Hot Posts

6/recent/ticker-posts

ভূষণের একদিন হাসান আজিজুল হক মুক্তিযুদ্ধের গল্প


--মুক্তিযুদ্ধের গল্প-- 

**ভূষণের একদিন

হাসান আজিজুল হক


সেই সময়টা এপ্রিল মাস। ভূষণ একটু আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আকাশ দেখছিল। রোদ তখনো ঝাঁ ঝাঁ করছে খালের পশ্চিম পাড়ের বড় গাছগুলোর ছায়া এখনো পানির ওপর এসে পড়ে নি।

কিন্তু ভূষণ আর দেরি করতে পারল না। সে শালতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তার মেজাজ আছে ভীষণ খিঁচড়ে। শানতি ঘুরলেই রোদ সোজাসুজি তার মুখে এসে পড়ছে, খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফের বাইরে মুখের যেটুকু বেরিয়ে আছে সে অংশটুকু আয়নার মতো চকচক করে উঠছে। তখন দেখা যায় মানুষের মুখ কতটা বীভৎস হতে পারে। ভূষণ রাশের কাটত বিকোচ্ছে মুখ খারাপ করে গালাগালি করছে। এপ্রিল মাসের বেলা আড়াইটায় মোদকে তো বটেই আশপাশে যা কিছু তার চোখে পড়ছে সবকিছুকেই সে বিত্তি জানিয়ে দিচ্ছে। অন্য মুখটা বন্ধ করলেই ভূষণ একেবারে বেচারা। ছোট ছোট চোখ দুটো কপালের ভেতর থেকে পিটপিট করে। ভূষণ কেমন শান্তভাবে বলে, একে আমার নাম ভূষণ দাশ। তবে আমরা সেই দাস নই যাদের শুমি বলে। একটু লজ্জিতভাবে ভূষণ বোঝাতে চেষ্টা করে যে জাত ব্যবসায় সে মুচি নয়।

**ভাষা-আন্দোলনের,একুশের গল্প ও মুক্তিযুদ্ধের আরো গল্প পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন   https://monoweredu13.blogspot.com/?


তেমন হচ্ছে জাত চাষী। তার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে সে চাষের কাজ ছাড়া অন্য কিছুই করে নি। এই সত্যটা তার শরীরের পেশিতে লেখা হয়েছে যে কেউ পড়ে নিতেপারে। তার পেশিগুলোর সবই পাকিয়ে গিয়েছে পায়ের ডিমটা লোহার বলের মতো,গোড়ালি থেকে একটা মোটা আঁকাবাঁকা শিরা উঠে হাঁটু পেরিয়ে গিয়েছে।

এসব থেকে সহজেই বোঝা যায় ভূষণ সমস্ত জীবনেই চাষী। মাটি ছাড়া এই মানুষ আর কোথাও কাজ করে নি। বীজ ছড়িয়েছে, চারা পুঁতেছে, জমি নিড়িয়েছে, ধান কেটেছে—ফসল বয়ে নিয়ে গিয়ে গোলাজাত করেছে। অথচ এটাও সত্যি, নিজের ভিটে আর ভিটের সঙ্গে লাগোয়া দশ কাঠা জমি বাদ দিয়ে ভূষণের কোনো জমি নেই। এ প্রসঙ্গে ভূষণের মন্তব্য হল, আমার বাপ পিতামো বড়লোক ছিল— বলতি গেলি জমিদার ছিল। এই রকম কথা বলে ভূষণ তার ছোট ছোট চোখ পিটপিট করে দূরের দিকে চাইবে — একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত। নজর দিয়ে একবার মাঠটাকে জরিপ করে নেবে। লোকটার হাড় মোটা হাতের থাবা দুটো বড় বড় সমস্ত জীবন ধরে হাল চৰে, কোদাল চালিয়ে থ্যাবড়া হয়ে গিয়েছে হাতের পাতা, বোঝা বসে বসে মাথা বসে গিয়েছে ঘাড়ের ভেতর – ভূষণের সেই বিখ্যাত মাথা— চৌকো ধরনের বিরাট বড় সামগার মতো। তার চুলগুলো শক্ত তার যেন ক আস কাটা পাকা। কখনো সে তা আচড়ায় না। টিকিটা ঠিক তালুর ওপরে যে কারণে মনে হয় সে পরচুলা পরে আছে টিকি ধরে টান দিলেই সব উঠে গিয়ে বেরিয়ে পড়বে তার ইস্পাতের মতো শক্ত মাথার খুলি।

