সাহায্য করেছেন; একজন ঔপন্যাসিক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মত সচেতন সতর্ক' ঔপন্যাসিক তো এই আঙ্গুল বাড়িয়ে ধরার কাজট কুই করেন, তার অতিরিক্ত কিছ, নয় ।
বলা হয়ে থাকে, প্রায়ই যে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অস্তিত্ববাদ ন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, এবং আলবেয়ার কাম, ছিলেন তাঁর আদর্শ, আর কামরে সেই মানষ, সেই আউটসাইডার, ছালাউল্লাহ সব মাননুষের ভেতরে খাঁজতে চেয়েছেন। আমরাও লক্ষ্য না করে পারি না, 'লালসাল, 'তে যে মজিদ নিজের রচিত মাজার দেখে নিজেই চমকে ওঠে, সে মানুষের ভেতরে শেষ পর্যন্ত মিশে যায় না, সে বড় নিঃসঙ্গবোধ করে-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ লেখেন, এ নিঃসঙ্গতা কালের মতো আনিষহীন যার কাছে মাননুষের সংখদঃখ অর্থহীন অপলাপ মাত্র।” আমাদের চমকে উঠতে হয়, মাজার দেখে মজিদেরই মত, যে, আলাউল্লাহ লি “মানষের সংখদঃেখ অর্থহীন অপলাপ মাত্র।” আমাদের মনে হয়, উপলব্ধিটি ষোল আনা আরোপিত, কিবা যদি আরোপিত না হয়, যদি এরই দিকে ধাবিত ছিল উপন্যাস, তাহলে মহৎ এক সুচনার শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ পরিণতির উদাহরণ এই 'লাगान।' 'আा অননুমান করে উঠতে পারি, যেন প্রায় প্রত্যক্ষই কর, म উল্লাহর বিদেশবাস, ইয়োরোপীয় সাহিত্য ও দর্শন যা ছিল সমসময়ের, সে সম্পর্কে তাঁর অতি উৎসাহ কিন্তু পরিপাক করা সময় কিবা প্রতিভার অভাব—তাঁর বাল্য ও কৈশোরে দেখা বাংলার জীবন, নিসর্গ' ও দিনরাত্রি থেকে প্রাপ্ত, বাংলার পলিতে বিনা যত্নেই উ ও বধিতে বৃক্ষের মত তাঁর সহজ সিদ্ধান্তগুলো কি ভাবে পতুনত্বে দিচ্ছে, বিস্তৃত করছে, কিম্ব। আড়াল করছে।
'লালসাল, ' তো এ দেশে লেখা, ইয়োরোপে লেখা 'চাঁদের অমাবস্যা" কিম্বা 'কাঁদো নদী কাঁদো'য় আমরা আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিজেই কি ভাবে আমাদের ঠেলে দিচ্ছেন, না, তাঁর রচনার অন্তর্গত অস্থি বা উপলব্ধি দিয়ে নয়, নিতান্তই আরোপিত, সংযোজিত কিছু, ভাবনার উচ্চারণ দিয়ে, এমন ধারণার দিকে, যে, তিনি অস্তিত্ববাদী দর্শনে বিশ্বাসী এবং সার্ত্র নয়, কামরে অস্তিত্ববাদের আলোকেই তিনি জগৎ ও মানব পর্য‘বেক্ষণ করছেন। 'চাঁদের অমাবস্যা'য় ববেক-শিক্ষক যখন যুবতীর লাশ দেখে ভাবে— 'মানষের জীবন এত মংলহীন নয়' সেই যাবক-শিক্ষকই যখন নেতির পথে পা বাড়ায় অবিলম্বে, ওয়ালীউল্লাহ যখন লেখেন, “তার পরিচিত জগত সে যে আর দেখতে পায় না তাতে তার দঃেখ হয় না, বরঞ্চ তাতে সে স্বস্তিই পার। তবে এমন স্বচ্ছন্দতার সঙ্গে সে জগত পরিত্যাগ করতে পেরেছে বলে মনে একট, বিস্ময় হয়। যে দলে ক্ষ্য প্রাচীরবেষ্টিত জগতের মধ্যে মানষে আষ্টে-পাষ্ঠে বাঁধা, তার আলিঙ্গন থেকে এত সহজেই যে মুক্তি লাভ করা সম্ভব সে কথা সে জানত না।”— আমরা পড়তে পড়তেই না-সচক মাথা নাড়তে শরে করি, এই কারণে, যে, যেভাবে ওয়ালীউল্লাহ এ উপন্যাসের ভিত্তি স্থাপন করেছেন, এবং যেদিকে তিনি অগ্রসর হবেন, তার সঙ্গে যাবক-শিক্ষকের এই উপলব্ধির কোন যোগ নেই, বলা ভাল ওয়ালীউল্লাহর উপলব্ধির যোগ নেই। 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসের প্রায় অন্তিমে সৈয়দ ওয়ালী- উল্লাহ্ লেখেন, "যখন বাড়ীর পশ্চাতে উপস্থিত হই তখন দেখতে পাই, যে তেল গাছের তলে বাল্যবাসে একটি অদশ্যে সীমারেখা পেরিয়ে সে-গাছ থেকে মহামমদ মোস্তাফার নিষ্প্রাণ দেহ ঝুলেছে, চোখ খোলা। "আমরা বিশ্বাস করতে পারি না, যে, মহাম্মদ মস্তফা এই আত্মহননের দিকেই এতক্ষণ এগিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের নিতে বড় কষ্ট হয়, नামকরণও বড় সচেতনভাবে রাউল্লাহ করেছিলেন, কারণ অন্যান্য চরিত্রের নাম খোদেজা বা আমেনা
