--উপন্যাসের পরিচয় দাও ও এর গঠন লিখো উপন্যাসের সংজ্ঞা উপন্যাস কি কি নিয়ে গঠিত উপন্যাসে লেখকের দৃষ্টিকোণ উপন্যাসের প্রকৃতি প্লট কি উপন্যাসের অঙ্গ আদর্শ উপন্যাস এর বৈশিষ্ট্য --
সাহিত্যের একটি অন্যতম বিষয় হলো উপন্যাস। ইংরেজি Novel এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘উপন্যাস।' Novel সম্পর্কে প্রখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক E. M. Forster (1879 -1970) বলেন, Novel is prose narrative of sufficient length to fill one or two volumes." অর্থাৎ পর্যাপ্তব্যাপ্তির এক বা দুইখণ্ডে পূর্ণতার জন্য গদ্য উপাখ্যানই হলো উপন্যাস।'শ্রীশচন্দ্র দাস বলেছেন "গ্রন্থাকারের ব্যক্তিগত জীবন দর্শন ও জীবনানুভূতি কোন বাস্তব কাহিনী। অলখ করিয়া যে বর্ণনাত্মক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয় তাহাকে উপন্যাস কহে।” অর্থাৎ -
"যে বর্ণনাত্মক রচনায় মানুষের বাস্তব জীবনকথা লেখকের জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অভিব্যক্ত হয়, তাকেই উপন্যাস বলে।"
***উপন্যাসের গঠনকৌশলঃ
উপন্যাসের অবয়ব গঠনের দিক থেকে হেনরী উইলিয়াম হাডসন ৬টি অঙ্গের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে
(১) প্লট বা গল্পাংশ
(২) চরিত্র-চিত্রণ
(৩) সংলাপ
(8) পরিবেশ বর্ণনা
(৫) স্টাইন বা লিখন শৈলী
(৬) লেখকের সামগ্রিক দর্শন।
(১) প্লট বা গল্পাংশঃ-
উপন্যাসের বিষয় বা প্লট হচ্ছে এর কাহিনী বা গলাশে। যে
কেনো উপন্যাসেই একটি কাহিনী থাকবে। ঔপন্যাসিকের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে, সুন্দর করে; -সেল করে উপন্যাসের গল্পটিকে বর্ণনা করা। কালভূমিক ভাবে কাহিনীর বিন্যাসই রূপ নেবে। Aristotle (384-322B.C) Poetics গ্রন্থে দুটের আলোচনায় বলেছেন, 'একটি মাত্র কর্মের সমগ্র রূপ অনুকৃত হয় প্লটে। বিভিন্ন অংশের মধ্যে গঠনগত ঠুক এমনভাবে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়, যার ফলে একটি অংশকে তার ভেতর থেকে আনান্তরিত করলে প্লটের সময় গঠনটিই ভেঙ্গে পড়বে।'থাকবে ঐক্য। তিনি প্লটকে সরল (simple) ও জটিল (complex) এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন।
(২) চরিত্র-চিত্রণ :
উপন্যাসের অঙ্গগুলোর মধ্যে চরিত্রের গুরুত্ব সর্বাধিক। কারণ উপন্যাসের কাহিনী গড়ে ওঠে চরিত্রকে আশ্রয় করে।বিভিন্ন চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়েই জীবন্ত হয়ে ওঠে উপন্যাসের চরিত্রসমূহ লেখক আপন বৈশিষ্ট্যে চরিত্রগুলোকে এমনভাবে চিত্রিত করেন যে তাদেরকে মনে হয়। আমাদের ঘরের মানুষ আমাদের সমাজের মানুষ।চরিত্র-চিত্রণের ব্যাপারে লেখকেরা নিজেদের সুবিধা মতো দুটি পদ্ধতি
(ক) বিশ্লেষণ
(খ) নাটকীয় পদ্ধতির
একটিকে গ্রহণ করে থাকেন। বিশ্লেষণ মূলক পদ্ধতিতে লেখক বাইরে থেকে চরিত্রকে চিত্রিত করেন। নাটকীয় পদ্ধতিতে লেখক নির্লিপ্তভাবে চরিত্রকে বিকাশের পথে ছেড়ে দেন।
(৩) সংলাপ : উপন্যাসের ঘটনা প্রাণ পায় চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সংলাপে। প্রথমত লেখক নিজস্ব একটা ভঙ্গিতে সহজ-সাবলীল ভাষা ব্যবহার করেন মূলকাহিনী তুলে ধরতে। তারপরই তিনি চেষ্টা করেন স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী চরিত্রের মুখে ভাষা দিতে।
(৪) পরিবেশ বর্ণনা :
উপন্যাসে একটা পরিবেশ থাকে। পরিবেশ অর্থে শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্যই নয়, স্থান-কালের স্বাভাবিকতা ও ঊচিত্যকেই বোঝানো হয়। কারণ উপন্যাসের কাহিনী বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য। ঔপন্যাসিক বাস্তব প্রয়োজনে গ্রহণ করেন একটি পরিবেশ, পরিবেশের সামাজিকতা ও ব্যক্তি মানুষ। অ্যারিস্টটলও তাঁর The Poetics গ্রদে যে ত্রি-ঐক্যনীতির হয় বলেছিলেন, তার মধ্যে Unity of Place এবং unity of time আধুনিক উপন্যাস সাহিত্যে ‘পরিবেশ' হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
