Hot Posts

6/recent/ticker-posts

মানসী কাব্য আলোচনা


--মানসী কাব্য আলোচনা 
মানসী
মানসী কাব্যের প্রেম ও সৌন্দর্য্যচেতনা
মানসী কাব্যের প্রকৃতি 
manoshi kabbo
Manoshi kabber prokriti
নিস্ফল কামনা কবিতা--

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 
মানসীতে প্রেম ও সৌন্দর্যচেতনা---

মানসী'তে রবীন্দ্র-কাব্য প্রতিভার পূর্ণ উদয় সংঘটিত হইয়াছে। এখন হইতে তাঁহার
কবি-কর্ম প্রকৃত শিল্পমর্যাদা লাভ করিয়াছে তাহার প্রকৃত কবি-শিল্পীর জীবন আরম্ভ
হইয়াছে। আত্মশক্তিতে তিনি দৃঢ়প্রতিষ্ঠ হইয়াছেন এবং সার্থক ও ধ্বনিসমৃদ্ধ শব্দ প্রয়োগে
এবং মনোমত ছন্দে তাঁহার ভাব ও কল্পনাকে রূপ দিতে সক্ষম হইয়াছেন। 'মানসী'
রবীন্দ্রনাথের প্রথম সার্থক কাব্য সৃষ্টি।
কবি এ সম্বন্ধে বলিয়াছেন,
"পূর্ববর্তী কড়ি ও কোমল-এর সঙ্গে এর বিশেষ মিল পাওয়া যাবে না। আমার রচনার
এই পূর্বেই যুক্ত-অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি। 'মানসী'তে হদের নানা খেয়াল দেখা দিতে আরম্ভ করেছি। কবির সঙ্গে একজন শিল্পী এসে যোগ দিল।
(রবীন্দ্র রচনাবলী, ২য় খন্ড, ভূমিকা)।
এই বিশ্বের অবারিত শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ তাঁহার হৃদয়-বেলায় অবিরামওরঙ্গাঘাত করিতেছে। এই আঘাতে তাঁহার প্রাণে বিচিত্র অনুভূতি ও ভাব জাগিতেছে। সেই
অনুভূতি ও ভাব যে বাণীরূপে গ্রহণ করিতেছে, তাহাই তাঁহার মানসী। বিশ্ব তাঁহার অন্দরেপ্রবেশ করিয়া তাঁহার অন্তরের ভাবে ও রূপে রূপায়িত হইয়া তাহার কাব্যে আত্মপ্রকাশ
করিতেছে। ভিতর ও বাহিরের মিলন হইয়াছে। এই ভিতর ও বাহিরের ব্যাকুলিত মিলন
মুহূর্তেই তাঁহার শ্রেষ্ঠ আনন্দমুহূর্ত -এই মিলনকে রূপায়িত করাতেই তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের
প্রকাশ হইয়াছে। তাঁহার এখন কাজ,

"""এ চির- জীবন তাই
আর কিছু কাজ নাই,
রচি শুধু অসীমের সীমা;
আশা দিয়ে ভাষা দিয়ে
তাহে ভালোবাসা দিয়ে
গড়ে তুলি মানসী প্রতিমা।"""

অসীম বিশ্ব তাঁহার কবি-চিত্ত স্পর্শ করিতেছে তাঁহার কবি-চিত্তও সেই বিশ্বের সব খণ্ড
সৌন্দর্যের রূপ দান করিয়া সীমা দ্বারা অসীমকে ব্যক্ত করিয়া চলিয়াছে। এইভাবেই কবি
অসীমের সীমারচনা করিয়া মানসী প্রতিমা গড়িয়া তুলিতেছেন। এইরূপেই চলিয়াছে কবির
সৃষ্টি-প্রবাহ। বিশেষের মধ্যে নির্বিশেষের লীলাই তাঁহার কবি-মানসের চিরন্তন সৃষ্টি-রহস্য।
‘কড়ি ও কোমল' কবি মানবজীবনের তীরে দাঁড়াইয়া তাহার দিকে স্থির দৃষ্টিতেতাকাইলেন। তরুণ চোখে নারী অপরূপ সৌন্দর্যে প্রতিভাত হইল। সেই নারী সৌন্দর্য ওপ্রেমের জয়গানে ‘কড়ি ও কোমল' মুখর। 'মানসী'তে সেই প্রেম বিভিন্ন ছন্দে ও রূপেউৎসারিত হইয়াছে। কবির মানস-প্রিয়ার প্রতি তাহার প্রেম নিবেদন ও প্রেমের সংশয়-সুখদুঃখ-হর্ষ-বিষাদময় বিচিত্র লীলাই 'মানসী'র প্রধান বিষয়বস্তু। প্রেমের বিচিত্র অভিজ্ঞতারমধ্যে কবি চিরন্তন সৌন্দর্য ও অনন্ত প্রেমের দিকে অগ্রসরহইতেছেন। কামনার সংকীর্ণতাও ক্ষণিকতা হইতে সৌন্দর্য ও প্রেমকে মুক্ত করিয়া একটি অপার্থিব ভাবস্তরে উন্নীত করিবার
জন্য একটা বেদনাময় ব্যাকুলতাই 'মানসী'র মূল সুর।

'কড়ি ও কোমল'-এর নারীর রূপ বর্ণনামূলক কবিতাগুচ্ছের মধ্যেই নারী-সৌন্দর্যের
প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আত্মপ্রকাশ করে। 'মানসী'তে প্রেম সম্বস্তে
রবীন্দ্রনাথের অনুভূতির সুস্পষ্ট প্রকাশ হইয়াছে। 'মানসী'কে সাধারণভাবে রবীন্দ্রন থেকে

প্রেমকাব্য বলা হয়।
সৌন্দর্যের উপলব্ধি হইতেছে রূপের রমণীয়তার অনির্বচনীয় উৎকর্যবোধ ও সেই
রমণীর রূপের প্রতি প্রবল আকর্ষণ হইতেছে প্রেম। সৌন্দর্য ও তাহার উপর আকর্ষণ প্রেমের
মধ্যে আমাদের intellect ও emotion বুদ্ধি ও অনুভব সমানভাবে ক্রিয়াশীল থাকে।
সৌন্দর্যের উপলব্ধি একটা নৈর্ব্যক্তিক মানস-ক্রিয়া বটে, কিন্তু সৌন্দর্যের আধারের প্রতি
আকর্ষণ ও মোহ হৃদয়-রাজত্বের সীমানায়, সুতরাং সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই
প্রেমানুভূতির সূত্রপাত হয়, — এই আবেগই রস। যাহা মুগ্ধ করে, যাহা হৃদয়কে অনির্বচনীয়
রসে আপ্লুত করে, তাহার প্রতি একটা অনিবার্য আবেগ উপস্থিত হওয়া, সৌন্দর্যের আধার
দেহকে কামনা করা, তাহার সান্নিধ্য আকাঙ্ক্ষা করা মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি। নারীর
সৌন্দর্যানুভূতির সঙ্গে প্রেমানুভূতির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ এবং প্রেমের মনস্তত্ত্বসম্মত পরিণতির জন্য
দেহ একান্ত প্রয়োজন। দেহই সৌন্দর্যের বাস্তব বিগ্রহ এবং দেহের চারিপাশ ঘিরিয়া হৃদয়ের
কামনা-বাসনার বিচিত্র রাগিণী গুঞ্জন করিয়া থাকে। প্রেম-মনস্তত্ত্বের ইহা একটি স্বীকৃত
সত্য।কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-কল্পনা ভিনস্তরের। বাস্তব জগৎ ও জীবনকে তাহাদের নিজস্ব
রূপ ও রসে গ্রহণ না করিয়া তাহাদের মধ্যে কবির মনোগত এক আদর্শ সৌন্দর্য আরোপ
করিয়া, ঐ জগৎ ও জীবন যতটুকু তাহার মানস—সৌন্দর্যের অনুগত, তাহাই মাত্র স্বীকার
করিয়া, তাহা হইতে এক অপার্থিব সৌন্দর্যধ্যানের ভাবজগৎ সৃষ্টি করা রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য।
এই অতীন্দ্রিয় মনোবিলাস বা ভাববিলাসমূলক যে সৌন্দর্যবোধ, জগৎ ও জীবনকে তাহারই
অধীন করিয়া তাহা হইতে এক অপার্থিব রসের উৎসারণই রবীন্দ্রকাব্যের প্রধান সুর।
রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-চেতনা বিশেষভাবে নারীরূপের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে।
'কড়ি ও কোমল'-এ কবি নারীর দেহ-সৌন্দর্যের যে উদাত্ত স্রোত্রপাঠ করিয়াছেন, তাহারমধ্যে দেহ-সম্ভোগের আকাঙ্ক্ষা বা বাস্তব রূপতন্ময়তার উল্লাস নাই। এই রূপের মধ্যে যেএক অপার্থিব সৌন্দর্য আছে, কবির দৃষ্টি তাহারই প্রতিআকৃষ্ট হইয়াছে। স্থলকে অবলম্বন
করিয়াই তিনি সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয়ের কামনা করিয়াছেন, দেহসীমাতেই দে অতীত সুন্দরকে
ধরিবার প্রয়াস করিয়াছেন। এই অপার্থিব রূপের তৃষ্ণা, এই সৌন্দর্যকাঙ্ক্ষা, এই ভাবময়
সৌন্দর্য-সাধনা হইতে তাঁহার প্রেমানুভূতির উদ্ভব হইয়াছে, সুতরাং এই প্রেমেও এক অতিসূক্ষ্ম মানসিক পিপাসা-এক ভাবময় আকুতি। এই প্রেম দেহসম্বন্ধ বিচ্যুত, নর-নারীর বাস্তবভোগ্যকাঙ্কার ঊর্ধ্বে এক অনিবর্ণীয় আনন্দরস।
মানসী কাব্যে এই প্রেমের স্বরূপ অভিব্যক্ত হইয়াছে। যে-প্রেম বুভুক্ষিত দৃষ্টিতে দেহেরচারিপাশে ঘুরিয়া মরে, ব্যক্তি মানুষের বাস্তব দেহ-মন যাহার ভিত্তি, সেই আকোময়,
আত্মহারা, সাধারণ মানুষের প্রেম রবীন্দ্রনাথের প্রেম নয়। মানসীর 'নিষ্ফল কামনা'কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ-কল্পিত প্রেমের রূপটি সম্পূর্ণভাবে উদ্ঘাটিত হইয়াছে। প্রেম অসীম,অনন্তের ধন, আত্মার সম্পদ, দেহের সীমায় তাহাকে ধরা যায় না। প্রেমপাত্রী নারীর নয়ন
হইতে ‘আত্মার রহস্যশিখা'র বিচ্ছুরণ দেখা যায়। সেই ‘অমৃত’, সেই স্বর্গের অসীম রহস্যকে
কবি দেহের মধ্যে খুঁজিয়া না পাইয়া অতৃপ্ত আকাঙ্খার বেদনায় অস্থির হইতেছেন। সেইঅসীম অনির্বচনীয় প্রেম-ধনের অধিকারী যে নারী, তাহাকে তো দেহের মধ্যে পাওয়া যায়না, তা কবি ‘সমগ্র মানব'কে পাইতে চাওয়া দুঃসাহস বলিয়া মনে করিতেছেন। 'ক্ষুধামিটাইবার খাদ্য নহে যে মানব’-অনির্বচনীয় সৌন্দর্য বিকাশ করিয়া প্রস্ফুটিত পদ্মের মতোতাহাকেসে ফুটিয়া উঠিয়াছে বিশ্বের আনন্দবর্ধনের আর ভগবানের মহিমা প্রচারের জন্য,
নিজের ভোগলিপ্সা চরিতার্থ করিতে 'বাসনা-ছুরি' দিয়া কাটিয়া উঠাইয়া লওয়া কি সম্ভব?
তাই কবি বলিতেছেন,

