Hot Posts

6/recent/ticker-posts

৫২পরবর্তী বাংলা উপন্যাস /ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক উপন্যাস


(৫২পরবর্তী বাংলা উপন্যাস 

ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক বাংলা  উপন্যাস

vasha andoloner uponnashh

বাংলা উপন্যাস ভাষা আন্দোলন ও বাংলা উপন্যাস ভাষা আন্দোলন) 

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

৫২পরবর্তী বাংলা উপন্যাস /ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক বাংলা  উপন্যাস----


১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার শিল্পীদের মনে-মননে স্নায়ুতে যে প্রগতিশীল চেতনার জন্ম দিয়েছিল, ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবরে প্রবর্তিত আইয়ুব খানের সামরিক শাসনে তা সাময়িকভাবে হয়ে গেল স্তব্ধ। পূর্ববাংলায় নেমে এলো সামরিক শাসনের বর্বর

অত্যাচার। নবজাগ্রত মধ্যবিত্তশ্রেণীর সামনে তখন অবরুদ্ধ সময়ের দুর্লঙ্ঘ্য দেয়াল, ধাতব অস্ত্রধারীর নিষ্ঠুর নিপীড়ন। বন্দি-সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের শিল্পীরা শৃঙ্খলমোচনের পথ-নির্দেশ নয়, বরং হন্যে হয়ে খুঁজলেন এক চিলতে নিরাপদ আশ্রয়।স্বাতন্ত্র্যাভিলাষী পূর্ববাংলার প্রগতিশীল যে সব শিল্পী সময়ের প্রথম পর্বে সত্যসন্ধানী এবংজীবন কেন্দ্রিক, ১৯৫৮ সালের পর তাঁরাই হলেন জীবন-পলাতক, ক্রমবিকাশে শংকিত এবংআত্ম-রোমন্থনে পরিতৃপ্ত। মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষের মতোই এঁরা তখন বেতার, টেলিভিশন,বি. এন. আর., লেখক সংঘ এবং প্রেস-ট্রাষ্টের আচ্ছাদনে পরিণত হলেন ঔপনিবেশিক শাসকের বেতনভুক্ত সেবাদাসে। কেউবা আবার সমাজবাদী জীবনভাবনাকে সরাসরিপ্রকাশ করতে ভীত হলেন, আশ্রয় নিলেন রূপক-প্রতীক ও রূপকথা-পুরাণের জগতে।একাধিক ঔপন্যাসিকের অন্বিষ্টলোকে হাতছানি দিল ফ্রয়েড-এলিস – ফলে আমাদের

ঔপন্যাসিক-চৈতনো এলো লিবিডো তাড়িত, রিরংসাপ্রিয়, পলায়নবাদী এবং বিবরসন্ধানী

অনর্থক জীবনভাবনা। এবং এভাবেই যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় বুর্জোয়া সমাজের পচনশীলতায়

আকণ্ঠ নিমজ্জিত হলো পূর্ববাংলার বেশ কিছু ঔপন্যাসিক। সমকালীন ঔপন্যাসিক চৈতন্যের

এই সংকট-সংশয় ও পরাভব কীভাবে আমাদের কথাসাহিত্যকে গ্রাস করেছিল,

সমালোচকের লেখায় তার রূপ ধরা পড়েছে—

-আমরা যেন এক রুদ্ধ ঘরে বাস করি। সব দরজা জানলা বন্ধ, বাইরে আকাশভাম্রাত, হাওয়া নেই এবং পাখিগুলির কণ্ঠ স্তব্ধ। আমাদের ঘরে তমোট হাওয়া,বৎব্যবহৃত। আমরা শান্ত, নিঃসঙ্গ, বিফল আত্মকৃগুলায়নে অসহ্য যন্ত্রণা তোগকরছি, একটা বিশ্রী খানির সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় অর্থহীন পরিক্রমণে আমরা আমাদেরসময়কে ক্রমাগত পুড়িয়ে নিঃশেষ করছি। বিপর্যস্ত যুগ-পরিবেশে বাস করেও সমকাল-চঞ্চল জীবনাবেগ, যুগ-সংক্ষোভ এবংপ্রতিবাদ-প্রতিরোধ-দ্রোহ-বিদ্রোহ অঙ্গীকার করে মহৎ শিল্পী-চৈতন্য অনুসন্ধান করে জীবনও শিল্পের জন্য সদর্থক এবং আলোকোজ্জ্বল এক মানস-ভূমি। সামরিক শাসনের ভয়েআমাদের অধিকাংশ ঔপন্যাসিক সমাজ-সংক্ষোভ আর জীবন-সত্য ভুলে গেলেও, ব্যতিক্রমযে দু'একজন ছিলেন না, এমন নয়। স্বৈরশাসনের শৃঙ্খলে বাস করেও কোন কোনঔপন্যাসিক ছিলেন সত্য-সন্ধানী, সংরক্ত সমকালস্পর্শী এবং প্রগতিশীল সমাজভাবনায়নিঃসন্ধিগ্ধ।

