Hot Posts

6/recent/ticker-posts

মুক্তিযুদ্ধের গল্প জহির রায়হান এর গল্প সময়ের প্রয়োজনে গল্প মুক্তিযুদ্ধের গল্প


--মুক্তিযুদ্ধের গল্প,,একাত্তরের গল্প--


**সময়ের প্রয়োজনে

জহির রায়হান


কিছুদিন আগে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে গিয়েছিলাম। ক্যাম্প কমান্ডার ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। সেই ব্যস্ততার মুহূর্তে আমার দিকে একটা খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি বসুন। এই খাতাটা পড়ুন বসে বসে।

আমি কয়েকটা কাজ সেরে নিই। তারপর আপনার সঙ্গে আলাপ করব।

খাতাটা হাত বাড়িয়ে নিলাম। লাল মলাটে বাঁধানো একটি খাতা। ধুলো, কালি আর তেলের কালচে দাগে ময়লা হবে, গেছে এখানে সেখানে।

খাতাটা খুললাম

মেয়েলি ধরনের গোটা গোটা হাতে লেখা। মাঝে মাঝে একটু এলোমেলো।

আমি পড়তে শুরু করলাম।

প্রথম প্রথম কাউকে মরতে দেখলে বাধা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনো চোখের কোণে এক ফোঁটা অশ্রুও হয়তো জন্ম নিত। এখন অনেকটা সংঙ্গ হয়ে গেছি। কী জানি, হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে, তাই । মৃত্যুর খবর আসে। মরা মানুষ দেখি। মৃতদেহ কবরে নামাই। পরক্ষণে ভূলে যাই।

রাইফেলটা কাধে তুলে নিয়ে ছোট্ট টিলাটার ওপরে এসে দাঁড়াই। সামনে তাকাই। বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা। কচি লাউ ঝুলছে। বাতাসে মৃদু দুলছে। কনেকটা ধানক্ষেত। দুটো তালগাছ। দূরে আর একটা গ্রাম। খবর এসেছে ওখানে ঘাঁটি পেতেছে করা। একদিন যারা আমাদের অংশ ছিল। একসঙ্গে থেকেছি। শুয়েছি। খেয়েছি। ঘুমিয়েছি। এক টেবিলে বসে গল্প করেছি। প্রয়োজনবোধে ঝগড়া করেছি। ভালবেসেছি। আজ তাদের দেখলে শরীরের রক্ত গরম হয়ে যায়। চোখ জ্বালা করে ওঠে। হাত নিশপিশ করে। পাগলের মতো গুলি ছুড়ি। মারার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠি। একজনকে মারতে পারলে উল্লাসে ফেটে পড়ি। ঘৃণায় ঘুতু ছিটোই মৃতদেহের মুখে।

সামনে ধানক্ষেত। আলের ওপরে কয়েকটা গরু। একটা ছাগল। একটানা ডাকছে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে চলে গেল দূরে গ্রামের দিকে। কী যেন নড়েচড়ে উঠল সেখানে। সন্দেহে মুহূর্তে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। ক্যাম্প কমান্ডারকে খবর দিলাম।

স্যার, মনে হচ্ছে ওরা এগুতে পারে।

**ভাষা-আন্দোলনের,একুশের গল্প ও মুক্তিযুদ্ধের আরো গল্প পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন   https://monoweredu13.blogspot.com/?

তিনি একটা ম্যাপের ওপরে ঝুঁকে পড়ে হিসেব কষছিলেন। মুখ তুলে তাকালেন। একজোড়া লাল চোখ। গত দুরাত ঘুমোন নি। অবকাশ পান নি বলে। তিনি তাকালেন।

বললেন, কী দেখছ?

