Hot Posts

6/recent/ticker-posts

ধর্মমঙগল কাব্য /ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী

 

(ধর্মমঙগল কাব্য /ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী 
ধর্মমঙ্গল কাব্য আলোচনা, ধর্মমঙ্গল কাব্যের কবি রাজা হরিশ্চন্দ্র লাউসেনের কাহিনী ধর্মমঙ্গল কাব্যের নারী চরিত্র) 

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 


**বাংলা সাহিত্যেকে প্রধানত তিনটি যুগে বিভক্ত করা হয়েছে।

১.প্রাচীন যুগ 

২.মধ্যযুগ

৩.আধুনিক যুগ 

মধ্যযুগের সে সকল সাহিত্য কর্ম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে মঙ্গল কাব্য অন্যতম।এবং ধর্মমঙ্গল কাব্য একটি মঙ্গলকাব্য।সমস্ত ধর্মমঙ্গল কাব্যে দু'টি কাহিনী দেখা যায়—(১) রাজা হরিশ্চন্দ্রের গল্প

 (২) লাউসেনের গল্প।

 এর মধ্যে লাউসেনের বীরত্বের কাহিনীই অধিকতর প্রাধান্য লাভ করেছে। অন্যান্য দু একখানি ধর্ম"-সাহিত্যে শুধ হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী আছে, লাউসেনের কোন উল্লেখই নেই। কেউ কেউ মনে করেন, ধর্মের কৃপায় হরিশ্চন্দ্রের পূরলাভের কাহিনীটিই অধিকতর প্রাচীন, ঐতরেয় আরণ্যকের বিশ্বামির শূনঃশেষের যে গল্প আছে, ধর্মসাহিত্যের হরিশ্চন্দ্রের গল্প প্রায় সেইরকম। আমাদের মনে হয়, হরিশ্চন্দ্রের গল্পটিই ধর্মমতালের মূল এবং আদিম গল্প। তারপর রাঢ়ের ইতিহাসের ছিটেফোঁটা निरा বীরত্বের গল্প গড়ে উঠেছে। হরিশ্চন্দ্রের কাহিনীতে দেখা লাউসেনের যাচ্ছে, রাজা হরিশ্চন্দ্র (কোন কোন পূথিতে হরিচন্দ্র) তাঁর স্ত্রী মদনা—এ রা নিঃসন্তান বলে লোকে তাঁদের গাল দেয়। মনের দুঃখে স্বামী-স্ত্রীতে ঘুরতে ঘুরতে বল্লুকা নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, ভক্তেরা ধর্মের পূজা করছে। তারাও ধর্মের উপাসনা আরম্ভ করলেন, এবং ধর্মের কাছে পূরলাভের বর পেলেন। অবশ্য কথা রইল, পত্রটি জন্মাবার পর যথাকালে তাকে ধর্মের কাছে বলি দিতে হবে। অপূরক রাজা তাতেই রাজী হলেন। তব, তো সন্তানের মধে দেখতে পাবেন। এদিকে পূত্র জন্মাল, বড় হল। তার নাম রাখা হল লাইচন্দ্র (বা লাইধর)। কালক্রমে রাজা-রাণী প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলেন। তারপর একদিন ধর্মঠাকুর ব্রাহ্মণের বেশে উপস্থিত হয়ে একাদশীর পারণ করবার জন্য রাজপত্র লুইচন্দ্রের মাংস আহারের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাজা-রাণী লাইচন্দ্রকে কেটে ফেলে নির্মম বাহ্মণের জন্য বাঞ্ছন প্রস্তুত করলেন। তখন ধর্ম নিজ মূর্তি ধারণ করে রাজা-রাণীর প্রতিজ্ঞা রক্ষণের অদ্ভূত নিষ্ঠাকে প্রশংসা করলেন এবং লাইচন্দ্রকে ফিরিয়ে দিলেন। বাস্তবিক রাজা-রাণী লাইচন্ডকে কাটেননি, তাঁদের পরীক্ষার জন্য ধর্ম লাইবে নিজের কোলে রেখেছিলেন। লাইচন্দ্র 'মা-মা' বলে রাণীর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অতঃপর রাজা মহাসমারোহে ধর্মের পূজাদির আয়োজন করলেন। ধর্মপূজার এই কাহিনীটি অতি পুরাতন।


