Hot Posts

6/recent/ticker-posts

বাংলা কথাসাহিত্যে নারী-পুরুষের সম্পর্ক

 বাংলা কথাসাহিত্যে নারী-পুরুষের সম্পর্ক


হুমায়ূন আহমেদ 

নর-নারীর সম্পর্ক বলতে কি বোঝায় ? যৌনতা অবশ্যই এর একটি বড় দিক এবং অবৈধ যৌন সম্পর্কও। কিন্তু এই কি সব? সম্পর্কের ব্যাপকতা তার অনস্বীকার্য” বহ,মাত্রিকতা কি কোনই তাৎপর্য বহন করে না? নজিবর রহমানের 'আনোয়ারা'তে আনোয়ারা এবং নরল ইসলামের যে সম্পর্ক তাকে কি নারী-পুরুষ সম্পর্ক বলব না ? ফয়েড সাহেব বলকে আর না বলকে যৌনতা নারী-পুরুষ সম্পর্কের একটি প্রধান দিক তবে এ-ই সব নয়। নর এবং নারী শব্দ দু’টিকে বিশেষ ভাবে খণ্ডিত অর্থে গ্রহণ করলেও তা কেবল প্রেমিক ও প্রেমিকায় সীমাবদ্ধ থাকে না। হাসনা বেগম তাঁর "কঠিন" প্রবন্ধটিতে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনটি মতবাদের আলোকে কয়েকটি উপন্যাস বা উপন্যাসে বর্ণিত চরিত্রের উল্লেখ ও আলোচনা করেছেন। আলোচনার এ পদ্ধতি তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা জোরালো করতে পারে তবে তা সাহিত্য বিশ্লেষণে বা অন ধাবনে কতটুকু সহায়ক এ নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে।

জীবনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ থেকে পাওয়। সাধারণ সত্যই এক সময় তত্ত্বের স্বীকৃতি পায়। কথাসাহিত্যিক জীবন থেকেই উপাদান গ্রহণ করেন। ফলে তত্ত্বের সঙ্গে সাহিত্যের সঙ্গতি অবাভাবিক কিছ নয়। তাই বলে জীবন বা সাহিত্য তত্ত্বের অনসারী নয়। বরং উল্টোটাই সত্য । অর্থাৎ জীবন বা সাহিত্যই তত্ত্বের আশ্রয়। আলোচনার উপসংহারই তত্ত্বের সমর্থন সংস্থাপনের যোগ্যতম স্থান। এতে আলোচনা উন্মুক্ত থাকার অবকাশ পায়।

'রক্তের সম্পর্ক' বলে বিবেচিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে 'দৈহিক বিষয়ের অবতারণা'য় বাধা নিষেধের কথা মনে করে হাসনা বেগম এ দিকটি এড়িয়ে গেছেন, কিন্তু রশীদ করীম তাঁর প্রবন্ধ শরণ করেছেন ইডিপাসের সংকট উল্লেখ করে।

এই সচনাকে কি আমি ইংগিত হিসেবে গণ্য করব? রশীদ কথাশিল্পী। অভিজ্ঞতা এবং অধ্যয়নে সমন্ধে। তাঁর প্রবন্ধে উভয়েরই ছাপ আছে। এর চেয়েও বড় কথা তাঁর তাত্ত্বিক আলোচনাও রস ও রসিকতায় ধন্য।

যেখানে যৌনতা বিশেষ করে অবৈধ যৌনতা প্রাধান্য পাবে সেখানে 'মনি' থেকে আলোচনা শহর, করে তিনি গভীর বোধের পরিচয় দিয়েছেন। মরহম মাহবর আলমের এই ছোট্ট উপন্যাসটি থেকেই সত্যিকার অর্থে এ দেশে জীবনের এই বিশেষ দিকটির রসোত্তীর্ণ রূপায়ণের সাচনা। তবে 'মফিজন' যদিও যথাথই শ্ৰী, খোকাকে কতটকু পুরুষ বলে গণ্য করা চলে? নাকি অবৈধতার আরেকটি নতুন মাত্রা হিসেবেই এটি বিশেষ আকর্ষণীয়।

জনাব করীমের সাহিত্যবোধ ও বিশ্লেষণক্ষমতা প্রশ্নাতীত। তবে তাঁর আলোচনায় আরোপের সীমা নিয়ে আমার কিছু, দ্বিধা আছে। শওকত ওসমানের 'জননী'র দরিয়া বিবির উত্তত দিনের দিবানিদ্রাকে 'ধর্ষিতা হওয়ার আয়োজন মনে করাকে বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়েছে। উত্তপ্ত দিনেই অনভ্যন্তরাও দিবানিদ্রার যায় কারণটা মানসিক নয় নেহা-