বললাম, মনে হল একটা মুভমেন্ট।

ভুল দেখেছ। আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন তিনি। ওদের দু-এক দিনের মধ্যে একবার কথা নয়। যাও, ভালো করে দেখ। এখান নিজের জায়গায়। একটানা তাকিয়ে থাকি। মাঝে মাঝে তন্দ্রা এসে যায়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। হয়তো তাই ভুল দেখি। কিছু বুড়িগঙ্গার পাশে সামারে যে দৃশ্য দেখেছিলাম সেটা গ্রুপ হবার নয়। অনেছিলাম, বহু লোক আশ্রয় নিয়েছিল ওখানে। যখন গেলাম, দেখলাম কেউ নেই।

রেকে পুডিঙের মতো জমাট রক্ত।

বুটের দাগ।

খালি পায়ের ছাপ। ছোট পা। বড় পা। কচি পা।

কতগুলো মেয়ের চুল।

দুটো হাতের আঙুল।

একটা আংটি।

চাপ চাপ রক্ত

কালো রক্ত লাল রক্ত । মানুষের হাত পা। পায়ের গোড়ালি 

পুডিঙের মতো রক্ত।

খুলির একটা টুকরো অংশ।

এক খাবলা মা

রক্তের জানে পিছলে যাওয়া পায়ের ছাপ।

অনেকগুলো ছোট-বড় ধারা। রক্তেদা ধারা।

একটা চিঠি। মানিব্যাগ।

গামছা।

একপাটি চটি।

কয়েকটা বিছ্কুট।

জমে থাকা রক্ত।

একটা নাকের নোলক।

একটা চিরুনি।

বুটের দাগ।

লাল হয়ে যাওয়া একটা সাদা ফিতে। চুলের কাঁটা।

দেশলাইয়ের কাঠি।

একটা মানুষ টেনে নিয়ে যাওয়ার ছাপ।

রক্তের মাওখানে এখানে-ওখানে অনেকগুলো কার্তুজ ছড়ানো।

পাশের নর্দমাটা বন্ধ।

রক্তের স্রোত শাতার মতো জমে গেছে সেখানে।

দেখছিলাম। দেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছিলাম সেখান থেকে।

আমি একা নই। অসংখ্য মানুষ।

অসংখ্য মানুষ পিঁপড়ের মতো ছুটছিল। মাথায় সুটকেস, বগলে কাপড়ের গাঁটরি। হাতে হারিকেন। কোমরে বাচ্চা।

• চোখেমুখে কী এক অস্থির আতঙ্ক।

কথা নেই। মৌন সবাই।

সহসা কে যেন বলল, ওদিকে যাবেন না। মিলিটারি। নৌকোয় করে লোকজন সব পালাচ্ছিল। মিলিটারি ওদের ওপরে গুলি করেছে। দু-তিন শ লোক মারা গেছে ওখানে।

যাবেন না।

মনে হল পায়ের সঙ্গে যেন কয়েক মন পাথর বেঁধে দিয়েছে কেউ। একা নই। অসংখ্য মানুষ। সহস্র চোখ। হতবিহ্বল মুহূর্ত। কোন দিকে যাব। লে

ফিরে যাবার পথ নেই। মৃতদেহের স্তূপের নিচে সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

সামনে এগিয়ে যান। ভরসা পাচ্ছি নে। সেখানে হয়তো মুর্তের পাহাড় পথ অবরোধ করে দাড়িয়ে আছে। 

কোন দিকে যাবা পরমুহূর্তে একটা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলাম। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটতে লাগলাম আমরা। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। কাঁচকি মাছের মতো চারপাশে ছিটকে

যাচ্ছে সবাই।

হেলিকপ্টার মাথার ওপরে নেমে এল।

তারপর।

তারপর মনে হল একসঙ্গে যেন অনেকগুলো বাজ পড়ল। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে

গেলাম। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। শুধু শুনছি। অনেকগুলো শব্দের তারুর। মেশিনগানের শব্দ। বাচ্চার কান্না। কতগুলো মানুষের আর্তনাদ। কাতরোতি। কয়েকটা কুকুরের চিৎকার। কান্না। মেশিনগানের শব্দ। মানুষের বিলাপ। একটি কিশোরের কণ্ঠস্বর। বাজান রোজানা হারিয়ে যাওয়া বাবাকে ডাকছে সে। বাজান বাজান। তারপর শ্মশানের নীরবতা। ঘাড়ের কাছে চিনচিনে একটা ব্যথা। ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম। না, কিছুই দেখতে পেলাম না। সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল। মনে হল চারপাশে অন্ধকার নেমে আসছে। বুঝতে পারলাম জ্ঞান হারাচ্ছি। কিংবা মারা যাচ্ছি।