ধর্মমগ্রলের দ্বিতীয় কাহিনী অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন কালের সৃষ্টি, কিন্তু দিক দিয়ে সমধিক উল্লেখযোগ্য। বলতে গেলে এই দ্বিতীয় তাহিনীই যথার্থ ধর্মমঙ্গল কাব্য নামে পরিচিত। ধর্মের সেবক বাঁর লাউয়েনের অদ্ভুত বীরত্বের কাহিনীকে কেন্দ্র করে ধর্মমঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। কাহিনীটির সঙ্গে রাতৃভূমির পালযাগের ইতিহাসের ক্ষীণ সম্পর্ক আছে। স্থানীয় গ্রামজনপদ-নদনদীরও উল্লেখ আছে। হরিশ্চন্দ্রের কাহিনীটি পৌরাণিক ঐতিহ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, লাউসেনের কাহিনী ঐতিহাসিক ও লৌকিক আখ্যানকে অবলম্বন করেছে। লাউসেন হচ্ছেন রাজা বর্ণসেন ও রাণী রাষ্ট্রাবতীর একমাত্র পত্রে (কর্ণসেন ছিলেন গৌড়েশ্বরের একজন সামন্ত। ইছাই ঘোষ বলে আর-এক দুর্দান্ত সামন্তের আক্রমণে কর্ণসেনের ছয় ছেলে মারা যায়, তিনি কাতর হয়ে পড়েন। তখন গৌড়েশ্বর তাঁর প্রিয় সামন্তকে পুনরার গৃহবাসী করবার জন্য নিজ অনুঢ়া শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে বদ্ধ কর্ণসেনের বিয়ে দিলেন। রঞ্জার ভাই, গৌড়েশ্বরের শ্যালক-তার নাম মহামদ বা মাদুল্যা। সে এই খবর পেয়ে বৃদ্ধ ভগিনীপতির ওপর থবে চটে গেল, এবং অফিকুড়ো বলে উপহাস করতে লাগল। অভিমানে রঙা ধর্মঠাকুরের কাছে নিসারণ কৃচ্ছতা অবলম্বন করল, লে ভর দিয়ে রক্তাক্ত কলেবরে প্রাণত্যাগে উদ্যত হল। অবশেষে ধর্ম আবির্ভূত হয়ে তাকে পরে বর দিলেন, যথাকালে রঞ্জাবতী সর্বগুণোন্বিত এক পূত্র লাভ করল। তার নাম লাউসেন। মাহদ্যা এ খবর পেয়ে আরও চটে গেল, এবং ভাগিনাকে শিশুকালেই বিনাশ করবার জন্য নানা চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ধর্মের কৃপায় লাউসেন প্রতিবারই রক্ষা পেল। রুমে লাউসেন যুবক হল, অসাধারণ বীরত্বের খ্যাতি অর্জন করে গৌড়েশ্বরের সভায় উপস্থিত হল। পথের মধ্যে ভয়ানক জন্তু-জানোয়ার মেরে সে বীরত্বের খ্যাতি দৃঢ়তর করল, এবং ব্যাপিকা রমণীদের কবল থেকে আত্ম রক্ষা করে নৈতিক চরিতবলেরও পরিচয় দিল। মাহদ্যার কুপরামর্শে গৌড়েশ্বর তাকে নানাবিধ দূরহ দঃসাধ্য কর্মে পাঠালেন ; যে সমস্ত কাজ তিনিও করতে পারেননি, নবযুবক লাউসেন অবলীলাক্রমে তা করল, প্রতিবেশী রাজাদের হারিয়ে তাদের মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল। এইসব ব্যাপারে মাহদ্যা জলে পড়ে মরতে লাগল। লাউসেনের অনুপস্থিতির সংযোগে সে লাউসেনের রাজ্য আক্রমণ করতে গিয়ে ভাগিনা-বধূর বারা ভালোমতো আপ্যায়িত হয়ে বেতাহত কুকুরের মতো পালিয়ে গেল। লাউসেনের কোনরকম ক্ষতি করতে না পেরে মাহদ্যা এক মারাত্মক চাল দিল। বৃদ্ধ গৌড়েশ্বর অনেক সময় দুর্বৃত্ত শ্যালকের কথামতোই চলতেন। মাহদ্যা গৌড়েশ্বরকে বলল, লাউসেন যদি ধর্মের বরে অসাধ্য সাধন করে থাকে, পশ্চিমে সূর্যোদয় দেখাক না। ধর্মের কৃপায় সে অদ্ভুত ব্যাপারও সম্ভব হয়। চারিদিকে লাউসেনের জয়জয়কার পড়ে গেল আর দুষ্কর্মের প্রতিফলকূপ মাহদ্যার কুণ্ঠবাাধি হল। অবশ্য লাউসেনের দয়ায় এবং ধর্মের নিকট লাউসেনের অনুরোধে সে রোগমত্তে হল। ধর্মের মহিমা ঘোষণার পর লাউসেন পরম গৌরবে রাজত্ব করতে লাগল, তার পরে ঝান পূর্ণ হলে সে পর্ব চিরসেনকে রাজ্য দিয়ে স্বর্গে যাতা করল।