রচনাকে গ্রহণ করে ধন্য করেছেন এবং খানিকটা লজ্জাতেও ফেলে দিয়েছেন। তবে রানুর চিন্তায় 'আমি যা খুশী করব, যার সঙ্গে ইচ্ছা তারই অকশায়িনী হব' এমন কিছু, কি দিরে কোথায়' উপন্যাসটিতে আছে? -পর সম্পর্কের ভিন্নতর সংকটই ছিল আমার রচনাটির উপজীব্য। জীবনের অন্যতম সত্য হিসেবে যৌনতাও হয়ত তার মধ্যে আছে তবে কাহিনীর প্রয়োজনেই অবৈধ যৌন সম্পর্কের অবতারণার দরকার হয়নি। এখানেও কি এই আরোপণ অপরিহার্য ছিল? ভা না করলে চরিত্রটির আধানিকতা ক্ষুণ্ণ হত ?

মাহমান্দলে হক, হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনের একটি করে উপন্যাসের কিছ, নির্বাচিত অংশ বিশ্লেষণ করে লেখক এদের প্রেম সম্পর্কিত বোধ ও বক্তব্যকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু লেখক তো কখনো দাঁড়িয়ে থাকেন না। তিনি গতিশীল। তিনি সব সময় নতুন জীবনবোধের কথা বলতে চেষ্টা করেন। পিতুল নাচের ইতিকথায়' নরনারী সম্পর্কে'র যে দিকটির কথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— 'দিবারাত্রির কাব্যে’ও কি তাই বলা হয়েছে?

তবে সত্যের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়। আর সাহিত্য- শিল্প সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি মেনে এই প্রকাশের মাত্রার হেরফের ঘটায়। একজন লেখক বা শিল্প সমাজেরই সদস্য। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও বহুলাংশে সমাজ-নিয়ন্ত্রিত। স্ত্রী-পরুষে সম্পর্কের ব্যাপারে তাই কিছু টা রাখ-ঢাক আসে ।

স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রকে তাঁর নায়ক এবং নায়িকার শষ, কথা বলবার সংযোগ করে দেবার জন্যে ঝড় বৃষ্টির রাত তৈরী করতে হয়েছে, বনের ভেতর নিজনি মন্দির তৈরী করতে হয়েছে। এই সমস্যা আজকের কথাশিল্পীদের নেই। তবে তাঁদের অন্য সমস্যা আছে। তাঁদের নায়করা নায়িকাদের সঙ্গে কথা বলেন কিন্তু তাদের গায়ে বোধ করেন। অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিধাটি নায়কের নয় লেখকের নিজের। অথচ খুবেই আশ্চর্যের ব্যাপার সচেনা পর্বের প্রাচীন কবিতা বা চিত্র ভাস্কর্যে হাত দিতে দ্বিধা অবাধ উন্মোচন আমরা লক্ষ্য করেছি। সমাজের তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ তখন ছিল না। আজকের গ্রাম্য গান, বিয়ের গান কিচ্ছা কাহিনীতে কিন্তু নরনারী সম্পর্কে'র খোলামেলা বিষয়গুলো আছে কিন্তু কথাসাহিত্যে আমরা এড়িয়ে

যাচ্ছি। এটা কি এক ধরনের 'সফিসটিকেসন'? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক সময় যেন হঠাৎ করে হৈমন্তী গল্পে শরীরের কথা নিয়ে আসেন। 

চোখে একট, ঘোর লাগিল, কবে যে তাহার সমস্ত শরীর ও মন যেন উৎসকে হইয়া উঠিল ... ব্যাস এই পর্য ন্তই। হৈমন্তীর শরীর উৎস কের অন্য কোন বিবরণ তিনি দেন না। সেই ঐতিহ্যই কি আমরা এখনো লালন করছি ?

আজকের দিনে সমাজের নিয়ন্ত্রণ প্রায় ক্ষেত্রেই কঠোর থেকে কঠোর- ভর হচ্ছে কিন্তু নর-নারীর সম্পর্কের ব্যাপারে উদার থেকে উদারতর হচ্ছে। কথাসাহিত্যে আমরা তারই প্রতিফলন দেখছি। সমকালীন বাংলা সাহিত্যে এই সম্পর্ক টির প্রতিফলন এ পরিবর্তনের আলোকেই বিশ্লেষিত হওয়া প্রয়োজন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