Hot Posts

6/recent/ticker-posts

ফ্রান্জ কাফ্কার মেটামরফোসিস গ্রন্থের বিষয়বস্তু আলোচনা



ফ্রান্জ কাফকা, 

একজন ব্যাতিক্রমিধর্মী লেখক। ১৮৮৩ সালে প্রাগ এ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বিচিত্র চিন্তা ও মননের অধিকারী কাফকা,রুপকের আড়ালে চরম বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি মানুষকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেন।মানুষ যখন পরিবর্তিত হয়,তখনই সে চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েে উঠে।এই পরিবর্তন হতে পারে, ভালো মানুষ থেকে খারাপ মানুষে,কিংবা ধনী থেকে গরিবে অথবা গরিব থেকে ধনীতে।হতে পারে সুন্দর থেকে হঠাৎ কুৎসিত হয়ে যাওয়া কিংবা কুৎসিত থেকে সুন্দর হওয়া।এই সব বিচিত্র বিষয়,  মানুষের মাঝে ইতিবাচক অথবা যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়,সেই অদ্ভুত বিষয়গুলোর ব্যাবচ্ছেদ করেছেন  কাফকা।


গতানুগতিক বিষয় থেকে বের হয়ে,অদ্ভুত এবং ব্যাতিক্রমি দর্শন কে অবলম্বন করে, তিনি পাঠকদের,সাহিত্য নিয়ে গভীর চিন্তার জগতে প্রবেশ করিয়েছেন।তার লেখা মেটামরফোসিস বা রুপান্তর, গ্রন্থ টিতে একটি চরিত্রের হঠাৎ করে  পরিবর্তনে, তার উপর,তার পরিবারের উপর যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিলো সেটি তিনি দেখিয়েছেন।


'রূপান্তর' যথার্থই একটি অত্যাশ্চর্য গল্প, সেই সঙ্গে সঙ্গে কাফকার প্রতিনিধিত্বমূলক রচনাও বটে। কাফকা-সাহিত্যের সবগুলো প্রধান লক্ষণ এর মধ্যে বিদ্যমান। মানুষের জীবন, কর্ম ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা- দুঃস্বপ্ন; মানুষের নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা ও অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থতা; নিজেকে অপরের কাছে স্পষ্ট করে তোলার অক্ষমতা; নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভাবনার কথা অন্যকে কিছুতেই বোঝাতে না-পারা; মানুষের চরম ঔদাসীন্য ও নিস্পৃহতা; বর্তমানের বিরাজমান পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে অতীতের স্নেহ-মমতা-সহানুভূতির অবলুপ্তি; তারুণ্যের কাছে তাৎক্ষণিক জীবনের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ এবং তার ফলে জীর্ণ-অসুস্থ-মৃতকে দ্রুত বিস্তৃত হওয়া-এই সবই কাফকা তাঁর 'রূপান্তর' গল্পে তুলে ধরেছেন। গল্পটি কাফকার অন্যান্য রচনার মতোই একাধিক স্তরে উপভোগ্য, বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ; এর মধ্যে ফ্যান্টাসি আছে, রূপক-প্রতীক আছে, আর তার আড়ালে আছে নির্মম সত্যের উদ্ভাসন । এখানে নাটকীয়তা আছে, নিখুঁত চরিত্র-চিত্রণ আছে, সর্বোপরি আছে বিশদ বাস্তববাদী বর্ণনার ঐশ্বর্য।

'মেটামরফোসিস'-এর কাহিনী সংক্ষেপে এই রকম যুবক গ্রেগর সামসা এক মধ্যবিত্ত ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান কঠিন তার জীবন-সংগ্রাম। বৃদ্ধ মা-বাবা আর তরুণী ছোটবোনকে নিয়ে সে থাকে। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব তার কাঁধে। নানা দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা, আনন্দহীন ক্লান্তিকর কাজের বোঝা, চাকরি ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঔদাসীন্য প্রভৃতিতে সে বিপর্যস্ত তবু এর মধ্যেও তার মনে একটা গোপন গর্ববোধও আছে। সে-ই সংসারটা চালাচ্ছে। ছোটবোনকে সে ভালোবাসে । তাকে সংগীতবিদ হবার সুযোগ করে দিতে সে দৃঢ়সংকল্প এসব কথা অবশ্য অমরা গল্পের শুরুতেই জানতে পারি না। 


