--মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বাংলা কবিতার বিষয়বস্তু সাহিত্য মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের কবি---
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা ----
কোনো পরাধীন জাতির মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘ সাধনা যখন সফল হয়, তখন তা জাতীয়চেতনার মর্মমূলে থাকে নিরন্তর প্রবহমাণ; বিরাজ করে অনাগত কাল ধরে অনিবার্গ প্রেরণারউৎস হয়ে। অসীম সমুদ্রে ভাসমান দূরগামী জাহাজের নাবিকের কাছে বাতিঘরেরআলোকস্তম্ভের মতো, মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রামী জাতিসত্তাকে নতুন আশা আর আকাঙ্ক্ষার বাণীশোনায় প্রতিনিয়ত। মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তম প্রেক্ষাপট নির্মাণে একটি দেশের জাতীয় সংস্কৃতিপালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি যেমন একটি দেশের মুক্তিসংগ্রামকেত্বরান্বিত করতে পারে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্নাত হয়ে সে দেশের শিল্প-সাহিত্যওযুগান্তকারী নতুন সৃষ্টিতে হয় ঋদ্ধ। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের পটভূমি নির্মাণেরুশো-ভলটেয়ার-মন্টেঙ্কুর চেতনাসঞ্চারী রচনাবলি যেমন প্রেরণা যুগিয়েছে; তেমনিমানবসভ্যতাকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়া যে রুশ বিপ্লব (১৯১৭)— তার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটনির্মাণ করেছেন টলস্টয় তুর্গেনিত-গগল আর ম্যাক্সিম গোর্কি। অপরদিকে, জাতীয়মুক্তিসংঘামের চেতনায় স্নাত হয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ শিল্প-সাহিত্য।বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রেক্ষাপট নির্মাণেও এদেশের সাহিত্য, বিশেষত কবিতা পালনকরেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা; আবার যুদ্ধোত্তর কালে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চেতনাকে মর্মমূলেলালন করে আমাদের সাহিত্যের অঙ্গনও হয়েছে নতুন ভাবনা এবং মূল্যবোধে পরিসুত ওসমৃদ্ধ, সাহিত্যে এসেছে নতুন মাত্রা।
সাহিত্য কোনো জাতির ব্যর্থতা-বেদনার ইতিহাস আর যুগ-যন্ত্রণাকে যেমন প্রতিভাতকরতে পারে, তেমনি দিক নির্দেশ করতে পারে অনাগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। বস্তুত সাহিত্যমানুষের মধ্যে জাগায় চেতনা, তাকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করে তোলে তার অধিকার সম্পর্কে।ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই বাংলা সাহিত্যে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের আহ্বানধ্বনিত হয়েছে। ব্রিটিশ-ভারতে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্রচট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্তভট্টাচার্য প্রমুখ আমাদের সাহিত্যে স্বাধীনতা-চেতনার ভিত্তি স্থাপন ও তা সুদৃঢ় করেছেন।ঐতিহ্যের এই সরণি অতিক্রম করেই ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ববাংলাকেন্দ্রিক
বাংলা সাহিত্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছে।সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের ষড়যন্ত্রে ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘পাকিস্তান' নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের
শৃঙ্খলে পূর্ববঙ্গের উঠতি মধ্যবিত্তশ্রেণীর অগ্রযাত্রা হল বাধাপ্রাপ্ত। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই পূর্ববাংলার উঠতি পুঁজিবাদী শ্রেণী এবং নবজাগ্রত মধ্যবিত্ত শ্রেণী অনুভব করলতাদের অস্তিত্বের অন্তর্গভুট। । আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাতৃভাষাকে কেন্দ্র
করে পূর্ববাংলার প্রগতিশীল নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রথম প্রতিবাদ উচ্চারিত হল ১৯৪৮সালে। ১৯৫২ সালে সংঘটিত হল গৌরবোজ্জ্বল ভাষা আন্দোলন। আমাদের রাজনীতি এবংসমাজ-সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনে ভাষা আন্দোলন সঞ্চার করলো স্বাধিকার প্রত্যাশী চৈতন্য। এইভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম এবং স্বাধিকারের বাণী বাংলাদেশেরমুক্তিযুদ্ধের সুদৃঢ় ভিত্তিভূমি নির্মাণ করল। কবির কণ্ঠে তাই ভেসে ওঠে এই নবজাগ্রত
"""কয়েকটি আত্মা চৌচির হয়ে পড়েছিলো
জন্য নিয়েছিলো একটি দিন।
ইতিহাসের খণ্ডিত স্ফুলিঙ্গের মতো একটি দিন
জন্ম নিলো,,
আমার সকল সভায় যার আকাঙ্ক্ষা
তেমনি পৃথিবী
জন্য নেবে এই চৌচির ছিন্নভিন্ন সৌরভ থেকে
বিষাপ্ত আত্মার সৌরভের উন্নথিত আলোছায়া থেকে
মুক্তির মতো স্বাধীনতার মতো প্রতিশোধের মতো
এই একটি দিন।
জন্ম নেবে
আমার সম্পন্ন জ্যোতিষ্মান ভূ-মণ্ডল!"""
