Hot Posts

6/recent/ticker-posts

উপন্যাস এর সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

 


---উপন্যাস এর সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ উপন্যাস বলতে কী বোঝ উপন্যাসের প্রকারভেদ সামাজিক উপন্যাস ঐতিহাসিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস রাজনৈতিক উপন্যাস
কাব্যধর্মী উপন্যাস -- 
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 
সাহিত্যের একটি অন্যতম বিষয় হলো উপন্যাস। ইংরেজি Novel এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘উপন্যাস।' Novel সম্পর্কে প্রখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক E. M. Forster (1879 -1970) বলেন, Novel is prose narrative of sufficient length to fill one or two volumes." অর্থাৎ পর্যাপ্তব্যাপ্তির এক বা দুইখণ্ডে পূর্ণতার জন্য গদ্য উপাখ্যানই হলো উপন্যাস।'শ্রীশচন্দ্র দাস বলেছেন  "গ্রন্থাকারের ব্যক্তিগত জীবন দর্শন ও জীবনানুভূতি কোন বাস্তব কাহিনী। অলখ করিয়া যে বর্ণনাত্মক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয় তাহাকে উপন্যাস কহে।” অর্থাৎ -

"যে বর্ণনাত্মক রচনায় মানুষের বাস্তব জীবনকথা লেখকের জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অভিব্যক্ত হয়, তাকেই উপন্যাস বলে।"

উপন্যাসের প্রকারভেদঃ
বাংলায় যাকে আমরা উপন্যাস বলি, ইংরেজিতে তা দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত--

(১)নভেল 
(২)রোমান্স।
উপন্যাস বা Novel-এর চেয়ে রোমান্স শুধু সময়ের বিচারে পূর্ববর্তীই নয়, উপন্যাস বা Novel যেমন অবিমিশ্রভাবেই বাস্তবনির্ভর রোমান্স তেমনটা নয়। সমকালীন সমাজ ও পারিবারিক জীবনের বিশ্বাসযোগ্য চিত্রণ, বাস্তবতার বর্ণনা ও বিশ্লেষণই উপন্যাসের মূল উদ্দেশ্য। রোমান্স অপরিচিত অতীতকে পুনরুদ্ধার করতে চায় অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস আর কবিত্বময় কল্পনার আলোতে। জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতার ঊর্ধ্বে উজ্জ্বল মুহূর্তগুলোকে এক মায়াময় রহস্যে ধরতে চায়। clara Reeve(1729-1807) এর মতে
--  "উপন্যাস হলো সামাজিক রীতিনীতি ও সমকালীন জীবনের একটি ছবি। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও সমুন্নত শব্দ ব্যবহার করে লিখিত রোমাঞ্চ এমন সব ঘটনা বর্ণনা করে যা কখনোই ঘটেনি। বা ঘটবে বলে মনে হয় না।"

**উপন্যাসকে সাধারণভাবে দুটি ভাগ করা যায়।

(1) ঐতিহাসিক উপন্যাস 
 (২) সামাজিক উপন্যাস

 (১)ঐতিহাসিক উপন্যাসঃ ইতিহাসের ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে লেখা উপন্যাসকে বলা ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই শ্রেণির উপন্যাসে ইতিহানের কাহিনী থাকলেও ই এর সাথে এর পার্থক্য হলো, ইতিহাসে কেবল ঘটনার বিবরণ ও মূল্যায়ন থাকে, আর ইতিহাসের ঘটনার সাথে ঔপন্যাসিকের জীবনবোধের প্রকাশ থাকে।Tolstoy (1828-1910) এর War and Peace Eliot এর 'Romola', বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ', রবীন্দ্রনাথের 'রাজর্ষি' 
ঐতিহাসিক উপন্যাসের দৃষ্টান্ত। 

