****ছন্দ কি? ছন্দের প্রকারভেদ ছন্দের সজ্ঞা দাও অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বলতে কি বুঝ স্বরবৃত্ত ছন্দের সজ্ঞা দাও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কাকে বলে ছন্দের উদাহরণ দাও****
**ছন্দ কি?ছন্দের প্রকারভেদঃ-
***ছন্দ অর্থে ছাঁদ, গড়ন, ঢং বা ভঙ্গিও বোঝায়। কবিতায় এই ছাঁদ, গড়ন বা ঢং সৃষ্টি করা হয় বাণী-বিন্যাস কৌশলের মাধ্যমে। তাই সাধারণ অর্থে ছন্দকে বাকবিন্যাস বা বাণীবিন্যাস কৌশল বলা যায়। এই বাক্বিন্যাস বা পদ বিন্যাস কৌশলের মাধ্যমে বাক্যে ভাষাগত ধ্বনি-সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় এবং বাক্যের সঙ্গে 'বাক্যের বন্ধন সঙ্গীত মধুর ও তরঙ্গ স্বকৃত হয়ে ওঠে।
বাক্যের অন্তর্গত পদগুলোকে কালগত ও ধ্বনিগত সামঞ্জস্য রক্ষা করে শ্রুতিমধুর ভাবে সাজাবার পদ্ধতিকে ছন্দ বলে। সংক্ষেপে বলা চলে “সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিমিত বাক্যবিন্যাসের নাম ছন্দ।
**ছন্দের শ্রেণীবিভাগঃ-
বাংলা কবিতার ছন্দকে মোটামুটি তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়
(১) অক্ষরবৃত্ত: (২) মাত্রাবৃত্ত এবং (৩) স্বরবৃত্ত।
(১)অক্ষরবৃত্ত ছন্দ (Mixed বা Composite Metre)- এই অক্ষরবৃত্ত ছন্দ আবার যৌগিক, মিশ্র কলামাত্রিক, মিশ্র কলাবৃত্ত, মিশ্র প্রকৃতিক, পয়ার জাতীয়, সংকোচ প্রধান এবং তান প্রধান ছন্দ নামেও পরিচিত।
(২) মাত্রাবৃত্ত ছন্দ (Moric Metre)— মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে কলামারিক, কলাবৃত্ত, ধ্বনি প্রধান,
ধ্বনিমাত্রিক এবং বিস্তার প্রধান ছন্দও বলা হয়।
(৩) স্বরবৃত্ত ছন্দ (Stressed Metre বা Syllabic Metrej- এই ছন্দকেই আবার দলমাত্রিক, দলবৃত্ত, শ্বাসাঘাতপ্রধান, স্বরাঘাত প্রধান, প্রস্বর প্রধান এবং বল প্রধান ছন্দ নামে অভিহিত করা হয়। একে ছড়ার ছন্দ বা লৌকিক ছন্দও বলা।
(১)রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – অক্ষরবৃত্ত, সাধু, পয়ার জাতীয়।
(২)প্রবোধচন্দ্র সেন – মাত্রাবৃত্ত, কলামাত্রিক, কলাবৃত্ত
(৩)রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-স্বরবৃত্ত : প্রবোধচন্দ্র সেন – স্বরবৃত্ত, সামাত্রিক, দলবৃত্ত, লৌকিক।
(১)অক্ষরবৃত্তঃ---
অক্ষরবৃত্ত নামটি সর্বপ্রথম চালু করেন প্রবোধচন্দ্র সেন ১৩২৯ (ইং ১৯২২) সালে। তখন থেকেই নামটি সুপরিচিত এবং সুপ্রচলিত। প্রবোধবাবু পরে অক্ষরবৃত্ত নামটি পরিত্যাগ ঠিকরে এর নামকরণ করেন 'যৌগিক' (Composite)।
(১)রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – অক্ষরবৃত্ত, সাধু, পয়ার জাতীয়।
অক্ষরাবৃত্ত ছন্দে হলন্ত বা ব্যঞ্জনান্ত অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে তাকে দুইমাত্রা হিসেবে গণ্য করা হয়।
