ইংরেজ কবি কোলরিজ 'সনেট’ বলতে বুঝেছিলেন এমন একটি ক্ষুদ্র কবিতা যাতে একটি অখন্ড ও সংহত ভাবকল্পনা বা অনুভূতি আত্মপ্রকাশ করে—
"A small poem, in which some lonely feeling is developed".
মন্ময় কবিতার এই বিশেষ রূপ 'সনেট', যে শব্দটির উদ্ভব ইতালীয় ‘সনেটো’ বা ‘মৃদুধ্বনি' থেকে।সমদৈর্ঘ্যের চোদ্দটি পংক্তিতে ও একটি বিশেষ ছন্দোরীতিতে যখন কবিমনের একটি অন্ত ভারকল্পনা কাব্যরূপ লাভ করে তখন আমরা তাকে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা বলে চিহ্নিত করি। ইতালীয় সনেট, যাকে পেত্রার্কের নামানুসারে ‘পেত্রার্কীয় সনেট’ও বলা হয়ে থাকে, দুটি ভাগ বা পর্বে বিভক্ত ‘অষ্টক’ (Octave) ও 'ঘটক' (Sestet)। 'অষ্টক’ অর্থাৎ প্রথম আট-পংক্তিতে প্রশ্ন কিংবা বিবরণের মাধ্যমে কবিতার মূল ভাববস্তুর আভাস দেওয়া হয়। আর ‘মটক’ পর্বে অর্থাৎ পরবর্তী ছয়-পংক্তিতে সেই প্রশ্ন বা অবতারণার উত্তর বা সমাপ্তি সূচিত থাকে।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের চতুর্দশপদী কবিতাবলীর আলোচনাঃ
চতুর্দশপদীর কবিতাগুলিকে বিভিন্ন ভাবকেন্দ্রের দিক থেকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত।কবির মানস-প্রবণতা ও প্রবৃত্তির, বিশিষ্ট জীবনদৃষ্টি ও আসক্তি এবং বিশেষ বিশেষ রূপকল্পের প্রতি আকৃতির পরিচয় আছে; কিন্তু তৎসত্ত্বেও কতকগুলি কবিতায় কবির হৃদয়াভ্যন্তরের ব্যক্তি-আমি আপনাকে প্রকাশিত করেছে প্রত্যক্ষ স্পষ্টতায় । যেমন—'যশের মন্দির', 'নন্দন কানন', 'সরস্বতী', 'তারা', 'কল্পনা', ‘সুভদ্রা-হরণ’, বিজয়াদশমী', 'কুরুক্ষেত্র', 'নূতন বৎসর', 'যশঃ', 'সাংসারিক জ্ঞান', ‘অর্থ', 'ভূতত্কাল', 'আশা', 'শনি', 'পৃথিবী', 'সমাপ্তে' প্রভৃতি।
অনেকগুলি কবিতায় ভারতবর্ষ তথা বঙ্গদেশের কবিদের প্রতি মধুসূদন তাঁর নমস্কার জানিয়েছেন আর কতগুলি পুরানো কাব্য-কবিতার রসাস্বাদকে ভাষায়-ছন্দে অমর করতে চেয়েছেন। যেমন—'কৃত্তিবাস', 'কাশীরাম', 'জয়দেব', 'কালিদাস', 'ঈশ্বর গুপ্ত’, ‘কমলে কামিনী', 'শ্রীমন্তের টোপর', 'অন্নপূর্ণার ঝাঁপি', 'ঈশ্বরী পাটনী', 'মেঘদূত', 'শকুন্তলা'। এবং রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের অনেক চরিত্র-চিত্র, কাহিনীর অংশ ও দৃশ্যের বর্ণনা;———'সীতাদেবী', 'সীতা-বনাবাসে', 'বাল্মীকি', 'মহাভারত', 'সুভদ্রা-হরণ”, ‘কিরাত-অর্জুনীয়ম্', 'গদাযুদ্ধ’, ‘গোগৃহ-রণ’, ‘কুরুক্ষেত্র', 'সুভদ্রা', 'উর্বশী', 'দুঃশাসন',
"হিড়িম্বা,' 'পুরুরবা', 'শিশুপাল', 'হরিপর্বতে দ্রৌপদীর মৃত্যু', 'ব্রহ্মবৃত্তান্ত' প্রভৃতি। কতগুলি কবিতায় আপনার দেশ, জাতি ও যুগযুগান্তের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচয় বিস্তৃত করেছেন কবি। যেমন— 'পরিচয়', 'দেবদোল', 'শ্রীপঞ্চমী', 'আশ্বিন মাস', 'বিজয়াদশমী', 'কোজাগর লক্ষ্মীপূজা', 'ভারতভূমি', 'আমরা' প্রভৃতি।