১৯৫৮ সাল থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হবার পূর্ব পর্যন্ত সময়-সীমায় আমাদের উপন্যাসসাহিত্যে ধরা পড়েছে উপর্যুক্ত দুটি প্রধান চেতনাস্রোত। বাংলাদেশেরস্বাধীনতার পর, সব কিছুর মতোই, আমাদের সাহিত্যেও এলো পরিবর্তন। তাই ১৯৫৮থেকে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে প্রকাশিত উপন্যাস সমূহকে আমরা বিবেচনা করবো দ্বিতীয়পর্বের উপন্যাস হিসেবে।জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার প্রশ্নে 'জননী'র স্রষ্টা শওকত ওসমান এ পর্বে সংরক্ত সমকাল এবং সমাজ-বাস্তবতা এড়িয়ে গেলেন; আশ্রয় নিলেন রূপক-প্রতীক ও রূপকথাপুরাণের জগতে। আলোচ্য সময়ে প্রকাশিত হয় তাঁর চারটি উপন্যাস-ক্রীতদাসের হাসি(১৯৬২), সমাগম (১৯৬৭), চৌরসছি (১৯৬৮) এবং রাজা উপাখান (১৯৭০)। ক্রীতদাসেরহাসি উপন্যাসে আইয়ুব-শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার শোষিত মানুষের প্রতিবাদ উচ্চারিতহয়েছে প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। প্রতি-ধ্বনির সাহায্যে গিরি-কন্দরের গভীরতা এবং দূরত্ব আপনের পন্থায় রচিত’ ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসে শওকত ওসমান স্বকাল-সমকাল থেকেযদিও পলাতক, তবু বিষয়-ভাবনা এবং আঙ্গিক-স্বাতন্ত্র্যের জন্য অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। দীরহাম দৌলত দিয়ে, ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে, বান্দী কেনা সম্ভব—ক্রীতদাসের হাসি কেনা যায় না। নায়কের এ উক্তি সর্বকাল, সর্বদেশের জন্যই সমানসত্য। তাঁর রাজা উপাখ্যানও প্রতীকাশ্রয়ী রচনা। সাহসী হরমুজ কর্তৃক দু'টো গোখরো সাপ

ধারা শৃংখলিত সম্রাট জাহক ও অন্যদের মুক্তিপাতের রূপকটিকে এখানে উদ্ভাসিত হয়েছেব্যক্তিস্বাধীনতা-আকাকী ও মুক্তিকামী মানুষের সভ্যাম ও বিজয়ের ইতিকরা। যাটেরমদকে সামরিক শাসনের শৃঙ্খলমোচনের জন্য মুক্তিকামী বাঙালির সংগ্রাম সংপ্রায় প্রত্যাশা এ উপন্যাসে শিক্ষিত তাষো রূপায়িত হয়েছে।


শওকত ওসমান সমাগম উপন্যাসে বিচরণ করেছেন রূপধার রাজ্যে। 'মানুষের বিশ্বভ্রাতৃত্ব অক্ষয় হোক। ধ্বংস হোক, সাম্রাজ্যবাদীগণ ও তাদের অনুচরেরা. মানুষের নির্বোধতম সংগঠন হিসেবে ধ্বংস হোক \eta>1 সুখীতর, আরো সমৃদ্ধতর হোক আগামী দিনের পৃথিবী'১৫ – এই-ই হচ্ছে সমাগম উপন্যাসে শওকত ওসমানের মৌল বক্তব্য। নগরজীবনের পথে বিন্যস্ত চৌরসন্ধি উপন্যাসে শওকত ওসমানপুঁজিবাদী সমাজের হীন ষড়যন্ত্র এবং শোষণের চিত্র তুলে ধরেছেন। শওকত ওসমানের এসবউপন্যাসে রূপকের মধ্যে দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে অবরুদ্ধ জাতিসত্তার স্বাধিকার স্পৃহা।আঙ্গিকগত অভিনবত্বে এবং বিষয়ের বৈচিত্র্যে শওকত ওসমানের উপন্যাসসমূহ বাংলাদেশের