(ফজল শাহাবুদ্দিন/ ‘উনিশশো বায়ান্নর একটি দিন')
শামসুর রাহমান এর ভাষায় ----
"""উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের বৌধ-অলসিত প্রতিধ্বনিত মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চা।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা, কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বা মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।
(শামসুর রাহমান / 'আসাদের শার্ট')""""
একাত্তর সালের ১৬ই ডিসেম্বর অনেক রক্তের পথ পেরিয়ে উঠল বাংলাদেশেরস্বাধীনতার সূর্য। আমরা জানি, সমাজ জীবনের অন্তর্গঠনের রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে
ভতপ্রোতভাবে জড়িত তার বহির্গঠন অর্থাৎ চৈতন্যপ্রবাহ।'১ এ জন্যই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেঅর্জিত একটি দেশের স্বাধীনতা সমগ্র জাতিকে রূপান্তরিত সত্তায় করে পুনর্জাত। আমাদেরমুক্তিসংগ্রাম সমগ্র জাতিসত্তার অন্তর্লোকে যে-চেতনা সঞ্চার করেছে, তা সাহিত্য-ক্ষেত্রেওএনেছে নতুন মাত্রা। তবু রূপান্তরিত এবং রক্ত-স্নাত বাঙালির সংগ্রামী চেতনা বাংলাদেশেরকবিতায় কতটুকু এবং কোন্ মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে তা-ই আমাদের বিবেচ্য।একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতায় জড়িয়ে আছেসংগ্রাম ও বিজয়ের বিমিশ্র অভিব্যক্তি, যা একান্তই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। দীর্ঘসিকি শতাব্দী ধরে নিজেকে শনাক্ত করার যে সাধনায় বাংলাদেশের কবিরা ছিলেননিবেদিত প্রাণ, তার সাফল্যে কবিতার ভাব-ভাষা-বাকপ্রতিমা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুদ্ধোত্তরকালে এসেছে নতুন মাত্রা। বিষয় এবং ভাবের দিক থেকে বাংলাদেশের কবিতায় যেমনমুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে; তেমনি কবি-ভাষা এবং উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষা সৃজনেওমুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ উপস্থিত। আমাদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্নভাবে।
কখনো সরাসরি যুদ্ধকে অবলম্বন করে কবিতা রচিত হয়েছে, কখনো-বা কবিতার ভাব সৃষ্টিহয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে। কোনো কোনো কবিতায় স্বাধীনতার স্বপক্ষীয়দেরপ্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং বিপক্ষীদের প্রতি ঘৃণাবোধ উচ্চারিত হয়েছে। আবার কোথাওবা কবিতার বহিরঙ্গে লেগেছে মুক্তিযুদ্ধের স্পর্শ।স্বধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের কবিরা ছিলেন পাকিস্তানি ঘাতকদের অন্যতমশকার। সন্ত্রাসের মধ্যে বাস করেও বাংলাদেশের কবিরা সংঘামের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে কবিতাচনা করেছেন, পালন করেছেন তাঁরা শব্দ-সৈনিকের ভূমিকা।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছিল প্রত্যাশার একটি নাম:গেরিলা'। গেরিলার সঠিক কোনো প্রতিকৃতি গ্রামের মানুষের জানা ছিল না। কিন্তু মেতারা চিনেছে, না জটাজালধারী অপরিচিত কেউ নয়, গেরিলা তাদেরই ভাই, তাদেরই
প্রাণপ্রতিম সন্তান–