ভূষণ শালতি আস্তে আস্তে বাইছিল। দুদিকে সমতল বিলের মাঝখান চিরে খালটা নিচু—বেশ নিচু—পানি কমে এসে তলায় ঠেকেছে। বিল শুকিনো খটখটে। দিগন্ত পর্যন্ত সমতল, খোলা—গাছপালা বিশেষ নেই। ভূষণ ঘাড় উঁচু না করে বিল দেখতে পায় না শালতি থেকে। খালের পাড় বেশ উঁচু এবং দু পাড়ে যথেষ্ট গাছপালা রয়েছে—বড় বড় জাম কাঁঠালের সঙ্গে সঙ্গে ঝোপঝাড়ও প্রচুর। কোনো ফুলের তীব্র গন্ধ ভূষণের নাকে এসে লাগল। এপ্রিল মাসের এই ফুল-কোনো ঘাসফুল হতে পারে— ঝোপের মধ্যে লুকানো তারার মতো দেখতে জুঁই ফুলও হতে পারে। কিন্তু ভূষণের মেজাজ তাতে একটুও ছিল না। সে সমানে দিস্তি করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘাড় উঁচু করে গাছপালার ফাঁক দিয়ে বিলের দিকে চেয়ে সে বলছে, হারামজাদা কমনেকার, বাড়ি এমবি শুধু ভাত গিলতিয়ার, তোর কপালের নেকন খণ্ডাবে কেডা সুষু আছে তোর কপালে বলে দেলাম। ভূষণের এই একটা মুদ্রাদোষ রয়েছে—সে কাজ করতে করতে অকারণে ঘাড় তুলে দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকে। কখনো বা হাঁ করে আকাশ পানে। কিছুক্ষণ এইভাবে চুপচাপ চেয়ে থেকে আবার গাড় নামিয়ে কাজ করে। বহুদিনের অভ্যাস এটা ভূষণের। আকাশ বা দূরের দিকে চেয়ে কী যে সে ভাবে সে-ই কাতে পারে।মেজাজ খারাপ হবার অনেকগুলো কারণ রয়েছে অবশ্য এখনো বিলের মাঠে ধানের নাড়া রয়েছে—যতদূর চোখ যাচ্ছে জড়াজড়ি করে রয়েছে ধান, খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে পাখিগুলো—অথচ তার বাড়িতে একমুঠো ধান নেই। গত বর্ষায় মালিকের কাছ থেকে লেখা ঢাকা ধানে শোষ দিতে গিয়ে ভাগে পাওয়া ধানটা সব শেষ হয়ে গিয়েছে। গরু দুটোকে খেতে দেবার জন্যে একমুঠো ঘড় পর্যন্ত নেই। ধুকছে গরু দুটো। হারামজাদা ছেলেটা পর্যন্ত পাঁচ মিনিট বাড়িতে থাকবে না যে বলন দুটোকে একটু মাঠের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।

**জহির রায়হান এর সময়ের প্রয়োজনে গল্পটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

**নচিকেতাগণ গল্পটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

**শওকত ওসমানের দুই ব্রিগেডিয়ার গল্পটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সকালে সে বেরিয়েছিল একটা কাস্তে হাতে করে। যদি কোনো কাজকর্ম পাওয়া যায়। কাজ সে পেয়েছিল মল্লিক বাড়ি বেড়া বাঁধার কাজ। আপন মনেই কাজ করছিল নে তিনটি ছেলে এগিয়ে এল। ভূষণ ওদের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে যায়। পুলিশের হাতে যেমন বলুক তেমনি বন্দুক ওদের হাতে। দুজনের খালি গা। দুজনকে ভূষণ চিনতে পাবল পাশের গাঁয়ের ছেলে, স্কুলে পড়ত, আজকাল চাষের কাজই তো করে ভূষণ জানে। জামা গায়ে ছেলেটিকে ভূষণ চেনে না। কী করতিছ ও ভূষণ। সে কথা বলতে পারল না, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। আমাদের সঙ্গে আসতি হবে বুজিছো? পরিচিত দুজনের একজন বলে।

