Hot Posts

6/recent/ticker-posts

হাসান আজিজুল হকের ছোট গল্প আলোচনা

---হাসান আজিজুল হকের ছোট গল্প আলোচনা  হাসান আজিজুল হকের গল্পে দেশভাগ খাঁচা গল্প আলোচনা আত্মজা ও একটি করবী গাছ গল্পআলোচনা আমৃত্যু আজীবন শকুন জীবন ঘষে আগুন ---
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 
***সাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হলো ছোট গল্প। অ্যাডগার এ্যালান পো র মতে"যে গল্প আধ থেকে এক বা দুই ঘন্টা য়,এক নিঃশ্বাসে পরে শেষ করা যায় তাকে ছোট গল্প বে।Brander Matthews এর মতে--short story deals with a single carrecter, single action, single event and single emotion,the Series of emotion called forth to a single emotion ".

বাংলা সাহিত্যের যে সকল ছোট গল্পকার এর নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে হাসান আজিজুল হক(১৯৩৯-২০২১) অন্যতম।তার লেখা গল্প গুলো র মধ্যে শকুন, উটপাখি, আত্মজা ও একটি করবী গাছ,আমৃত্যু আজীবন, খাঁচা,জীবন ঘষে আগুন অন্যতম।

হাসান আজিজুল হকের গল্পের বিষয়বস্তু...

**শকুন গল্পের বিষয়বস্তু --

'শকুন' নামক গল্পটি 'সমকাল' পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে ষাটের দশকের শুরুতে হাসান আজিজুল হকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণা' ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। গল্পগ্রন্থে স্থান পেয়েছে দশটি গল্প। প্রথম গল্পটির নাম 'শকুন'। এ গল্পের মূল বিষয় রাঢ়বঙ্গের একদল গ্রাম্য কিশোরের নানাবিধ কর্মকাণ্ড। গল্পটি গ্রামীণ পটভূমিকায় রচিত। গল্পটির বহুমাত্রিকতায় দেখা যায়, সুদখোর মহাজন অঘোর বোষ্টমের অনবদ্য এক লোলুপ দৃষ্টি। গল্পে শকুনটিকে দেখা যায় সন্ধ্যার সময় পথ হারিয়ে শোষক ও নির্যাতনকারী মহাজনের ভূমিকায়


**মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 


"ছেলেদের কথায় শকুনটাকে দেখে তাদের রাগ লাগে, মনে হয় তাদের খাদা যেন শকুনের খাদ্য, তাদের পোশাক যেন ওর গায়ের গন্ধভরা নোংরা পালকের মত। সুদখোর মহাজনের চেহারার কথা মনে হয় ওকে দেখলেই। নইলে মহাজনকে লোকে শকুন বলে কেন। কেন মনে হয় শকুনটার বদহজম হয়েছে। যে ধূসর রঙটা দেখলেই মন দয়ে যায় তার সঙ্গেই এর রঙের এত মিল থাকবে কেন??। (শকুন)

কিন্তু গল্পটির আবহ, চেহারা ও প্লট কোনোটিই সুদখোর মহাজন অঘোর বোষ্টমের মতো নয়। বহুবিধ মাত্রায় গল্পটি ব্যঞ্জিত হয়েছে। সকালে সবাই শকুনটিকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। আরো দেখা যায়, কাদু শেখের বিধবা বোনের অর্ধফুট অবৈধ সন্তানটি মৃত অবস্থায় শকুনের পাশে পড়ে আছে। শিশুটির মাংসের লোভে শকুনেরা আসতে থাকে এবং ভিড় জমায়। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয়টি হচ্ছে, মৃত শিশুটিকে দেখতে সমস্ত গ্রামবাসী এলেও কাদু শেখের বিধবা বোন আসে না। মনুষ্য চেতনা বিবর্জিত বোধই যে সামগ্রিক ক্ষতির কারণ তা ফুটে উঠেছে গল্পে। হাসান আজিজুল হকের গল্পে মূলত বস্তিত্বের চিরন্তন রূপ বর্তমান। গল্পকার গল্পটিতে বাস্তবতার নির্মমতাকে প্রতীক অর্থে ব্যবহার করেছেন।