(৫) স্টাইল বা লিখনশৈলী বা ভাষা : স্টাইল বা রচনাশৈলী বা লিখনশৈলীই হলো উপন্যাসের ভাষা—যা এক অর্থে উপন্যাসের অবয়ব সংস্থানের ভিত্তি। লেখকের জীবনদৃষ্টি ও জীবনসৃষ্টির সঙ্গে ভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উপন্যাসের বর্ণনা (Narration). পরিচর্যা (Treatment), শান বা পশ্চাৎপট উপস্থাপন, চরিত্রের রূপ ও স্বরূপ নির্ণয়ে অনিবার্য ভাষারীতির প্রয়োগ যে কোনো ঔপন্যাসিকের কাম্য।
(৬) লেখকের সামগ্রিক দর্শন বা জীবন দর্শন : উপন্যাসে লেখক তাঁর লেখার মাধ্যমে পাঠকের কাছে একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সমাজের ও জীবনের যে ছবি তিনি জীবেন, তার ভেতর দিয়েই প্রকাশ পায় লেখকের অভিজ্ঞতা বা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর ধ্যান-ধারণা, তাঁর জীবনদর্শন) লেখক দু ভাবে এই জীবন দর্শনকে উপন্যাসে প্রকাশ করেন।
এক : চরিত্র, ঘটনা অথবা দ্বন্দ্ব সংঘাতের মাঝে উপস্থাপন করে।
দুই : উপন্যাসের বিভিন্ন স্থানে তাঁর ব্যক্তিগত ভাষার মাধ্যমে।
**উপন্যাসে লেখকের দৃষ্টিকোণ--
উপন্যাসে লেখকের দৃষ্টিকোণ মুলত তিনটি--
(১)লেখক যখন নিরাসক্তভাবে ঘটনা বিবৃত করেন, তখন তাকে বলা হয় লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ (Author's Omniscient Point of View)।
(২) কেন্দ্রীয় বা মুখ্য চরিত্রের দ্বারা যখন ঘটনা বিবৃত হয়, তখন তাকে বলা হয় উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণ (First Person's Point of View)।
(৩)ঘটনার প্রান্তে অবস্থানকারী কোনো চরিত্রের দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হলে তাকে বলা হয় প্রান্তিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ (Peripherid Character Point ofView)।
এ তিন বর্ণনারীতি থেকে লেখককে নির্বাচন করতে হয়, তিনি কোন প্রেক্ষিতে তিনি উপন্যাস রচনা করবেন।
**উপন্যাসের প্রকৃতি সম্পর্কে বলা যায় :
(১)লেখকের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন ও অনুভূতি কোনো কাহিনীকে অবলম্বন করে শিল্পে রূপায়িত হলে তাকে উপন্যাস বলা চলে।
(২)উপন্যাসের কাহিনী বা প্লট হলো এর প্রধান অঙ্গ। এটিকে কার্যকরণসূত্রে আবন্ধ করে এবং সরস করে পাঠকের মনে উপস্থিত করা সার্থক উপন্যাসের অন্যতম কর্তব্য। অসংলগ্ন বা শিথিল আখ্যানভাগ উপন্যাসের পক্ষে মারাত্মক ত্রুটি বিশেষ।
(৩) এই কাহিনী কাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠবে তার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে, তা যেন সু-সংবন্ধ হয়।
(৪) কাহিনীর মূল উদ্দেশ্য হবে চরিত্র সৃষ্টি করা এবং ঐ চরিত্রসমূহের ভেতর দিয়েই লেখকের জীবন-দর্শন বা জীবনানুভূতি প্রকাশিত হবে।
(৫) বাণীভঙ্গির ওপর ঔপন্যাসিকের প্রথর দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ খুব ভালো কাহিনীরও অপমৃত্যু ঘটতে পারে, যদি লেখকের ভাষা ও স্টাইল দুর্বল হয়।
মোটকথা, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস প্লট, চরিত্র-চিত্রণ, সংলাপ, পরিবেশ, রচনাশৈলী ইত্যাদি মিলে একটি সুসংবদ্ধ রূপ-শিল্প মাত্র। তবে এর শ্রেষ্ঠত্ব লেখকের জীবন দর্শনের ওপরই বেশি নির্ভর করে।
***তথ্যসংগ্রহ--
(১)সাহিত্য তত্ত্ব-কথা[সাহিত্যের রূপ, ছন্দ, অলঙ্কার ও রসতত্ত্ব]আবুল ফজল ও রেজাউল ইসলাম।
(২)কুন্তল চট্টোপাধ্যায় -সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ।
0 মন্তব্যসমূহ