"""লও তার মধুর সৌরভ,
দেখো তার সৌন্দর্য বিকাশ,
মধু তার করো তুমি পান,
ভালোবাসা, প্রেমে হও বলী...
চেয়োনা তাহারে।
আকাঙ্ক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।"""

সুতরাং “নিভাও বাসনাবহ্নি নয়নের নীরে। প্রেম দেহসম্বন্ধ বিরহিত, অপার্থিব
সৌন্দর্যের নিবিড় অনুভূতি এক অনির্বচনীয় আনন্দরস। এই রসে সিঞ্চিত করিয়া বিমুগ্ধশিল্পীর মতো তিনি প্রেমকে আস্বাদন করিয়াছেন। কবির মানসী দেহ সম্বন্ধের ঊর্ধ্বগতি একচিরন্তন সৌন্দর্যময়ী নারী-যাহার অধিষ্ঠান তাহার চিত্তলোকে, যাহাকে তিনি মানবীর মধ্যে
পাইবার জন্য বারবার আকাঙ্ক্ষা করিয়া ব্যর্থমনোরথ ও হতাশ হইয়াছেন। 'মানসী'তে পূর্ণযুবক কবির মধ্যে বাস্তব রূপ-রসের অতিপ্রবল আকর্ষণ এবং বাস্তবার্তীত সৌন্দর্য-প্রেমেরজন্য তীব্র আকাঙ্খা-এই দুয়ের দ্বন্দ্ব দেখা যায়। বাস্তব কামনা-বাসনার সংকীর্ণতা হইতেপ্রেমকে মুক্ত করিবার জন্য একটা বেদনাময় ব্যাকুলতা প্রকাশ পাইয়াছে 'মানসী'র মধ্যে।এই 'সুখ-দুঃখ-বিরহ মিলনপূর্ণ ভালোবাসা' ও 'সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষা' উভয়েইসমানভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে পরবর্তী গ্রন্থ 'সোনার তরী' ও 'চিত্রা'য়। বস্তুনিরপেক্ষসৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্খা ও ধ্যান মানসী অপেক্ষা বহুল পরিমাণে গভীরতর, ব্যাপকতর
ও বৈচিত্র্যমন্ডিত হইয়াছে এ দুই গ্রন্থে।রবীন্দ্রনাথ প্রেম কল্পনায় দেহের ঊর্ধ্বচারী বলিয়া তাহার প্রেমকবিতা মিলনের আবেগউত্তেজনা-চাঞ্চল্য প্রকাশ অপেক্ষা স্থির ও স্নিগ্ধ-মধুর জ্যোতি বিকীর্ণ করিতেছে। বিরহে
তাহার মানসী প্রতিমাকে বিশ্বব্যাপিনী করিযা কবি তাহার উদ্দেশ্যে হৃদয়ের সমস্ত আর্তি
প্রকাশ করিয়াছেন এবং হৃদয়ের বহু-বিচিত্র প্রেমানুভূতির অর্থ নেই অপ্রত্যক্ষ হৃদয়বাসিনীকেপ্রদান করিয়াছেন। বিরহেই কবির প্রেমানুভূতির চরম আনন্দ প্রকাশ পাইয়াছে। দেহধর্মেরদ্বারা আবদ্ধ প্রেম সীমাবদ্ধ, সংকীর্ণ, বাস্তব কামনার দ্বারা পঞ্চিল; দেহসম্বন্ধ যেখানে নাই,
সেখানেই প্রেমের মুক্তি, প্রেমের সর্বজনীনত্ব, প্রেমের দেশকাল পাত্রনিরপেক্ষ সর্বজনীন রূপ।
এই প্রেম অনস্তের সামগ্রী এবং বিরহেই তাহার স্ফূর্তি। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের পরিভাষায়
রবীন্দ্রনাথ বিপ্রলব্ধ শৃঙ্গারের কবি।
'মানসী'র পর রবীন্দ্রকাব্যে প্রেমের আর এক রূপ দেখি 'মহুয়া'য় প্রেমের অনুভূতি কবি
চিত্তের স্বভাবজাত বৃত্তি। চিত্তের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঐ অনুভূতি নানারূপে পরিবর্তিত
হয়। প্রথম যৌবনের প্রেমানুভূতি ও প্রেমের কল্পনা পূর্ণ-যৌবনে বদলায়, যৌবনের অনুভূতি
প্রৌচত্ব, প্রৌঢ়ত্বের অনুভূতি বার্ধক্যে বদলায়। এই বিভিন্ন স্তরের অনুভুতির মধ্যে একটা
যোগসূত্র থাকিলেও, রূপ হয় বিভিন্ন মহুয়ার প্রেমানুভূতি, রবীন্দ্র-সোনার তরী-চিত্রা বা
ঋণিকার অনুভূতি নয়, 'পূরবী'র অনুভুতিও নয়। রবীন্দ্র-কাব্যে প্রেম চিরকালই দেহ-মনের
আকাঙ্ক্ষা
কামনার ঊর্ধ্বে একটা ভাবময় প্রেরণা যৌনাকর্ষণ বর্জিত, দেহমন নিরপেক্ষ
একটা ভাব-সাধনা মাত্র। তাঁহার প্রেম কবিতায় উৎকৃষ্ট কাব্য, সঙ্গীত ও ব্যঞ্জনার অপরূপ
লীলা থাকিলেও দেহ-সৌন্দর্যের যে নিবিড় আকর্ষণ প্রাণের সমস্ত তন্ত্রীকে ঝংকার তুলিয়া
উন্মুক্ত রাগিণীর সৃষ্টি করে, ‘প্রতি অঙ্গ তরে প্রতি অঙ্গ কাঁদে, যে-চরম কামনা দেহকেই স্বর্গ
বলিয়া মনে করে ও এই জড় দেহকেই চিরন্তনত্ব দান করে, লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাকুন,
তবু হিয়া জুড়ন না গেল' বলিয়া অতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, যে আকাঙ্খা দেহ ও মনকে
ঘিরিয়াই তাহার সার্থকতার স্বপ্ন রচনা করে, দেহ ও মনের সমস্ত লীলা ও অভিব্যক্তির মধ্যে
পায় চরম আনন্দ ও রহস্যের সন্ধ্যান, সেই নর-নারীর পরস্পর আকর্ষণ, কামনা-আকাঙ্ক্ষার
সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত মনোহর প্রকাশ তাহাতেই নাই। ইহা 'ক্ষণিকা' পর্যন্ত প্রেম-কবিতায়
লক্ষ্য করা গিয়াছে।