উপন্যাস সাহিত্যের তাৎপর্যপূর্ণ শিল্পকর্ম।

দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত হয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দু'টো উপন্যাস – চাঁদের অমাবস্যা(১৯৬৪) এবং কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮)। লালসালু উপন্যাসে মজিদ কল্পিত মোদাচ্ছের পীরের মাজারে জমিলার পদাঘাত-সঙ্কেতে অস্তিত্বের যে অভীদা প্রতীকায়িত—এ দু'টোউপন্যাসে সেই অস্তিত্ব চেতনা হয়েছে আরো বলয়িত এবং সুস্পষ্ট। ভয়-ভীতি অতিক্রম করে।চাঁদের অমাবস্যা'র আরেফ আলী এবং কাঁদো নদী কাঁদো-র খতিব মিঞা উত্তীর্ণ হয়েছে।পরম নির্ভীক সত্তার শুদ্ধ জাগর চৈতন্যে। চাঁদের অমাবস্যা এবং কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ মানবমুখীন এবং কল্যাণময় অস্তিত্ববাদী দর্শনে হয়েছেন স্থিতধী।আমাদের উপন্যাস সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিশেষত্ব হলো—তিনি বিষয়াংশ-নির্বাচনেএবং আঙ্গিক-নির্মিতিতে সতত নিরীক্ষাপ্রিয় ও পরীক্ষাপ্রবণ। তাঁর শিল্পী-চৈতন্য ক্রম অগ্রসরমান; স্বাতিক্রমণই তাঁর জীবনার্ধের মূলকথা।চরিত্রের অভ্যন্তর সংকট ও সংক্ষোত উপস্থাপনে ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর উপন্যাসে কখনো ব্যবহার করেছেন ইমপ্রেশনিস্ট পরিচর্যা,কখনো এক্সপ্রেশনিষ্ট; আবার কখনো বা পরাবাস্তববাদী পরিচর্যা। যেমন, কাঁদো নদীকাঁদো উপন্যাসে বিকৃত-বিপর্যস্ত মুহাম্মদ মুস্তাফার অস্তিত্বহীনতা উপস্থাপনে পরাবাস্তববাদীপরিচর্যা।।


"সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস আমাদের নিয়ে যায় অস্তিত্বের প্রগাঢ় অন্ধকার থেকেআলোর দিকে, বিমিশ্রসত্তা থেকে শুদ্ধসত্তার অভিমুখে।১৭ দৃষ্টিকোণ-নির্বাচনে, ভাষা

প্রয়োগে প্রতীক-চিত্রকল্প-উপমা-উৎপ্রেক্ষা সৃষ্টিতে এবং জীবনার্থের প্রাতিস্বিকতায় সৈয়দওয়ালীউল্লাহর এয়ী উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যে উজ্জ্বল স্বাস্থ্যের স্বাক্ষরবাহী।


পঞ্চাশের দশকে মার্কসবাদী চেতনায় আত্মস্থ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও এ পর্বেঅনুসন্ধান করলেন জীবনের সহজ নিরাপত্তা এবং সমর্পিত হলেন রোমান্টিক নীলিমাভ্রমণে।

এ পর্বে প্রকাশিত তিনটি উপন্যাসেই শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬১), নাম না-জানা তোর

(১৯৬২) এবং নীল যমুনা (১৯৬৪)। তিনি হারিয়ে ফেললেন চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান-এরবস্তুনিষ্ঠা; সংরক্ত সমকাল ভুলে গিয়ে আত্মমগ্ন হলেন রোমান্টিক স্বপ্নচারিতায়। তাঁর শেষরজনীর চাঁদ ঢাকা শহরে একই বাড়ির বাসিন্দা চারটি পরিবারকে কেন্দ্র করে রচিত একটি শাহরিক-জীবনের উপন্যাস। 