গল্পটিতে রাঢ়বঙ্গের মানুষের গ্রামীণ জীবন ও তাদের শোষণ-নিষ্পেষণে বেঁচে থাকার কথা আছে। এসেছে মানুষ ও প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং একে অপরের সম্পর্কের টানাপোড়েন। যেখানে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমাজের শ্রেণি, শোষণ ও তোষণের বিবিধ রূপ চিত্রিত হয়েছে।

**আত্মজা ও একটি করবী গাছ গল্পের বিষয়বস্তু:-

হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'-এর প্রথম গল্প এটি। এ গল্পগ্রন্থটিতে মোট আটটি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পে ফুটে উঠেছে ১৯৪৭ এর দেশবিভক্তির চিত্র। যে চিত্রে ফুটে উঠেছে উদ্বাস্তু জীবনের প্রত্যাশা, হাহাকার, মনুষ্য চেতনার বিপর্যয় ও বেকারত্ব। এমনকি বৃদ্ধ বাবার বোধ বিপর্যয়ের চিত্রও ফুটে উঠেছে কন্যার দেহ বিক্রির টাকায় সংসার চালানোর বাস্তবতায়। গল্পে ইনাম, ফেকু ও সুহাস—এই তিন চরিত্র মূল ভূমিকা পালন করেছে শীতের রাত। নারকেল গাছের মাথায় চাঁদ উঠেছে। কানুর মার কুঁড়েঘরে পৈঠায় শিয়ালের ডাক শোনা যায়। শিয়ালটা মুরগি খেয়ে পালাবার চেষ্টা করে। চাঁদমণির বাড়ির লোকেরা শিয়ালটাকে তাড়া করেন

সরদারদের ছোট ছেলে ইনাম পুলের ওপর দিয়ে হেঁটে শুকনো বিলের কাছে এসে দাঁড়ায়, যেখানে সুহাস আর ফেকু গল্পে মশগুল) তাদের ট্রানজিস্টারে গান চলছে। ইনাম ট্রানজিস্টার বন্ধ করে দেয়। তারা আর দেরি করতে চায় না। দেরি করলে কেশো বুড়ো হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে। তারা উঠে পড়ে।

**সাহিত্যের ইতিহাস জানতে এখানে ক্লিক করুন 

-সুহাস ইনামকে জিজ্ঞেস করে সে স্কুলে যায় কিনা। ইনাম না-সূচক জবাব দেয়। কারণ পড়ে কোনো লাভ নেই, কে তাকে চাকরি দেবে। ইনামের চোখের সামনে স্কুলজীবনের স্মৃতি ছবির মতো ভেসে ওঠে। হেডমাস্টার, তারাপদ মাস্টার, রেল লাইনের ভাঙা টুকরোকে স্কুলের ঘন্টা হিসেবে ব্যবহার—এসব কথা ইনামের মনে পড়তে থাকে। সুহাস ছোট মামার বিয়ের গল্প করেই চলেছে। ইনামের কাছে মুহাসের এই মামার বিয়ের ইতিহাস অসহ্য মনে হয়। সুহাসের মামীর বোনেরা সুন্দরী জানতে পেরে তারা বলে, এ জন্যেই বোধ হয় সুহাস মাসে পাঁচবার ছোট মামার শ্বশুরবাড়ি যায়।