সামনে ধানক্ষেত। একটা লাউয়ের মাচা। কচি লাউ বলছে। পেছনে কয়েকটা বাশবন। আড়ালে চার-পাঁচটা তাঁবু। একটা পুরোনো দালান। ওখানে আমরা থাকি। মোট সাতাশজন মানু

প্রথমে উনিশ জন ছিলাম। আট জন মারা গেল মর্টারের গুলিতে। ওদের কবরে তামিয়ে দিয়ে যখন ক্যাম্পে ফিরলাম, তখন আমরা এগার জন।

এক জন পালিয়ে গেল সে রাতে। গেল আর এল না। আরেকজন মারা গেল হঠাৎ অসুখ করে। কী অসুখ বুঝে উঠবার আগেই হাত-পা টান টান করে শুয়ে পড়ল সে। আর ঠিল না। তার বুক পকেটে একটা চিঠি পেয়েছিলাম। মায়ের কাছে লেখা। মা। আমার জন্য তুমি একটুও চিন্তা কোরো না, মা। আমি ভালো আছি। চিঠিটা এর কবরে দিয়ে দিয়েছি। থাক। ওখানেই থাক। তখন ছিলাম তখন। এখন

এবার বেড়ে সাতাশে পৌঁছেছি।

সাতাশ জন মানুষ।

নানা বয়সের। ধর্মের। মতের। আগে কারো সঙ্গে আলাপ ছিল না। পরিচয় ছিল না। চেহারাও দেখি নি কোনো দিন।

কেউ যার ছিল। কেউ দিনমজুর। কৃষক কিংবা মধ্যবিত্ত বেনানি। পাটের বাগান।

অথবা প্রাগারের ছেলে। এখন সবাই ।

একসঙ্গে থাকি। খাই। ঘুমোই ।

রাইফেলগুলো কাঁধে তুলে নিয়ে যখন কোনো শত্রুর সন্ধানে বেরোই তখন মনে হয় পরস্পরকে যেন বহুদিন ধরে চিনি। জানি। অতি আপনজনের মতো অনুভব করি। মনে হয় দীর্ঘদিনের আত্মীয়তার এক অবিচ্ছেদা বাঁধনে আবদ্ধ আমরা। আমাদের অস্তিত্ব লক্ষ্য দুই-ই এক। মাঝে মাঝে বিশ্রামের মুহূর্তে গোল হয়ে বসে গল্প করি আমরা

অতীতের গ


বর্তমানের গল্প।


ভবিষ্যতের গা।


টুকিটাকি নানা আলোচনা।


ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। আনতে হবে। কদিন ধরে শুধু ভাগ-ভাত চলছে। একটু আর মাংস গেলে মন্দ হত না। সাতাশ জন মানুষ আমরা। মাত্র ন যদি অস্ত্র পেতাম। সবার হাতে যদি একটা করে রাইফেল থাকত, তাহলে সেদিন এক জন সৈনাকেও পালিয়ে যেতে দিতাম না।


মোট দু শ জনের মতো এসেছিল ওরা। পঁয়তাল্লিশটা লাশ পেছনে ফেলে পালিয়ে তাড়া করেছিলাম আমরা। খেয়াপার পর্যন্ত। গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে ফিরে চলে এদেখি এসে দেখি আশপাশের গ্রাম থেকে অসংখ্য ছেলে-বুড়ো নেয়ে গেরস্তবাড়ির ব এসেছে সেখানে। কারো হাতে ঝাঁটা। দা। কুড়োল। যুক্তি।

মৃতদেহগুলোর মুখে ঝাঁটা মারছে ওরা। ইফাদ নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে ওদের হাত। পা। মাথা বিশ্বের