অর্থাৎ শব্দাঝে) অবস্থিত বদ্ধাক্ষরকে সর্বদাই দুইমাত্রার এবং শব্দের প্রথমে অথবা শব্দমধ্যবর্তী বদ্ধাক্ষরকে সচরাচর একমাত্রার ধরা হয়।একটি বন্ধাক্ষরই যদি একটি শব্দে পরিণত হয় তবে অক্ষরবৃঙে দুই মাত্রার মর্যাদা পায়। বর্ণ বা (যুক্তবর্ণকে এক অক্ষর ধরে পূর্বে এই ছন্দের মাত্রা নির্ণয় করা হতো। সে কারণে এই ছন্দ অক্ষরবৃত্ত নামে পরিচিত।অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সাধারণত সাধু ভাষা ব্যবহৃত হয় এবং এর গতিবেগ মন্থর। এইজাতীয় কবিতার ছন্দে, বিশেষ করে পয়ারে (অক্ষর ধ্বনি ছাড়াও প্রাধান্য লাভ করে সরের প্রবাহ বা একটা টান বা তান। সেজন্য অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় এই ছন্দকে তানপ্রধান ছন্দ
নামে অভিহিত করেছেন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। এর নানা শাখা প্রশাখা রয়েছে। যেমনঃ
বিভিন্ন পয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী, অমিত্রাক্ষর, মুক্তক, গৈরিশ ছন্দ, সনেট প্রভৃতি।
দৃষ্টান্তঃ-
(১)পাখী নহু তার ঠাঁই
মেদিনী বিদার দেও | পঁসিয়া লুকাউ """
—বড় চণ্ডীদাস (শ্রী কৃষ্ণকীর্তন)
(২)চঞ্চল চপল ভেল | বাউর যুবতি।
খেনে কান্দে খেনে হাসে | বিপরীত গতি ॥
বসন ভূষণ বুঝি | মুকুল কুত্তল।
দুঃখিত হৃদ এ তান | নআন চঞ্চল ৷৷
—শাহ মুহম্মদ সগীর (ইউসুফ জোলেখা)
"
(৩)"আমাদের ছোট নদী, চলে বাকে বাকে
বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি
দুই ধার উঁচু তার,,ঢালু তার পাড়ি।।"""""
(৪)আমাদের ছোট গায়ে । ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে | নাহিছে-পর।
পাড়ার সকল ছেলে। মোরা ভাই ভাই,
একসাথে খেলি আর। পাঠশালে যাই)।
(২)মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ-
যে ছন্দে বদ্ধাক্ষর (Closed Syllable) সর্বত্রই দুইমাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয় তাকে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বলে। মাত্রাবৃত্তে বদ্ধাক্ষর সর্বদাই বিশ্লিষ্ট ভঙ্গিতে (টেনে) উচ্চারিত হয়। পয়ারের অক্ষরধ্বনির অতিরিক্ত একটি সুরের টান বা তান থাকে। অর্থাৎ অক্ষুরধ্বনিকে আচ্ছন্ন করে টান বা তানের একটা প্রবাহ সমগ্র চরণের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। পয়ারের এই তান প্রবাহ মাত্রাবৃত্তে থাকে না। অক্ষরবৃত্তে (অর্থাৎ তানপ্রধান ছন্দে) থাকে তানের প্রাধান্য আর মাত্রাবৃত্তে ধ্বনির প্রাধান্য মাত্রাবৃত্ত ছন্দে অক্ষরধ্বনি বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে বলে একে ধ্বনিপ্রধান ছন্দও বলা হয়।