কাশবনের কন্যা রচয়িতা শামসুদ্দীন আবুল কালামও আলোচ্য পর্বে জীবন-পলাতক।সংস্কৃত পঞ্চাশ-ষাটের দশক বিস্তৃত হয়ে কাঞ্চনমালা-য় (১৯৬১) তিনি বিচরণ করলেনবেদে জীবনভিত্তিক লোককাহিনীর ধূসর জগতে। কাঞ্চনমালা-র কাহিনী নিরাবিল পুথিরজগতে প্রসারিত।... সমগ্র উপন্যাসের পটভূমি ও বক্তব্য পূর্বাপর পূর্ববাংলার বিখ্যাত লোকগীতিকা ‘মহুয়া'র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৮ তবে লোককাহিনীকে আধুনিকজীবনচেতনার অঙ্গীকারে উপন্যাসের অবয়বে উপস্থাপনে শামসুদ্দীন আবুল কালাম যেসম্পূর্ণ সফল হননি, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।


সরদার জয়েনউদ্দীনের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস অনেক সূর্যের আশা-র (১৯৬৭) বিস্তৃত ক্যানভ্যাসে যুদ্ধ, মহামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দুর্ভিক্ষ, আর্থিক বিপর্যয়, মানুষের নৈতিক অধঃপতন এবং জীবন-সংগ্রামের বহুমাত্রিক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। । উত্তম পুরুষে বিবৃত এউপন্যাসের নায়ক রহমত অনেক সূর্যের আশার আলোয় উদ্ভাসিত----

"""তখন সুবেহ সাণিকের আলোয় আলোয় পূব আকাশ আলোর বন্যায় নেয়ে উঠেছে,ঝলমল করে থেকে উঠছে গিন্ত। মনে মনে কেবলই ভাবছি, ঐ ওখানে ঐ আলোরপারে সে দেশ-সে স্বপ্নের দেশ- সে আমার দেশ আমার। সেখানে মানুষেমানুষে ভেদাভেদ নাই, নাই অভুক্ত জনমানব। গরীব কাঙ্গাল রাজা-জমিদারসব যেখানে সমান, সব একই মানুষ। """


ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের অন্ত-অসঙ্গতি এবং লুপ্তপ্রায় পাই-সম্প্রদায়ের জীবনযন্ত্রণা নিয়েগড়ে উঠেছে সরদার জয়েনউদ্দীনের পান্নামোতি (১৯৬৫) উপন্যাস। ঊনবিংশ শতাব্দীতেইংরেজ নীলকরদের অত্যাচার-উৎপীড়ন এবং কৃষক সমাজের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-বিদ্রোহ—বাংলার এই আয়ত ইতিহাস অয়েনউদ্দীনের নীল রঙ রক্ত (১৯৬৫) উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনাংশ। এ উপন্যাসে লেখকের ইতিহাস জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংঘামী চেতনা। মানুষ

অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে একদিন জিতবেই'—পাবনার নীল বিদ্রোহের নায়ক তিতুমীরের এই উক্তির মধ্য দিয়ে লেখক পরোক্ষে প্রকাশ করে দেন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামশীল চৈতন্য।


১৯৫৮ সাল থেকে স্বাধীনতা-পূর্ব কালসীমায় রচিত আমাদের উপন্যাসের গতি-প্রকৃতিযেমন বিচিত্র্যমুখী এবং বৈচিত্র্যসন্ধানী; তেমনি এ পর্বে আবির্ভূত নতুন ঔপন্যাসিকদেরসংখ্যাও আশাব্যঞ্জক। সময়ের এ পর্বে যে-সব নতুন ঔপন্যাসিকের আগমন ঘটেছে, তাঁদেরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১),শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৬-১৯৭১),আলাউদ্দিন আল-আজদি (১৯৩২-), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-), রাজিয়া খান (১৯৩৬),শওকত আলী (১৯৩৬-), জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২), মিজানুর রহমান শেলী, হুমায়ুনকদির (১৯৩৫-১৯৭৭), আবদুর রাজ্জাক (১৯২৪-১৯৮১), রশীদ করিম (১৯২৫-),আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫), চৌধুরী শামসুর রহমান (১৯০২-), আবু জাফর শামসুদ্দীন১৯১১-১৯৮৮), আনোয়ার পাশা (১৯২৮-১৯৭১), নীলিমা ইব্রাহিম (১৯২১-২০০১),দিলারা হাশেম, আহমদ ছফা (১৯৪৩–১৯৯৯), আবদুর রশীদ (১৯৩০-২০০৫),ইন্দুসাহা(১৯৪০-), খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস (১৯২৪-), শহীদআখন্দ (১৯৩৫-) প্রমুখ। এঁদেরঅধিকাংশের রচনায় উপস্থাপিত হলো মধ্যবিত্ত জীবনের অতলগামী ক্ষয়িষ্ণুতা আর অতলান্তশূন্যতা। ব্যক্তির বিনষ্টি-চিত্রই এ পর্বের অধিকাংশ ঔপন্যাসিকের অন্বিষ্ট যেন। 