বার্ধক্যে আধ্যাত্মিক ও নানা তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ভাব-চিন্তার মধ্য দিয়া অতিক্রম করিয়া
আসিয়া কবি আবার যে-প্রেমের কবিতা লিখিয়াছেন তাহাতে প্রেমের একটা ভিন্নরূপ আমরা
দেখিতে পাই। এই প্রেমে কিছু বাস্তবতার স্পর্শ থাকিলেও ইহা দেহমনের ঊর্ধ্বস্তরের; ইহা
প্রেমের অন্তর্নিহিত স্বরূপ, মানব জীবনে প্রেমের প্রভাব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা প্রেমের
জয়ঘোষণা। ইহা জীবনাশ্রয়ী প্রেমের তত্ত্ব ও দর্শনের অপূর্ব কাব্যরূপ।

‘মহুয়া'য় প্রেমের ভাব-কল্পনার নূতন রূপ হইতেছে—কবি প্রেমকে দেখিয়াছেন এক
মহাশক্তিরূপে। এই প্রেম অমিতবীর্যশালী, বলিষ্ঠ পৌরুষের উপর দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত এবং ত্যাগও তপস্যার হোমাগ্নিপূত। জীবনপথে এই প্রেম সমস্ত বাধা-বিপত্তিতে পদদলিত করে,
প্রেমিক-প্রেমিকাকে নির্ভয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে অগ্রসর হইবার শক্তি দান করে। এই যুগল-প্রেমপ্রেমিকাকে নির্ভয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে অগ্রসর হইবার শক্তি দান করে। এই যুগল প্রেমবাস্তবজীবনের সঙ্গে নিগূঢ় সম্বন্ধযুক্ত, রূঢ় জীবনবোধে উদ্দীপ্ত, সংগ্রামশীল এবং পতনঅভ্যুদয় বন্ধুর পন্থায় আলোক বর্তিকা। এই প্রেমবন্ধন নয়, চলার পথের একমাত্র পাথেয়।নারী আত্মার সঙ্গিনী—বিলাসের নমসহচরী নয়। মহুয়ায় প্রেমিক প্রেমিকাকে বলিতেছে—

""পঞ্চশরের বেদনামাধুরী দিয়ে
বাসররাত্রি রচিব না মোরা প্রিয়ে...
উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান
দুর্গম পথ-মাঝে
দুর্গম বেগে, দুঃসহতম কাজে।
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই-তো পাব,
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।""
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি,
ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব
তুমি আছ, আমি আছি।"""

এই প্রেম আত্মকেন্দ্রিকতা ত্যাগ করিয়া বিশ্বচেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। ইহা
আধ্যাত্মদীপ্তিমন্ডিত, বিশ্বের প্রাণধারার সঙ্গে ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ যে চিরযৌবন, তাহারই
উদাত্ত বাণী।রবীন্দ্রনাথ দুঃখ-বেদনার দ্বারা পরিশুদ্ধ, ত্যাগ-তপস্যাকর্ষিত, কেবলমাত্র জৈবপ্রেরণার
গন্ডিতে অনাবদ্ধ, সংসারের নর-নারীর এই প্রেমকে অতি-উচ্চ স্থান দিয়াছেন। তিনি
কালিদাসের 'কুমারসম্ভব' ও 'শকুন্তলা'র মধ্যে এই প্রেমের রূপ দেখিয়াছেন। ইহাই
কালিদাসের প্রেমাদর্শ। প্রেম কেবল আদিম প্রবৃত্তির প্রেরণা নয়, দেহগত রূপের প্রতি
আকর্ষণ নয়, ইহা দুঃখের তপস্যার দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের
সহায়ক, এক মঙ্গলময়, কল্যাণময় সত্যের অনুভূতি। রবীন্দ্রনাথ তাহার এই প্রেম কল্পনায়ভোগতান্ত্রিকতাকে বর্জন করিয়াছেন, দেহকেই একান্তভাবেগ্রহণ করেন নাই, দেহ ওআত্মার, সীমা ও অসীমের বাস্তব ও আদর্শের মিলন-সাধনের চেষ্টা করিয়াছেন। কবি নর
নারীর এই কল্যাণময় প্রেম সম্বন্ধে বলিয়াছেন—
নারীর প্রেমে পুরুষকে পূর্ণশক্তিতে জাগ্রত করিতে পারে, কিন্তু সে প্রেম যদি শুক্লপক্ষের
না হয়ে কৃষ্ণপক্ষের হয় তবে তার মালিন্যের আর তুলনা নেই। পুরুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ
তপস্যার নারীর প্রেমে ত্যাগধর্ম সেবাধর্ম সেই তপস্যারই সুরে সুর মেলানো, এই দুয়ের
যৌগে পরস্পরের দীপ্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নারীর প্রেমে আর এক সুরও বাজতে পারে
মদনধনুর জ্যায়ের টংকার-সে মুক্তি সুর না, বন্ধনের সঙ্গীত। তাতে তপস্যা ভাঙে, শিবের
ক্রোধানল উদ্দীপ্ত হয়।' –(পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরি)।

রবীন্দ্রনাথ সুরুচি, সংযম ও শালীনতার একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। দেহ-লালসা
সাহিত্যে সংযমের সীমা অতিক্রম করিয়া বীভৎস আকার ধারণ করিতে পারে বলিয়া তাহার
আশঙ্কা ছিল। সেজন্যও কবি প্রেমে দেহ-সান্নিধ্য কামনা করেন নাই। এ সম্বন্ধে তাহার
নিম্নলিখিত উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য—
সাহিত্যে লালসা জিনিসটা অত্যন্ত সস্তা-ধুলোর উপরে শুয়ে পড়ার মন্ত্রেই সহসসাধ্য।পাঠকের মনে এই আদিম প্রবৃত্তির উত্তেজনার সঞ্চার অতি অল্পেই হয়।...... মানুষের শরীর
ঘেঁষা যে-সব সংস্কার, জীবন-সৃষ্টির ইতিহাসে সেগুলো অনেক পুরানো প্রথম অধ্যায় থেকেইতাদের আরম্ভ। একটু ছুঁতে না ছুঁতেই তারা ঝন্‌ঝনে করে বেজে ওঠে। 'মেঘনাদবধের নরকবর্ণনায় বীভৎস রসের অবতারণা উপলক্ষ্যে মাইকেল এক জায়গায় বর্ণনা করেছেন, নারকী
ৰমন করে উদগীর্ণ পদার্থ আবার খাচ্ছে-এ বর্ণনায় পাঠকের মনে ঘৃণা সঞ্চার করতেকবিশক্তির প্রয়োজন করে না, কিন্তু আমাদের মানসিকতার মধ্যে যে-সব ঘৃণ্যতার মূলতারপ্রতি ঘৃণা জাগিয়ে তুলতে কল্পনাশক্তির দরকার। ঘৃণাবৃত্তির প্রকাশটা সাহিত্যে স্থান
পাবে না, একথা বলবো না, কিন্তু সেটা যদি একান্তই দৈহিক সপ্তা জিনিস হয়, তাহলে আকে
অবজ্ঞা করার অভ্যাসটাকে নষ্ট না করলেই ভালো হয়।' –(সাহিত্যের পথে)
কয়্যোল যুগের লেখকেরা আধুনিক রিয়ালিজিমের নামে দেহ-ভোগের যে চূড়ান্ত অতীদ
চিত্র আঁকিতেছিল, সে সম্বন্ধেও কবি সুচিন্বিত মন্তব্য করিয়াছেন......

সম্প্রতি আমাদের সাহিত্যে বিদেশের আমদানি যে একটা আত
সেটাকেও কেউ কেউ মনে করেছেন নিত্য পদার্থ; ভুলে যান, যা নিত্য অসম্পূর্ণ
প্রতিবাদ করে না। মানুষের রসবোধে যে আক্রতা আছে সেইটেই নিত্য, সে-আ
আছে, রসের ক্ষেত্রে সেইটেই নিত্য। এখনকার বিজ্ঞানমত ডিমোক্রেসি তাল ঠুকে বলছে,
ঐ আক্রটাই দৌর্বল্য, নির্বিকার অলজ্জতাই আর্টের পৌরুষ।

এই ল্যাঙ্কটা-পরা গুলি পাকানো ধুলোমাখা আধুনিকতারই একটা স্বদেশী দৃষ্টান্ত
দেখেছি হোলিখেলার দিকে চিৎপুর রোডে। সেই খেলায় আবীর নেই গুলাল নেই, চির
নেই, গান নেই, লম্বা লম্বা ভিজে কাপড়ের টুকরো দিয়ে রাস্তার ধুলোকে পাঁক করে তুলে
তাই চীৎকার শব্দে পরস্পরের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাগলামি করাকেই বসন্ত উৎসব বলে
গণ্য করেছে। পরস্পরকে মলিন করাই তার লক্ষ্য, রঙিন করা । মাঝে মাঝে এই
অবারিত মালিন্যের উন্মত্ততা মানুষের মনস্তত্ত্বে মেলে না এমন কথা বলি নে। অব
সাইকোনোলিসিসে এর কার্য-কারণ বহুযত্নে বিচার্য। কিন্তু মানুষের রসবোধই যে উৎসবের
মূল প্রেরণা সেখানে যদি সাধারণ মলিনতায় সকল মানুষকে কলঙ্কিত করাকেই আনন্দ প্রকাশ
বলা হয়, তবে সেই বর্বরতার মনস্তত্ত্বকে এক্ষেত্রে অসঙ্গত বলেই আপত্তি করব, অসত্য বলে
নয়।