এই বন্দুক ধরতি হবে পড়তি হবে এমনি করে।

একজন খালি গা তার বন্দুক আকাশের দিকে তাক করল। কড়াৎ করে একটা বিকটআওয়াজ উঠল। ভূষণ চমকে উঠে কাস্তে ফেলে দিল। দিলে তো দ্যাওড় করে কী আওয়াজ, বাপরে — ভূষণ কাঁপা গলায় বলে। জামা গায়ে ছেলেটি এইবার বলে, তার চোখের রং পিঙ্গল, দৃষ্টি চিলের মতো— নাকের দুপাশ কোঁচকানো। সে বলল, দেশ নিজের করে নাও ভূষণ স্বাধীন করে নাও। পাকিস্তান আর রাখা যাচ্ছে না।

ভূষণ কিছু কিছু গণ্ডগোলের কথা শুনেছিল। ঢাকায় নাকি ভারি গোলমাল চলছে—

মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছে খুলনাতেও হা

ঙ্গামা চলছে। ভূষণ এ সব শুনেছে মাত্র। গণ্ডগোল তো এদেশে লেগেই আছে তেমনই কিছু হবে হয়তো। এখন সে অস্ত্র দেখে আর বিকট আওয়াজ শুনে খুবই ভয় পেয়ে গেল।

সবাইকে আসতি হবে আমাদের সাথে কী কও, রাইফেল ধরতি পারবা না?

জামা গায়ে ছেলেটা আরো এগিয়ে এল ভূষণের কাছে, শোন কাকা, তোমরা ভয় পেলে কোনো কাজই হবে না-- তোমাদেরই তো অস্ত্র ধরতে হবে – তোমারই তো হ কোটি মানুষ আছ এদেশে এই তোমরা যারা চাষী জমিজমা চাষবাস কর। আমাদের দেশটা শুনে খেয়ে ফেললে শালারা। ভালো ভালো অস্ত্র দিয়ে ঢাকায় খুলনায় সব জায়গায় আমাদের মেরে মেরে শেষ করে দিলে। অস্ত্র না চালালে এখানেও আসবে ব্যাটারা লুকিয়ে বাঁচবে ভেবেছা

এইসব বলে ছেলে তিনটি চলে গেল।

ভূমণ ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। পুলিশের বন্দুক এদের হাতে, এটা ভীষণ সাংঘাতিক কাজ মনে হল তার কাছেকাজ করে দেড় টাকা পেয়েছিল ভূষণ। দুপুরে কড়া রোদে বাড়ি এসেই কিন্তু মেজাজ তার বিগড়ে। গুরু দুটো ঠায় বাঁধা আছে। দুপুরে রান্না হয় নি - সকালের দুটো ভাত পানিতে ভেজানো ছিল। তাই নিয়ে এর ভূষণের রঙ। ছোট ছেলে দুটো ন্যাংটো হয়েউঠোনে পিটুলিগাছের ছায়ায় মাচ্ছে। ভূষণের বাড়ির চারদিকই খোলা পিটুলি গাছটাতেই যা একটা ছায়া হয়েছে— না হলে রোদে পুড়ে যাচ্ছে যেন তার তিটে।।

ভূষণ সে কালে হরিদাস শুনে এর বউ জবাবে বলে যে সকাল থেকেই সে উধাও।

এই কথা শুনেই ভূষণের খুদে খুদে কটা চোখে যেন আফন জ্বলে উঠল, উরে হারামজাদা শুয়োর, ওরে যদি না আজ গাড়ে পতি— আসুক শালার বিটা আজ। গরু দুটোর কোনো ব্যবস্থা করা গেল না। ভূষণকে দেখে তাদের বড় বড় কালো চোখ আশায় ঝকঝক করে উঠল। পারণি কিছু খাতি দিস—ভূষণ বউকে বলল।

