--বাংলাদেশের উপন্যাস
বাংলাদেশের উপন্যাসের প্রেক্ষাপট
৪৭ পরবর্তী উপন্যাস বাংলা উপন্যাসের বিষয় বস্তুবাংলা উপন্যাস বাংলা উপন্যাসের পরিচয় উপন্যাসের বিষয়---
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
৫২পরবর্তী বাংলা উপন্যাস /ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক
বাংলাদেশের উপন্যাস/বাংলাদেশের উপন্যাসের প্রেক্ষাপট-/৪৭ পরবর্তী উপন্যাস /বাংলা উপন্যাসের বিষয়বস্তু----
পন্যাস হচ্ছে আধুনিকতম এবং সমগ্রভাস্পর্শী সেই শিল্প প্রতিমা, যেখানে ধ্বনিতকি হয় জীবনের আদি-অন্ত: শিল্পিত স্বরগ্রামে উদ্ভাসিত হয় লেখকের জীবনার্স আরতাঁর স্বদেশ-সমাজ-সমকাল) বুর্জোয়া সমাজের শক্তি এবং স্বাতধো আত্মস্থ হয়ে, মধ্যযুগীয়জীর্ণ সামন্তসমাজ কাঠামো ভেঙে দেওয়ার অতীক্ষা নিয়ে উপন্যাসের জন্য। নবোধিতশিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিতশ্রেণী এবং বুর্জোয়া-সেবিত সমাজই উপন্যাসের আদি-অনয়িতা।আধুনিক যুগে সমাজ ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে ব্যক্তিমানুষের যে সংগ্রাম—তারই মহাকাব্যিক রূপ
উপন্যাস। এ প্রসঙ্গেই স্মরণীয় Ralph Fox-এর সেই উদ্ধরণযোগ্য উক্তি
The Novel is the epic-form of our modern, bourgeois society... Itdid not exist, except in very rudimentary form before that moderncivilisation which began with the renaissance and like every newart-form it has served its purpose extending and deepening
consciousness.
অবক্ষয়িত সামন্তসমাজকে ভেঙে দিয়ে ষোল-সতের শতকে ইয়োরোপে নতুনঅর্থনৈতিকশ্রেণী এবং সামাজিক শক্তির জন্ম হলো এবং তখনি ঘটলো আধুনিক রূপকল্পউপন্যাসের আবির্ভাব। উনিশ শতকের প্রারম্ভেই কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণীরবিকাশ ঘটে; শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নবজাগ্রত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতেই বাংলা উপন্যাসেরঅঙ্কুরোদ্গম। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে পূর্ববঙ্গের মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণীরবিকাশ হয়েছে শতবর্ষ বিলম্বিত। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়(১৯২১) পূর্ববঙ্গের মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিকাশে রাখে ঐতিহাসিক অবদান। ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ববাংলার বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ নব্য-শিক্ষিতের সমবায়েবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকেই ক্রমবিকশিত হচ্ছিলো ঢাকা শহরকেন্দ্রিক নতুনমধ্যবিত্তশ্রেণী। পূর্ববাংলার নবজাগ্রত এই মধ্যবিত্ত-শ্রেণীর চেতনা-স্নাত কয়েকজন শিল্পীর
সাধনায় রচিত হয়েছে বাংলাদেশের উপন্যাসের প্রাথমিক ভিত্তি।