পুল আর বিল পেছনে ফেলে তারা অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে। বড় রাস্তাটা পেরিয়ে তারা গলির ভেতর ঢোকে। সুহাস ফেকুকে জিজ্ঞেস করে সে কীভাবে এত মার সহ্য করে। ফেকু উত্তরে বলে, এ বিদ্যেটাও লেখাপড়া শেখার মতো ওস্তাদের কাছে শিখতে হয়। লেখাপড়ার কথা কানে আসতেই ইনাম বিরক্তিতে গালাগালি দিয়ে ওঠে। টাকা-পয়সার কথা শুনে ইনাম বিমর্থ হয়ে পড়ে। তার কাছে আজ টাকা-পয়সা নেই। অবশ্য সে একবার ভিড়ের ভেতর এক ভদ্রলোকের পকেটে হাত দিয়েছিল; কিন্তু পকেট মারতে পারেনি, তাই সে আজ কপর্দকহীন। ফেকু বলল, একদিন দ্রুতগামী বাসে এক ভদ্রলোকের পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়েছিল। কিন্তু ধরা পড়ে যায়। ভাগাড়ে গরু মরার মতো চারদিক থেকে পিটুনি শুরু হয়ে গেল। ফেকু পকেট মারার কৌশল, নিজস্ব স্টাইল ও অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বর্ণনা তাদের কাছে দিল। তার তো আর কিছুই করার নেই। লেখাপড়া শিখল না, জমিজমা, ব্যবসার পুঁজি নেই। তাই এ পথ ছাড়া আর বিকল্প তার সামনে খোলা নেই। কিন্তু তারএই পরিণতির জন্য কে দায়ী? এটাই ফেকুর জিজ্ঞাসা। পালদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের নার্কে পোড়া মাটির গুঞ্জ আসে। সুহাস ফেশো বুড়োটার কথা ভাবতে থাকে। ওর মনে হয় বুড়োটা বোধ হয় এখনই মারা যাবে। আবার মনে হয় সে সবাইকে খুন করে ফেলবে।বুড়োর পয়সার লোভের কথা নিয়ে ওরা হাসাহাসি করে। ইনাম, ফেকু ও সুহাদের কাছে টাকা ধার চেয়ে ব্যর্থ হয়। তারা ওকে খালি হাতে মজা লুটতে এসেছে বলে ব্যঙ্গ করে। অবশেষে তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায়। বুড়োটা তাদের সাড়া পেয়ে এখানে কে' বলে করে ওঠে। দরজা খুলে করবী গাছের কাছে দাঁড়িয়ে পরিচিত তিনজনকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়। বুড়ো সবাইকে নিয়ে ঘরে যায়। ওদের তিনজনকে চৌকিতে বসিয়ে নিজে ভাঙা চেয়ারটায় বসে হাঁফাতে থাকে। বুড়োর অ্যাজমার কষ্টটা বোধ হয় আজ বেড়েছে। সে তাদের বলে যে, তারা না থাকলে তাকে এই জঙ্গলে পড়ে মরতে হতো। বুড়ো তাদের জানায় তার মেয়ে রুকু চা তৈরি করছে। কিন্তু তারা কেউই চা খাবে না বলে জানায়। সুহাসের চাদরের ভেতর থেকে নোটের কড়মড় শব্দ হয়। কিন্তু সুহাসের টাকার সাথে নিজের পকেট থেকে আরো দু টাকা নিয়ে বুড়ো হাতে গুঁজে দিয়ে বলে সে আর সুহান নিল। বুড়োর শরীর কেঁপে ওঠে। সে জানায় আর কতকাল সে ওদের গলগ্রহ হবে। এ ঋণের বোঝা কি কোনোদিন তার পক্ষে শোধ করা সম্ভব হবে। বুড়ো ভেতর থেকে ঘুরে এসে ওদের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, তারা যেন ওই বাঁশের ঘরে গিয়ে রুকুর সাথে কথা বলে আসে।বুড়ো আর ইনাম বসে গল্প করতে থাকে। বুড়ো প্রথমে কীভাবে এখানে এসেছিল সেই গল্প করতে থাকে। কিন্তু হাঁফানিটা বেড়ে যাওয়ায় কথা বলতে কষ্ট হয়। বুড়ো বলে, এখানে এসেই সে একটি করবী ফুলের গাছ লাগায়, তবে ফুলের জন্য নয়, বীজের জন্য। কারণ এই বীজ থেকে ভালো বিষ তৈরি হয়। তাদের কথোপকণ্ঠনের মাঝে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে চুড়ির শব্দ, এলোমেলো শাড়ির শব্দ আর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। বুড়ো অন্যমনস্ক হয়েপড়ে। গল্পটা শেষ করতে পারে না বুড়ো। অর্থাৎ সমস্ত গল্পজুড়ে যে বিষণ্ণতা, যে আর্তনাদ, সে ভাঙন আমরা পরিলক্ষিত হতে দেখেছি, তার প্রেক্ষাপ্টই মূলত দেশভাগ। ফলে মর্মমূলের চিত্র গড়ে স্থান পেয়েছে গল্পকারের অসাধারণ নৈপুণ্যে। গল্পের অঙ্গ প্রত্নীকী ব্যঞ্জনায় মোড়ানো, যা গল্পকারের আঙ্গিকতাকে ঋন্ধ ও সমৃদ্ধ করেছে।