–(সাহিত্যের পথে)
রবীন্দ্রকাব্যে প্রেমের আলোচনার রবীন্দ্রনাথের এই দেহে-বিতৃষ্ণা তাঁহার জীবদ্দশাতেইকি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিয়াছিল তাহার একটু সংক্ষিপ্ত উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হইবে বলিয়া মনে হয়।রবীন্দ্রনাথের এই দেহাহীত ও অতিন্দ্রীয় প্রেমের বিরুদ্ধে মোহিতলাল মজুমদার তাহার
কবি-কন্ঠের স্পষ্ট প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। মোহিতলাল বলিলেন, দেহ ছাড়া আত্মার কোনো
স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, দেহদ্বারাই আত্মাকে উপলব্ধি করা যায়। মোহিতলালের এই দেহাত্মবাদ
কিন্তু নাস্তিকের অনাত্মবাদ নয়। কবির মতে আত্মা অমৃত বটে, কিন্তু তাহা এই দেহভান্ডারে
প্রতি অণুপরমাণু ব্যাপ্ত করিয়া এবং পূর্ণ করিয়া আছে।

""""দেহের মাঝে আত্মা রাজে—ভুল সে কথা, হয় প্রমাণ;
আত্মা-দেহ ভিন্ন কেহ হয় যে কভু-এক সমান!
তাইত তোমার দেহের সীমায় ধরতে পারি আলিঙ্গনে
দুই–এর ক্ষুধা একের সুধা কেবল ত সেই পরম—ক্ষণে""!

এই দেহাত্মবাদ প্রেমকে বাস্তব জীবনের মধ্যে, নর-নারীর দেহ-মিলনের সঙ্গেএকান্তভাবে যুক্ত করিয়াছে। জীবনের সমস্ত আনন্দ দেহকেই কেন্দ্র করিয়া বিকশিত এবং
দেহ-মিলনের মধ্যেই প্রেম পৃথিবীকে অমৃতময় করিয়া তোলে, জীবনের বৃহত্তর সত্যেরঅভ্যাস দেয়। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনেও মানুষের অবাধ আনন্দের অধিকার আছে।
মানবজীবনের মত-সহস্র দুঃখ-জ্বালা সত্ত্বেও কবি মোক্ষ কামনা করেন না-পুনর্জন্ম নিরাধ
করিতে চাহেন না; বার বার সংসারে ঘুরিয়া আসিয়া এই জীবনের নব নব রূপ ও রস-নবনব আনন্দ-বেদনা উপভোগ করিতে চাহেন :
জীবনের সুখ-দুঃখ বারবার ভুঞ্জিতে বাসনা
অমৃত করে না লুব্ধ, মরণেরে বাসি আমি ভালো।
যাতনার হাহারবে গান গাই,–তৃষ্ণার্ত রসনা
বলে, 'বন্ধু! উগ্র ওই সোমরস ঢালো, আরো ঢালো।
তাই আমি রমণীর জায়ারূপ করি উপাসনা
এই চোখে আরবার না নিবিতে গোধূলির আলো,
আমারি নূতন দেহে, ওগো সখি, জীবনের দীপখানি জ্বালো।এই বলিষ্ঠ জীবনবাদ ও সুস্থ দেহকামনা মোহিতলালের কাব্যে ক্লাসিক্যাল প্রকাশভঙ্গির
সংযম ও ভাস্কর্যরীতির দৃঢ় সংহতির সঙ্গে প্রকাশলাভ করিয়াছে।মোহিতলালের দেহবাদে যে-সংযম, যে-মননশীলতা ও সৌন্দর্যবোধ ছিল,
পরবর্তীকালে কল্লোলযুগ-প্রভাবিত বুদ্ধদেব বসুর প্রেম কবিতার তাহার অভাব দেখা যায়।
রোমান্টিক প্রেমকে উভয় কবিই প্রতিবাদ করিয়াছেন, কিন্তু বুদ্ধদেবের কবিতায় দেহ
কামনার উগ্রতা এবং বিরংসার আবেগময় রূপটি উজ্জ্বলভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। ইংরেজ কবি
ডি. এইচ লরেন্সের প্রভাব বুদ্ধদেবের উপর বেশি। বুদ্ধদেবের অনেক প্রেম কবিতায়লরেন্সের সুস্পষ্ট প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। তাহার কবিতায়দেহ-কামনার এই আবেগময়উচ্ছাস, লরেন্সের অনুপ্রেরণা বলিয়া মনে হয়।
বুদ্ধদেব প্রেমের দেহাতীত রূপ কল্পনা করিতে পারেন না। প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য
কারাগারে চিরন্তন বন্দী' যে-মানুষ, দেহগত পীড়নে যে উদ্ভ্রান্ত, তাহার কাছে অতীন্দ্রিয়
সৌন্দর্য-প্রেমের কোনো অর্থ নাই :

""বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন,
দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।
রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষবর্ষ-উপবাসী শৃঙ্গার কামনা
রমণী-রমণ-রণে পরাজয়-ভিক্ষা মাগে নিতি,
‘আনন্দনন্দিত দেহে কামনার কুৎসিত দংশনে'""

 কবি বিপর্যস্ত তাহার কাছে যৌবন আমার
অভিশাপ। যৌবন দেহকে অস্বীকার করিতে পারে না, দেহসঞ্জাত কামনা-বাসনাকেও লুপ্ত
করিতে পারে না। কবি মানুষের এই সহজাত দুর্বলতা লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন,—আসঙ্গ
বাসনা পঙ্গু আমি সেই নির্লজ্জ কামুক'। বুদ্ধদেবের মধ্যে যৌন কামনার তাড়না, আদিম
প্রবৃত্তির এই দুর্দমনীয় আবেগের সঙ্গে ডি. এইচ. লরেন্সের এই কবিতাটি তুলনীয়—

But then came another hunger
Very deep,and ravening;
The very body's body crying out
With a hunger more frightening, more profound
Than stomach or throst even the mind;
Roedder than death, more clamorous,
The hunger for the woman. Alas!

It is so deep a Moloch ruthless and strong,
Tis like the untterable name of the dread Lord.
Not to be spoken aloud.
Yet there it is, the hunger which comes upon us,

Which we must learn to satisfy with pure, real satisfaction:

Or perish, there is no alternative.
মোহিতলালের মতো বুদ্ধদেবও এই দেহের মধ্যেই অমৃতকে
চাহিয়াছেন, দেহকে অবলম্বন করিয়াই দেহাতীতের সন্ধান করিয়াছেন:

আহ্বান করিতে

... এই দেহ-যূপ দহি উঠিয়াছে কামনার ধুম,
তাহারি সুগন্ধে মোর স্নায়ুতন্ত্রী শিহরিত। সেই মোর কলঙ্ক-কুসুম।

পবিত্র বলিয়া এই নরদেহে করেছি স্বীকার
দেহস্পর্শে উচ্ছ্বসিছে অমৃত আত্মার;

লরেন্সের ঐ কবিতাটির মধ্যেও এইরূপ ভাবের প্রকাশ দেখা যায়।

Immortality, the heaven, is only a projection of this strange

but actual fulfilment
here in the flesh.

(১) প্রিয়ার সহিত কবির নিবিড় মিলন হইয়াছিল। একদিন উভয়েরই দেহ ওউভয়ের জন্য অসীম প্রেম ব্যক্ত করিয়াছিল। তাহাদের জগৎ ছিল সুন্দর জীবন ছিল মধুর।
কিন্তু সে প্রেম এখন বিস্তৃতপ্রায়-উভয়ের মধ্যে আজ একটা ব্যবধান রচিত হইয়াছে। তবুওসে প্রেমের স্মৃতির আজ মন হইতে লুপ্ত হয় নাই। তাহার—

""শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি,
লাজে বাধ্যে-বাধ্যে সোহাগের বাণী,
মনে পড়ে সেই হৃদয়-উচ্ছ্বাস
এই প্রিয়া-শূন্য জীবন বড় বেদনাদায়ক-সঙ্গীহীন জীবন দুর্বিষহ। তিনি ভাবিতেছেন,
নয়ন-কুলে। –(ভুলে)"""

""এমন করিয়া কেমনে কাটিবে
মাধবী রাতি?
দখিনে বাতাসে কেহ নেই পাশে
সাথের সাথী।""

তিনি মনে করিয়াছিলেন যে তাহাদের প্রেম হইবে চিরস্থায়ী-জীবন চিরদিনের মতোঅফুরন্ত সুধায় ভরিয়া উঠিবে। কিন্তু যে উন্মাদনা, যে আবেগ, যে মাদকতা জীবনকে গ্রাস
করিয়াছিল, তাহা প্রায় নিঃশেষ হইয়াছে—কেবল স্মৃতিটুকু অবশিষ্ট আছে। তিনি

বলিতেছেন --

""বুঝেছি আমার নিশার স্বপন
হয়েছে ভোর!
মালা ছিল তার ফুলগুলি গেছে,
রয়েছে ডোর।—(ভুল ভাঙা)""

প্রেমের সর্বজয়ী আহ্বানে প্রিয়ার সহিত তিনি মিলিত হইয়াছিলেন, কিন্তু মিলনে তিনি
যেই সুলভ ও সাধারণ হইয়া গেলেন, অমনি প্রেমের অনির্বচনীয়ত্ব ও মাধুর্য কপুরের মতো