"""দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুচ্ছি তোমার আঁতিগীতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে
কানু চর, সৈন্য পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতিঘর, পারলে নীলিমা চিরে বের
করতো তোমাকে ওরা, দিতো, ডুব গহীন পাতালে।
ভূমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর।
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, সুঃখ তাড়ানিয়া
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।
(শামসুর রাহমান / 'গেরিলা')"""
যুদ্ধের সময়ে আমাদের জাতীয় চৈতন্যের জাগরণ কবি তুলে ধরেছেন প্রত্যয়দীপ্তশব্দগুচ্ছে। সমবেত বাঙালির আত্ম-জাগরণ কবির কাছে যেন হয়ে যায় একটি কবিতা সৃষ্টিররূপকচিত্র–
""যেদিন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করল
সেদিন আমরা প্রাচীন সঙ্গীতের মত
বন্ধু এবং সংহত হ'লাম
পর্বতশৃঙ্গের মত মহাকাশকে স্পর্শ করলাম,
দিকচক্রবালের মত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হ’লাম,
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উৎপাটিত করলাম।
সেদিন আমরা সমবেত কণ্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।
(আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ/ আমরা কি তার মতো কবিতার কথা বলতে পারবো")"""
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনী মানবতার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে মেতে উঠেছিলগণহত্যায়। লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছেন পাকিস্তানি সৈনিকের পাশবিক হত্যাযজ্ঞে।কবির ভাষায় সেই বর্বরতার চিত্র—
""হানাদার খুঁজে ফিরল নগর গ্রাম
বধ করে গেল স্বজন, সুহৃদ, আসাদ লক্ষ নাম।।
(মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান/ স্বীকৃতি)""
—এই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে কবির কণ্ঠে ঘোষিত হলোপ্রতিহিংসার অনল—
"""টিক্কার ইউনিফর্মে শিশুর মগজ,
যুবকের পাঁজরের গুঁড়ো,
নিয়াজীর টুপিতে রক্তের প্রস্রবণ,
ফরমান আলীর টাইয়ের নটে ঝুলন্ত তরুণী...
তুমি কি তাদের
কখনো করবে ক্ষমাঃl
(শামসুর রাহমান/ 'রক্তসেচ')"""
স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়াবহ নৃশংসতা কবিকে বিক্ষুব্ধ করেছে, করেছে
বেদনাহত এবং সে বিক্ষোভ-বেদনা থেকেই জন্ম হয়েছে ঘৃণার। ফলত অস্ত্র না ধরলেও
তিনি লেখনিকে করলেন কৃপাণ, অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে শব্দ-সৈনিকের ভূমিকায় তাঁকে নামতে
হল লড়াইয়ে। সৌন্দর্যের অপার মুখাবয়ব অঙ্কন করবার একান্ত শব্দগুচ্ছে তাঁকে তুলে নিতে
হল যুদ্ধকালীন প্রাত্যহিকতার স্পর্শ। কবিও তাই প্রতিদিনের শব্দে কবিতার দেহ সাজান এবং
জল্লাদ বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেন তীব্র ঘৃণা-------
"""দ্বিখণ্ডিত শিশুর মৃতদেহ নিয়ে
অট্টহাস্যে যারা রাত্রির নীরবতাকে
তয়াল করল"""
পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্যে একাত্তরে বাঙালি জাতিসত্তার যে উদ্বোধন, কবিসেখান থেকে প্রতিনিয়ত পান কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিরআকাঙ্ক্ষা, সমবেত বাঙালির আত্মজাগরণ এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইতিহাস হাসানহাফিজুর রহমানের কবিতায় ধরা পড়েছে—
