Hot Posts

6/recent/ticker-posts

মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমার আল্লারে গল্প,বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এর মুক্তিযুদ্ধের গল্প গল্প ও মুক্তিযুদ্ধ

 

--মুক্তিযুদ্ধের গল্প --

**আমার আল্লারে-

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর


**স্টেশনে এসে দেখি আমার ট্রেন রাত ৯টায়। আজ দুপুরে 'পারাবত' ট্রেন নেই। আমি ভালো করে টিকিট দেখি নি। যে গাড়িতে শহর থেকে স্টেশনে এসেছি, তাও ছেড়ে দিয়েছি।

কিছু করবার নেই। স্টেশনের উল্টোদিকে অনেক চা এবং খাবারের দোকান আছে। আমি একটার মধ্যে ঢুকি। রেস্টুরেন্টটা প্রায় নিরিবিলি, মালিক কিংবা ম্যানেজার কাউন্টারে বসে আছে নির্লিপ্ত। আমি কিছু লেখার কথা ভাবি, যে বইটা সঙ্গে আছে তার একটি বাক্য মনে পড়ে : জেনারেলরা ষড়যন্ত্র করছিল এবং আমরা কিছুই জানি নি। দুদিন ধরে সিলেট

ঘুনেছি। মাজার থেকে মাজারে, চা বাগান থেকে চা বাগানে পরানু শা'র সংসারে এক ডাউলের গান শুনেছি আমার আল্লারে নিয়া মশকরা কেন কর তুমি) সেই গানটা এবং "বইটার থাকা প্রসঙ্গে আমার মনে পড়তে থাকে। এক কাপ চার কথা বলে আমি নোটবইটা মেলে ধরি। আমি পড়তে থাকি। যা আমি লিখেছি।

(২)

শা' পরানের দরগার মূল মসজিদটার গঠন আমার ভালো লেগেছে। সম্প্রসাি মসজিদটির গঠন আমার ভালো লাগে নি। মূল মসজিদটার স্পেসের ধারণা ছিল খুব নছর এ রকম : সমসংখ্যক লোক এবাদত-বন্দেগি করবে। নিভৃতে। নীরবে। নিজের চিন্তার মধ্যে বিভোর থাকবে। নিজের মধ্যে উৎস খুঁজবে আল্লার। সম্প্রসারিত মসজিদটিতে এসব নেই।

(৩)

**ভাষা-আন্দোলনের,একুশের গল্প ও মুক্তিযুদ্ধের আরো গল্প পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন   https://monoweredu13.blogspot.com/?

রেস্টুরেন্টের বয়গুলো দুপুরের খাবার খেতে বসেছে। একটি ছেলের চুলের রং কটা, এবং চক্ষু টানা নীল, কোনাগুলো লাগছে। ছেলেটির বাবা বোধহয় সিলেটি, মা বিলেতি। আমি ভাবি : (মিশ্রণ ছাড়া জাতি হয় না। কোনো ব্যক্তি যেমন অন্ধ নয় তেমনি জাতিও। মিশ্রণে যখন জাতি হয়, তখন কোনো জাতি কি আল্লার বিশেষ পেয়ারা হা

(৪)

ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করা যায়। ষড়যন্ত্র করে কি আরাকে দখল করা যায়? যায়না। এই একটা জায়গায় পৃথিবীর শক্তিধররা নিরুপায়। আন্নাকে যে পায়, তার মুখে

জ্যোতি আসে। ক্ষমতা যে পায় তার মুখে? আমার ইচ্ছা হয়, বাউলটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করি।

(৫)

একটা লোক আসে, হয়তো সে রোজই আসে দুপুরে এখানে ভাত খেতে। কাউন্টারেরমালিক কিংবা ম্যানেজারের সঙ্গে অস্ফুটে দু-একটা কথা বলে। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তি, পরনেলুঙ্গি, কালো চশমা।

(৬)