উল্লিখিত গাপটিতে কিছু কিছু ঐতিহাসিক সংকেত আছে মনে হয় পালযুগে ধর্ম পালের পরবর্তী কালের ঐতিহাসিক ঘটনার একটু-আধট, প্রভাব এই কাহিনীতে থাকতে পারে। ঢেকুরগড়ের দুর্দান্ত সামন্ত ইছাই ঘোষ হয়তো ইতিহাসের ঢেকরী-বিষয়ের ঈশ্বরী ঘোষ হতে পারেন। কিন্তু এসব বিষয়ে অনেক মতান্তর দেখা দিয়েছে। ধর্মমপালে উল্লিখিত দ" একটি ব্যক্তি বা স্থানের নাম ইতিহাসে পাওয়া গেছে। অবশ্য ইতিহাসের কালের সঙ্গে ধর্মমঙ্গলের কালেরও অন্যান্য ব্যাপারের বিশেষ সম্পত্তি নেই। মনে হয় কল্পনার কাহিনীতে ইতিহাসের ঈষৎ রং ধরেছে মাত্র। এর কতটুকু প্রকৃত ইতিহাস, আর কতটুকু স্থানীয় গল্প কাহিনী তার পরিমাণ নির্দেশ সহজ নয়। কিন্তু এর ঐতিহাসিক দাবি মানি আর নাই মানি, কাবাটিতে যে বাস্তব জীবনচিত্র দৃষ্টিভঙ্গী, হবিগ্রহের জীবত বর্ণনা এবং রাঢ় দেশের পুরাতন যযুগের জীবন-আলেখ্য আছে তা নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের পটভূমিকা আরন্ত কাল্পনিক, সরে পৌরাণিক। ধর্মমঙ্গলের পটভূমিকা বাস্তব, সর অনেকটা ইতিহাসঘোষা। কাব্যটি বাস্তবিক মহাকাব্যের মতো বিপুলকায়। ধর্মপাল কাব্য মঙ্গলকাবাই থেকে গেছে, মহাকাব্যের কোঠায় উঠতে পারেনি। এই শ্রেণীর সাহিত্যে একজনও উপযুক্ত প্রতিভাধর কবি আসেননি বলে এই বিশাল আকারের কারা নানা বিচিত্র বর্ণনা ও চরিত্র পর্ণে হলেও কোন দিক দিয়েই পাঁচালীর স্তর ছাড়িয়ে মহাকাব্যের বিশাল প্রান্তরে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। যাঁরা ধর্মমঙ্গল কাবকে বাংলার “জাতীয় মহাকাব্য” (National Epic) বলতে চান আমরা তাঁদের সঙ্গে একমত নই। কারণ লাউসেনের 'কেরামতের কাহিনী ফ্লুরোপের মধ্যযন্ত্রের ব্যালাডের মতো। তাতে গোটা জাতির আত্মবোধ ফুটে ওঠে না, কাজেই তা 'জাতীয়' নয়। আর তা ছাড়া এর কাবালক্ষণ বহস্থলে অভিবিস্তাবিত, বিরক্তিকর ও পংসিত পৌনা পূনিকতায় শ্রীচষ্ট। সতরাং ধর্মমঙ্গলকে মহাকাব্য বললে মহাকাব্যের জাতি নাশ হবে। ধর্মমঙ্গল কাব্যের যে সকল কবি রয়েছেন তারা হলেন যথাক্রমে --রামাই পন্ডিত, রুপরাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক,সীতারাম দাস প্রভৃতি। 

**তথ্যসংগ্রহ- 

১.বাংলা সাহিত্যের সম্পুর্ন ইতিবৃত্ত (ড.অজসতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)

২.প্রাচীন সাহিত্য,সৌন্দর্য জিজ্ঞাসা ও নব মূল্যায়ন(ক্ষেত্র গুপ্ত)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