প্রবোধচন্দ্র সেন সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ছন্দ শাস্ত্র থেকে ‘মাত্রাবৃত্ত' নামটি গ্রহণ করেছিলেন । বাংলা ছন্দ আলোচনায় তিনি নামটি চালু করেন ১৩২৯ সালে (ইং ১৯২২)। অবশ্য তাঁর পূর্বে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন 'তীর্থরেণু' কাব্যে ‘সঙ্গীত মিস্ত্রির নিবেদন'-শীর্ষক কবিতার পরিচয় সূত্রে ১৩১৭ সালে। তবে প্রবোধ বাবুর ব্যবহারের পর থেকে ‘মাত্রাবৃত্ত' নামটি সুপ্রচলিত হয়েছে।মাত্রাবৃত্ত ছন্দের লয় বা গতি বিলম্বিত। বিলম্বিত লয়ে উচ্চারণ করা এই ছন্দের প্রকৃতি। স্বরবৃত্তে বদ্ধাক্ষরকে (Closed Syllable) একমাত্রা হিসেবে গণনা করা হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ দ্রুত লয়ের বিরোধী। এর ছন্দদোলা অপেক্ষাকৃত ধীর। তাই এতে বন্ধাক্ষর বা যুগ্মধ্বনিকে দুই মাত্রার ধরা হয়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রতি পংক্তির পর্বসংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। পংক্তিগুলো দুই তিন বা চার পর্বে বিভক্ত হয়। আবার একপর্ববিশিষ্ট পংক্তিও হতে পারে। প্রতি পর্বের মাত্রাসংখ্যা চার, পাঁচ, ছয়, সাত এবং আট পাওয়া যায়। পংক্তির শেষে প্রায়ই অপূর্ণ পর্ব থাকে। শেষের পর্বটি অপূর্ণ থাকায় ছন্দ-সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। অবশ্য পংক্তির শেষে পূর্ণ পর্বও পাওয়া যায়।
***মাত্রাবৃত্ত ছন্দ মুলত ৪,৫,৬,৭,৮ মাত্রার
হয়ে থাকে**।
যেমনঃ-
**অবহেলি | জলধির। ভৈরব। গর্জন
প্রলয়ের।ডঙ্কার।ওঙ্কার। তর্জন।
-নজরুল ইসলাম
মাত্রাবিন্যাস: ৪+৪+8+8
ছয় মাত্রার পর্ব :
১) শুধু বিঘে দুই। ছিল মোর ভুঁই,।আর সবি গেছে।ঋনে ০০০০।
বাবু বলিলেন।বুঝেছ উপেন?| এ জমি লইব |কিনে০০০০।
কহিলাম আমি|“তুমি ভূস্বামী,|ভূমির অন্ত| নাই,০০০০
চেয়ে দেখো মোর |আছে বড়োজোর |মরিবার মতো |ঠাঁই 0000
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (দুই বিঘা জমি–চিত্রা)
মাত্রাবিন্যাস : ৬+৬+৬+২
(৩)স্বরবৃত্ত ছন্দ ঃ-
অক্ষরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্তের ন্যায় স্বরবৃত্ত নামটিও চালু করেন প্রবোধচন্দ্র সেন ১৩২৯ সালে (ইং ১৯২২)। তখন থেকেই নামটি সুপ্রচলিত। পরবর্তীকালে যদিও তিনি এর নামকরণ করেছিলেন 'দলমাত্রিক' বা 'দলবৃত্ত' তবু স্বরবৃত্ত নামটিই সুপরিচিত।
স্বরবৃত্ত ছন্দে বন্ধাক্ষর (Closed Syllable) সর্বদাই (সংশ্লিষ্ট ভঙ্গিতে) এক মাত্রার ধরা হয়। এই ছন্দে প্রতি পর্বের প্রথমে একটি শ্বাসাঘাত বা প্রস্বর বা স্বরাঘাত (Accent) পড়ে বলে একে স্বাসাঘাত প্রধান বা স্বরাঘাত প্রধান ছন্দ নামেও অভিহিত করা হয়। স্বরবৃত্ত ছন্দ বাংলা কবিতার ঘরোয়া ছন্দ-ছড়ার ছন্দে এর মূল নিহিত। এই ছন্দে গ্রাম্য ছড়া বা অধিকাংশ লৌকিক কাব্যসাহিত্য রচিত হয়েছে বলে একে ছড়ার ছন্দ বা লৌকিক ছন্দও বলা হয়।
স্বরবৃত্ত ছন্দে সাধারণত প্রতি চরণে বা পংক্তিতে চারটি পর্ব থাকে এবং প্রত্যেক পূর্ণ পর্বের মাত্রাসংখ্যা চার। শেষের পর্বটি প্রায়ই অপূর্ণ হয়।
যেমনঃ-
কে ব কে ছেঁকে মেরে ছে কে দি য়ে ছে গা ল ০০০
তা ই তো খো কা রা গ ক রে ছে ভাত খায় নি কাল ০০|
**তথ্যসংগ্রহঃ-
ছন্দ পরিচিতি(এস. এম. আব্দুল লতিফ)
0 মন্তব্যসমূহ