ভাষা-ছন্দ, কাব্যরূপ ও রস সম্পর্কে কয়েকটি কবিতাও এই গ্রন্থে সঙ্কলিত; — 'বঙ্গভাষা', 'সংস্কৃত', 'ভাষা', 'মিত্রাক্ষর', 'কবি', 'কবিতা', 'করুণারস', 'বীরবস'
‘শৃগাররস', 'বৌদরস' প্রভৃতি। বিদেশি কবি-পণ্ডিতের প্রতি কবি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন ‘পেত্রাকা', 'দান্তে'
,‘গোল্ডস্টুকার', 'টেনিসন', 'হুগো' প্রভৃতি কবিতায়। সামান্য কয়েকটি সনেটে কবি ব্যক্তি-প্রেমের বিষয়ে প্রবেশ করেছেন—'কে না জানে কবিকূল', 'নহি আমি চারুনেত্রা', প্রফুল্ল কমলে যথা’, ‘মেঘদূত' প্রভৃতি।
অপর কয়েকটি সনেটে নীতি ও ধর্মতত্ত্ব আলোচিত। যেমন— 'মধুকর', 'সূর্য',‘সৃষ্টিকর্তা', 'বটবৃক্ষ', 'কুসুমে কীট’, ‘ভারসলেস্ নগরে রাজপুরী ও উদ্যান’, ‘শ্মশান', 'দ্বেষ' প্রভৃতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চিত্র ও ভাবাসগ বহন করেছে অনেকগুলি কবিতা’, ‘বউ কথা কও', 'সায়ংকাল', 'সায়ংকালে তারা', 'নিশা', 'নিশাকালে নদীতীরে বটবৃক্ষতলে শিবমন্দির', 'ছায়াপথ', 'কপোতাক্ষ নদ', 'বসন্তে একটি পাখীর প্রতি', 'নদীতীরে প্রাচীন স্বাদশ শিবমন্দির’, ‘শ্যামাপক্ষী', 'তারা' প্রভৃতি। এদের নানাস্তর কবিমনের নানা প্রবণতা ও দিগন্তের সংবাদ বহন করে।
মধুসূদন পৃথিবীর কবি।বর্নে গন্ধে,সংগীতে,সৌন্দর্য্যে এবং আনন্দে এ পৃথিবীর অণু পরমাণুও যেন স্বর্ণময়। আকুল আগ্রহে দুটি বাহু বাড়িয়ে দেন কবি এই সুন্দরী ধরিত্রীর দিকে—
"নির্মি গোলাকারে তোমা আরোপিলা যবে।
বিশ্ব-মাঝে স্রষ্টা, ধরা। অতি সৃষ্ট মনে
চারিদিকে তারাচয় সুমধুর রবে
(বাজায়ে সুবর্ণ বীণা) গাইল গগনে,
কুল-বালা দল যবে বিবাহ-উৎসবে
হলাছলি দেয় মিলি বধূ-দরশনে।
আইলেন আদি প্রভা হেম-ঘনাসনে,
ভাসি ধীরে শূন্যরূপ সুনীল অর্ণবে,
দেখিতে তোমার মুখ। বসন্ত আপনি"
(পৃথিবী)
কবি সাগর-মেখলা, শ্যামল-বসনা, মণি-কুন্তলা এই পৃথিবীকে আলিঙ্গন করেও প্রাণের পক্ষবিস্তার করেন এক অন্তহীন জিজ্ঞাসায়--
"পাপ, পাপ- জাত মৃত্যু, জীবন কাননে,
তব দেশে কীটরূপে কুসমে কি নাশে?"
(শনি)
একদিকে য়ুরোপীয় জীবনবোধ, অন্যদিকে কাব্যসৃষ্টি। একদিকে লক্ষ্মী, অন্যদিকে সরস্বতী। কবিপ্রাণে এ-দ্বন্দ্ব অন্তত একবার দেখা দেবেই, আর মধুসূদনের কবিচিত্তের অর্থই হল এই দ্বন্দ্ব। 'অর্থ' ও 'সাংসারিক জ্ঞান' কবিতায় এ দ্বন্দ্ব আছে এবং তাকে সমন্বিত করবার চেষ্টাও আছে--
ভেবো না জনম তার এ ভবে কুক্ষণে,
কমলিনী-রূপে যার ভাগ্য-সরোবরে
না শোভেন মা কমলা সুবর্ণ কিরণে;—
- কিন্তু যে কল্পনা-রূপ খনির ভিতরেকুড়ায়ে রতন ব্রজ, সাজায় ভূষণে
ভেবো না জনম তার এ ভবে কুক্ষণে,
কমলিনী-রূপে যার ভাগ্য-সরোবরে
স্বভাষা, অঙ্গের শোভা বাড়ায়ে আদরে!
