--মুক্তিযুদ্ধের গল্প ৭১ এর গল্প --
**নচিকেতাগণ
কায়েস আহমেদ
সরু একটা বাথরুম, এর মধ্যে ১৬ জন মানুষ, শোয়া তো দূরের কথা ছড়িয়ে বসাও যায় না, পা গুটিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দিনরাত বসে থাকতে থাকতে ঘাড়, পিঠ, কোমরে টনটনে ব্যথা। জানিতে চোখ জড়িয়ে আসে, কিন্তু গোসলহীন অতু শরীর, অবিরাম টেনশন, অস্বাচ্ছন্দ্য থেকে থেকে জাগিয়ে দেয়। একটিমাত্র দরজা, সব সময় বন্ধ জানালা নেই, দেয়ালের একদিকের মাথায় সিলিং ছোঁয়া একটা ১০ ইঞ্চি বাই ৮ ইঞ্চি ফাঁকা ভেন্টিলেটর। এর মধ্যেই ১৬ জন মানুষের প্রস্রাব-পায়খানা; দুর্গন্ধের চেয়ে অস্বস্তিটাই মারাত্মক।
শত বুধবার ভোর ছটার দিকে আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল এখাে ছিপের পেছনের সিটে আমার দুপাশে দুজন রাইফেলধারী মিলিটারি, মুখোমুখি দুজন। সামনে, ড্রাইভিং সিটে একজন, তার পাশে আরেকজন বোধহয় অফিসার লেভেলের কেউ হবে। আমি তার মুখের এক পাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম, মসৃণ গাল, জুলফির নিচে চকচকে ফরসা গানে নীলচে আভা। এত সকালেই এমন শেভ করা মূখ । মুখোমুখি সৈনিক দুজন আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, অস্বস্তিতে আমি চোখরাখলাম বাইরের দিকে।
রাস্তায় লোকজন খুব কম, ১টা বাস চলে গেল, ২টি বিকশা, ১টা কুকুর, ২ জন মানুষ। রাস্তা মোড় নিল বাঁদিকে পার্ক, ডানদিকে পানির ট্যাংক, ৩টি রিকশা, ১টা বেবিট্যাক্সি, ১ জন বৃদ্ধ ভিখারি, ডানদিকে কোর্ট, বাঁদিকে চার্চ, ডানদিকে ট্রেজারি, বাঁদিকে সিনেমা হল, ছিল এগিয়ে যাচ্ছে, এই পরিচিত রাজা পরিচিত বাড়িঘর, গাড়ি, মানু এক সীমাহীন অর্থহীনতার ভেতর দিয়ে আমি চলেছি।
আমি আবার সৈনিক দুজনকে দেখলাম, তারা তেমনিভাবেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একজনের মুখে খুব সূক্ষ্ম একটু হাসির আভাস, কিন্তু তার চোখ দুটি আগের মতোই ধারালো এবং স্থির। নড়েচড়ে বসতে গিয়ে খেয়াল হল আমি কাঁপছি, আমার হাঁটু দুটো, তার ওপর রাখা।
হাত দুটো ভীষণভাবে কাঁপছে।
আমার পাশের দুজনের মুখ দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তারাও ব্যাপারটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য
করে আসছে এতক্ষণ ধরে।
আমি মাথা নিচু করে চোয়ালের দাঁত দিয়ে দাঁত চেপে ধরলাম; কিন্তু আমার এত যে পরিচিত শরীর, সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে এখন আমার সবচেয়ে আপন, তাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। হাঁটুর ওপর রাখা হাত দুটো হাতের আঙুলের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, থেকে থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম পড়ছে। অনুভব করলাম, এই সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি ঘামে সমস্ত শরীর আমার ভিজে গেছে।
কে যেন কেশে উঠল। কেমন ঘড়ঘড় আওয়াজ। কে হতে পারে? আনিস,?দুলাল?আজাদ?আতিক?