গল্পের বিকাশ হয়েছে অদ্ভুত এক ঘটনা দিয়ে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর দেখেন, সে একটি আরশলা তে পরিণত হয়েছে!!!... নিজেকে এমন ভয়ংকর ভাবে আবিস্কার করে, ভীত হয়ে পড়েন গ্রেগর।সে রুম থেকে বের হতে চাই না,কারণ তার পরিবার বিষয়টি সহজ ভাবে নিতে পারবেনা।তাই সে বের হতে চাই না।এইদিকে গ্রেগর কখনো তার অফিস মিস করতো না,কিন্তু আজ সে বের হতে পারেনা।এইদিকে অফিসের কেরানি তাকে ডাকতে আসে।শেষ পর্যন্ত, বাবা মা এবং বোনের কাছে পরাজিত হয়ে, বেরিয়ে আসেন গ্রেগর।পুরো পরিবার ভয় আর আতংকে তাকে আঘাত করতে থাকে।আর এইদিকে কেরানি বিরাট আরশোলা দেখে পালিয়ে যায়।গ্রেগর এর মা, তার একমাত্র ছেলের এমন পরিণতি দেখে অসুস্থ হয়ে পরেন।তার বাবা গ্রেগর কে আঘা ত করতে থাকেন।শেষ পর্যন্ত তারা মেনে নেয়। তবে বাবা মা খুব একটা কাছে আসতো না,তার বোন প্রতিদিন তার জন্য ঘাস,সবজি,উচ্ছিষ্ট দিয়ে যেতো। আস্তে আস্তে তার পরিবার গইসব বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে পরে।একসময় দেখা যায়,তার পরিবার আর গ্রেগ্রর কে নিয়ে চিন্তা করেনা।এক প্রকার ভুলেই যায়।বাবা মা নিজেদের টিকিয়ে রাখার চিন্তায় ব্যাস্ত অন্যদিকে, বোন নিজের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নিতে ব্যাস্ত।এইদিকে পরিচারিকাও তাকে অবহেলা করতে থাকে,তার থাকা ঘরে,নোংরা জিনিসপত্র ছুড়ে মারে,এবং সেইসব এর আঘাতে গ্রেগর অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং শেষ পর্যন্ত গ্রেগর এর মৃত্যু হয়।এক চরম ট্র্যাজেডির মাধ্যমে, গ্রেগর অধ্যায় এর পরিসমাপ্তি ঘটে।


আর এর পর দেখা যায়, তার পরিবার কিছু দিন এর জন্য কস্ট পেয়ে,নিজেদের আবার ব্যাস্ত করে ফেলেন। তাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়,আরশোলায় পরিণত হওয়া গ্রেগর জেনাফ।আর এভাবেই গ্রন্থের পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে। 


এই গল্প আমাদের জন্য এমন একটা জগতের ছবি তুলে আনে যা পারম্পর্যহীন চরম নৈরাজ্যের, যেখানে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কিছুতেই অর্থবহ যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না, শুধু সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ও চরম শূন্যতার মধ্যে হাবুডুবু খায়।   সম্ভবত আধুনিক পাঠক কুল 'মেটামরফোসিস'সহ কাফকার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মে এক নতুন আঙ্গিকে সমকালীন বিপর্যন্ত সমাজের নির্ভুল চিত্রকে প্রতিফলিত হতে দেখে বলেই, এর আপাত-উদ্ভটতা সত্ত্বেও, এর প্রতি প্রবল আকর্ষণ বোধ করে।

কাফ্কা গ্রন্থ টিতে একটি গভীর চিন্তার বার্তা দিয়েছেন।মানুষের সামান্য পরিবর্তনে, তার অবস্থান, সম্পর্ক ইত্যাদি যে কোনো সময় পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। আমরা যে সমাজ বা পরিবেশ নিয়ে বেচে আছি,তা যে কোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে।আর সেটি কারো জন্য হতে পারে ইতিবাচক, কিংবা করো জন্য নেতিবাচক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