আমি দেব কনে থে—বউ বলল । মুখে মুখে জবাব করিস নি দিনি যা বলাম, পারলি করিস।

এই কথা বলে ভূষণ গিয়ে তার শানতিতে উঠেছিল। এপ্রিলের রোদে তেতে খালের ঘোলা পানি গরম হয়ে উঠেছে— বাতাসটাও আগুনের মতো গরম। মাঠের ঘাস পুড়ে যাবার পটপট শব্দ ভূষণ শুনতে পাচ্ছিল। সে ঘাড় উঁচু করে শুকনো বিলের দিকে অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে দেখছিল দিগন্তের কাছ বরাবর তাপ কয়ক কাছে। সেই সাদা ধোঁয়া পেরিয়ে গ্রামগুলো গভীর সবুজ উঁচুনিচু রেখায় স্থির হয়ে রয়েছে।

কিন্তু ভূষণ ব্যাপার-স্যাপার কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কী আরম্ভ হয়েছে দেশে=দুধের ছেলেরা বলুক হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পঞ্চাশ বছর আগে ভূষণ যখন জন্মেছিল এই বিলের ধারের গ্রামে — সরু সরু খালে ক্ষতবিক্ষত—কোনাকুনি লম্বালম্বিভাবে ফালা ফালা করে চেরা-কিছু আম, জাম, কাঁঠাল, কিছু ঝোপঝাড়, লতাপাতা আর ছোট ছোট গোলপাতায় হাওয়া কুঁড়েঘর: ক'ঘর জেলে, গুটিকয়েক চাষী পরিবার—এই অসহা একঘেয়ে গ্রামে পঞ্চাশ বছর আগে যখন ভূষণ পৃথিবীতে এল, তারপর থেকে অনেক কিছুই ঘটে গিয়েছে। এই কথা ভূষণ শুনতে পায়, কিন্তু সে নিজে থেকে বিশেষ কিছু বুঝতে পারে নি

খুব ছোটবেলার কথা ভূষণের মনে পড়ে। উঠোনের পূবদিকে ছিল একটা বড় আমগাছ—ভূষণ পরিষ্কার দেখতে পায় গ্রীষ্মকালের লম্বা দুপুরে সে সেই আমের ছায়ায় ন্যাংটো হয়ে শুয়ে আছে। নিজের কোমরের ঘুনসিটা পর্যন্ত ভূষণের নজর এড়ায় না। ওর বাপের ছিল ঝুলে পড়া কাঁচাপাকা একজোড়া গোঁফ। ভূষণ তার বাবাকেও স্পষ্ট দেখতে পেল। বাবাকে আরো ভালো করে দেখবার জন্যেই যেন ভূষণ ঘাড় তুলে বিলের ওপর দিয়ে অনেক দূরে চেয়ে রইল। রোদ এখন পড়ে এসেছে— বালের দুপাড়ে বড় বড় গাছগুলো থেকে ঝিরঝিরে হাওয়া দিতে শুরু করেছে। ভূষণ দেখা কচি নতুন পাতা বেরিয়েছে গাছগুলোয় জাম গাছের নিচে দিয়ে যেতে একটা রমরম শব্দ এল বাতাসের। লতাগুলো এগিয়ে এসে খালের পানিতে স্কুলে পড়েছে।

আমি তো কিছুই দেখতেছিলেন— ভূষণ বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে এল, কী হইছে দেশের, এই বিল যেমনকার তেমনি রইছে, কেডা এই বিলের মালিক ভলোমান জানে। বাবাও যা করত আমিও তাই করছি— খালের ধারে এই জামগাছটা পর্যন্ত যেমন তেমনি রইছে।