উবিয়া গেল—

"""এখন কেবল চরণে শিকল
কঠিন ফাঁসি।
রহিয়াছে, এখন—
প্রেম গেছে, শুধু আছে প্রাণপণ
মিছে আদর।"""

কবি সেই লোক—দেখানো, প্রাণহীন আদরের দ্বারা নিজেকে ও তাঁহার প্রিয়াকে
অপমান করিতে চাহেন না, তাই বিদায় লইলেন। কবি তাহার মানস-প্রিয়ার সহিত ক্ষণ–

""মিলনের সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলেন। সে প্রিয়া
একদা এলোচুলে কোন তুলে ভুলিয়া
আসিল সে আমার ভাঙা খুলিয়া।
জ্যোৎস্না অনিমিখ, চারিদিক সুবিজন,
চাহিল একবার আঁখি তার তুলিয়া। – (ক্ষণিক মিলন)
)"""

তারপর বিরহে কবি প্রিয়ার ধ্যানে আত্মাহারা হইয়াছিলেন—

"""বিরহে তারি নাম শুনিতাম পবনে,
তাহারি সাথে থাকা মেঘে ঢাকা ভবনে।
পাতার মরমর কলেবর হরষে,"""

তখন ছিল—'ত্রিভুবনমণি তন্ময়ং বিরহে।' কবি বিরহের স্বপ্নলোকে প্রিয়ার মূর্তি রচনা
করিয়া পূজা করিতেছিলেন। কিন্তু সংসারে বাস্তব-প্রিয়ার সম্মুখীন হইয়া তাহার স্বপ্ন রূঢ়ভাবে
ভাঙিয়া গেল :

""বিরহ সুমধুর হলো দূর কেন রে?
মিলন দাবানলে গেল জ্ব'লে যেন রে।
কই সে দেবী কই, হেরো ওই একাকার,
শ্মশান-বিলাসনী বিবাসিনী বিহরে।""

হৃদয় হইতে প্রেম নিঃশেষ হইল। মানস-প্রিয়ার স্বপ্নমূর্তি ভাঙিয়া গেল। কবির হৃদয়বিরাগ—ভরা বিবেকে পূর্ণ। এই শূন্য হৃদয়ে আবার প্রেমের আকাঙ্খা জাগিয়াছে। প্রেমই যে
কবিচিত্তের সঞ্জবনী শক্তি। কবি প্রেমের সেই মধুরউন্মাদনা আবার অনুভব করিতে
চাহিতেছেন,

""আবার প্রাণে নুতন টানে
প্রেমের নদী
বহায় যদি।
আবার দুটি নয়নে লুটি
হৃদয় হরে নিবে কে?
আবার মোরে পাগল করে
পাষাণ হতে উছল-স্রোতে
দিবে কে?
(শূন্য হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষ)""

কবি জোর করিয়া প্রেম ও প্রিয়াকে হৃদয় হইতে নির্বাসন দিলেও, তিনি যে তাদেরভুলিতে পারিতেছেন না। তাহার মানস-প্রিয়া সারা বিশ্ব জুড়িয়া আছে। তিনি দূরে থাকেন
না যতই ভুলিতে চেষ্টা করুন, হৃদয়-অন্তঃপুরে তাহার মানসীর আসন-চরিতরে প্রতিষ্ঠিতহইয়াছে। তিনি যাহা বুঝিতে পারিয়া অকপটে তাহার হৃদয়ের দুর্বলতা স্বীকার
করিতেছেন

"""তবে লুকাবো না আমি আর
এই ব্যথিত হৃদয়ভার।
আপনার হাতে চাব না রাখিতে
আপনার অধিকার।
বাঁচিলাম প্রাণে তেয়াগিযা লাজ,
বদ্ধ বেদনা ছাড়া পেল আজ,
আশা-নিরাশায় তোমারি যে আমি
জানাইনু শতবার। -(আত্মসমর্পণ)"""

কবি আত্মসমর্পণ করিয়া তাহার প্রেম ব্যক্ত করিলেন বটে, কিন্তু যৌবনের সমস্ত আশাআকাঙ্ক্ষা-কামনার সিন্ধু মথিত করিয়া যে মানসী কবি-চিত্তে আবির্ভূতা হইয়াছে, যাহাকে
কেন্দ্র করিয়া কবি-হৃদয়ের উজ্জ্বল প্রেমধারা উৎসারিত হইতেছে, তাহাকে তিনি পরিপূর্ণরূপেপাইতেছেন না। প্রণয়িনীর দ্বারা তাহার সৌন্দর্যক্ষুধা, প্রেম-ক্ষুধা কিছুতেই মিটিতেছে না।কবি প্রিয়ার মধ্যে তাহার আকাঙ্খিত সৌন্দর্য ও প্রেমের মূর্তিবর্তী মানসীকে পাইতেছে না।
তাই তাহার ব্যাকুল অন্বেষণ –

"""দুটি হাতে হাত দিয়ে ক্ষুধার্ত নয়নে
চেয়ে আছি দুটি আঁখি নয়নে
খুঁজিতেছে, কোথা তুমি,
কোথা ভূমি।
যে অমৃত লুকানো তোমার
সে কোথায়।
অন্ধকার সন্ধ্যার আকাশে
বিজন তারার মাঝে কাঁপিছে যেমন
স্বর্গের আলোকময় রহস্য অসীম,
ওই নয়নের
নিবিড় তিমিরতলে কাঁপিছে তেমনি
আত্মার রহস্যশিখা।
–(নিষ্ফল কামনা)"""

কবি প্রণয়িনীর দেহের মধ্যে তাহাকে খুঁজিয়া পাইতেছে না—তাই তাহার নয়নে
বিচ্ছুরিত আত্মার রহস্য-শিখার আলোকে তাহাকে সম্পূর্ণ চিনিতে চাহিতেছেন। সৌন্দর্য ও
প্রেম-উভয়েই অনন্ত, অসীম। খন্ডিত করিয়া নিজের প্রয়োজনের উপযোগী করিয়া পাইতে
হইলে তাহাদিগকে পাওয়া যায় না। প্রেমিক অনন্ত প্রেমের নিকট জীবনের উৎসর্গ করে ও
প্রেমিকাকে অনন্ত বলিয়া অনুভব করে। প্রেমিকার অনস্ত মহার আহাস পাওয়া যায় মাত্র,
তাহাকে সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায় না

সমগ্র মানব তুই পেতে চাস,

এ কী দুঃসাহস!

কী আছে বা তোর
কী পারবি দিতে।

সেই অনন্ত জীবনকে পাইতে হইলে অনন্ত প্রেম আরণ্যক মানুষের অনন্ত অভাব
মিটাইতে হইলে অনন্ত প্রেমের প্রয়োজন।

আছে কি অনন্ত প্রেম?
পারবি মিটাতে

জীবনের অনন্ত অভাব?

কিন্তু মানুষ নিজেই বন্ধ, দুর্বল, অন্ধ-নিজের দুঃখ-বেদনা-অভাবের ভারে জর্জরিত
সে কাহারে পেতে চায় চিরদিন তরে।

মানুষের ভোগ-লালসা নিবৃত্তির জন্য মানুষ সৃষ্ট হয় নাই। সৌন্দর্য ও প্রেমে

""ভোগতৃপ্তির জন্য নারী সৃষ্ট হয় নাই।
ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব,
কেহ নহে তোমার আমার।
অতি সযতনে,
অতি সঙ্গোপনে,
সুখে, দুঃখে, নিশীথে দিবসে,
বিপদে সম্পদে,
জীবনে, মরণে,
শত ঋতু -আবর্তনে,
বিশ্বজগতের তরে, ঈশ্বরের তরে
শতদল উঠিতেছে ফুটি।
সুতীক্ষ্ণ বাসনা-ছুরি দিয়ে
তুমি তাহা চাহ ছিঁড়ে নিতে?
(নিষ্ফল কামনা)"""

যখন সমগ্রকে পাওয়া যাইতেছে না, তখন প্রেমাস্পদের মধ্যে যে অসীম সৌন্দর্য
প্রেমের আভাসটুকু পাওয়া যায়, তাহা লইয়াই সন্তুষ্ট তাকা উচিত। তাহাদের একান্ত করি
উপভোগের যে আত্মসুখসর্বস্ব বাসনা, তাহাকে বিসর্জন দেওয়া যুক্তিযুক্ত।
"""
ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী,
চেয়ো না তাহারে।
আকাঙ্ক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।
নিরাও বাসনা–বহ্নি নয়নের নীরে। – (নিষ্ফল কামনা)""
সমগ্ৰ স্বৰীন্দ্রসাহিত্যে 'নিষ্ফল কামনা' কবিতাটির একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। ইহার
মধ্যে নর-নারীর প্রেম সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ভাব-চিন্তার প্রথম সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখা যায়। এমন
করিয়া দেহের সমস্ত দাবি অগ্রাহ্য করিয়া আত্মার মহিমা ঘোষণা করা এবং প্রেমকে ব্যক্তি
সম্পর্ক বিবর্জিত এক অনায়ক আদর্শের অঙ্গীভূত করিয়া নির্বিশেষে আনন্দরস পানের
সামগ্রীতে পরিণত করার দৃষ্টান্তও এই প্রেম-তত্ত্বের সদস্ত ঘোষণা রবীন্দ্রকাব্যের আর কোথাও
দেখা যায় না।