দা দিয়ে তৃপিয়ে কুপিয়ে একটি মৃতদেহকে শত টুকরো করতে করতে জনৈক বৃদ্ধ চিৎকার 

করে কাদছিল। আমার পুলাডারে মারছস। বউডারে নিয়ে গেছস। মাইয়াভাবে

করছস। আমার সোনার সংসার পুড়ায়া পিছস

আল্লার গজব পড়ব। আল্লার গজব পড়ব।

ঘৃণা। ক্রোধ। যন্ত্রণা

আমরা বাধা দিলাম। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডুকরে কেঁদে উঠল ওরা। করুণ বিল করল। বিনাগের অবসরে নিজেদের সহস্র দুঃখ-বেদনার ইতিহাস বর্ণনা করতে লাগব। ছেলে নেই। স্বামী নেই। স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে। যুবতী মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেছেতিন মাস হল। হালের গরু। গোলার ধান। গায়ের অলঙ্কার। কিছু নেই। সব লুট করে

ঘৃণা। ক্রোধ। যন্ত্রণা। এতসব বুকে নিয়ে ওরা বাঁচবে কেমন করে। একটা বিস্ফোরণে যদি সবকিছু

চুরমার হয়ে যেত তাহলে হয়তো বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে পারত ওরা। ওরা একা নয়। অনেকগুলো মানুষ। সাড়ে সাত কোটি। এক কোটি লোক ঘর

মাটি ছেড়ে পালিয়েছে। তিন কোটি লোক সারাক্ষণ পালাচ্ছে এক গ্রাম থেকে অন্য খানে।

ভয়। এাস আতংক। 

জ্ঞান ফিরে এলে আমিও পালিয়েছিলাম। পোড়ামাটির ঘ্রাণ নিতে নিতে। অনেক

মৃতদেহ ডিঙিয়ে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী তেন করে। একটা গহনা নৌকায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। ছেলে বুড়ো মেয়ে বাচ্চাতে গিজগিজ করছিল সেটা।

দুপাশের গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলছে।

কিছুক্ষণ আগে কয়েকটা প্লেন এলে একটানা বোমাবর্ষণ করেছে সেখানে। -

কাছেই একটা মফস্বল শহর। এখনো পুড়ছে। কালো জমাট ধোয়া কুন্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে আকাশের দিকে।মানুষ নেই, কুকুর নেই। 

শূন্য বাড়িগুলো প্রেতপুরীর মতো দাড়িয়ে। সহসা অনেকগুলো মেঘের কন্ঠস্বর শোনা তাকিয়ে দেখলাম। দূরে নদীর পারে একসঙ্গে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে কতগুলো মেয়ে চিতকার

কিরে নৌকাটাকে পারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ডাকছে। ওরা আশ্রয় পেতে চায় নৌকাতে। না খবরদার, নৌকা ভেড়াবে না। জনৈক বৃদ্ধ ওদের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠল।


की কেন, কী হয়েছে।


কী আর হবে? বাজে মেয়ে। বাজারের মেয়ে।


বাংলাদের মেয়ে মাে


মানে আবার কী সাহেব। বেশ্যা। বেশ্যা চেনেন না। ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে এল তার। তার একার নয়। অনেকের।


অনেকেই মুখ বার করে তীরে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ্যাগুলোকে দেখল। না না। নৌকা এ থামাবার দরকার নেই। আপদগুলো মরুক। মরলেই ভালো।


নৌতা থামাও। সহসা ভিড়ের ভেতর থেকে একটা ছেলে চিৎকার করে উঠল। মুখভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রক্তজবার মতো লাল চোখ। শিগগির নৌকাতে তুলে নাও ওদের। কঠিন

কন্ঠে আদেশ করল সে। উত্তরে বুড়োটা বিরক্তি প্রকাশ করল। না, নৌকা থামবে না। সঙ্গে সঙ্গে সামনে লাফিয়ে এসে বুড়োটার গলা চেপে ধরল ছেলেটা। কুত্তার বাচ্চা।

মা তোমাকে এখুনি তুলে ওই নদীর জলে ফেলে দেব আমি। কোন শালা শুয়োরের বাচ্চা আছে এখানে বাধা দেয় আমাকে। নৌকা ভেড়াও মাঝি। ওদের তুলে নাও।

কয়েকটা নীরব মুহূর্ত। নৌকা ভিড়ল।

ভয়ে আতঙ্কে অর্ধমৃত বেশ্যাগুলো ভেড়ার পালের মতো নৌকায় এসে চড়ল।

ছোট বেশ্যা। মাঝারি বেশ্যা। বড় বেশ্যা। কিশোরী বেশ্যা। যুবতী বেশ্যা। বৃদ্ধা বেশ্যা।

ঘূর্ণায় একপাশে সরে গেল নৌকার কুলীন যাত্রীরা। বেশ্যারা কোনো কথা বলল না।

এক কোনে গাদাগাদি করে বসল। অনেকগুলো মুখ।

একটি মুখ আমার মায়ের মতো দেখতে।

মা এখন কী করছে?