ভূষণ তার সেই বিকট অদ্ভুত ধরনের মাথা খুব গভীরভাবে নাড়ল, হারামজাদা হরিদাসটা পর্যন্ত—ভূষণ মাথা ঝাঁকি দিতে তার মোটা মোটা কর্কশ চুলগুলো মাথার চারপাশে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ল। তেমনই বিরসমুখে সে শালতি বাইতে লাগল। যাচ্ছিলযে পাড়ের কোল ঘেঁসে তার জোরে এখন এসে পড়েছিল। এদোহারো জু অন্যমনক হয়ে ভূষণ একটা নাম্বার মাস ছিড়তে চোন। ফোঁস করে গর্জন করে উঠে যেন সেই গানই ফণা তুলে তার সামনে লেখা তেজী একটা গোখরোগানকে গায়ের রং খানের পশ্চিম পাড়ে একটা বড় বিলালের পাশে বিকেলের হালকা রোদে দুই সাপটার খোলা চোখে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে খুব ছোট দুটি বিন্দু বিবাহিত করছে। ভূষণের মনে পড়ল তার বাপ হবেছি কামা গিয়েছিল। ভূষণ তার বাঘের মতো হাতের ধারার বৈঠা ধরে একটি নিশ্চিত আঘাতে সাপটা কোমর ভেঙে দিল। হিসহিস করে এখনো গঠন করে যাচ্ছিল সাপটা ভূষণের শানতি এক দমকায় খানের মাঝখানে চলে এসেছিল। আননে আর আক্রোশে মনের চৌকো মুখ গারদের লোহার দরজার মতো আটকে গেল তার চোয়ালের পাশে মাংসপেশি কাপতে থাকল -- চোষে এপ্রিলের সূর্য কিকি করতে করণ। শালতি আবার পাড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে সে সাপটাকে থেতলে দিয়ে এল।

দুটি কাছাকাছি চলে এসেছে। ভূষণ পেছনে চেয়ে দেখল, বাল উপোর পাতের মতো এঁকেবেঁকে বিলের ভেতর দিয়ে দক্ষিণে চলে গিয়েছে, বহু দূর পর্যন্ত কোনো লোকালয় নেই। এই পর্যটা একা কতদিন পাড়ি দিয়ে এসেছে তৃণ আর হঠাৎ একটু ভয় করে উঠল তার। হাট থেকে ফিরতে নিশ্চয়ই রাত হয়ে যাবে – হরিনামকে না গেলে সে ফিরবে কেমন করে। এই অদ্ভুত সমস্যায় ভূষণ কিন্তু এর আগে কোনোদিন পড়ে নি। হাটের একেবারে মাঝামাঝি গিয়ে দ্রুতনের মুদির দোকানের পেছন দিকটায়।


শালতি বেঁধে রেখে ভূষণ লাউশাক, কাঁচকলা আর গাল দুটো মাথায় নিয়ে নেমে এল।


রতনের মুদিখানার উত্তর পাশ দিয়ে একটা চাদু পুঁতিপর ধরে তরকারির হাটে আসা


যায়।


সেই পথটা নিয়ে উঠে আসতে গিয়ে বারকতক ভূষণের পা হড়কে গেল। খুবই খাড়াই পথটা, দুপাশে আবার কিছু কাঁটাযোগ আছে। কিছুতেই এগোতে দেয় না। উঠে এসে তরকারির হাটের মুখটায় দাঁড়িয়ে ভূষা হাপাতে লাগল। দেরি হয়ে গিয়েছে তার— হাট অনেকক্ষণ জমে উঠেছে, মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে জায়গাটা, আশপাশের গাঁ থেকে সমর্থদেহ প্রায় প্রত্যেকটি পুরুষমানুষ এসেছে হাটে। তিত্বটা আজ বড্ড বেশি মনে হল। ভূষণের—মানুষের কোলাহলে এমন একটা গম্ভীর শব্দ উঠছে যে কান তো তো বলাতে থাকে। ঊষণ হঠাৎই দেখতে পেল সামনের চায়ের দোকানটায় হরিদাস আড্ডা দিচ্ছে আর হ্যা হ্যা করে হাসছে। অসহ্য রাগে ভূষণ কাঁপতে শুরু করে—তার কটা চোখ দুটি জ্বলে ওঠে আর মুখের আকার পুরোপুরি চৌকো হয়ে যায়। ভূমণ নিশ্চয়ই বাঘের মতো গিয়ে হরিদাসের ওপর লাফিয়ে পড়ত – কিন্তু তার মাথায় শাক আর লাউয়ের বোঝা — হাত জোড়া। সে কী করবে ভেবে পেল না। শেষে তড়বড় করে মামার আর হাতের। বোকা মাটিতে নামিয়ে রেখে ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হয়ে ভূষণ কিছু করতে করতে হরিদাসের দিকে ছুটে গেল। দোকানের পৈঠায় দাঁড়িয়ে সে হাতে নি, আয়, হারামজাদা অনুযান, শালার বিটা পিচেশ, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন

ভূষণকে দেখে হরিদাসের মুখ জড়িয়ে গিয়েছিল। সে ভয়ে ভয়ে নেমে আসছিল দোকান থেকে। কৃষ্ণা প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল দোকানের নিচে, নাগালের মধ্যে এলেই হরিদাসের মুগ্ধ ছিঁড়ে নেবে এই ভঙ্গিতে ঠিক তখন একটি গভীর বড় শব্দ খালের দিকথেকে ভেসে এল। ভূষণ জানে এই শব্দ লক্ষের, লালা যখন ঘাটে ভেতে এই শব্দ পানি তেতা থেকে উঠে আসে। কিন্তু এই খালে তো কখনো লঞ্চ আসে না। (হরিদাস ততক্ষণে সামনে এসে গিয়েছে, ভূষণ তবু হতত্ত্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। সেই

মুহূর্তে নিকট একটি বোমা ফাটার শব্দে হাট ফেঁপে উঠল । ভূষণ দেখতে পেল বড় তেঁতুলগাছটা আমূল এর পরিয়ে উঠল, কিছু কাক বলেছিল, ভয়ানক চিৎকার করে ঘুরে ঘুরে উড়তে শুরু করল। শব্দটা আবার এল প্রথমে প্রচণ্ড একটা আওয়াজ, কান ফাটিয়ে দেয়, তারপরেই বোহার তৈরি কোনো যন্ত্র থেকে বেরোনো একটা পাতলা ও তীক্ষ্ণ ধাতব প্রতিষ্ঠানি। আওয়াজের সাথে সাথে ভূষণের যুক্তি পট করে তার পায়ে বাড়ি খেল। এখন তার পা দুটি যেন মাটিতে আটকে যায়— সামনেই বিহ্বল হরিদাস। হাটের কোলাহল থেমে গেল—নেতা নেমে এল তখন। এই গুরুতাকে বর্ণনা করা যায় না— আকাশ কাঁপিয়ে তোলা আতংক আর আর্তনাদ সেই স্তব্ধতাকে শানিয়ে তুলেছে আর তার ওজনকে করেছে দুর্বহ।

থেকে থেকে সেই ভয়ংকর আওয়ার চলতে থাকে। প্রথমে ভয়াবহ গম্ভীর তন তন্যপরেই ধাতব প্রতিধ্বনি—চাইই। তারপর ভূফা আর লঞ্চের শব্দ শোনে না—একটা নতুন শব্দ শুনতে পায়—ফরবার। জমির নাড়ার ফাঁক দিয়ে খুব দ্রুত পায়া নেড়ে মাটির ওপর দিয়েই উড়ে যাবার সময় একজাতীয় ছোট পাখি যেমন শব্দ করে; শব্দটা অনেকটা তেমনি। এই শব্দ শোনবার পরেই হাটের একপ্রান্ত থেকে রক্ত জমানো হাহাকারতরা চিৎকার কানে আসে, আর হরিদাসের আতংকভরা চোখের চাউনি অনুসরণ করে ভূষণ পেছন ফিরে নদীর দিকে চেয়ে দেখতে পায় গলিপথ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে আসছে একজন মানুষ তার পরনে খাকি প্যান্ট আর থাকি জমা, মাথার কপাল-ঢাকা টুপি তেরছা করে বসানো ফরসা, লম্বা, পাহাড়ের মতো জোয়ান। ভূষণ মানুষটার চোখের দিকে চাইল। প্রথম যৌবনে সে সুন্দরবনে খুব কাছ থেকে একটি বাঘের একজোড়া চোখ নেমেছিল। প্রতি, অতি দ্রুত ভূষণের সেই কথা মনে পড়ে গেল। মানুষটা ভীষন চিৎকার করছিল যা বোঝার ক্ষমতা ভূষণের ছিল না শুধু বেইমান, মাতাউন, কাফের এই রকম শব্দ সে শোনে আর একদৃষ্টে লোকটার হাতের লোহার কালো বেঁটে বন্ধুকটার দিকে চেয়ে চোখের পলকে লোকটা যেন দুটো হয়ে গেল। ভূদ দেখল তার পাশে ঠিক তারই মতো আর একজন। মুড়িপথ ধরে ঘটঘট শব্দ তুলে একজনের পর একজন উঠে আসছে উপরে বসেই নদীর কিনারা বরাবর ওরা ছড়িয়ে লাল। এবং এতক্ষণে একটানা শব্দ উঠ একটু কট কট কটু। কান বা করতে থাকে ইরিদাস দু পা করে দিয়েছে, ভূষণ তেমাক্রোনের মতো এপ্রিলের আকাশের দিকে চেয়ে রইল একটুক্ষণ অন্যমনভের মতো। রোদ তখনো ঝিকমিক করছে বড় বড় গাছের মাথায়। আবার একটানা শব্দ উঠ কটু কষ্ট করেই তখন দেখল গোড়া কেটে গেলে গাছ যেমন তাড়াহুড়ো না করে আর মাটিতে শুয়ে পড়ে, মানুষ তেমনি করে মাটিতে পড়ছে।