দেহের দাবী ও জীবনের বাস্তবক্ষুধাকে অস্বীকার করিয়া, মানুষের স্বাভাবিক রূপতৃষ্ণা
ও প্রেমোৎকণ্ঠাকে উপেক্ষা করিয়া কবি প্রেমকে অতীন্দ্রিয় ও আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত করায়
এই প্রেম সূক্ষ্ম মানস-ক্রিয়া দ্বারা উপলব্ধির বস্তু হইয়া পড়িয়াছে, এবং হৃদয়ের আবেগ
উদ্দীপনা, হর্ষ-বিষাদের উত্থান-পতনের অনুভূতির গভীর বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। এই
কবিতাটিতে কবি প্রেমে দেহসম্বন্ধের ব্যর্থতা সম্বন্ধে যুক্তি ও তত্ত্বের অবতারণা করিয়া
উপদেশছলে তাহার মনোভাব ব্যক্ত করিয়াছেন।

মানুষের আত্মা অনন্ত ও অসীম, দেহাবন্ধ হইলেও দেহের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত নয়। দেহেরমধ্য হইতে সেই আত্মার জ্যোতি অপরূপ সৌন্দর্যরূপে বিকীর্ণ নয়। কামনা-বাসনা দ্বারাউত্তেজিত হইয়া সেই অনন্তের ধনকে ভোগ করিতে গেলে ব্যর্থতা অনিবার্য। গতঅসম্পূর্ণতায় জর্জরিত মানবের পক্ষে দেহবিচ্ছুরিত সেই চিরন্তন সৌন্দর্যকে লালসার তাড়নায়নিজস্ব করিতে গেলে-দেহকে বাহুবন্ধনে বাঁধিতে গেলে, তাহার নৈরাশ্য অবশ্যম্ভাবী। দূরহইতে সেই সৌন্দর্যকে শান্ত-স্নিগ্ধ আনন্দের সঙ্গে অনুভব করিতে হইবে—তাহার রহস্যেবিষয়মুগ্ধ হইতে হইবে। দুর্বল মানুষের পক্ষে ইহাই যথেষ্ট। তাহা না হইলে কেবল কামনার
অনলেই দগ্ধ হইতে হয়, কোনো সার্থকতাই লাভ হয় না। কবি রূপমোহ বা সৌন্দর্যতৃষ্ণাকে
একান্তভাবে দেহকামনাবিচ্যুত করিবার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। —

""রূপ নাহি ধরা দেয়—বৃথা সে প্রয়াস। (নিষ্ফল প্রয়াস)
শত অন্বেষণ করিলেও সৌন্দর্যকে দেহের মধ্যে পাওয়া যাইবে না
নাই নাই–কিছু নাই, শুধু অন্বেষণ।
নীলিমা লইতে চাই আকাশ ছাঁকিয়া।
কাছে গেলে রূপ কোথা করে পলায়ন,
দেহ শুধু হাতে আসে শ্রান্ত করে হিয়া। -(হৃদয়ের ধন)""

কামগন্ধহীন বিস্তৃদ্ধ সৌন্দর্য উফলব্ধির জন্য কবির একান্ত কামনা এই কবিতাটিতে এবং
'মানসী'র অনেক কবিতায় প্রকাশ পাইয়াছে।
এই সৌন্দর্যকাঙ্ক্ষা বা প্রেমকে কবি অতীন্দ্রিয়লোকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। ইহার মূলে
আছে একটা Principle of Beauty-র উপলব্ধি। এই Intellectual Beauty কে শেলি
অসীম ও অনন্ত বলিয়া অনুভব করিয়াছেন। বিহারীলালও সারদাকে চিরন্তনী বলিয়া উপলব্ধি
করিয়াছেন। সকল রোমান্টিক কবিই একটা শ্বাশত ভাবগত ঐক্য কামনা করে। শেলি ওবিহারীলালের প্রেমের আদর্শ ও ভাব-কল্পনার প্রভাব রবীন্দ্রনাথের উপর কিছু পড়িলেও,রবীন্দ্রনাথের কবি-মানব স্বতন্ত্র। শেলির মতো রবীন্দ্রনাথ Dreamer of dreams ---
আকাশে স্বপ্নরাজ্যে নির্মাণ করিতে সদা ব্যস্ত হন। রবীন্দ্রনাথ বস্তুজগৎ ও ভাবজগতের মধ্যে
একটা সজ্ঞান ব্যবধান রক্ষা করিয়া কবি– কর্মে অগ্রসর হইয়াছেন। প্রেম-কল্পনায় রবীন্দ্রনাথ
সজ্ঞানে বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে উঠিয়া এক নূতন ভাবজগৎ নির্মাণ করিয়াছেন এবং প্রেমকে
নৈর্ব্যক্তিক, নির্বিশেষে ও চিরন্তন তত্ত্বের উপলব্ধিতে পরিণত করিয়াছেন।

দুইটি পাশ্চাত্য সাহিত্যশিল্পীর সঙ্গে প্রেম-কল্পনায় রবীন্দ্রনাথের অল্পবিস্তর সাদৃশ্য
আছে। একটি নাট্যকার মেটারলিংক, অপরটি কবি ব্রাউনিং। ব্রাউনিং সম্বন্ধে পূর্বে আলোচনা
করা হইয়াছে, পরেও করা হইবে। সুবিখ্যাত সাংকেতিক নাট্যকার মরিস মেটারলিংক
প্রেমকে আত্মার সৌন্দর্য্যকাঙ্খায় মিলনের কামনা বলিয়া মনে করিয়াছেন।

তাহার মতে মানবের আত্মা দেহের অতীত এক চিন্ময় সত্তা। প্রেম আত্মার স্বতঃস্ফূর্ত
অনুভূতি। প্রেমের মধ্যে তাহার আনন্দের অভিব্যক্তি। প্রেমের অর্থ এক মানবাত্মার সঙ্গে অন্য
মানবাত্মার মিলনাকাঙ্ক্ষা। একটি মানবাত্মার অপর মানবাত্মার প্রতি এই যে আকর্ষণ ইহার
মূলে আছে একটি পরিপূর্ণ সৌন্দর্যবোধ। আত্মার সহিত আত্মার সম্বন্ধই সৌন্দর্যের মধ্য
দিয়া। সৌন্দর্যই আত্মার কামনার বস্তু, সৌন্দর্যেই তাহার একমাত্র তৃপ্তি। অন্য কোনো দিকে
তাহার লক্ষ্য নাই। এই সৌন্দর্যাকাঙ্ক্ষাই প্রেমের ধারায় প্রবাহিত—উহাই একের প্রতি
অন্যের আসক্তির মূল।

'Certain it is that the natural and primitive relationship of soul to soul is a

relationship of beauty. For beauty is the only language of our soul; none other is
known to it.
(The Inner Beauty The Treasure of the Humble).
(উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য"")

"নিস্ফল কামনা' কবিতাটির ভাববস্তু :

প্রেম দুইটি আত্মার মিলন। জড় দেহসংস্কারের পরিমন্ডল হইতে ঊর্ধ্বগত, কামনা
বাসনার দ্বন্দ্বমুক্ত, দুইটি আত্মার নির্মল, পরম আত্মীয়তা উপলব্ধির মধ্যে যথার্থ প্রেমের
অবস্থিতি। সেই দুইটি আত্মার মিলনকে কেবল কেহ সৌন্দর্য ভোগের মধ্যে আবদ্ধ করিলে।
প্রেমের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় না। দেহ-সৌন্দর্য আত্মারই অলৌকিক রহস্যময় দীপ্তিরূপায়িত। মানুষ মূলত ভূমার অংশ, সীমার মধ্যে অবাদ্ধ হইলেও তাহার প্রকৃত স্বরূপসীমাহীন, বৃহৎ ব্যান্ডির মধ্যেই তাহার পরিপূর্ণতা তাহার সমগ্রতা। কামনার কলুষলিও, শতঅসম্পূর্ণতায় জর্জরিত সংসারের মানুষের পক্ষে সমগ্র মানবকে, আত্মার দেহাশ্রয়ী স্বরূপকেলাভ করিবার আকাঙ্ক্ষা দূরাশামাত্র। সেই অনন্তের ধনকে পাইতে হইলে অনন্ত প্রেমেরপ্রয়োজন, তাহা ভীত, কাতর, দুর্বল, ভোগ-কামনায় অন্ধ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।মানুষের দেহাশ্রিত সৌন্দর্য ব্যক্তি বিশেষের জন্য সৃষ্ট হয় নাই, সে বিশ্বের আনন্দবর্ধনের
জন্য, ভগবানের অভিপ্রায়ের মূর্ত প্রকাশ রূপে পদ্মের মতো স্বাভাবিকভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে;
দেহের এই সৌন্দর্য বিকাশকে কামনা-বাসনা-তাড়িত হইয়া ভোগের সামগ্রীতে পরিণতকরিবার আকাঙ্ক্ষা মূর্খতা। সৌন্দর্যকে দূর হইতে দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া ও তাহার নিকট
আত্মসমর্পণ করিয়া প্রেমের অপূর্ব আনন্দরস পান করাউচিত। এই কামনা কলুষ-বর্জিতপ্রেম মানুষকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান করে। দেহাতীত, কামগন্ধহীন বিশুদ্ধসৌন্দর্য-রসের উপলব্ধির তীব্র আকাঙ্ক্ষা এই কবিতায় ব্যক্ত হইয়াছে।সৌন্দর্য ও প্রেমের উপভোগের প্রতি কবি-হৃদয়ের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক। কিন্তু
কবি বুঝিতেছেন যে, সৌন্দর্যকে নিতান্ত নিজের করিয়া ভোগ করিতে গেলে তাহার প্রকৃত
স্বরূপের আস্বাদ পাওয়া যাইতেছে না-সত্যকার তৃপ্তিও মিলিতেছে না। প্রেমের প্রকৃতঅমৃতময় আস্বাদ তিনি পাইতেছেন না–সংকীর্ণ গণ্ডতে আবদ্ধ হওয়ায় প্রেম জ্বালাময় কামেপরিণত হইতেছে। যুবক কবির দুর্নিবার ভোগলালসার আবেগ ও সৌন্দর্য ও প্রেমের প্রকৃত
স্বরূপ উপলব্ধি করিবার প্রবল ইচ্ছার মধ্যে, এই বাস্তবও আদর্শ প্রেমের মধ্যে, সংঘাতউপস্থিত হইয়াছে—এই দ্বন্দ্বে কবি-হৃদয়ে যে আনন্দ-বেদনা-আশা-নিরাশা, যে ভাব-চিন্তা
উত্থিত হইয়াছে, তাহাই 'মানসী'র অনেক প্রেম-কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। নিষ্ফল কামনাতে
কবি এই ভোগ প্রবৃত্তিকে সংযত করিয়া যথার্থ প্রেমের স্বরূপ উপলব্ধি করিবার জন্য প্রবল
চেষ্টা করিয়াছেন। 'মানসী'র প্রেম কবিতার মধ্যে এই কবিতাটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার
করিয়াছে।