এই যে বাংলাদেশে একের পর এক জেনারেলরা ক্ষমতা দখল করেছে, ক্ষমতা দখল করে মিথ্যার মিনার বানিয়েছে, এসব মিনারে ঘুণ ধরেছে। ঘুণপোকা খেয়ে ফেলছে কিটির কিটির। কিন্তু হারারে না মিথ্যা কথাগুলো। মানুষ সেসব তাদের মগজের মহাফেজখানায় রেখে দিয়েছে। মধ্যে মধ্যে বার করে দেখবে মিথ্যার কারসাজি। ভুলে যাওয়া এবং মনে থাকা পাশাপাশি থাকবে। আমরা ভুলে যাব জেনারেলদের কিন্তু মনে থাকবে তাদের মিথ্যার বারসানি। জামরা ভুলি ानীনতার না। নির্যাতন ভুলে। বেঁছে পাতার জন্য আকুল থাকি। আমরা প্রেমিক। আমাদের মধ্যে পুলের উষ্ণতা। দু হাতের মধ্যে পুল, কুসুম ফুল। পদগুলো একটা অর্থ নম্র, বিভিন্ন অর্থ। সোনা কি বাউল বলছেন: আমার আল্লারে নিয়া মশকরা কেন কর তুমি।

(৭)

আমি উঠব উঠব করে উঠি না। কেন তো রাত ৯ টায়। এখানে যতক্ষণ পারি থাকি। সঙ্গে আমার একটা ব্যাগ। আমি রেস্টুরেন্টটার চারদিকে তাকাই। পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকটি

একমনে ভাত খাচ্ছে। একজন বয়ের খাওয়া শেষ হয়েছে। অন্য একজন বয় ভেজা কাপড় দিয়ে টেবিল মুছছে। অন্য একজন টেবিলে মাথা গুঁজে ঘুমাচ্ছে। মালিক কিংবা ম্যানেজানটি বাইরের দিকে রুয়ে আছে। রাস্তায় রিকশা, গাড়ি, ট্রাকের জটলা। ঘটনা থেকে একটা আওয়াজ তৈরি হচ্ছে। এই আওয়াজের মধ্যে মানুষের গলা এবং যন্ত্রের মিশেল আছে এবং এই মিশেলের মধ্যে রোদ, পাখির সঙ্গীত আছে। এই মিশেলের সঙ্গীত তৈরি করছে নির্জনতার মধ্যে নির্জনতা, কোলাহলের মধ্যে কোলাহল, বুঝি শা' পরানের পাহাড়টি কোলাহল করছে সকল নির্জনতার মধ্যে। একেই বোধহয় ধরতে চান বাউলটা। একেই বোধহয় করতে চেয়েছেন পণ্য। তাহিতীতে জাহাজ থেকে নেমে। একেই বোধহয় ধরতে চেয়েছেন ডি-কুনিগ আমেরিকায় জাহাজ থেকে নেমে। আমিও তো পাড় থেকে নেমে যেতে যাচ্ছি স্রোতে।

(৮)

তফশিলা মিউজিয়াম এ আমি একটা মুখ দেখেছি। মুখে হাসি, ধীর, মধু স্থগিত, যেন তিনি দূরে মৃত্যুকে দেখছেন, তার কল্পমান চোখের পাতায় রহস্য, তাঁর চোখের কোণে মেঘাড়া, তাঁর চোখে হয়তো বা বিদ্রূপ। তাঁর ঠোঁটে জ্বলফুল বলাছে ইশারা। আমার মনে হয়েছে ঐ কুলকিনারাহীন হাসি থেকে উত্থিত মানুষের সকল রহস্য, এভাবে মানুষ বোধহয় মৃত্যু থেকে জীবন ছিনিয়ে আনে, এভাবে মানুষ বোধহয় ঈশ্বরের দিকে তাকায়। এই হাসি কি ঈশ্বরমগ্নতা, নাকি ঈশ্বরকে নিয়ে বস করা।

(৯)

পঞ্চাশোর্ধ লোকটি ভাত খেয়ে বেরিয়ে যায়। ঘুম থেকে মাথাটা তুলে তাকায় বালী। বেশ লোকজন রেস্টুরেন্টে ঢোকে। অর্ডারের পর অর্ডার হতে থাকে। রেস্টুরেন্ট পরগরম। মালিক কিংবা ম্যানেজার সজাগ চোখে সবদিকে তাকায়।

(১০)

(যুদ্ধকে নিয়ে জেনারেলরা ঠাট্টা করেছেন। কারণ তারা ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছেন কিন্তু আমার কাছে যুদ্ধ তো ক্ষমতা দক্ষণ ছিল না। যুদ্ধের সময় সারা মারা যায়। সারা যার সঙ্গে আমি থাকতে চেয়েছি গোটা জীবন। সারা আমাকে জীবনের কাছে রেখে যায়।সারা যুদ্ধের সময় কী সব লিখত একটা খাতায়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি, সারা তুমি কি ডায়েরি রাখছ?