দেখতে পায় কোনো মানুষের মাথা থেকে, কালো পা থেকে, কারো কাঁধ, সূত বা পেট থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে থাকে বলে ছোটার কলকল করে শব্দটাই যা ভূষণ শুনতে পায় না কিন্তু দলে দলে মানুষ মাটিতে শুয়ে পড়ছে এটা সে দেখতে পায়।

ভূষণ এতক্ষণ নড়তে পারে নি হাটের কোনো মানুষ কিছুক্ষণ নড়ে নি। হঠাৎ সেই ভয়াবহ স্তব্ধতা কেটে যায়      চিতকার করতে করতে  মানুষ তিব্রবেগে দৌড়াতে দৌড়াতে মাটিতে হুমকি খেয়ে পড়ে, কেউ মুহূর্তের জন্যে দাড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে একবার নদীর দিকে তাকায়, তারপর তলপেট চেপে মাটিতে বসে পড়ে আর রক্ত ছোটে কলকল অনন শব্দে। শানের মতো মসৃণ সাদা পথের ওপর দিয়ে রক্ত এত দ্রুত গড়িয়ে যায় যে তাতে সাদা ফেনা দেখা যায় কোথাও ঘাস ভিজে যায়— ডগায় রক্তের বিন্দু নিয়ে লম্বা ঘাস ঝুলতে থাকে।

একভাবে কট কট কট কট শব্দ চলতেই থাকে—এখন বস্তার ওপর বস্তার মতো মানুষের ওপর মানুষ স্তূপীকৃত হতে থাকে – কেউ প্রবল বেগে হাতপা নাড়ে, কারো চোখের পাতাটি শুধু কাপতে কাপতে স্থির হয়ে যায়। মানুষেরা ঘোলা চোখে এপ্রিলের আকাশের দিকে কঠিন চোখে বা যন্ত্রণার চোখে বা অভিমানের চোখে চেয়ে থাকে। ঈশ্বরের নামে বাতাস চিরে যায়—বহু লোক একসঙ্গে একযোগে ঈশ্বরকে ডাকে এবং যেটুকু সময় চুপ করে থাকে সেই সময়টার মধ্যে মানুষ ইতস্তত মাটিতে শুয়ে পড়ে। শাকসবজিভর্তি বাজারের থলে কাঁধে নিয়ে কাত হয়ে এক পা গুটিয়ে কেউ পড়ে থাকে। আশি বছরের বুড়ি বুলেটে চুরমার হয়ে যাওয়া বুক অগ্রাহ্য করে কোমরে ছেঁড়া কাপড়ের কসিটা আঁটবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