**আমৃত্যু আজীবন গল্পের বিষয়বস্তু:--

হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গ্রন্থ 'আত্মা ও একটি করবী গাছ’-এর সর্বশেষ গল্প 'ভ্রামৃত্যু আজীবনা। গল্পটির মূলে আছে করমালি ও তাঁর পরিবার। গল্পে উপস্থাপিত হয়েছে মহাকাব্যিক এক বায়না। যে ব্যল্পনায় স্থান পেয়েছে মানুষের জীবনের নিয়তি, সংগ্রামী মনোভাব ও বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা। মূলত গল্পের প্রেক্ষাপটটি নির্মিত হয়েছে এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক কৃষক পরিবারের বাঁচার সংগ্রাম। যাতে স্থান পেয়েছে নিম্নবিত্তের পরাজয়। যে নিম্নবিত্তের কথা এসেছে গল্পে, তার মর্মমূলে আছে করমালি ও তার পরিবার। মূলত এ গল্পে প্রতীকের ব্যবহার করা হয়েছে। অবলম্বিত চরিত্রের রূপ ফুটে উঠেছে গল্পে। গল্পটি বর্ণনাপ্রধান।

**ভাষা আন্দোলন এর গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

করমালির চাষ করার জন্য জমির পরিমাণ কম থাকার ফলে বর্গা নিয়ে জমি চাষ ও দিনমজুরের কাজ করে। কামালির সংসারে আছে বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও পুত্র রহমালি। জীবনের বিচিত্র পথে করমালি যুদ্ধ-সংগ্রামে লড়াই করে টিকে থাকা এক পুরুষ। অতিরিক্ত আয়-রোজগারের প্রয়োজনে করমালি বাড়ির পাশের পতিত জমিটিকে আবাদি করার জন্য কাজ করতো। কোদাল চালাতে গিয়ে হঠাৎই এক বৃষ্টির দিনে বিশাল দেহের এক গোখরো সাপ দেখতে পায়। কল্পনা ও বাস্তবের স্বপ্নে করমালি জীবনকে হার-না-মানা পথে এগিয়ে নিয়ে চলতে চাইতো। সে বুঝেছিল গোখরো সাপটির কারণে আর এ জমিতে চাষ করা যাবে না, তারপরও স্বভাবসিদ্ধ আচরণ করমালির হার-না-মানা। বরং করমালি গোখরোটিকে মেরে ফেলতে চায়, উল্টো বিপদ ঘটে করমালির। চাষের জন্য দুটি গরুর মধ্যে একটি গোষরোর কামড়ে মারা যায়। করমালি ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে এ অবস্থায়। এর ফলে জমির মালিক যাতে জমি ফিরিয়ে না নিতে পারে, সে জন্য সে ভাবে পতিত জমিটিকে বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করে গরু কিনে আনবে এবং চাষে মনোযোগ দেবে। আবার সে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে বজ্রাঘাতে করমালির মৃত্যু হয়। গল্পকারের বর্ণনায় তাই ফুটে উঠেছে

‘"করমালি খড়ের গাদার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা-পাকা চুল দাড়ি ভ্রু চোখের পাপড়ি ইত্যাদি নিশ্চিহ্ন হয়ে কদাকার বিস্তৃত দেখাচ্ছে তাকে। রহমালি বাড়ির বাইরে এসে তাকে বুকে করে বৃদ্ধির মধ্যে সবল পায়ে অশ্রহীন চোখে ভিতরে নিয়ে গিয়ে পরম যত্নে দাওয়ায় শুইয়ে দিয়েছে। বৃষ্টি তখন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল।'" (আমৃত্যু আজীবন)