ঢাকা শহরকেন্দ্রিক নতুন মধ্যবিৱশ্রেণী মর্মমূলে সামন্ত-মূল্যবোধ ধারণ করেও বুর্জোয়াসমাজ-সংগঠনের চিন্তা-চেতনা, উদার মানবতাবাদ এবং যুক্তিবাদে আকৃষ্ট হয়ে ১৯২৬সালে গঠন করলো ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ'। অপরদিকে মার্কসবাদে বিশ্বাসী অথচবুর্জোয়া মানবতাবাদে আস্থাশীল লেখক ও শিল্পীরা গঠন করলো ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পীসংঘ' (১৯৩৯)| এই দুই সংগঠনের শিল্পীদের মানস-ভূমিতে পূর্ববঙ্গ উপ্ত করেছে স্বাতন্ত্র্যেরবীজ; এবং এঁরাই স্বাতন্ত্র্যাভিলাষী পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীকে আধুনিক জীবন-চেতনায়অনেকাংশে উদ্বুদ্ধ করেছে।প্রাক্-সাতচল্লিশ পর্বে আমাদের ঔপন্যাসিক-চেতনাপুঞ্জ প্রবাহিত হয়েছে দুটি ভিন্নস্রোতে। একটি স্রোতের উৎসে ছিলেন সামন্ত-মূল্যবোধে বিশ্বাসী ঔপন্যাসিকরা; অন্যটি
সৃষ্টি হয়েছে উপার বুর্জোয়া মানবতাবাদে প্রত্যয়ী কথাকোবিদদের সাধনায়। প্রথম স্রোতটিনির্মাণ করেছেন মোহাম্মদ নজিবর রহমান (১৮৭৮-১৯২৩),কোরবান আলী, শেখ ইদরিসজালী (১৮৯৫-১৯২৬), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), আকবরউদ্দীন (১৮৯৫
১৯৭৮), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) এবং হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯)। তবে এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন যে, অসম সমাজ বিকাশের কারণে বিশ শতকের সূচনাকাল থেকেচল্লিশের দশক পর্যন্ত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানসলোকে বুর্জোয়া ভাবধারার ভূমিকা ছিলপ্রগতিশীল এবং সত্যসদ্ধ। কারণ ‘যতক্ষণ বুর্জোয়াশ্রেণী সামন্তশ্রেণীর সঙ্গে সংঘর্ষরত, সেপর্যন্ত বুর্জোয়া চেতনা-প্রবাহ সত্যসন্ধ।
নজিবর রহমানের আনোয়ারা (১৯১৪), প্রেমের সমাধি (১৯১৯) এবং গরীবের মেয়ে(১৯২৩) উপন্যাসত্রয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকেপূর্ববাংলার বিকাশমান মুসলিমসমাজের জগৎভাবনা এবং জীবনবিশ্বাসের বিশ্বস্ত শিল্পপ্রতিমা। আনোয়ারার নূরল এসলাম, প্রেমের সমাধিরমতিয়র রহমান এবং গরীবের মেয়েরনূর মহম্মদ—এই তিন নায়ক-চরিত্রের আচার-আচরণ-উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিকমূলত ধরতে চেয়েছেন সমকালীন মুসলিমসমাজের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্নসংগ্রাম এবং সংশয়-সংকটের আলেখ্য। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের ষড়যন্ত্রে ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘পাকিস্তান' নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রেরশৃঙ্খলে পূর্ববঙ্গের উঠতি মধ্যবিত্তশ্রেণীর অগ্রযাত্রা হলো বাধাপ্রাপ্ত। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায়সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ববাংলার উঠতি পুঁজিবাদীগোষ্ঠী এবং নবজাগ্রত মধ্যবিত্তশ্রেণী অনুভব করলোতাদের অস্তিত্বের অন্তসঙ্কট। পাকিস্তানি বৃহৎ পুঁজির আর্থিক স্বার্থেই পূর্ববাংলা রূপান্তরিতহলো আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে। ইতিহাসেরস্বাভাবিক নিয়মে সমাজ-বিকাশের এই প্রতিবন্ধকতা শিল্পী-চৈতন্যকে অনিবার্যভাবেইপ্রভাবিত করলো। ফলতঃ বুর্জোয়া মানবতাবাদে প্রত্যয়ী শিল্পীর মানসলোকে উপ্ত হলোসংকটের বীজ।আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাতৃভাষাকে কেন্দ্রকরে পূর্ববাংলার প্রগতিশীল নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণীর প্রথম প্রতিবাদ উচ্চারিত হলো, ১৯৪৮সালে। ১৯৫২ সালে সংঘটিত হলো ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষা আন্দোলন। আমাদের