""ঝোপঝাড়, নদীনালা, ফসলের ক্ষেত,
সমস্ত বাংলাই আজ কঠোর এ্যামবুশ।
সবুজ মানুষেরা আচম্বিতে আজ প্রত্যেকেই গেরিলা।
(হাসান হাফিজুর রহমান /গেরিলা) """
পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে বাংলার লক্ষনারীর লাঞ্ছনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি বেদনার্ত পরিচ্ছেদ। দেশমাতৃকার মতোই তারাছিন্ন-ভিন্ন ধর্ষিতা; তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই এক দুর্মর যন্ত্রণার স্মৃতি। বাংলার এইবীরাঙ্গনাদের যন্ত্রণার শব্দরূপ-সৃজনে কবি হয়ে ওঠেন বেদনার্ত; তিনি তাদের আহ্বানকরেন আসন্ন বিজয়ের মহোৎসবে
""তোমাদের ঠোঁটে দানবের খুণ,
স্তনে নম্বরের দাগ, সর্বাঙ্গে দাঁতালের ক্ষত চিহ্ন প্রাণান্ত গ্লানিকর।
লুট হয়ে গেছে তোমাদের নারীত্বের মহার্ঘ্য্য মসজিদ
(হাসান হাফিজুর রহমান/ 'বীরাঙ্গনা')"""
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে বাঙালির ত্যাগ আর আত্মবিসর্জনের ইতিহাস পৃথিবীরমুক্তিসংগ্রামীদের কাছে এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা হয়ে বিরাজ করবে। 'স্বাধীনতা' এই শব্দটিঅর্জনের জন্যে যুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালি যে অত্যাচারের শিকার হয়েছে, কবির শব্দগুচ্ছে
""সেই ভয়াল দিনের চিত্র
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মতো চিৎকার করতে করতে।
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
(শামসুর রাহমান/ 'তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা)""
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণের বিপুল প্রবাহ মুক্তির নেশায় সমস্ত বাঁধন ছিঁড়েসূর্যের মতো দীপ্ত হয়ে উঠেছিল। সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সে-প্রবাহ তখন খড়গের
মতো নির্ভয়। এই বিপুল প্রবাহকে কে রুখবে? দিকে দিকে তাই এখন তার জয়যাত্রা। এজয়যাত্রা মানুষের চিরকালের ইতিহাসে সূর্যের আলোয় লেখা হয়ে থাকবে। এই আলোয়উদ্ভাসিত হয়ে কবি-কণ্ঠেও ধ্বনিত হল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ; কবি
উচ্চারণ করলেন স্বাধীনতার সোনালি সম্ভাবনা
""ঐ দ্যাখো স্বাধীনতা জ্বলছে,
বিরুদ্ধ আক্রোশে বলছে
অনলা বই রণতূর্য""
(দিলওয়ার/স্বাধীনতা জ্বলছে))
দীর্ঘদিনের সংগ্রামের পর তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ষোলই ডিসেম্বরবাংলার স্বাধীনতার রক্তিম বালার্ক সবুজের পটুকে রাঙিয়ে হল উদিত; পূনর্জন্ম হল বাঙালি
জাতির--
""তোমাদের হাড়গুলো বাংলা হৃৎপিণ্ডে অবিনাশী ঝড়,
বাঙালির জন্মতিথি, রক্তে লেখা ষোলো ডিসেম্বর।
(মুহম্মদ নূরুল হুদা/ ‘বাঙালির জন্মতিথি)""
মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লক্ষ বীর শহীদের আত্মত্যাগের অম্লান স্মৃতি আমাদের প্রতিদিনেরচলার পাথেয়। প্রতিজন শহীদ আজ সমগ্র জাতির গৌরব-গর্ব আর অহঙ্কার; তাদেরআত্মবিসর্জন আমাদের সকলের উত্তরাধিকার। তাই কবিও ব্যক্তিগত শোককে সমগ্র জাতিরশোকে পরিণত করেন এবং এক সময় এই সর্বজনীন শোক বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের জন্যে
শক্তির উৎসে পরিণত হয়—
""কবিতায় আর নতুন কি লিখব
যখন বুকের রক্তে
লিখেছি একটি নাম
বাংলাদেশ।""
(মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান/ শহীদ স্মরণে')
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও যুদ্ধোত্তরকালে রচিত হয়েছেএকগুচ্ছ কবিতা, যে-কবিতার শরীরে ও মর্মে উৎকীর্ণ হয়ে আছে ঐ মহান মুক্তিসংগ্রামীরগৌরবগাথা। একাত্তরের সাতই মার্চে বাঙালির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার জন্যে বঙ্গবন্ধুর সেইশ্রদীপ্ত ঘোষণা কবির হাতে যুদ্ধোত্তর কালে পায় নতুন ব্যঞ্জনা
"""শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত
পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা।
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা
কে রোধে তাঁহার বস্তুকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা' শব্দটি আমাদের।
((নির্মলেন্দু গুণ! স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো'।))"""
মুক্তিযুদ্ধের আসন্ন বিজয় রুখে দেওয়ার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল প্রথম থেকেই
তৎপর। বাঙালির স্বাধিকার স্পৃহাকে নস্যাৎ করার জন্যে পাকিস্তানিদের তারা যুগিয়েছে
মদদ, আমাদের হত্যার জন্যে তারা দিয়েছে অস্ত্র আর গোলাবারুদ। একাত্তর সালে
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়-লগ্নে পাকিস্তানি বাহিনীর সাহায্যার্থে পেন্টাগন পাঠালো আণবিক
শক্তিচালিত নৌ-বহর। যুদ্ধোত্তরকালে কবি মার্কিনিদের এই ষড়যন্ত্র তুলে ধরলেন শব্দের
শৃঙ্খলে –
"""আমাকে হত্যার জন্য কী দারুণ ষড়যন্ত্র,
কী ঘৃণ্য আয়োজন, আমেরিকার গোপন বন্দরে!
একে-একে পাঁচটি জাহাজ এসে গর্তে তুলে
নিয়েছে সন্তান। ব্রজেন দাশের মতো দ্রুতগতি
এক একটি জাহাজ ব্রজেনের হত্যাকারী হতে
হিংস্র তিমির মতো ধেয়ে আসছে সমুদ্রের জলে।
(নির্মলেন্দু গুণ/ ‘নিক্সনের জাহাজ')"""
আবার আবুল হাসান এর কবিতায় বলেন--
""অনেক যুদ্ধ গেলো,
অনেক রক্ত গেলো
শিমুল তূলার মতো সোনারুপো ছড়ানো বাতাস।
শোকের')
(আবুল হাসান/ উচ্চারণগুলি শোকের))
বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ শুধু স্বদেশের কবিদেরই উদ্বুদ্ধ করেনি, তা পৃথিবীর অনেক মহত শীল্পির সংগ্রামের চেতনাও জাগ্রত করেছে।।।
তথ্যনির্দেশ
এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য আমাকে সরবরাহ করেছেন আবুল হাসানের জননী
মোসাম্মাৎ সালেহা বেগম। সাক্ষাৎকার গ্রহণ – ০২. ১০. ১৯৯০
“পাখী হয়ে যায় এই প্রাণ”, রফিকুল ইসলাম—–সম্পাদিত, আধুনিক কবিতা গ্রন্থে সঙ্কলিত।
দ্রষ্টব্য—‘আধুনিক কবিতা’, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭১ পৃ. ২৮৫-৮৬
খোন্দকার আশরাফ হোসেন : 'আবুল হাসান' : জয়শ্রী জীবনের সন্তু-কবি, সচিত্র সন্ধানী,
১৯ আগস্ট ১৯৯০, ঢাকা, পৃ. ৩৩-৩৪
আবুল হাসান : ‘অন্যরা যা বলে বলুক', দৈনিক জনপদ, ১০.০৬.১৯৭৩
আবুল হাসান : ‘আপন ছায়া', দৈনিক জনপদ, ০৪.০২.১৯৭৩
মুশাররফ করিম : “আবুল হাসানের কবিতায় মৃত্যুচিন্তা ও জীবনবোধ", দৈনিক বাংলা,
অগ্রহায়ণ ৮, ১৩৯৭
খোন্দকার আশরাফ হোসেন, আবুল হাসানের কবিতায় লোরমা অনুষঙ্গ', কবি ও কবিতা,
ফাল্গুন ১৩৯২, পৃ. ২৪-২৫
‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা', সম্পাদক : মুহম্মদ নূরুল হুদা ও অন্যান্য, ঢাকা, ১৯৮৬,
'।
0 মন্তব্যসমূহ