(২) সামাজিক উপন্যাস: সমাজ জীবনের নানা বিষয়বস্তু নিয়ে যে উপন্যাস রচিত হয় তাকে সামাজিক উপন্যাস বলে। মানুষ সামাজিক জীবআর সে কারণেই সমাজ জীবনের সাথে সম্পর্কিত পরিবার, দেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, প্রভৃতিএ শ্রেণির উপন্যাসে প্রাধান্য পায়।এ জাতীয় উপন্যাসের মধ্যে মেরি স্টো (Merry Stowe 1811-96)-র লেখা 'আঙ্কল টমস কেবিন' (Uncle Tom's Cabin, 1852) কালজয়ী উপন্যাস হয়ে আছে। এ ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্রের 'কৃষ্ণকান্তের উইল’, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরতলি', শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ', নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা', সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।
সামাজিক উপন্যাসকে আবার আরও কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা--
(ক) কাব্যধর্মী উপন্যাস : আখ্যানভাগ বা চরিত্র সৃষ্টির নৈপুণ্য অপেক্ষা লেখকের দৃষ্টি যে উপন্যাসের জীবন দর্শনকে স্নিগ্ধ-মধুর করে তোলে, তাকে কাব্যধর্মী উপন্যাস বলে।ভার্জিনিয়া উল্ফের (Virginia Woolf 1882 (1911) 'The Waves', রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা', বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রভাত ও সন্ধ্যা' এ জাতীয় উপন্যাসের নিদর্শন।
(খ) মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস: যে উপন্যাসে পাত্র-পাত্রীদের মনোবিশ্লেষণ লেখকের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে সে ধরনের উপন্যাসকে মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস বলে। এ জাতীয় উপন্যাসে লেখক 'প্লট' বা আখ্যানভাগের চাইতে অনেক বেশি নজর দেন চরিত্রের মন, মনন, মেজাজ ও মানসিকতাকে।যেমন--বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল', রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে', 'চোখের বালি', শরতন্ত্রের শ্রীকান্ত' ইত্যাদি।
(গ) গোয়েন্দা বা ডিটেকটিভ উপন্যাস : বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করে এ ধরনের উপন্যাস লেখা হয়। এ শ্রেণির উপন্যাসের কাহিনী সাধারণত খুব জটিল এবং লোমহর্ষক হয়। অর্থাৎ খুন, আত্মহত্যা, জখন, তল্লাসী বা গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এ ধরনের উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়।স্যার আর্থার কোনান ডয়েল (Sir Arthur Conan Doyle 1859. 1930)-এর 'শার্লক হোমস্' (Sherlock Holmes)।বাংলা সাহিত্যে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের 'দারোগার দপ্তর’, বনফুলের ‘পঞ্চপর্ব' শরৎচন্দ্র সরকারের 'গোয়েন্দা কাহিনী' এ শ্রেণির উপন্যাস। এছাড়াও শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়, নীহার রঞ্জন সেনগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়, কাজী আনোয়ার হোসেন, রোমেনা আফাজ এ শ্রেণির উপন্যাসের জনপ্রিয় লেখক।

(ঘ) পত্রোপন্যাস : পত্রোপন্যাস বা Epistolary Novel-কে বিশেষ ধরনের উপন্যাস না বলে বিশেষ উপস্থাপন-রীতির উপন্যাস বলাই ভাল। পত্রাকারে যখন উপন্যাসের নানা ঘটনা ও তথ্য পরিবেশিত হয়, উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র যখন পত্রলিখনের ভেতর দিয়ে উপস্থাপিত হয় এবং আখ্যানভাগের বিস্তার ঘটে চরিত্রাবণীর লিখিত পত্রের মাধ্যমে, তখন সে উপন্যাসকে বলা হয় পত্রোপন্যাস।
নটেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বসন্তকুমারের পত্র'। এরপর কাজী নজরুল ইসলামের 'বাঁধনহারা', শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'ক্রৌঞ্চমিথুন’, বনফুলের ‘কষ্টিপাথর', নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য পত্রোপন্যাস।
(ঙ) আত্ম জীবনীমূলক উপন্যাস : যে উপন্যাসে ঔপন্যাসিক নিজেই তাঁর উপন্যাসের চরিত্র হয়ে নিজের কথা ব্যক্ত করেন এবং আখ্যানভাগ পরিচালনা করেন এমন উপন্যাসকে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বলে।
ডিকেন্সের ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ (David Copperfield), সে অ্যান্ড লাভার্স' (Sons and Lovers) বাংলায় শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী'-এ শ্রেণির রচনা। 
(চ) গথিক উপন্যাস/লোমহর্ষক উপন্যাস: সাধারণভাবে 'গথিক’ বলতে আমরা এক ধরনের স্থাপত্যকেই বুঝি। 'গথ' ছিল জার্মানির একটি বিশেষ উপজাতি বর্বরতার সাথে যাদের ছিল ঘনিষ্ঠ সংযোগ।হোরেস (Horace Walpole 1717-1797)। তিনি তাঁর উপন্যাসের নাম নিয়েছিলেন 'Castle of Otranto, A Gothic Story:। প্রখনাথ বিশীর ‘লালকেল্লা', আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কাল তুমি আলেয়া'-র নাম উল্লেখযোগ্য।
(ছ) বীরত্বব্যঞ্জক উপন্যাস: বীরত্ব ব্যঞ্জক কাহিনী অবলম্বন করে এ শ্রেণির উপন্যাস লেখা হয়। মধ্যযুগের রোমান্সগুলোতে অভিজাত বংশীয় বীরদের শৌর্যবীর্যের কীর্তি-কাহিনী বর্ণিত হতো। রোমান্সের কন্নরাজ্যে অবিশ্বাস্য নানা কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে চিত্রিত এসব বীরগাথার শিল্প-সম্মত কাহিনীই বীরত্বব্যঞ্জক উপন্যাস। শশধর দত্ত-র 'দস্যুমোহন' সিরিজ, খগেন্দ্রনাথ দে ‘রঘুডাকাত’, রোমেনা আফাজ-এর ‘দস্যু বনহুর' সিরিজের নাম এ ক্ষেত্রে উল্লেখ কর যায়। হিসেবে কোনো বি নিয়ন্ত্রিত