রাজিয়া খানের বটতলার উপন্যাস (১৯৫৯) এবং অনুকম-এর (১৯৫৯) মঈনসুমিতা-হেটি-শামলী-মিন্টু-রেণু-আশরাফ—সকলেই প্রেম আর শান্তির প্রত্যাশী; কিন্তুমনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, আধুনিক নাগরিক-চৈতন্যের যন্ত্রণা এবং মরুভূ শূন্যতায় তারানিঃশেষিত প্রায়। নগরবাসী আধুনিক মানুষের হৃদয়ের রক্ষক্ষরণ, দুর্নর নিঃসঙ্গতা এবংঅতলান্তিক শূন্যতা উদ্ভাসিত হয়েছে রাজিয়া খানের উপন্যাসদ্বয়ে; এবং দুটি উপন্যাসেইশতাব্দীর যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং ক্লেদ-গ্লানি আর আত্মরতির পক্ষেনির্দেশিত হয়েছে জীবনের পরিণতি। আধুনিক মানুষের যন্ত্রণা এবং ব্যক্তিক মনস্তত্ত্ব উন্মোচনে ব্রাজিয়া খানের ভাষা কবিতাস্পর্শী, আবেগসিক্ত এবং গীতিধ্বনিময়।জেগে আছি (১৯৫০) কিংবা ধানকন্যা (১৯৫১) গল্পগ্রন্থে আলাউদ্দিন আল আজাদেরমৃত্তিকা সংলগ্ন জীবনচেতনা তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০) কিংবা শীতের শেষ রাতবসন্তের প্রথম দিন (১৯৬২)।।। 

নদী-তীরবর্তী মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না—এইসবপ্রাত্যহিকতা নিয়ে গড়ে উঠেছে আলাউদ্দিন আল-আজাদের কর্ণফুলী (১৯৬২) উপন্যাস।কাহিনীর মানবমুখীন পরিণতির মধ্য দিয়ে এখানেও অভিব্যঞ্জিত হয়েছে লেখকের আশাবাদীমানসতা। কল্লোলিত কর্ণফুলী, তার বুকে ভেসে চলা মাঝি সম্প্রদায়, কর্ণফুলী-তীরবর্তীজনপদ, বিশেষ অঞ্চলের মাটি আর মানুষ, আঞ্চলিক ভাষা এবং আঞ্চলিক পরিবেশসবকিছু এ উপন্যাসে একাত্ম হয়ে গেছে।সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার রূপকার সত্যেন সেনের উজ্জ্বল আবির্ভাব ঘটে আলোচ্যকালসীমায়। এ পর্বে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাসসমূহ হচ্ছে ভোরের বিহঙ্গী (১৯৫৯), রুদ্ধদ্বারমুক্তস্রাণ (১৯৫১), অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৭), পদচিহ্ন (১৯৬৮), পাপের সন্তান (১৯৬১),বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৬৯), আলবেরুণী (১৯৬৯), পুরুষমেধ (১৯৬৯), সাত নম্বর ওয়ার্ড(১৯৬৯), কুমারজীব (১৯৬৯), সেয়ানা (১৯৬৯), উত্তরণ (১৯৭০), মা (১৯৭০) এবং এলভাঙ্গে ওকূল গড়ে (১৯৭১)।আমাদের পাতি-বুর্জোয়া সাহিত্য-জগতে সত্যেন সেন হতেপারেন স্বল্প-পরিচিত সাহিত্যিক; কিন্তু মার্কসবাদীসাহিত্যসৃষ্টিতে তাঁর অবদান কোন সূত্রেইবিস্মরণীয় নয়। মার্কসবাদের দিকে জনচেতনাকে জাগিয়ে তোলবার উদ্দেশ্যে সত্যেনসেনের মতো অধিক সংখ্যক উপন্যাস বাংলাদেশে আর কেউ লেখেননি। ঐতিহাসিকউপন্যাস সৃষ্টিতেও বাংলা সাহিত্যে সত্যেন সেন সংযোজন করেছেন একটি নতুন মাত্রা।।তানুগতিক প্রেম-বর্ণনায় মানস-যাত্রা, কারা জীবনের অভিজ্ঞতার রূপায়ণে সে যাত্রায়অগ্রগমন, আর শ্রেণী-সংগ্রামের চেতনায় আকাঙ্ক্ষিত উত্তরণ—এই হচ্ছে সত্যেন সেনেরশিল্পী-মানসের ক্রমবিকাশ রেখা।  জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে (১৯৬৪) উপন্যাসে অভিব্যঞ্জিত হয়েছে হাজার