রাজনীতি এবং সমাজ-সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনে ভাষা আন্দোলন সঞ্চার করলো স্বাধিকার
প্রত্যাশী চৈতন্য। বায়ান্নর রক্তিম প্রতিবাদ পূর্ববাংলার জনমনে যেমন তোলে ঊর্মিল
আলোড়ন; তেমনি সামন্ত-মূল্যবোধসিক্ত মধ্যবিত্তশ্রেণীর সুদৃঢ় পলল ভিতও হয়ে পড়ে
শিথিল। মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক এবং মার্কসীয় চেতনাপুষ্ট শক্তিসমূহ পূর্ববাংলার
সমাজজীবনের প্রায় সকল স্তরে অতিদ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে থাকে, যার ফলে ১৯৫৪-র
সাধারণ নির্বাচনে বেণিয়াপুঁজি ও সামন্তশক্তির ধারক মুসলিম লীগ, সকল প্রয়াস সত্ত্বেও,
পরাজিত হয়; এবং প্রগতিশীল শক্তি যুক্তফ্রন্ট অর্জন করে বিপুল বিজয়। অতঃপর ১৯৫৮-র
আগস্ট পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ বার বার মন্ত্রিসভার পতন সুগম
করে দেয় পাকিস্তানি সামরিকজান্তার ক্ষমতাদখলের পথ।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিকশাসন প্রবর্তন-পূর্ব
কাল-পরিসর এ দেশের সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি বিশেষ পর্যায়। তাই
আলোচ্য সময়-সীমায় রচিত উপন্যাসসমূহ আমরা বাংলাদেশের উপন্যাসের প্রথম পর্ব
হিসেবে বিবেচনা করেছি। সময়ের এই পর্ব-বিভাজন মোটেই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নয়;
সাতচল্লিশোত্তর পূর্ববাংলার আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিভাজন
অবশ্যই সমাজসত্য-সম্মত।
বিভাগোত্তর কালে প্রথম দশকে উপন্যাস রচনায় যাঁরা ব্রতী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে
আবুল ফজল, আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০২),
আকবর হোসেন (১৯১৭-১৯৮১), কাজী আফসারউদ্দীন (১৯২১-), আবু রুশদ (১৯১৯-),ইসহাক চাখারী (১৯২২-), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্(১৯২২-১৯৭১), সরদার জয়েনউদ্দীন
(১৯২৩-১৯৮৬), শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬১৯৯৭), আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (১৯৩১-) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ থেকে১৯৫৭, সময়ের এ পর্বে প্রকাশিত উপন্যাসসমূহ প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক ঘটনাংশ আশ্রয় করেনির্মিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্র হলেও ঢাকা শহরের প্রকৃত নগরায়ণবিলম্বিত হয়েছে ঐতিহাসিক কারণেই। ফলত আমাদের শিল্প-সাহিত্যেও নাগরিকচেতনারঅনুপ্রবেশ হয় বিলম্বিত। তবু, সীমিত অর্থে হলেও প্রথম পর্বের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে আবুল
ফজল এবং আবু রুশদের শিল্পকর্মে নগরচেতনার প্রতিভাস দুর্লক্ষ্য নয়। সৈয়দওয়ালীউল্লাহকে বাদ দিলে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, প্রথম পর্বের ঔপন্যাসিকরা আঙ্গিকনির্মিতি, ভাষা ব্যবহার এবং প্রকরণ-প্রসাধনে একান্তই অসতর্ক, অমনোযোগীউদাসীন।আলোচ্য পর্বে প্রকাশিত হয় আবুল ফজলের দু'টি উপন্যাস— জীবন পথের যাত্রী(১৯৪৮) এবং রাঙ্গা প্রভাত (১৯৫৭)। জীবন পথের যাত্রী ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনের শিল্পরূপ।এ উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা কল্লোলীয় নাগরিক-চেতনার বৃত্তে অনুসন্ধান করেছে জীবনের