এতগুলো আকস্মিকতা তাঁর মত লেখকের কাছে হয় না যে মোস্তফা এ উপন্যাসে জীবন সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী, জীবনের সবচে মনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক, এবং যার সম্পর্কে আলী নিজেই লেখেন, অনেক কথা সহজে সক্ষম হয় এবং সে মা গোদা নিরাকার জেনেও তাকে সাকার কলিজা রূপে কল্পনা না করে পারে না, সেই বাস্তববোধসম্পন্ন, সংবেদী, পরিপার্শ্ব' সচেতন, নিজের জীবনকে মূল্যবান মনে করবার মত ব্যক্তি মহাম্মদ মস্তাফা, যাঁর নামের সঙ্গে মিল রয়েছে সবচেয়ে বাস্তববাদী এক পরগরের, সে যে আত্মহত। করবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কলিজার রংপকটি টেনে এনে, ঈশ্বরের প্রতি- রূপ হিসেবে সেই কলিজাকে উপস্থিত করে তাকে থরথর করে কাঁপিয়ে যে শেষ পর্যন্ত মহাম্মদ মাস্তাফার জীবনঘাতী পরিণতি রচনা করবেন, এটা আমি অন্তত কৃত্তিম ও আরোপিত মনে করি; সংষ্টিশীল এর অন হিসেবে আমি বলতে পারি মস্তোফার আত্মহত্যার বিষয়ে শেষ পৃষ্ঠার আগের পৃষ্ঠার বাক্য দুটি কেটে দিলে সেটা উপন্যাসের কিছুই এসে যেত না, কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রক্ষা পেতেন নিজে আমার মতে, তাঁর আহক অন্তরবাদপ্রীতির হাত থেকে অহেতুক এইজন্যে যে তাঁর কোন রচনার কোথাও অনিবার্য হয়ে এটা আসেনি - এবং আমরাও অস্তিত্ববাদ বিষয়ে সরল মন্তব্য করা ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনা- আালোচনা প্রসঙ্গে উৎসাহের সঙ্গে এসব টেনে আনা থেকে বিরত থাকতাম।
এই হচ্ছে, সংক্ষেপে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দুর্বলতা, যে তিনি অস্তিত্ববাদের ফ্যাশনের থাপরে পড়েছিলেন; তাঁর লেখায় এর প্রভাব সম্পর্কে তাঁর জীবদ্দশাতেও যখন কিছ, উচ্চারিত হত তিনি খন্ডন করেননি, বাধা দেননি, বরং প্রশ্নর দিয়েছেন বলা যার একের পর এক গল্পে বা নাটকে বা উপন্যাসে অস্তিত্ববাদ দর্শনের ছদ্মবেশী কিছু, বাকা কিন্তু, রচনার নির্মিতি, জীবনের উপলক এবং অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্নের উত্থাপন-সরল ও তরল উপন্যাস পাঠে অভ্যন্ত বাঙালী পাঠকের কাছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে সবল মহত্ত্ব এনে দিয়েছে; কুসংস্কার ও ধর্ম ব্যবসায়কে তিনি যে তুমলে হাতে নগ্ন করে দিয়েছেন, বাঙালী ন;সলমানের জীবনযাপনের ভেতর থেকে তিনি যে উপাদানগগুলো বের করে উপন্যাস ও নাটকে ব্যবহার করেছেন যা অন্য ধর্মে যাদের জন্ম ও বৃদ্ধি তাদের কাছে আদৌ পাওয়া যাবে না, এবং এই 'ভাষাপ্রেমিক দেশে ভাষার প্রায়-সম্পাদনকারী জাতির কাছে বাংলা গদ্যের যে এক বিস্ময়কর ইপে নির্মাণ করে গেছেন, তার জন্যে আমাদের সকল শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি তিনি তাঁরই দুর্বলতার অনেক ঊর্ধে তাঁকে আমাদের বারবার পাঠ করতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