বছরের সীমানায় প্রসারিত 'আবর্তন-সঙ্কুল অথচ বিবর্তনহীন' পূর্ববাংলার গ্রামীণজীবন।বিষয় ভাবনায় গৌরব-দীপ্ত আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), জহির রায়হানের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।বায়ান্নর রক্ত-স্নাত ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছে এ উপন্যাস। সামরিকশাসনের নিগ্রহের মধ্যে বাস করেও, একুশের মর্মকোষ-উৎসারিত আরেক ফাল্গুন পাঠ করেআমরা হয়ে উঠি সাহসী মানুষ; আসাদ-মুনিম রসুল সালমার মতোই নিৰ্ভীক-চিত্তেআমরাও বলে উঠি—'আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।' তাঁর বরফ গলা নদী(১৯৬৯) অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারের সামগ্রিক ভাঙনের শব্দচিত্র।


এ পর্বে বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকের অন্যতম প্রবণতা হচ্ছে ইতিহাস আশ্রয়ীকাহিনীর রূপকল্প-নির্মাণ। ইবনে রশীদের ফাল্গুনকরা (১৯৫৮), মেসবাহুল হকের পূর্বদেশ(১৯৬৩), আবু জাফর শামসুদ্দীনের ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান (১৯৬৩), বদরুদ্দীনআহমদের অরণ্য মিথুন (১৯৬২), চৌধুরী শামসুর রহমানের মস্তানগড় (১৯৬২), খালেকদাদ চৌধুরীর রক্তাক্ত অধ্যায় (১৯৬৬), এবং পূর্বে আলোচিত সরদার জয়েনউদ্দীনের নীলবন্ত রক্ত (১৯৬৫), সত্যেন সেনের অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৭), পাপের সন্তান (১৯৬৯), বিদ্রোহীকৈবর্ত (১৯৬৯), পুরুষমেধ (১৯৬৯) ও কুমারজীব (১৯৬১) প্রভৃতি এ ধারার অন্যতমউপন্যাস। মোঘল আমলের শেষপাদে অন্যায়-অত্যাচার, অরাজকতা-অবিচার আর মগহার্মাদ-বর্গীর হাঙ্গামায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের শ্যামল প্রান্তরে, এসব অত্যাচার এখানে প্রকাশিত হয়েছে।। 