সুস্থ মূল্যবোধ।।
গ্রামীণ জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত শওকত ওসমানের জননী (১৯৬১/১১ উপন্যাসেশব্দবন্দি হয়েছে লেখকের উদার মানবতাবাদী জীবনজিজ্ঞাসা। পশ্চিম বাংলার গ্র্যান্ড ট্রাঙ্করোডের ধারে মহেশডাঙা নামক গ্রামের কোন এক দরিয়া বিবির স্তূপকে এখানেঅভিব্যঞ্জিত হয়েছে সমাজ-শৃঙ্খলে বন্দি গ্রামীণ নারীর নীরব সহনশীলতা এবং আত্মত্যাগের
ইতিকথা। জননী মনীষাদীপ্ত উপন্যাস নয়, বরং আবেগধর্মী। প্রতিকূল সমাজ-প্রতিবেশেরবিরুদ্ধে তীব্র জীবনসংগ্রামের প্রেক্ষাপটে এ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে চিরায়ত বাঙালিমাতৃস্নেহ। সমাজ-সত্য আছে, আছে গ্রামীণ জোতদারের লিবিডোতাড়িত বিকৃত বাসনারচিত্র–তবু জননীর মুখ্য উপজীব্য মাতৃত্বের গৌরব-গাথা। যেমন সমাজসত্য উপস্থাপনে ওচরিত্রচিত্রণ নৈপুণ্যে, তেমনি প্রকরণ-পরিচর্যায় শওকত ওসমানের জননী পূর্ববাংলারকথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল শিল্পকর্ম।
ঘটনাংশ এবং প্রকরণের শৈল্পিক সমন্বয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু (১৯৪৮) বাংলাউপন্যাস-সাহিত্যের একটি দীপ্তিমান এবং অনতিক্রান্তশিল্প-প্রতিমা। এ উপন্যাসে চিত্রিতহয়েছে ধর্ম-ব্যবসায়ী মজিদের অস্তিত্বের অন্তসংকট। বহির্মুখী জীবন নয়, বরং মজিদেরঅভ্যন্তর সংকট-সংশয় এবং নৈঃসঙ্গ্য এ উপন্যাসের মৌল প্রতিপাদ্য। মজিদচরিত্রেরমাধ্যমে লেখক এখানে চিত্রিত করেছেন পূর্ববাংলায় ধর্মব্যবসায়ীদের শোষণ ও ভণ্ডামিরচিত্র। ওয়ালীউল্লাহর পরবর্তী রচনা চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) কিংবা কাঁদো নদী কাঁদো
(১৯৬৮) উপন্যাসে অভিব্যঞ্জিত হয়েছে যে অস্তিত্বের অভীপ্সা, তার পূর্বাভাস লালসালু-তেইলক্ষণীয়। লালসালুতে আচ্ছাদিত মাছের পিঠের মতো মাজারের দিকে জমিলার পদাঘাতসঙ্কেত অস্তিত্বের তত্ত্ব সভায় উত্তরণেরই প্রতীক-চিত্র। আত্মস্থ রচনাশৈলি, পরিষত ভাষা,পরিমার্জিত গীতময়তা এবং প্রতীক-উপমা-উৎপ্রেক্ষার সমন্বয়ে লালসালু হয়ে উঠেছে একটি
স্বতন্ত্র শিল্পকর্ম। লালসালু উপন্যাসে লেখকের প্রকরণ সতর্কতা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।বলসালু-তে ওয়ালীউল্লাহ্ প্রধানত ব্যবহার করেছেন ইমপ্রেশনিষ্ট এবং প্রতীকী পরিচর্যা।যেমন, প্রকৃতির অনুষঙ্গে, তাহেরের বাপের নিরস্তিত্ব হওয়ার প্রতীকী পরিচর্যা
""!
দুদিন পরে ঝড় ওঠে। আকাশে দুরন্ত হাওয়া, আর দলে ভারী কালো কালো মেঘেলড়াই, মহব্বত নগরের সর্বোচ্চ তালগাছটি বন্দী পাখির মত আছড়াতে থাকে।হাওয়া মাঠে ঘূর্ণিপাক খেয়ে আসে, তির্যক ভঙ্গিতে বাজপাখির মত শো করে নেমেআসে, কখনো ভোঁতা প্রশস্ততায় হাতীর মত ঠেলে এগিয়ে যায়। """
আবু ইসহাকের স্বেচধর্মী রচনা সূর্যদীঘল বাড়ী-তেও (১৯৫৫) চিত্রিত হয়েছে গ্রামীণ
জীবনের কুসংস্কার, মহাজনী শোষণ, জোতদারের বিকৃত-লালসা, দরিদ্র মানুষ জয়গুন
হাসুদের জীবন সংগ্রামের ছবি। জয়গুনদের গ্রাম ছেড়ে শহরে নির্বাসন আসলে গ্রাম
বাংলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্কেত। বিষয়-গৌরবে ব্যতিক্রমী হলেও লেখকের