কেউ কাউকে চিনতাম না, তবু সবাই সবার চেনা হয়ে গেছে। সকাল হলে দরজা খোলার শব্দ হয়, সময়টার জন্যে আমরা উৎকর্ণ থাকি; প্রত্যেকেই তারি আজ আমাকে নেবে কিন্তু সবাইকে নেয় না, কোনোদিন ৮ জন, কোনোদিন ১২ জন, আবার কোনোদিন ৪ জন ৫ জনকেও নিয়ে যায়।
রাতের বেলা তারা ফেরে টলতে টলতে। আমরা যারা থেকে যাই, সারাদিন নানান তমার মধ্যেও তারি, যে কজন গেল সবাই ফিরবে তো?
রাতের বেলা যখন ফেরে তখন মনে মনে শুনি। না, এ কদিনে একজনও মারা যায় নি নতুন কাউকেও আনে নি ওখানে আর আনবে কোথায়? এখন যেদিন আমায় আল ১০ জন ছিল সেদিন। আমাকে ভেতরে আটকিয়ে দিয়েই
দেখি দরজা বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে। এতক্ষণ আমি যেন অন্য কারো শরীর কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গেছি। দরজা বন্ধ হতেই শরীরের ভার আর বইতে পারলাম না, ছোনা বিছানো কোনো মেঝেতে এগবিচিত আলোর মধ্যেই পটিয়ে পড়লাম। ঘরের ভেতর চলে যেতে যেতে কারো কথা যেন
শুনতে পেলাম: ভয় পেয়েছে। কিন্তু ভয়েরও রূপভেদ আছে। এমন হত, আজকে এখন এই রাতে বলা হল, কাল সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে তোমাকে বাইরে পাঁচিলের ধারে দাঁড় করিয়ে রেখে মারা হবে। তাহলে সেটা যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে ততক্ষণে প্রতি মুহূর্তের যে ভীতি তার সঙ্গে এই যে, ততদিন সঙ্গীদের নিয়ে যাচ্ছে, টার্গেট করছে, অত্যাচার করছে ( এবং সবই নেপথ্যে) তারপর আবার সরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেন্ট্রি দরজা বন্ধ করে চলে গেলে আমরা সেইসব সঙ্গীদের সেবা করছি, এর মধ্যকার ভীতির যথেষ্ট পার্থক্য আছে। বলা যায়, ভয় করেও এই পরিচিত দৈনন্দিনতার মধ্যে ভয়ের বিরুদ্ধে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের প্রতিরোধ গড়ে উঠছে, আমার প্রথম দিনের ভীতির সঙ্গে যার ফারাক অনেক। তারমানে কি ভয়ের একটা নির্দিষ্ট সীমা জেনে গেছি আমরা? কিন্তু আমার নিজের ব্যাপারে স্থির-নিশ্চিত হতে পারছি না এখনো।
কেননা সেই যে এখানে নিয়ে এসেছে আমাকে, এর মধ্যে একদিনও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নেই, কোনো নির্যাতন নেই, শুধু বসে থাকা। আড়াই দিন পরপর রুটির ছেঁড়া ধারগুলো, আর পচা ডাল। এই একঘেয়েমি, টেনশন, ক্লান্তি, শরীর ব্যথা, ভার হয়ে থাকা মাথায় সর্বক্ষণের দপদপে যন্ত্রণা নিয়ে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছা করে, মনে হয়। প্রচণ্ড চিৎকারে এই চারপাশের দেয়াল ধসিয়ে দিই।
কী করতে চায় এরা আমাকে নিয়ে? আমার ছোট ভাই দীপু জুনের শেষদিকে হঠাৎবাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়। নিদারুণ উদ্বেগের মধ্যে ৭/৮ দিন পর একদিন সন্ধ্যাবেলাএকটি ২০/২২ বছরের ছেলে এসে খবর দিয়ে যায় দীপু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, মা তাকে
বসিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল, ছেলেটির বোধহয় সারাদিন খাওয়া হয় নি, মা ছেলেটির হাত ধরে খেয়ে যেতে বলেছিল, ছেলেটি দাঁড়ায় নি, খবরটা দিয়েই চলেগিয়েছিল।
ততদিনে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরা ঢাকা শহরের এখানে-ওখানে বোমা ফাটাতে শুরু করেছে। এক সময় আমাদের এমন হল যেদিন বোমার আওয়াজ শুনতে না পাই সেদিন মনটা বিমর্ষ হয়ে থাকে। কিন্তু আমি তো সেই ছেলেটিকে ছাড়া কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে দেখি নি, পরিচয় তো দূরের কথা। আমরা প্রতিদিন প্রতীক্ষায় থাকলেও দীপু আজ পর্যন্ত। পাঁচ মিনিটের জন্যেও বাড়িতে আসে নি কখনো। অন্তত গত বুধবার সকাল ছ'টা পর্যন্ত এর মধ্যে এসে গেছে কি না জানি না। আচ্ছা এমন কি হতে পারে, বাড়িতে এসে দীপু আমার কথা জেনেছে, আমি দীপুকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, বেবী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, গাল বেয়ে পানি নামছে। দীপু দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে। আপা চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে ধীর শান্ত গলায় বলল, একে দেরি করিয়ে দিও না। দীপু কী করছে এখন? এমন কি হতে পারে, আমরা যে এখানে আছি এ খবর সে জেনেছে, সঙ্গীদের নিয়ে প্ল্যান করছে কীভাবে এই খানাটিকে হঠাৎ করে অ্যাটাক করা যায়; খুব কঠিন কাজ, কিন্তু আমি তো তাঁর ভাই !
দূর, এসবই ছেলেমানুষি চিন্তা। কিন্তু আমাকে এখানে কেন? যাদের ধরে নিয়ে এসেছে তাদের দু/তিনজন ছাড়া কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। তবু আমি ছাড়া আর সবাইকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, জেরা করছে, অত্যাচার করছে কমবেশি, কিন্তু আমার ব্যাপারেই নীরব। আজ পাঁচ পাঁচটা দিন এ-ও কি এক ধরনের শান্তি। অত্যাচারের রূপ দেখ আর টেনশনে ভোগো।
শাহীন খুব জুলিয়াস ফুচিকের রেফারেন্স দেয় কথায় কথায়। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে,চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মনটা কল্পনায় ঠাসা। ওকে ধরেছে মালিবাগের কোন
বেইবেণী থেকে।
ভেরা, মারধর ওর ওপর দিয়েও গেছে মানকয়েক, কিন্তু কথা হল, गान মুচিক কত অত্যাচার সহ্য করে মরেছে, যে তুলনায় ..... বন্ধ বোধহয় ভেতরে ভেতরে একটা বিশ্বাস ছিল যে, ও যখন মরাল সাপোর্ট ছাড়া
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়, তখন ওকে ছেড়ে দেবেই, দুদিন আগে আর পরে। তাই অমন জুলিয়াস চিক আগুড়ায়। বেচারা নব্য যুবক, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের পারই এক লাফে বোধহয় "ফাসির মতা থেকে" পড়েছে। কিন্তু সে বিশ্বাস কি ওর এখনো অবশিষ্ট আছো তাহলে ও মুখ দিয়ে অমন ঘড়ঘড় আওয়াজ করছে কেন, অমন কেঁপে উঠছে কেন থেকে থেকে।