মায়ের কথা মনে পড়তে বুকটা ব্যথা করে উঠল।

ছোট ভাই বোন। ইহুদি। ওরা কেমন আছে? বেঁচে আছে না মরে গেছে জানি না। হয়তো বদি জান না। তবু একটা কথা বারবার মনের মধ্যে উকি দেয় আমার।

আবার কি তাদের সঙ্গে একসাথে নাশতার টেবিলে বসতে পারব আমি?

আবার কি রোজ সকালে মা আমার বন্ধ দুয়ারে এসে কড়া নেড়ে ডাকবে? কী বে এখনো মোদি অনেক বেলা হয়ে গেল যে। ঠ। চা খাবি না

দল বেঁধে সবাই বাড়ির ছাদের ওপরে কেরাম খেলা। পারব কি আবার?

মাকে সাক্ষী রেখে, সবাই দিলে বাবার পকেটমারা? হয়তো জানি না। জানতে গেলে তারা হয়। ভাবনাটাই একটা যন্ত্রণা। অথচ ভাৰতে আমি এককালে

ভালবাসতাম। বিশেষ কবে। অযাকে নিয়ে। চিনু ভাবীর বোন জয়াকে। চিনু ভাবির বোন জয়া।কতভাবে

ভেবেছি তাকে।

কখনো সমুদ্রের উত্তাল পটভূমিতে।

কখনো ঢেউ জাগানো মিছিলের মাঝখানে। কখনো ছোট্ট একটি ঘরের একান্তে। দিনে। রাতে।অন্ধকারের নিবিড়তায়।

কিংবা কোনো দুপুরে। কোনো রেস্তরাঁর কোণের টেবিলে। নিরিবিলি নির্জনে। দু কাপ সামনে রেখে অনেকক্ষণ ধরে কোনো কথা না বলে বসে থাকার মুহূর্তে। ভাবতে ভালো লাগত। 

ইছামতী, করতোয়া, ময়ূরাক্ষী বলে যে-নদীর নাম, তার জলে দুজনে সাঁতার ঢেউয়ের সঙ্গে কানামাছি খেলতে।

জয়া কোনোদিন সমুদ্র দেখে নি। সমুদ্র দেখার বড় ইচ্ছে ছিল তার।

একদিন হাসতে হাসতে বলল, জান, সমুদ্র দেখে এলাম ।

কখন কোথায়? অবাক হয়েছিলাম আমি। কেন, এই শহরে? কপালে জমে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘাম আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বলেছি জয়া। শহরের অলিতে গণিতে এত সমুদ্রের ছড়াছড়ি জীবনে দেখেছ কখনো?

জনতার সমুদ্র।

সমুদ্রের চেয়ে গভীর।

সাগরের চেয়েও উত্তাল ।

গতিময়।

মনে হচ্ছিল সামনে যত বাধার পাহাড় আসুক না কেন, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কোটি কোটি মুখ। পাথরে খোদাই করা চেহারা। মুষ্টিবদ্ধ হাত সীমানা ছাড়িয়ে লক্ষ-কোটি বক্সের শব্দ কিংবা ঢেউয়ের ধ্বনি সে মিছিলের গর্জনের কাছে অর্থহীন।

আগে তো দেখি নি কোনোদিন।

বাহাদুর ফেব্রুখারিতে। চুষতে। বাঘাট, ছেষটি কিংবা গুনগুনে কিন্তু এত প্রাণের জোয়ার কখনো দেখি নি।

এত মৃত্যুও দেখি নি আগে।

সামনে তাকাই। বিরাট আকাশ। কয়েকটা লাউয়ের মাচা। কচি লাউ ঝুলছে। কয়েকটা ধানক্ষেত। দুটো তালগাছ। দূরে আরেকটা গ্রাম।