মানসীতে প্রকৃতিঃ

মানসীতে প্রকৃতি স্বরূপের অবস্থান করেই কবিকে আকৃষ্ট করেছে দেখতে পাওয়া যায়।কড়ি ও কোমলে প্রকৃতির এই স্বরূপাবস্থান নেই। সেখানে প্রকৃতি কবির মিলন বিরহজনিত
উচ্ছ্বাসের উদ্বোধনে সহায়ক হয়েছে মাত্র। কৈশোরের রচনা বনফুল ও কবি কাহিনীতে অবশ্য
এক প্রকারের প্রকৃতি-প্রীতি বিদ্যমান, কিন্তু তা ওআর্ডস্ওআর্থ বা বিহারীলালের
অনুকরণসূত্রে গঠিত। মানসীর কয়েকটি কবিতা আলোচনা করলে দেখা যায় কবির এই
প্রকৃতি-প্রীতি সহসা উদিত হয়নি। এর ভাবনামুলে প্রথমে একটা সংশয়বোধ ছিল। এই
সংশয় সৃষ্টির সামগ্রিক রূপ সম্পর্কে। যেমন—

""পাশাপাশি এক ঠাঁই
দয়া আছে, দয়া নাই,
বিষম সংশয়।(বসুন্ধরা) ""


""মনে হয় সৃষ্টি যেন বাঁধা নাই নিয়ম-নিগড়ে
(নিষ্ঠুর সৃষ্টি)""""

অন্ধ সৃষ্টিলীলার একদিকে যে—ধ্বসের মূর্তি ফুটে উঠেছে কবিকে তা ক্ষণিকের জন্য
আচ্ছন্ন করলেও তিনি একমাত্র প্রকৃতি-প্রীতির বশেই এই সংশয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন,
এবং কিছু-পরবর্তী ‘যেতে নাহি দিব' কবিতায় ধ্বংসের উপর প্রেমকেই মৃত্যুঞ্জয়ী সত্য বলে
স্থির সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন—

""দিব না দিব না যেতে ডাকিতে ডাকিতে
হুহু করে তীব্র বেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করে বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
তবু প্রেম বলে,
সত্য-ভঙ্গ হবে না বিধির। আমি তাঁর
পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার
চির-অধিকারলিপি।"""

মানসীর প্রকৃতি-প্রীতিই কবিকে সৃষ্ট-সম্পর্কিত সংশয়াত্মিকা বৃদ্ধি থেকে পরিত্রাণকরেছে। নিষ্ঠুর সৃষ্টির পরের দিন লেখা জীবন-মধ্যাহ্ন কবিতায় কবি গভীর অনুরাগের সঙ্গেপ্রকৃতির উদার মধুর ও গম্ভীর রূপের বর্ণনা দিয়ে পরে স্বকীয় কবিমানসের একটি উল্লেখ্য
পরিচয় উদ্ঘাটিত করেছেন—

""নিত্যনিশ্বসিত বায়ু উন্মোচিত ঊষা,
কনকে শ্যামলে সম্মিলন,
দূরদূরান্তরশায়ী মধ্যাহ্ন উদাস,
ঘনচ্ছায়া নিবিড় গহন,
যতদূর নেত্র যায় শস্য শীর্ষরাশি
ধরার অঞ্চলতল ভরি
জগতের মর্ম হতে মোর মর্মস্থানে,
আনিতেছে জীবনলহরী।""

তখনকার কবিমানসের রসাবস্থা কবি নিম্নলিখিতভাবে বিবৃত করেছেন

"""বচন-অতীত ভাবে ভরিছে হৃদয়,
নয়নে উঠিছে অশ্রুজল,
শুধু জেগে ওঠে প্রেম মঙ্গল-মধুর,
বেড়ে যায় জীবনের গতি,
ধূলিধৌত দুঃখশোক শুভ্র শান্ত বেশে
ধরে যেন আনন্দ-মুরতি।
বন্ধন হারায়ে গিয়ে স্বার্থ ব্যাপ্ত হয়।
অবারিত জগতের মাঝে,
বিশ্বের নিশ্বাস লাগি জীবন–কুহরে
মঙ্গল-আনন্দ-ধ্বনি বাজে।
বিরহ-বিষাদ মোর গলিয়া ঝরিয়া
ভিজায় বিশ্বের রক্ষ""""।

বাঙলা সাহিত্যে এই অনাবিল শান্তরসের বর্ণনা দ্বিতীয়রহিত। তা ছাড়া রবীন্দ্রপক্ষে
বিশেষ এই যে, রসাবস্থায় তিনি আত্মসমাহিত থাকতে চান না, পৃথিবী ও মানুষকে চান,
নিজকে প্রসারিত করে দিতে চান দেশ ও সমাজের জীবনের মধ্যে।
কবির এই প্রথমিক যুগের প্রকৃতি-প্রীতি আরো সহজ ও স্পষ্টভাবে উৎসারিত হয়েছে‘প্রকৃতির প্রতি' কবিতায়। শত শত প্রেম-পাশে টানিয়া হৃদয় এ কী খেলা তার থেকে আরম্ভ
করে প্রাণমন পসারিয়া ধাই তোর পানে, নাহি দিস্ ধরা এবং যত অস্ত নাহি পাই তত জাগেমনে মহারূপরাশি; তত বেড়ে যায় প্রেম, যত গাই ব্যথা, যত কাঁদি হাসি প্রভৃতির মধ্য দিয়েকবি তাঁর প্রকৃতি-সম্পর্কিত দুর্নিবার আকর্ষণ আমাদের গোচরে এনেছেন। আদিতে যেঅপরিস্ফুট প্রকৃতি একটি অনির্দেশ্য অপরিণত মনোভাবের পোষাক মাত্র ছিল, বর্তমানে তাস্বরূপে অবস্থান করে কবিকে মুগ্ধ ও বিহ্বল করে তুলেছে। এরপর 'কুহুধ্বনি' কবিতায় পল্লীর
সঙ্গে বিজড়িত এই প্রকৃতির মানজীবনের উপর অপরিসীম প্রভাব বর্ণিত হয়েছে—

""বিশ্বের বক্ষের কাছে,
যেন কোন সরলা সুন্দরী,
যেন সেই রূপবতী
যেন কে বসিয়া আছে
সংগীতের সরস্বতী
সম্মোহন বীণা করে দরি।...""

প্রকৃতি-সম্পর্কিত এই বাসনার বিকাশের মূলে কবিচিত্তের একটি বিশেষ ভাব বা দৃষ্টি
প্রণিধানযোগ্য। প্রকৃতিতে ভয়ঙ্করতা ও মাধুর্য, মহান এবং সুন্দর পাশাপাশি থেকেই কবিকে
মুগ্ধ করেছে। ঝটিকা, প্লাবন প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ধ্বংসের অনিবার্যতায় এবং
সমুদ্র, পর্বত প্রভৃতির দুরধিগম্য ভীষণতার প্রকৃতি নিষ্ঠুর হলেও এর লীলাময় রমণীয় রূপ
যার মধ্যে বিবিধ বর্ণের খেলা, আলোকের সমারোহ, পত্রের শ্যামলিমা ও ফুলফলের বিকাশ
থেকে আরম্ভ করে পশুপাখি ও মানুষে প্রাণের ও প্রেমের লীলা প্রকাশিত—তাও অপূর্ব। নিষ্ঠুর
জড়ত্বকে অতিক্রম করে প্রাণের স্ফূর্তি জয় ঘোষণা করে চলেছে, এই ভাবই কবিকে ক্রমশপ্রকৃতির দিকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। 'নিষ্ঠুর সৃষ্টি' ও 'সিন্ধুতরঙ্গে' কবিচিত্তের সংশয়ের
কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি। প্রথমটির নিম্নলিখিত পংক্তিগুলিতে ঐ সংশয় আরো প্রকট—

"""হায় স্নেহ, হায় প্রেম, হায় তুই মানব হৃদয়,
খসিয়া পড়িলি, কোন নন্দনের তটভরু হতে?
যার লাগি সদা ভয়,
পরশ নাহিক সয়,
কে তারে ভাসালে হেন জড়ময় সৃজনের স্রোতে?""