হতচকিত হয়ে সারা ডাকাত।

তার পর নায়িক

ডায়েরি? না তো। 

তাহলে সারা?

আমি কিছু লিখে রাখি যুদ্ধটা শেষ হলে পড়ব বলে। পেছন ফিরে তাকাব যুদ্ধটার দিকে।

সারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে মারা যায়। সে রাত্রে সারাদের বাড়িতে আমি আশ্রয় নিয়েছি। সারার বাবা-মা এখনো বেঁচে। আমি সারাদের বাড়িতে থেকে গিয়েছি। স্মৃতি আমাদের তিন জনকে একসূত্রে বেঁধেছে। সারার মা কেঁদে বলেন, আমাদের কাঁদা ছাড়া আর কী করবার আছে তুমি তোমার

এখন বয়স কম। যখন বয়স বাড়বে, তখন মনে পড়া ছাড়া তোমার আর কিছু থাকবে না।

এই দেশের হাজার হাজার মানুষের মনে পড়ে পাকিস্তানিরা কী নির্মম ছিল।


নিষ্ঠুরভাবে তারা মানুষ হত্যা করেছে। আর জেনারেলদের ক্ষমতা ছাড়া আর কোনো বোধ নেই। তারা যুদ্ধ করেছে ক্ষমতা দখলের জন্য। আর আমরা যুদ্ধের মধ্যে বেঁচে থেকেছি যুদ্ধ কত কদর্য তার সাক্ষি দেয়ার জন্য। আমরা সাক্ষী সবকিছুর। পাকিস্তান আর্মি নিজেদের মনে করল আল্লার আর্মি বলে। আর জেনারেলরা ক্ষমতায় এসে আল্লার আইন চালু করতে চায়। বাউলের কথাটা মনে পড়ে আবার আমার আল্লারে নিয়া মশকরা কেন— কর ভূমি।

(১১)

এক দল বেরিয়ে যায়। আরেক দল ঢোকে। এই দলটার সবাই তরুণ। জিনসের প্যান্ট পরা, চামড়ার বেল্ট, সকলের জ্যাকেট গায়ে। হইচই করে অর্ডার দেয় খাবারের মধ্যে মধ্যে ইংরেজি বলে। রোদের তাপ কমে আসে। রোদের তাপ কমে এলে শরীর টের পায়।

(১২)

সারা, আমরা, সাধারণ মানুষরা, দেখো যুদ্ধের পর ক্ষমতার দখল নেব।

মনে হয় না।

কেন? যেভাবে যুদ্ধ হচ্ছে জেনারেলরা ক্ষমতা দখল করবে।

তোমার যুক্তি? এই জেনারেলরা তো পাকিস্তান আর্মিরই অংশ। পাকিস্তান আর্মি ক্ষমতা ছাড়া,কিছু বোঝে না। এই বোধটা আমারের জেনারেলদের মধ্যেও আছে। কারণটা বল। দেখছ না সব সেক্টর আর্মিদের নামে। এরাই দখল নেবে।

আমি রেগে যেতাম। হঠাৎ আচমকা আমি ভোরের আলোক ফোটার মতো কদর্য সত্যটা বুঝতাম। যদি কখনো মুক্ত হং, আমাদের মুক্তি এবং জেনারেলদের ক্ষমতার লোভের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবে।)

১৩


রাস্তায় জটলা বেধেছে। রিকশা ঠেলাগাড়ি ট্রাক প্রাইভেট গাড়ি একসঙ্গে থেমে গেছে। রিকশা থেকে ফুটার থেকে ঠেলাগাড়ি গাড়ি ট্রাক থেকে প্রাইভেট গাড়ি থেকে চিৎকার। উঠছে। সবাই গাল দিচ্ছে সবাইকে। মাণিক কিংবা ম্যানেজার হাসছে। একজন বহু দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। ভেতরের জিনিসপরা সঙ্গলটি গান শুরু করেছে। শব্দগুলো না ইংরেজি না বাংলা, সাতিশয় উঠানামা করে অন্ধকারের পর আলোকের মতো। কিংবা ভালবাসার নিরা জনতার পর ভালবাসার হেমন্তের মতো। শুধু গলায় থেকে যায়, যেমন আমার গলার মধ্যে সারা।