প্রতিদিন দেখি। জয়াকেও এত নিবিড় করে দেখি নি কোনোদিন। পেছনে কয়েকটা বাশবন। আ

চার-পাঁচটা তাঁবু। একটা পুরোনো দালান। সে দালানের গায়ে কাঠকয়লা দিয় অনেকগুলো ছোট ছোট রেখা এঁকেছি আমরা। ওগুলো মৃতের হিসেব।

আমাদের নয়। ওদের।

যখনি কোনো শত্রুকে বধ করেছি, তখনি একটা নতুন রেখা টেনে দিয়েছি দেয়ায হিসেব রাখতে সুবিধে হয় তাই। প্রায়ই দেখি। শুনি। তিন বাহার, ডিয়ার, মা পুরো দেয়ালটা করে ভরে যাবে সে প্রতীক্ষায় আছি। 

আমাদের যারা মরেছে তাদের হিসেবুও রাখি। কিন্তু সেটা মনে মনে। মনের মধে অনেকগুলো দাগ। সেটাও মাঝে মাঝে শুনি)

একদিন।

বেশ কিছুদিন আগে। সেক্টর কমান্ডার এসেছিলেন আমাদের ক্যাম্পে দেখতে। সাহ্যিতভাবে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। অভিবাদন করেছিলাম তাকে। তিনি আমাদের একটি

প্রশ্ন করেছিলেন।

কেন যুদ্ধ করছ বলতে পার?

প্রায় এক ধরনের উত্তর দিয়েছিলাম আমরা।

বলেছিলাম, দেশের জন্মে। তুমি না করছি। যুদ্ধ করছি দেশকে মুক্ত করার জন্যে। বাংলাদেশ।

না। পরে মনে হয়েছিল উত্তরটা বোধহয় ঠিক হয় নি। নিজেরা অনেকক্ষণ আলাপ করেছি আমরা। উত্তরটা ঠিক হল কি? দেশ তো হল ভূগোলের ব্যাপার। হাজার বছরে যার হাজারবার সীমারেখা পাল্টায়।

পাল্টাচ্ছে। ভবিষ্যতেও পাল্টাবে।

তাহলে কিসের জন্যে লড়ছি আমরা? বন্ধুরা নানাজনে নানারকম উক্তি করেছিল।

কেউ বলেছিল, আমরা প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে লড়ছি। ওরা আমাদের মা-বোনদে  র কুকুর-বেড়ালের মতো মেরেছে তাই। তার প্রতিশোধ নিতে চাই। কেউ বলেছিল, আমরা আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছি। ওই শালারা বহু অত্যাচার করেছে আমাদের ওপর। শোষণ করেছে। তাই ওদের তাড়াবার জন্যে লড়ছি।

কেউ বলেছিল, অতশত বুঝি না মিয়ারা। আমি শেখসাহেবের জন্যে লড়ছি।

কেউ বলেছিল, কেন লড়ছি জান? দেশের মধ্যে যত গুণ্ডা, বদমাশ, ঠগ, দালাল, আলোচনা ইতর, মহাজন আর ধর্ম-ব্যবসায়ী আছে তাদের সবার পাছায় লাথি মারতে।

আমি ওদের কথাগুলো শুনছিলাম। ভাবছিলাম। মাঝে মাঝে আলোচনায় অংশ নিতে

গিয়ে তর্ক করছিলাম। কিন্তু মন ভরছিল না।

কিসের জন্যে লড়ছি আমরা ? এত প্রাণ দিচ্ছি, এত রক্তক্ষয় করছি?