এই সংশয় থেকে মুক্তির ও প্রীতির প্রতিষ্ঠা হয়েছে উপরি-লিখিত 'প্রকৃতির প্রতিকবিতায়। কবি তাঁর এই মনোভাবের সঙ্গে স্বভাবতই এ দেশের চিরন্তন মায়াবাদের তুলনা
করে দেখেছেন এবং দৃঢ়কণ্ঠে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে দ্বৈতের বা বহুত্বের এইভ্রান্তিকে অতিক্রম করে নয়, একে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেই তিনি বেঁচে থাকতে চান।
এইসুখে দুঃখে শোকে

"""বেঁচে আছি দিবালোকে,
নাহি চাহি হিমশান্ত অনন্তযামিনী।"""

সোনার তরীতে যখন কবির প্রকৃতি-প্রীতি সুগভীর বিশ্বাত্মবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে
স্থির মর্তপ্রীতি বা মানবানুরাগে পরিণত হয়েছে তখন কবি যে আরও স্পষ্টভাবে মায়াবাদকে
অস্বীকার করলেন তা একটু পরেই আমরা দেখতে পাব। এবং আরও পরবর্তীকালে রুদ্র ও
সুন্দরের ধ্বংস ও সৃষ্টির রহস্যময় লীলা-অনুভূতি কেমনভাবে তাঁরা কাব্য-প্রতিভাকে
পরিণামের পথে নিয়ে গেছে তখন সেই বিশ্বয়কর ইতিহাসও দেখব।
প্রকৃতি সম্পর্কে কবির এই দৃষ্টিভঙ্গি একমাত্র প্রকৃতির কবি ও সাধারণ মানুষের কবিওয়ার্ডওআর্থ থেকে অল্পবিস্তর স্বতন্ত্র। ওয়ার্ডসওআর্থের প্রকৃতি-ভাবুকতা প্রকৃতির এই
সমগ্রতাবাধ থেকে উদ্দীপ্ত হয়নি, ঐহিকতাবাদী ইউরোপের অকস্মাৎ আগত বৈপ্লবিক
পরিবর্তনের সূত্রে এসেছিল বলে সৃষ্টির নিঠুর দিক সম্পর্কে ঐ কবি প্রায় অচেতন ছিলেন।
আবার রবীন্দ্র-আবির্ভাব-কালে যদিও বাঙালী সমাজে ভোগলিপ্সা, অকর্মণ্যতা, আদর্শচ্যুতি ও
নীতিহীনতা সর্বত্র প্রকট হয়ে নবতম নিসর্গ দর্শনের আবির্ভাবের উপযুক্ত পটভুমি সৃষ্টি
করেছিল, তথাপি, প্রকৃতি ও জীবনকে অবলম্বন করে অরূপাশ্রয়ই ঐ সংকীর্ণতা থেকে মুক্তিরসমাধানরূপে মনীষীদের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল কেবলমাত্র প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ নয়।সম্ভবত ভারতীয় জীবন ও সাধনার বৈশিষ্ট্যই এজন্য দায়ীআর এই সঙ্গে রবীন্দ্রপক্ষে বিরোধ
বৈচিত্র-সমন্বয়ী নব্য-হেগেল সম্প্রদায়ের ভাবদর্শনের স্বজাত্যও অনুমেয়। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেরোম্যান্টিক ভাবভঙ্গির যে সর্বতোমুখী পরিণাম আমরা দেখতে পাই, তাতে এটুকু বোঝা যায়,যে, উনিশ শতকে প্রারম্ভ বিশ্বের এই নবীন মনোভাব যেন রবীন্দ্রনাথেই পূর্ণতা পাওয়ার জন্যেঅপেক্ষা করছিল। সেজন্য প্রকৃতির একদেশানুবর্তী প্রীতি সম্পর্ককে অতিক্রম করে সমগ্রসৃষ্টিগত দ্বান্দ্বিক রহস্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত স্থায়ী মতানুরাগ এবং রুদ্র সুন্দরের লীলারস
এই কবির কল্পনার ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষয়ীভূত হল। ওআর্ডস্ওআর্থ অতি ক্ষুদ্র বস্তুর মধ্যেও
যে অর্থ আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছিলেন তা-ই যেন অধুনা অধিকতর ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গির
দ্বারা গৃহীত হয়ে সুনির্দিষ্ট ও চিরন্তন সত্যের রূপ লাভ করলে। নিসর্গের সঙ্গে মানজীবনওএকসূত্রে প্রথিত হয়ে পড়ল।নিসর্গ-প্রীতি সম্পর্কে বর্তমান কবিমানসের এই যে পর্যাকুল অবস্থা, এ কি অপেক্ষাকৃতনিম্নতর সংবেদনাবস্থা, না এ অনির্বচনীয় আহাদরূপ রসতাপ্রাপ্তির যোগ্যতা রাখে। বলাবাহুল্য, প্রকৃতিগত কবিতার কাব্যমূল্য সম্পর্কে এই সংশয় উনিশ শতকের পূর্বে দেখা দিলে
অর্থহীন হ'ত না, কিন্তু বর্তমানে তার অবকাশ নেই। নিসর্গপ্রীতিরূপ স্থায়ীভাবে যে
যথার্থভাবে রসপর্যায়ভূত হতে পারে তা ওআর্ডস্ওআর্থ ও রবীন্দ্রনাথ এবং বিহারীলালও
সমভাবে দেখিয়েছেন। 'জীবন-মধ্যাহ্ন' কবিতার পূর্বোদ্ধৃত অংশটুকুতে যে কবির এই
রসাবস্থা বিবৃত হয়েছে তা পূর্বেই বলেছি। কিন্তু এই আনন্দ অনুভবকে যদি প্রাচীন কোনও
রসের পর্যায়ে ফেলতেই হয় তাহলে শান্তরসেরই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পূর্বেকার উদ্ধৃতিতে
এই রসেরই অনুভাব ও সঞ্চারীগুলি কবি বিবৃত করেছেন। নিসর্গভাবুকতার
শান্তরসপরিণামের ইঙ্গিত কবি চিত্রার 'সুখ' শীর্ষক কবিতাটিতেও দিয়েছেন—

""আজি বহিতেছে।
প্রাণে মোর শান্তিধারা; মনে হইতেছে
সুখ অতি সহজ সরল, কাননের
প্রস্ফুট ফুলের মতো,""
—ইত্যাদি

কবি ওআর্ডওআর্থ তাঁর Prelude কাব্যে নিসর্গ-প্রীতিসঞ্জাত মানসিক অবস্থার বিস্তৃত
বর্ণনা দিয়েছেন, আর নিম্নলিখিত বিখ্যাত পংক্তি কয়েকটিতে সংক্ষেপে প্রকৃতি-প্রীতি সম্পর্কে
স্বীয় চিত্তের প্রায় সমাহিত যোগাবস্থাই বিবৃত করেছেন—

*** that blessed mood,
In which the burthen of the mystery,

In which the heavy and the weary

Of all this unintelligible world

weight

Is lightened— that serene and blessed mood,

In which the affections gently lead us on,—

Until, the breath of this corporeal frame

And ever the motion of our human blood

Almost suspended, we are laid asleep

In body,and become a living soul

(Lines composed a few miles above Tintern Abbey)
প্রকৃতি—প্রীতির সঙ্গে বিজড়িত বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে একটি সমগ্র দৃষ্টির পরিচয় অপর
কোনো সমকালীন বাঙালী কবির রচনায় পাওয়া যায় না। কী সৌন্দর্য-কল্পনা, কী
বিশ্বাত্মবোধ, সবই রবীন্দ্রনাথের একটি কাল্পনিক নিগূঢ় সমগ্রতাবোধ থেকে উৎসারিত।
রবীন্দ্র—সমকালীন দেবেন্দ্রনাথ সেন ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতির নিসর্গ-প্রীতি বা সৌন্দর্য -
স্পৃহা ইউরোপীয় কবিদের মতোই বিশিষ্ট বস্তুর প্রেরণায় ও বিশিষ্ট বিষয় ও ঘটনার মাধ্যমে
প্রকাশিত হয়েছে। অপরপক্ষে কল্পনার এই সমগ্র দৃষ্টি থাকার ফলে নিসর্গ প্রীতি থেকে বিশিষ্ট
বিশ্বাত্ববোধ, সমাজ জীবনবোধ এবং রূপময় অরূপের লীলার অনুভবের রবীন্দ্র-কবি মানসের
উৎকান্তি অতি স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছে।।
(ক্ষুদিরাম দাস)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