গল্পটিতে শ্রেণিবন্ধের যে বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে, তাতে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় গোখরো সাপটিকে দেখানো হয়েছে। যার কাছে করমাণি হার-না-মানা কারবারের যুদ্ধ-সংগ্রামে পরাস্ত হয়েছে। গ্রামের সমস্ত লোকের চেষ্টাতেও গোখরোটিকে মেরে ফেলা যায়নি। মারার বারবার চেষ্টাতে গোখরোর এক আঙুল লেজ কাটা সম্ভব হয়েছে মাত্র। করমালির পুত্র রহমালিকে গোখরোটি শেষ করতে না পারলেও সাদেক নামের এক কিশোরকে কামড়ে শেষ করে।দিয়েছে। অর্থাৎ সাদেককে শেষ করার ভেতর দিয়ে প্রতিহিংসার রূপটি ফুটে উঠেছে, যা উচ্চবিত্তের ও সম্পদশালীর আচরণের প্রতিফলিত এক রূপ গল্পকার হাসান আজিজুল হকের বিন্যাসক্রম অত্যন্ত চমৎকার, যেন অন্তর নিঃসৃত ছুটে চলা ভাবাবেগ। অন্যতম প্রধান চরিত্র গোখরোকে ঘিরে করমালিকে সংযুক্ত রেখে ছোট ছোট বাঁক গল্পটিকে অত্যন্ত উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করেছে। করমালি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও তাকে ঘিরে প্রকৃতি, নিসর্গ ও আত্মিক বোধের যে পরিবেশ গল্পে ফুটে উঠেছে তা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবতাকে মনে রেখে সম্মুখীন হওয়ার যে চমৎকারিত্ব করমালিকে ঘিরে দেখানো হয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ, যা গল্পের শিল্পকে দান করেছে সৌন্দর্য।

**খাঁচা গল্পের বিষয়বস্তু:--

গল্পকার হাসান আজিজুল হকের 'জীবন ঘষে আগুন' গল্পগ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প ‘খাঁচা'। গল্পটি আকারে ছোট। দেশবিভাগ পরবর্তী সময়ের মধ্যবিত্ত এক স্বাঙালি পরিবারের কথা এ গল্পে ফুটে উঠেছে। গল্পটির প্রধান চরিত্র অম্বুজাক তার স্ত্রী সরোজিনী, বাবা কালীপ্রসন্ন, পুত্র অরুণ, সূর্য, বরুণ, কমল ও ভ্যাবলা। এদের নিয়েই অম্বুজাক্ষের জীবন। অম্বুজাক্ষের জীবনে ফেলে আসা ক্ষণে সে একজন দক্ষ সেতার বাজক ছিল। জীবন এবং জীবিকার তাগিদে সে শিক্ষকতা ছেড়ে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসায় মনোযোগ দেয়। কিন্তু চিকিৎসা করতে গিয়ে অম্বুজাক্ষ দরিদ্র ও দুস্থদের কথা বিবেচনা করে তার ফির ব্যাপারে নতুন করে কিছু ভাবতে পারে না, তার সংসারে দারিদ্র্য বাড়তে থাকে। এসবের ভেতর দিয়ে বেশ চলতে থাকা ছন্দের পতন ঘটে অম্বুজাক্ষের। দেশবিভাগের ফলে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় দেশত্যাগের অন্তর মোচড়ানো।

ভাবনায় অম্বুজাক্ষ ভাবতে পারে না মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার কথা। পরিবারের সবার চাপে তাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়, কিন্তু গল্পকার তার বেদনার কথা পরিস্ফুট করেছেন গল্পে--

""আমিরাও যাব, আমরাও যাব। বাজে। বুকের মধ্যে। এইসব পরিত্যাগ করে, এইসবের মধ্যে মরে গিয়ে। সঞ্জল আকাশ, ঠাণ্ডা বাড়ি, পুকুরঘাট, শাদা পথ, লতার মিষ্টি গন্ধ, জমির শেষ, পদ্মপিসী—এইসবের মধ্যে মরে গিয়ে আবার বেঁচে ওঠা। নতুন আলোয় চোখ রেখে। সেই নী পর্বতশ্রেণী, উদ্ভিক্ত সমুদ্র চেতনায় দোলে। আমরাও যাব। অম্বুজাক্ষ খুব ভাড়াতাড়ি খেতে থাকে, আচ্ছা, আমাদের এই দেশেরই মতো দেখতে কোথাও গেলে হয় না? যেমন ধরো নদী আছে, গাছপালা একটু বেশি—কোনো ঠাণ্ডা জায়গায়? অম্বুজাক্ষ প্রশ্ন করে। অর্থাৎ একই পাখি দেখব—একই মেঘ আর আকাশ—এইরকম কথা বলে ফেলে সে""। (খাঁচা)