১৪

সারার কঠায় গুলি লেগেছে। টেলিফোন ডেড। বাইরে অবিশ্রান্ত গুলি। গুলির উন্মত্ততা। গুলির অচিন দীর্থতা। গুলির প্রচ্ছন্ন বাস্তবতা। সারার মার শাড়ি একে ভিজে যায়। আমাদের করবার কিছু নেই। গুলির আওয়াজ আমাদের আমাদের মধ্যে গুটিনো আনে। রক্তে ভিজে যায় সাীা,সারার মা। আমার চক্ষুর মধ্যে, আর সারার বাবার

চক্ষুর মধ্যে নিঃসঙ্গ। দরজার ওপারে আকাশ, মাঠময়দান শুয়ে আছে। কিন্তু রক্তের উপস্থিতিতে আমাদের করার কিছু নেই। জীবনে যুদ্ধ হয়তো একবারই আসে। সারার হৃদয়ের ধুকপুক থেমে আসে। আমার হৃদয়ে সেই গেমে আসা শুনি। এই শোনা সাবার মৃত্যুর এবং আমার বেঁচে থাকার।

(১৫)

আমার পাশের টেবিলে একটি যুবক এসে বসে। সে অর্ডার দেয় চিকেন টিক্কার। প্লেট থেকে তুলে নেয় এক টুকরো লেবু, গোশতের ওপর নিংড়ে দিতে থাকে লেবুর রস। তারপর টেবিলের ওপর ঝুঁকে লোশতে ছড়াতে থাকে দেদার, মনে হয় সব শক্তি যুবকটি এ কাজে লগ্নি করেছে।


১৬


পরদিন আমরা সারাকে কবর দিতে যাই। প্রতিবেশীরা জিজ্ঞেস করে না কীভাবে মৃত্যু হয়। যেন সবার জানা। রোজ রাত্রে পাড়ায় গুলি চলে তো


দাফনের পর আমরা ফিরে আসি। আমার বোধহয় এ বাড়িতে থাকা উচিত নয়। আমার যাওয়ার জায়গা এত কম।সারার মা বলেন, তুমি এখানেই থাক।

আমি জবাব দিই না, যেন চুপ থেকে জেনে নিই ।

সারার বাবা বলেন, মনে রেখো, জাস্ট ওয়ার বলে পৃথিবীতে কিছু আছে। জাস্ট আর্মি

বলে কিছু নেই। আমি মাত্রই পোতী। আমি ইতিহাসের শিক্ষক, আমার ভাই মনে হয়।

(১৭)

ষ্টেশন থেকে একটা হুইসেল ওঠে। একটা ট্রেন এসেছে। কিছু লোক ব্যস্তসমস্ত হয়ে স্টেশনের দিকে ছুটে যায়। একটা চিল চিৎকারে চিৎকারে আকাশটা ফালা ফালা করে। চিৎকারটা যেন চামড়ার কটকি কারুকাজ। দূর কোনো হলুদ ধানক্ষেতে নৌকার আওয়াজ হাওরের দিকে একা একা ভেসে যায়।

১৮

সারা মারা যাবার পর সারার মা-বাবা একটি সন্তান পান। সন্তানটি তাদের পুত্র নয় এবং জামাতা নয়। সম্পর্কহীনতার মধ্যে একটা সম্পর্ক। এই সম্পর্কটি জীবিত এবং মৃত সাধ্য থেকে উখিত তিনটি মানুষের মধ্যে অড়ানো।

মধ্যে মধ্যে সারার গুলিজীর্ণ মুখ মনে পড়ে। আমার চোখে জাগে সারার মুখের একটি চকিত হাসি, ঈষৎ হাসির রেখা। হাসিটা স্থগিত, বুদ্ধের মুখের স্থগিত হাসির মতো। সারা, তক্ষশীলার বুদ্ধদেবের হাসির মতো এক অপার ইশারা। আমি ভার বহন করে। বেড়াই জীবন এবং মৃত্যুর রহস্যের। কূলকিনারাহীন হাসির মধ্যে আমি আন্নাকে টের পাই। আমি চাবি :- আবার যদি জীবন পাই এই জীবনটাই মেনে নেব, কদর্যতার বিরুদ্ধে পড়াই করার জন্য।

কদর্য কদর্য চারদিকে। আমার আল্লারে, দু হাতে মাথা ধরে, আমি লোকভর্তি জালালাবাদী রেস্টুরেন্টটার মধ্যে নিজেকে শোনাই চারপাশে এত কদর্য কেন!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