কি লাভ সঞ্চয়ি, কহ, রজত কাঞ্চনে, ধনপ্রিয়??
(অর্থ)
কবির সৃষ্টি-ক্ষমতা আজ অবসিত। "The fit has passed away"। একাধিক অসমাপ্ত কাব্য-নাটক এই অবসানের স্তূপীকৃত ব্যর্থতা বহন করছে—সুভদ্রাহরণ, দ্রৌপদী-স্বয়ম্বর, রিজিয়া, সিংহল- বিজয়, বীরাঙ্গনার খণ্ডিত পত্রগুলি। আর ভগ্নস্তূপের মধ্য থেকে উঠে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস সনেট 'সুভদ্রা-হরণে'র কয়েকটি পংক্তি –
"তোমার হরণ-গীত গাব বঙ্গাসরে
নব তানে, ভেবেছিনু, সুভদ্রা সুন্দরি !
কিন্তু ভাগ্যদোষে, শুভে, আশার লহরী
তথাইল, যথা গ্রীষ্মে জলরাশি সরে ।"
শক্তিহীন প্রতিভার এই কাতরোক্তি অন্তত দুটি সনেটে সার্থক ছন্দ-মূর্তি পেয়েছে— 'নন্দন কানন' এবং 'কল্পনা’য়। নন্দন-কাননে উড়ে যেতে চান কবি, কামনার মোক্ষধামে,—যেখানে চেতনার প্রতিটি ভাল লাগা চয়ন করে অনন্ত যৌবন আর শাশ্বত সৌন্দর্য হিল্লোলিত, যাকে চাওয়া যায়, কিন্তু পাওয়া যায় না কোনোদিনঃ-
"কামের আকাশে বামা চির-পূর্ণ-শশী,—
যথা রম্ভা, তিলোত্তমা, অলকা রূপসী
লও দাসে, হে ভারতি, নন্দন কাননে,
যথা ফোটে পারিজাত; যথায় উর্বশী,
নাচে করতালি দিয়া বীণার হননে;
মোহে মনঃ সুমধুর স্বর বরিষণে
মন্দাকিনী বাহিনীর স্বর্ণভীরে বসি,
মিশায়ে সু-কণ্ঠ-রব বীচির বচনে "।
কবির জীবনের বিজয়া দশমী সমাগত,আর তাই বলেন--
"যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে।
গেলে তুমি দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে।""
(বিজয়া দশমী)
'কমলে কামিনী'র গজ-ভক্ষণ নিয়ে মধুসূদন বলেনঃ
"বসি বামা শতদল-দলে
(নিশীথে চন্দ্রিমা যথা সরসীর জলে
মনোহরা।) বাম করে সাপটি হেলনে
গজেশে, গ্রাসিছে ভারে উগারি সঘনে।
গুঞ্জরিছে অলিপুঞ্জ পরিমলে,
বহিছে দহের বারি মৃদু কলকলে।"
'ঈশ্বরী পাটনী'তে অন্নপূর্ণার সৌন্দর্য সম্পর্কে —
"রূপের খনিতে আর আছে কিরে মণি
এর সম"
কিংবা 'শ্রীমন্তের টোপরে'র ঐশ্বর্য দীপ্তিঃ—
"(ইন্দ্ৰ-ধনুঃ-সম দীপ্ত বিবিধ বরণে)
পড়িল মুকুট, উঠি, অকূল সাগরে,
উজলি চৌদিক শত রতনের করে
দ্রুতগতি!"
কবি ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে মধুসূদনের ধারণা খুব উচ্চ ছিল না। আলোচ্য কবিতার নাম —অন্নপূর্ণার ঝাঁপি 'ঈশ্বর গুপ্ত’ হলেও এটি আসলে ঈশ্বর গুপ্ত সম্বন্ধে নয়। আপন কবি-জীবন ও কীর্তির এক সংশয়ান্বিত ভবিষ্যৎ অন্য এক কবিকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেয়েছে এখানে—আর সেই অন্য কবির নাম ঈশ্বর গুপ্ত। কবি ঈশ্বর গুপ্ত কে নিয়ে মধুসূদন বলেছেন ---
"এই ভাবি মনে—
নাহি কি কেহ তব বান্ধবের দলে,
তব চিতা ভষ্মরাশি কুড়ায়ে যতনে,
স্নেহ-শিল্পে গড়ি মঠ, রাখে তার তলে??
**তথ্যসংগ্রহ--
(মধুসূদনের কবি আত্মা ও কাব্যশিল্প-ক্ষেত্রগুপ্ত)
0 মন্তব্যসমূহ