- হরিদাসের হাত ধরে টানতে টানতে ভূষণ এতক্ষণে তেঁতুলগাছটার আড়ালে গিয়ে পৌঁছেছে। ভূষণ আর কোথায় যেতে পারে? সে সেখানে দাঁড়িয়ে শুনল সমানে কট্‌ কট্ শব্দ চলছে আর এখন হাটের যত দূর চোখ যায় কোথাও কোনো মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। অজস্র মানুষ মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে—কেউ কেউ তখনো চিৎকার করছে, ভগবানকে ডাকছে, পানি চাইছে, হাতপা ছুড়ছে। হাটের ছোট ছোট চালাগুলো গুঁড়িয়ে ভেঙে পড়ছে মাটিতে-- শন শন শব্দে চারদিকে বুলেট ছুটছে। ভূষণ দেখা এর মধ্যে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একটি মেয়ে তার কালো কুতকুতে বাচ্চা কোলে তেঁতুলগাছের দিকে এগিয়ে এল। ঠাস করে একটি শব্দ হল। মেয়েটি বাচ্চার মাথায় হাত রাখে। ভূষণ দেখে মেয়েটার হাত দিয়ে গলগল করে রক্ত আসছে শেষে রক্ত মেশানো সাদা মগজ বাচ্চাটার ভাঙা মাথা থেকে এসে তার মায়ের হাত ভর্তি করে দিল। মেয়েটি ফিরে দাঁড়াল, বাচ্চার মুখের দিকে চাইল, পাগলের মতো ঝাঁকি দিল তাকে কবার — তারপর অমানুষিক তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ছুড়ে ফেলে দিল বাচ্চাটাকে; দু হাতে ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলল তার ময়লা ব্লাউজটাকে তিরি দুধে-ভরা ফুলে ওঠা স্তন দুটিকে দেখতে পেল ভূষণ। সে সেই বুক দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, মার হারামীর দূত, খানকীর পুত—এইখানে মার। পরমূহর্তেই পরিপক্ব শিমুল ফুলের মতো একটি স্তন ফেটে চৌচির হয়ে গেল। ছিটকে এসে সে পড়ল তেঁতুলতলায়।

আকাশপূর্ণ ভয়শূন্য উনি নিয়েই সে মরে নাইল। এর মধ্যেও ভূষণ হরিদাসকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তখুনি ছুটে সে তার কাছে যাচ্ছিল, কিন্তু হরিদাস হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল। ভূষণ ফিরে তাকিয়ে দেখে একেবারে সামনে, এক হাতের মধ্যে সেই মানুষ হাতে বেঁটে একটা বন্দুকের মতো জিনিস ফরসা বিরাট মুখ ঘামে ভিজে গিয়েছে, রাগে রক্ত যেন ফেটে পড়ছে। খুব কাছ থেকে ভূষণ পোকটার কুতকুতে চোখ দুটো দেখা, তার গায়ের ঘামের গন্ধ পর্যন্ত পেল সে। লোকটা গলা ফাটিয়ে বলল, এই কমিন, তুম মালাউন হো?

ভূষণ এইবার আর কিছুই দেখছিল না— তার সেই যাব থাবা হাত ইস্পাতের মতো। শক্ত হয়ে উঠেছিল সে দুবার লোকটার ফুলে ওঠা গলনালীর দিকে তাকাল—চুপচাপচেয়েই থাকল একটু সময়। শেষ পর্যন্ত মনস্থির করল ভূষণ—একটিমাত্র প্রচণ্ড লাফে সে হরিদাসের কাছে পৌঁছে গেল।

তখন হরিদাস শুয়ে—সমস্ত শরীর স্থির, শুধু চোখ দুটিতে তখনো আছে জীবনের তাল। তাপ। ভূষণ তার মুখের ওপর মুখ নিয়ে আদরে ডাকল, বাবা হরিদাস, বাপ আমার মানিক আমার এই বলে সে তার রুক্ষ কর্তৃশ হাত ছেলের গায়ে মাথায় অতি ধীরে বোলাতে বোলাতে অস্ফুটে আবার ডাকল, বাবা হরিদাস।

এরপর আবার যখন বিচ্ছিন্নভাবে একটিমাত্র আওয়াজ উঠল কড়াং করে, তখন ভূষণের চৌকো থামের মতো দেহটা বার দুয়েক ঝাঁকি খেয়ে স্থির হয়ে যেতে সে সমস্ত বোধের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গেল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