কিন্তু অম্বুজাক্ষের মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি, পুত্র অরুণের তক্ষকের কামড়ে মৃত্যুহয়। অম্বুজাক্ষের মনের সরল মানুষটির মৃত্যু হয়। তার ভেতরে খেলা করেধ্বংসের চিন্তা 'ঠিক এখন আগুন দেবার সময়। অম্বুজাঙ্ক ভাবল, একটিমাত্র দেশলাই কাঠি খরচ করলেই হু হু আগুন জ্বলবে, আগুন এগিয়ে যাবে ছাত্রে, বরগায়, শূন্য ধানের গোলায়, সরোজিনীর শুকনো হাড়ে। লাগিয়ে দিলে হয়, অম্বুজাক্ষ আবার ভাবল, তারপর সরোজিনীকে জড়িয়ে ধরি, বুকে টেনে আনি— তারপর আমি, সরোজিনী, বাবা, সূর্য, বরুণ, কমল, ভ্যাবলা সবাই দাঁড়িয়ে থাকি, সর্বনাশ দেখি—শেষে ধ্বংস হয়ে যাই। কি বিশ্রী কথা, অম্বুজাক্ষ ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিল না সম্ভবত, চোখ ঘষল বারে বারে, তখন দেখতে পেল অশথ গাছটা কত বড় হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠা করা গাছের মতো বিশাল, সবুজ-উত্তর দিকের দেয়ালটায় তলা পর্যন্ত ফাটল ধরেছে। চেয়ে থাকতে থাকতে রোদ আরো তীব্র হয়ে উঠল আর যেন চোখের ওপরেই চড়াৎ শব্দ করে দেয়ালটা চৌচির হয়ে গেল।' (খাঁচা)

এ কথায় বলা যায়—*গল্পটি যেন একটি পরিবারের হতাশা, দুঃখ, দুর্দশা, বেদনা ও হাহাকারের চরম বিপর্যয়ের কথামালা। এই বিপর্যয়ের ফলে সে তার শখের সেতার ও হ্যারিকেন ভেঙে ফেলেছে। *

**জীবন ঘষে আগুন গল্পের বিষয়বস্তু:-

সত্তর দশকে প্রকাশিত 'জীবন ঘষে আগুন' গ্রন্থের সর্বশেষ এবং নামগল্পটিহচ্ছে ‘জীবন ঘষে আগুন। গল্পটিতে সামন্ততন্ত্রের পতন পরিলক্ষিত হয়েছে।এ গল্পের পটভূমি গড়ে উঠেছে রাঢ়বঙ্গকে ঘিরে। যেখানে ফুটে উঠেছে মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবন। গল্পে রাঢ়বঙ্গে বঞ্চিত সমস্ত মানুষের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত হওয়ার এক সফল প্রয়াস ফুটে উঠেছে। হলকর্ষণের মেলাকে ঘিরে রাঢ় অঞ্চলের সমস্ত শ্রেণির মানুষ বৈশাখের শেষ দিন ও জ্যৈষ্ঠের প্রথম দিন একত্রিত হয়। এই দুই দিনই মেলাটি চলে। মেলাতে দোকানপাট ও নাগরদোলা যেমন থাকে, তেমনি থাকে ব্যান্ডপার্টি, সার্কাসের দল ও রাজার হাতি। মেলার মূল আকর্ষণ হচ্ছে দুটি ষাঁড় ও যূপকাষ্ঠকে ঘিরে দর্শকের ভিড। এছাড়া মহাপুণ্যভূমিতে নরবলিদান ও বাবুশ্রেণির প্রতি বাগদি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ ও প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়। মূলত নিম্নবর্গের মানুষের বিক্ষোভের বিবিধ প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়।গল্পটিতে একক কোনো চরিত্র নেই। চারপাশের পরিবেশ, জীবন ও মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস ফুটে উঠেছে, যা গল্পকারের বৈশিষ্ট্যের নতুন এক সংযোজন। মূলত নিম্নবিত্তের চেতনার উৎসারণ ঘটেছে। যা গল্পে উপস্থাপিত হয়েছে