অমীমাংসিত জীবনদৃষ্টি, সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং সমাজ-প্রগতির ধারা অনুসন্ধানে
মধ্যবিত্তসুলভ ভ্রান্তি ক্ষুণ্ন করেছে সূর্যদীঘল বাড়ী-র শিল্পমূল্য। তবু এ কথা স্বীকার করতেই
হয়, আবু ইসহাকের সূর্যদীঘল বাড়ী ধর্মজীবীর শোষণে নিষ্পেষিত, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে
উজ্জ্বলিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম জীবনের সমর্থতা স্পর্শী অসংখ্য জয়গুন-হাসুদের জীবনযাপনের বিশ্বস্ত রূপবদ্ধ।আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান-এ (১৯৫২ সালে সাময়িক পত্রেপ্রকাশিত; গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৬০) মার্কসীয় দৃষ্টিকোণে জীবন-বীক্ষণের প্রতিশ্রুতি আছে:তবে সে-প্রতিশ্রুতি অভি-রোমান্টিকতার মোহাবেগে সহসাই দ্বিধান্বিত। লেখকের
সমাজবোধ ও ইতিহাসচেতনা বুর্জোয়া রোমান্টিকতার চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে—ফলতঃ
প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি বিচ্যুত হয়ে উপন্যাসটি মহৎ সৃষ্টির সম্ভাবনাকে অঙ্কুরোদ্গমের পরেই
বিনষ্ট করেছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষাবোধ এবং পরিচর্যা-সচেতনতা তাঁরপ্রাতিস্বিক শিল্প-চৈতন্যেরই স্বাক্ষরবহ।গ্রামীণ মানুষের জীবন-যাপনের একদিন প্রতিদিনের শব্দরূপু কাজী আফসারউদ্দীনেরচর ভাঙ্গা চর (১৯৫১)। এটিই পূর্ববাংলার প্রথম উপন্যাস, যেখানে ঔপন্যাসিক, সীমিতহলেও, সচেতনভাবে প্রকৃতিকে উপস্থাপন করেছেন প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। মানুষ নয়, বরংপ্রকৃতিই চর ভাঙ্গা চর-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র, বর্গীর আক্রমণ থেকে পাঠান এবং মোঘলআমলে ধলেশ্বরী চরের সংগ্রামশীল মানুষের জীবন-চিত্র এখানে অঙ্কিত হয়েছে। কাজীআফসারউদ্দীনের কলাবতী কন্যা (১৯৫৬) এবং নোনা পানির ঢেউ (১৯৫৮) এ পর্বের দু'টোজনপ্রিয় উপন্যাস। দৌলতুন্নেছার পথের পরশ (১৯৫৭);ইসহাক চাখারীর পরাজয় (১৯৫৪),
মেঘবরণ কেশ (১৯৫৫) প্রভৃতি উপন্যাস কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্ম-ভীরু, স্থবির চিত্র পাওয়া যায়।
আবু রুশদ (সামনে নতুন দিন (১৯৫৬) উপন্যাসে মধ্যবিত্তের জীবনযন্ত্রণা নগরজীবনেরপরিবেক্ষিতে উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন; তবে শিল্পসচেতনতার অভাবে তাঁর এ প্রয়াসশিক্ষিত হয়ে ওঠেনি। মধ্যবিত্তের জীবনসঙ্কট নয়, বোধ করি, নগরজীবনের উপরিতলের চিত্রঅঙ্কনেই তিনি অধিক উৎসাহী। কেন্দ্রানুগ শক্তির অভাবে জনৈক রহমান সাহেবের জীবনেরঘটনাগুলো একসূত্রে মিলিত হতে পারেনি এবং এখানেই এ উপন্যাসের আঙ্গিকগত সঙ্কট।তবু আবু রুশদের ‘সামনে নতুন দিন' উপন্যাস এ অর্থেই তাৎপর্যপূর্ণ যে, ষাটের দশকেআমাদের উপন্যাস-সাহিত্যে নাগরিক-চেতনার যে প্রতিভাস, তার প্রাথমিক প্রকাশ এখানেদুর্লক্ষ্য নয়।