(জ) ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস : সামাজিক মানুষের নানা অসঙ্গতিকে তীব্র ব্যঙ্গ ও হাস্যরসের মাধ্যমে যে উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয় তাকে ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস বলে।  যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু, প্রমথ চৌধুরী, রাজশেখর বসু, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী এ ধরনের রচনায় বিশেষ সাফল্য দেখিয়েছেন।

(ঝ) আঞ্চলিক উপন্যাস : বিশেষ কোনো অঞ্চল এবং সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বা জীবনচিত্র ও চরিত্রদের মুখে সে অঞ্চলের ভাষা প্রয়োগ করে যে উপন্যাস রচিত হয় তাকে আঞ্চলিক উপন্যাস বলে।
তারাশঙ্কর ব্যাপাধ্যায়ের 'ধাত্রীদেবতা' ও 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি', অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম', সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর স্বানু' এ শ্রেণির উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের নাম।
(ঞ) রাজনৈতিক উপন্যাস: রাজনৈতিক ঘটনার উপর লেখা উপন্যাসগুলোকে রাজনৈতিক উপন্যাস বলা হয়। বমিচন্দ্রের 'আনন্দমঠ', রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’, শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী, বনফুলের স্থগ্নি', দীপক চৌধুরীর 'পাতালে এক ঋতু'-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।"
(ট) চেতনাপ্রবাহমূলক উপন্যাসঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার ঠিক পরবর্তী একদিকে মনস্তত্ত্ব ও মনঃসমীক্ষণ বিষয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভাব-ভাবনা ও অন্যদিয়ে 'আধুনিক' (Modernist) শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনসমূহের বাতাবরণে এক নতু ধরনের উপন্যাসের উদ্ভব ঘটে যা চেতনা প্রবাহমূলক উপন্যাস নামে পরিচিত। । বঙ্কিমচন্দ্রের  'বিষবৃক্ষ' ও 'কৃষ্ণকান্তের উইল' অন্যতম।

(ঠ) বিজ্ঞান নির্ভর উপন্যাস: বিজ্ঞানের কোনো সত্যকে অবলম্বন করে ভবিষ্যতের পৃথিবী সম্পর্কে কল্পনামূলক উপন্যাসকেই বিজ্ঞাননির্ভর উপন্যাস বা কল্প-বিজ্ঞানধর্মী উপন্যাস বলা যায়। ইরেজিতে একে বলা হয় Science Fiction উদ্ভট, খেয়ালি কল্পনা, রহস্য-রোমান্স, এসব উপন্যাসের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শত্রু', মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'নিঃসঙ্গ গ্রহচারী', 'ক্লোমিয়াম অরণ্য' ইত্যাদি এ জাতীয় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
ওপরে উল্লেখিত শ্রেণি ছাড়াও পৌরাণিক উপন্যাস, ভ্রমণ উপন্যাস, রহস্য উপন্যাস, প্রতীকী উপন্যাস  ইত্যাদি নামেও আরো উপন্যাস রয়েছে। 

**তথ্যসংগ্রহ--

(১)সাহিত্য তত্ত্ব-কথা[সাহিত্যের রূপ, ছন্দ, অলঙ্কার ও রসতত্ত্ব]আবুল ফজল ও রেজাউল ইসলাম।

(২)কুন্তল চট্টোপাধ্যায় -সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