"**চারিপাশের জনপদসমূহ হতে দুর্ভের সংস্কারের টানে বা কিছু অর্থসংগ্রহের চেষ্টায় অথবা অভ্যাসে বা শূন্যোদনের প্রতিপক্ষ হিসেবে উৎকট উত্তেজনার খোঁজে যারা আসতে শুরু করেছিল মাঠ এবং বনবাদাড় ঢেঙে তারা হয়তো ভেবেছিল আমরা এই মেলায় যাই। অভি পৰিত্ৰ পীঠস্থান গ্রন্থটি, আমরা মায়ের সন্তান যদিও অন্নপূর্ণার ছেলে আমরা, আমাদের ধান উঠল অন্নপূর্ণার বেজন্যা বাপের বাড়িতে, বিটি সেখানে দাসীবিত্তি করে। **(জীবন ঘষে আগুন,)

গল্পটি যেহেতু একক কোনো চরিত্রের বিস্তার নেই, ফলে খণ্ড খণ্ড করেএকেকটি চরিত্র আপন বৈশিষ্ট্যে উপস্থাপিত হয়েছে। ঘণ্টাবাবু চরিত্রের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত ও সমাজের বাবুলের চেহারা বা রূপের প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। তারা বাগদিদের নানাভাবে নির্যাতন ও যৌনসম্ভোগে রাজি করায় এবং বাগনিদের হাতে ঘণ্টাবাবুর মৃত্যু হয়। শ্রেণিবৈষম্যের বিষয়টি এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রকাশই ঘটেছে এ ধরনের চরিত্রে। বিষয়টি এমন যে, সামাজিকভাবে বাগদাদের কোনো সম্মান ও স্থান দেয়া হয় না কিন্তু কামচরিতার্থতার প্রয়োজনে সেইবাগদিদের কাছেই ঘণ্টাবাবুরা যায়। কথোপকথনে যার প্রকাশ দেখা যায়--

**আমরা দ্যাখো শুয়োর বাই-কি বলো, শুয়োর খেয়ে থাকি মোরা, তা বাসে ধরো গিয়ে আমরা যোমের অরুটি নিচু জাত, নিচু কাজকম্মো করি,জাত বেবসা ছেড়েছি গ, আর মোরা জেলে লই, চাষ বাস ধরেছি এ্যাকন। ই সবই তো ছোট কাজ, লয়? এ্যাকন মোদের পেটে ভাতও নাই, পরনে কাপড়ও নাই। ছোট জাতের সবেতেই দোষ। তবে একটোতে বোধায় দোষ নাই -কি বলো বাবু?? 

কিসে দোষ নাই? 

ছোট জাতের মিয়েতে দোষ নাই। 

ঠিক কতা নয়, বাবু??। মিয়েগুনো খায় না দায় না, তবু তাদের গতর হয় ধাড়ি শুয়োরের মতো, লয়? ভারি মজার কতা বটে!** (জীবন ঘষে আগুন)

 এর ফলে গ্রামবাসীসহ কালী, মনোহর, ভামিনী, অভিরাম—এদের মধ্যে বাবুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চিত্র সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। এবং প্রতিবাদে সবাই সোচ্চার হয়েছে। এর ফলে বাবুরা বাগদীপাড়ায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে বাগদীরা সমবেত প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে। যেন সকলের এক সূত্রে জীবন গাঁথা, যা মানবীয় চেতনা। সত্যের পথে যেন বাগদীদের উচ্চকিত এক কন্ঠস্বর।

**তথ্য সংগ্রহ --

হাসান আজিজুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প বিষয় ও প্রকরণ সরিফা সালোয়া ডিনা, জুন ২০১০, বাংলা একাডেমি, ঢাকা-১০০০

 ২. বাংলাদেশের ছোটগল্পের শিল্পরূপ, চঞ্চল কুমার বোস, এপ্রিল ২০০৯, বাংলা একাডেমি, ঢাকা-১০০

৩. হাসান আজিজুল হক সংখ্যা, গল্পকথা, সম্পাদক : চন্দন আনোয়ার, ফেব্রুয়ারি ২০১২, রাজশাহী-৬০০০ ৪. হাসান আজিজুল হকের গল্পে নিম্নবর্গের জীবন, হারুন পাশা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫,ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০ ৫. হাসান আজিজুল হক, গল্পসমগ্র১.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