সরদার জয়েনউদ্দীনের আদিগন্ত (১৯৫৬) গ্রামবাংলার নিম্নবিত্ত মানুষের প্রাত্যহিকজীবনসংগ্রামের ভাষাচিত্র। সমাজসচেতন আশাবাদ ধ্বনিত হলেও ভাষা ব্যবহার ওপরিচর্যার শৈথিল্য এবং মননশীলতার অভাবে শিল্প-বিচারে আদিগন্ত দুর্বল সৃষ্টি। শামসুদ্দীনআবুল কালামের কাশবনের কন্যা (১৯৫৪) উপন্যাস নির্মিত হয়েছে দক্ষিণ-বাংলারনিম্নবর্গের মানুষদের জীবনকে কেন্দ্র করে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো লেখকের মধ্যবিত্তসুলভরোমান্টিকতার চোরাগলিতে আত্মসমর্পণ করেছে। সংগ্রামশীল হওয়া সত্ত্বেও অন্তরধর্মে তারাবিধাগ্রস্ত, ভাবাবেগপূর্ণ এবং উচ্ছ্বাসপ্ররণ। তবু এ উপন্যাসের কবিতাস্পর্শী শব্দস্রোতেপ্রতিদিনের নদীময় দক্ষিণ বাংলা কল্লোলিত যেন। এ পর্বেই প্রকাশিত হয় তাঁর আরো তিনটিউপন্যাস-আশিয়ানা।১৯৫৫), আলম নগরের উপকথা১৩ (১৯৫৫) এবং জীবনকাব্য(১৯৫৬)। যুগ-পরস্পরায় প্রসারিত আলম নগরের উপকথা উপন্যাসে উপকথা এবংইতিহাসের ঘটেছে পরস্পর অন্তর্বয়ন মিলন। এ উপন্যাস লেখকের ইতিহাসজ্ঞান, সময় ওসমাজ-অভিজ্ঞতার স্বাক্ষরবাহী। অবক্ষয়িত সামন্ত পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং প্রাচীনসমাজকাঠামো-ভাঙনের রূপচিত্রের মধ্য দিয়ে এখানে উৎসারিত হয়েছে নতুন সমাজনির্মাণের অভিলায়।গ্রাম ও নগরজীবনের পটভূমিতে বিধৃত এবং শিল্পচেতনা ও সমাজবোধের সমন্বয়েরচিত আবুল মনসুর আহমদের জীবন ক্ষুধা (১৯৫৫) এ পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।উপন্যাসের নায়ক হালিম নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তের সচেতন প্রতিনিধি। এ উপন্যাসেরবিস্তৃত পটে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বিয়াল্লিশের ভারত-ছাড় আন্দোলন, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষপ্রভৃতি ঘটনা। জীবনার্থ, ভাষা ব্যবহার এবং ঘটনা বিন্যাসের বিচারে জীবন ক্ষুধা আবুলমনসুর আহমদের একটি নিরীক্ষাধর্মী শিল্পকর্ম।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭, সময়ের এ পর্বে প্রকাশিত অধিকাংশ উপন্যাসেই উৎসারিতহয়েছে ঔপন্যাসিকদের বুর্জোয়া মানবতাবাদী জীবনভাবনা। আলোচ্য কালসীমায় রচিত প্রায়সব উপন্যাসেই উদ্ভাসিত হয়েছে পূর্ববাংলার গ্রামীণ জীবন। এ পর্বের ঔপন্যাসিকরাঘটনা-নির্বাচনে প্রধানত গ্রামমুখীন। তবে আবুল ফজল, আবু রুশদ, আবুল মনসুর আহমদপ্রমুখের রচনায় নাগরিকচেতনার সীমিত প্রকাশ এ পর্বেই লক্ষণীয়। ব্যক্তির সামাজিকজীবনের সঙ্গে তার অন্তর্জীবনের বহুমাত্রিক জটিলতারউন্মোচন-প্রয়াসও এ পর্বেরউপন্যাসের অন্যতম স্বভাবলক্ষণ। প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, এ সময়ের অধিকাংশউপন্যাসই মহৎ সৃষ্টির পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি, লেখকদের সংশয়ী এবং দ্বিধান্বিতসমাজবোধের জন্য। প্রাক-সাতচল্লিশ সময়ের ঔপন্যাসিক মূল্যবোধের সঙ্গে এ পর্বে যুক্তহয়েছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একাকিত্ববোধ এবং অন্তরমুখিতা, আবুল ফজলের নাগরিকচেতনা, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সমাজবাদী জীবনভাবনা এবং শামসুদ্দীন আবুলকালামের নঞর্থক রোমান্টিকতা। প্রাক-সাতচল্লিশ পর্বের উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্যগ্রামীণ মুসলিমসমাজের জীবনচিত্রণ আলোচ্য পর্বে আর প্রাধান্য পায়নি বরং তার জায়গায়এসেছে শাহরিক মধ্যবিত্ত জীবন। একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, বায়ান্নর রক্তিম উজ্জ্বীবনেরফলেই এ পর্বের উপন্যাসসমূহ জীবনকেন্দ্রিক, সত্য-অন্বেষী এবং মৃত্তিকামূলসংলগ্ন।
0 মন্তব্যসমূহ