গত রাতে আতিক ভাইকে যখন ফেরত দিয়ে গেল তখনো আমরা কেউ বুঝতে পারি নি। এমনিতেই আতিক ভাইয়ের ওপর টর্চারটা বেশি হয়। নিজে একদিনও তাঁর ওপর অত্যাচারের কোনো বর্ণনা করেন নি, কিংবা সহজে দেখতেও দেন না। তাঁর বাড়ির উঠোন খুঁড়িয়ে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ট্রাকভর্তি অস্ত্র পেয়েছিল একটি ছেলের বিশ্বাসঘাতকতায় ।
আতিক তাই ভাষা আন্দোলন্দের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, জেল খেটেছেন, '৫২-এর পর দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। কিন্তু তবু ২৫শে মার্চের পরও দেশ ছেড়ে যান নি। দিনকয়েক স্তব্ধ হয়েছিলেন, তারপর এক সময় যোগাযোগ স্থাপিত হয়, ধীরে ধীরে তাঁর বাড়ি হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। অপারেশন করে এসে ছেলেরা তার বাড়িতে উঠত, কিংবা এখান থেকে প্ল্যান হত অপারেশনের, নতুন নতুন ছেলেকে রিক্রুট করে বেলাঘর ক্যাম্পে পাঠাবার ব্যবস্থা করতেন। তিনি। বাড়ির লোকজন বহুবার তাকে বলেছে ওপারে চলে যেতে। তিনি যাচ্ছি যাব করে করে থেকে গেছেন। ভেতরে ভেতরে বোধহয় দেশত্যাগের পক্ষপাতী ছিলেন না, তাছাড়া এখানেও তো অনেক কাজ, কাউকে না কাউকে থাকতে তো হবেই। এসব কথা আত্মাদের কাছ থেকে শুনেছি, ফিজিক্স-এ এমএসসি ফার্স্ট পাটের ছাত্র, আতিক ভাইয়ের কাছাকাছি বাড়ি।
আমি বলেছিলাম, এসব কথা যে বলছেন এটা কি ঠিক হচ্ছে। টর্চারের মুখে কেউ যদি বলে ফেলি।
আজাদ বলেছিল, প্রথমত, এসব প্রশ্ন আপনাদের কাউকে জিজ্ঞেস করবে না, বিকজ ইউ আর নট রিলেটেড উইথ হিম ইন দিস কনসার্ন। সেগুলো, যা জানার ওরা সবই ডোনেছে, এখন এসব কথা বদনে নিজের তো কোনো লাভই হবে না, বরং নিজেকে হেভূত অানো হবে। আমরা কে বাঁচি তে মরি জানি না, বিষয়টা জানা দরকার, সকলে হয়তো না-ও মরতে পারি, কারো না কারো স্মৃতিতে ব্যাপারটা থেকে যাবে, কেননা ইট সি আতিক ভাইকে ওরা স্পেয়ার করাবে না, হি উইল বি কিন্তু, কিন্তু সেটা খুব যন্ত্রণাদায়ক, তাঁর জন্যে এবং আমাদের জন্যেও এ তো বুঝতেই পারছেন।
কাল রাতে যখন তাঁকে বে আমরা হয়ে উঠলে তিনি শুধু কললেন, ঠিক তারপর দেয়ালে হেলান দিয়ে স্তর হয়ে থাকলেন। আমরা আন কোনো ক থাকতে না পেরে এক সময় আমাকে বললেন, একটু শুই।
আমি তাঁর মাথাটি আমার কোলের বারে রাখতেই দেখতে পেলাম আতিক ভাইয়ের একটি চোখ উপড়ে নিয়েছে, দু হাতের এন্ডোকটি আঙুলের মাঝখান থেকে কেটে ফেলে। দিয়েছে।
আমার ভেতর কী হল বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠলাম, লুক শাহীন। শাহীন ও অন্য সকলে আমার দিকে চমকে তাকাল, আমি আতিক ভাইয়ের চোখ এবং হাতের দিকে আঙুল নেড়ে শাহীনের উদ্দেশে তেমনি গলায় বললাম, হিয়ার ইজ ইওর জুলিয়াস ফটিক।
হতভম্ব বিস্ফারিত চোখে সকলে তাকিয়ে আছে আতিক ভাইয়ের দিকে। শাহীনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে ঝুলে পড়েছে, ওর অজান্তেই খাবি খাওয়া মাছের মতো ঠোঁট দুটো নড়ছে অবিরত।