আলোচ্য পর্বে রচিত উপন্যাসসমূহ গ্রামজীবন অতিক্রম করে ক্রমশ শহরমুখী হয়ে।উঠেছে। তুলনা-সূত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের ঔপন্যাসিকরা গ্রামীণজীবনচিত্রণে যতটা স্বচ্ছন্দ এবং বস্তুনিষ্ঠ, নগর-জীবনচিত্রণে ততটা নন।” তিরিশ্বেপশ্চিমবঙ্গীয় উপন্যাসের প্রভাবে এ পর্বে নবীন ঔপন্যাসিকদের রচনায় এসেছে আধুনিকনাগরিকচেতনা, লিবিডোতাড়িত মনোবিকলন এবং যুদ্ধোত্তর পশ্চিমী অবক্ষয়ী মূল্যবোধ।কিন্তু একই সাথে একথা এখানে স্মরণীয় যে, তিরিশের শ্রম আর সিদ্ধিকে এঁদের কেউইসাহিত্য-ক্ষেত্রে যথার্থভাবে অঙ্গীকার করতে পারেন নি। পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনেঅবরুদ্ধ সংক্ষুব্ধ পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটও এ সময়েরউপন্যাসে অভিবঞ্জিত হয়েছে। পাকিস্তানোত্তর প্রথম দশকের তুলনায় এ পর্বের ঔপন্যাসিকরাঅনেক বেশি আঙ্গিক-সচেতন—বিষয়াংশ নির্বাচন, ভাষা ব্যবহার এবং প্রকরণ-পরিচর্যায়অধিকাংশ ঔপন্যাসিক পরীক্ষাপ্রবণ ও বৈচিত্র্যসন্ধানী। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকালের এইউত্তরাধিকারের ওপরই নির্মিত হয়েছে বিদেশী শত্রুমুক্ত স্বাধীন-সার্বভৌমবাংলাদেশের উপন্যাসসাহিত্য।।।


তথ্যনির্দেশ--

 বাংলাদেশের সাহিত্য (বিশ্বজিৎ ঘোষ)

Ralph Fox The Novel and the People, 1937, London, p. 27সৈয়দ আকরম হোসেন বাংলাদেশের উপন্যাস চেতনাপ্রবাহ ও শিল্প-জিজ্ঞাসা প্রসঙ্গ,

সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদক প্রফেসর নীলিমা ইব্রাহিম), সপ্তদশ বর্ষ; দ্বিতীয় সংখ্যা (শীত

(১৩৮০), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, পৃ. ১৬

মোহাম্মদ নজিবর রহমান আনোয়ারা, ১৯১৪, ত্রয়োদশ মুদ্রণ-১৩৮১, ঢাকা, পৃ. ২৪২

কাজী ইমদাদুল হক : আবদুল্লাহ্, ১৯৩৩, ৪র্থ সংস্করণ-১৯৬২, ঢাকা, পৃ. ২৫২

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : নদীবক্ষে উপন্যাসের প্রথমে মুদ্রিত।

আনোয়ার পাশা : সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজল, ১৯৬৭, চট্টগ্রাম, পৃ.উদ্ধৃত — আবুল ফজল রচনাবলী (প্রথম খণ্ড), ১৩৮২; চট্টগ্রাম, পৃ. ১৬৩-৬৪

সৈয়দ আকরম হোসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯

আবুল ফজল : প্রদীপ ও পতঙ্গ, আবুল ফজল রচনাবলী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৮

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান : ‘পূর্ব পাকিস্তানী কথা-সাহিত্য, আধুনিক বাংলা সাহিত্য, ১৯৬৫,

বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ১৩৬

দশকের প্রথম

১১ জননী ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হলেও, এ উপন্যাসটি লিখিত হয়েছে চল্লিশের

দিকে, দ্রষ্টব্য—‘মুখবন্ধ।

১২ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ লালসানু, ১৯৪৮, ষষ্ঠ সংস্করণ ১৯৬৭, ঢাকা, পৃ. ৩০


লেখক পরবর্তীকালে উপন্যাসটির নাম রাখেন দুই মহল।

হাসান আজিজুল হক : 'পূর্ব পাকিস্তানের কথাসাহিত্যে চিন্তার সংকট' পরিক্রম (সম্পাদক :

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও রফিকুল ইসলাম) তৃতীয় বর্ষ : নবম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪,


ঢাকা, পৃ. ৪১১

১৫ শওকত ওসমান সমাগম, ১৩৭৪ ঢাকা, পৃ. ১৪৫-৪৬

১৬ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কাঁদো নদী কাঁদো, ১৯৬৮, ঢাকা, পৃ. ২৪৪-৪৫


১৭ সৈয়দ আকরম হোসেন : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস', শব্দরূপ (সম্পাদক : সৈয়দ হাফসা

আলমগীর), তারিখবিহীন, ঢাকা, পৃ. ১৭

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান : পূর্বোক্ত পৃ. ১৩৮-৩৯

১৮

১৯সরদার জয়েনউদ্দীন: অনেক সূর্যের আশা, ১৯৬৭, চট্টগ্রাম, পৃ. ৩৪৭এক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম আলাউদ্দিন আল-আজাদের ক্ষুধা ও আশা এবং কর্ণফুলী।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