হয়তো সুখের জন্যে। শান্তির জন্যে। নিজের কামনা-বাসনাগুলোকে পরিপূর্ণতা দেবার জন্যে

কিংবা, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে।

অথবা, সময়ের প্রয়োজনে। সময়ের প্রয়োজন মেটাবার জন্যে লড়ছি আমরা।

না। অতশত ভাবতে পারি না। আমার ছোট মাথায় অত ভাবনা এখন আর ধরে না। বাথা

যেটা বুঝি সেটা সোজা। আমাদের মাটি থেকে ওদেরকে তাড়াতে হবে। এটাই দেয়ালের ধৈর্যাগুলো বাড়ছে।

এখনকার প্রয়োজন))

মনের দাগও বাড়ছে প্রতিদিন ।

হাতের কব্জিতে এসে একটা গুলি লেগেছিল কাল। সেটা হাতে না লেগে বুকেও

পাত্র দু আঙুলের ব্যবধান।

এখন ক দিন বিশ্রাম।

মা কাছে থাকলে,মাথায় হাত বুলিয়ো দিত। কাঁদত। বকুনি দিয়ে বলত,

বাহাদুর। অত সামনে এগিয়ে গিয়েছিলি কেন? সবার পেছনে হাত এই পারলি না? আর অত বাহাদুরির দরকার নেই বাবা। ঘরের ছেলে এখন ঘরে ফিরে চল।

ঘর?

সত্যি, মানুষের কল্পনা বড় অদ্ভুত।

ঘর-বাড়ি করে ওরা পুড়ে ছাই করে দিয়েছে। তবু ঘরের কথা ভাবতে মন চায়। খবর পেয়েছি মা, বাবা, ভাই, বোন ওরা সবাই কোথায় যেন চলে গেছে। হয়তো

কোনো গ্রামে কোনো গঞ্জে। কোনো উদ্বাস্তু শিবিরে। কিংবা

না। ওটা আমি ভাবতে চাই না।

জয়ার কোনো খবর নেই। কোথায় গেল মেয়েটা? জানি না। জানতে গেলে ভয় হয়। শুধু জানি, এ যুদ্ধে আমরা জিতব আজ, নয় কাল। নয়তো পরশু।

একদিন আমি আবার ফিরে যাব। আমার শহরে, আমার গ্রামে। তখন হয়তো পরিচিত অনেকগুলো মুখ সেখানে থাকবে না। তাদের আর দেখতে পাব না আমি। যাদের পাব

তাদের প্রাণভরে ভালবাসব।

যারা নেই কিন্তু একদিন ছিল, তাদের গল্প আমি শোনাব ওদের। সেই ছেলেটির গল্প। বুকে মাইন বেঁধে যে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

কিংবা, সেই বুড়ো কৃষক। রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে যে মৃদু হেসে বলেছিল,

চললাম। আর ফিরে আসে নি। অথবা উদ্বাস্তু শিবিরের পাঁচ লক্ষ মৃত শিশু।

দশ হাজার গ্রামের আনাচে-কানাচে ছড়ানো এক কোটি মৃতদেহ।

না, এক কোটি নয়। হয়তো হিসেবের অঙ্ক দখন তিন কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে।

এক হাজার এক রাত কেটে যাবে হয়তো। আমার গল্প তবু ফুরোবে না। সামনে ধানক্ষেত। বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা, কচি লাউ ঝুলছে। দুটো তালগাছ। দূরে আরেকটা গ্রাম। গ্রামের নাম রোহনপুর ( ওখানে এসে ঘাঁটি পেতেছে এরা, 

একদিন যারা আমাদের অংশ ছিল।

ভায়েরিতে আর কিছু লেখা নেই ৷

খাতাটা ক্যাম্প কমান্ডারের দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, কার লেখা, আপনার?

না, আমাদের সঙ্গের একজন মুক্তিযোদ্ধার।

তার সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারি কি? আবার প্রশ্ন করলাম। উত্তর দিতে গিয়ে মুহূর্ত কয়েকবার আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, দিনকয়েক আগে একটা অপারেশনে গিয়ে ওদের হাতে ধরা পড়েছে সে। তারপর তারপরের খবর ঠিক বলতে পারছি না। হয়তো মেরেফেলেছে। বেঁচেও থাকতে পারে হয়তো।

চোখজোড়া অজান্তে আবার খাতাটার ওপরে নেমে এল। অনেকক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখলাম সেটা। তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম বাইকের দিকে। বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা, রুটি লাউ ঝুলছে। কয়েকটা ধানক্ষেত। দুটো তালগাছ। দূরে আরেকটা গ্রাম। সেখানে আগুন জ্বলছে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