রাত শেষ হয়ে আসছে, একটু পরেই ভোরের আলো এসে পড়বে ভেন্টিলেটারের ফাকে, সেই আলোর সঙ্গে আসবে চড় ইটা, কদিন থেকেই লক্ষ্য করছি আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ছোট পাখিটা এসে ডাকাডাকি করে ভেন্টিলেটরে বসে; দেখে অপরিসর এই বাথরুমটায় তালগোল পাকিয়ে কজন মানুষ পড়ে আছে। কী বোঝে কে জানে। খানিকক্ষণ লাফালাফি ডাকাডাকি করে আবার উড়ে যায় বাইরে। আমি তার অবাধ উড়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি, ভেন্টিলেটারের ওপারের ফাঁক আলোকিত শূন্যতা বিশাল পৃথিবীটার আভাস দেয়।
আতিক ভাই নিথর হয়ে পড়ে আছে, কী অবলীলায় এই বীভৎসতার দিকে তাকাতে পারছি। সমস্ত রুমটা জুড়ে এই যে সব পড়ে আছে, যেন অবহেলায় পড়ে থাকা লাশের
শাহীন চোখ মেলল। চল্লিশ পাওয়ার বারের আলোয় ওর ফ্যাকাসে মুখ আরো ফ্যাকাসে লাগছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজের চোখে হাত দিয়ে দেখে, হাত দুটো চোখের সামনে মেলে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আঙুলগুলো দেখে নিয়ে আবার কাত হল। মুখ গোঙানির শব্দে শরীরটা মৃদু মৃদু কাঁপছে।
বাহু নিতে গেল। বাইরে ফরসা হয়ে এসেছে। ভেন্টিলেটরে আলোর রেখা এসে পড়ছে।
কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে আজ আমাকে নিয়ে যাবেই? কী করাকে পা ওপর দিকে বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে চারকাবে? শরীরে। সিগারেটের ছ্যাঁকায় টাকায় সড় করবে। আজাদের মতো আমারও আঙুলের নোখ উপড়ে নেবে? নাকি আঙুল কেটে ফেলে দেবে আতিক ভাইয়ের মতো? অথবা এই আমার চোখ, যে চোখ দিয়ে এখন সঙ্গীদের দেখছি, ভেন্টিলেটর দিয়ে আসা আলো দেখছি, এই চোখ আমার থাকবে না। কিংবা।।।।।....
চড়ুই টা এসেছে।
কী। দেখছ তুমি পাখি? দেখছ কতগুলো বন্দিমানুষ মৃত্যুর প্রতীক্ষায় পড়ে আছে।
কিন্তু তুমি কি জান, এরা তোমার চেয়ে স্বাধীন। এই দেখ, আতিক ভাই, চোখ উপড়ে নিয়েছে, দু হাতের সবগুলো আঙুল কেটে ফেলে দিয়েছে তার প্রতি মুহূর্তের আর্তনাদের মধ্যে প্রতিবাস জানিত হয়েছে। এই যে শাহীন কারো গোল, কেঁপে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে, আর প্রতিটি গোঙানি, শরীরে প্রতিটি কম্পনের মধ্যে আছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা।
যারা এখন ঘুমিয়ে আছে, তারা কেউ-ই পরাধীন নয়। এই যে আমি, আমার বুকের ভেতর আতংক গুরু গুরু করে উঠছে। আমি দেখতে গাচ্ছি আমাকে একটি দেয়ালের ধারে দাঁড়া করিয়েছে, আমার সামনে একটি উদ্যত রাইফেল। আমি সেই রাইফেলের নলের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে যেতেদেয়ালের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছি, আর আমার মুখ দিয়ে জন্তুর মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে, সেই ভীতির মধ্যে স্বাধীনতার যে আকাক্তা; তেমন করে স্বাধীনতাকে তুমি কখনো অনুভব করবে না। বাইরে তারি বুটের শব্দ দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। চড়ইটা উড়ে গেল, আমি শূন্যদৃষ্টি মেলে তার সেই অবাধ উড়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দরজা খোলার শব্দ পেলাম।
0 মন্তব্যসমূহ