Hot Posts

6/recent/ticker-posts

বিষ্ণু দের চোরাবালি কাব্য আলোচনা

--বিষ্ণু দের চোরাবালি কাব্য আলোচনা বিষ্ণু দের চোরাবালি কাব্য আলোচনা 
বিষ্ণু দের কবিতা 
ঘোড়সওয়ার কবিতা 
ক্রেসিডা কবিতা আলোচনা 
ওথেলো কবিতা আলোচনা --
*বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 
 চোরাবালি আত্মসচেতনতার বহিরাশ্রয়

চোরাবালি  (১৯৩৭ সাল) কানো আছে পাশ্চাত্য ফর্মের পরিবৃত্তি ও নাগরিকচেতনার পরিপ্রেক্ষিত। উর্বশী ও আর্টেমিস এবং চোরাবালির কবিতাগুলো প্রায়

একই সময়সীমায় (১৯২৬-৩৭ সাল পর্যন্ত) রচিত হলেও প্রসঙ্গ ও প্রকরণেউভয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। চোরাবালি প্রকাশকাল ১৯৩৭ সাল

হলেও রচনাকাল ১৯২৬ সাল থেকেই শুরু, এমনকি উর্বশী ও আর্টেমিসেরআগের কবিতাও এতে গৃহীত হয়েছে। কাব্যটিতে মোট কবিতার সংখ্যা একুশ,

ভূমিকা লিখেছিলেন বিষ্ণু দে-র অগ্রজ কবিবন্ধু সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, উৎসর্গ করাহয় রবীন্দ্রনারায়ণ ঘোষকে। চোরাবালিতে কখনো কখনো কবিতারশিরোদেশে কবি এলিয়ট ও পাউন্ডের উদ্ধৃতি ব্যবহৃত হয়েছে) গ্রন্থেরউৎসর্গপত্র ছাড়াও ব্যক্তিবিশেষকে কবিতা উৎসর্গ করা হয়েছে। উভয় কাব্যেরকিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের চিহ্নিতকরণে সমালোচকবৃন্দ নানারকম মন্তব্যকরেছেন। অরুণ সেন বলেছেন যে, প্রথম কাব্যেরঅভিজ্ঞতার ঈষৎ ব্যক্তিগত এখানে হয়ে উঠেছে অনেকটাই নৈর্ব্যক্তিক। অর্থাৎ উর্বশী

ও আর্টেমিস'-এ নেতির যে প্রখর রূপ দেখা দিয়েছিল, তা এখানেও আছে কিন্তুআগের মতো এখন তা যেন অতটা ব্যক্তি-আচ্ছা নয়, আবার 'চোরাবালি'তে নেতিথেকে মুক্তির যে আভাস আছে, তা উর্বশী ও আর্টেমিস'-এ সম্পূর্ণ অপরিচিত নাহলেও ঐ পরিণতির সাক্ষ্য বেশি 'চোরাবালি’তেই। সে কারণেই উভয় গ্রন্থ মিলেঅভিজ্ঞতার একটা পরম্পরা ও পরিপূরকতা এনে দেয় অভিজ্ঞতার গোড়াকারসততা ও সমগ্রতা—তাকেই বলা হয়েছে 'দুটি বইয়ের সমমতা'।উর্বশী আর্টেমিস ও চোরাবালি কাব্যদ্বয়কে ‘দু'টি বইয়ের সমগ্রতা রূপেঅভিহিত করেছিলেন অশোক সেন।” অর্থাৎ একই সময়সীমায় রচিত বলেচোরাবালিতে প্রথম কাব্যের পরিমণ্ডলটি বর্তমান, তবে কবির দৃষ্টিভঙ্গি ওপ্রকরণ-সৌকর্য পরিবর্তিত হয়েছে। উর্বশী ও আর্টেমিসেছিল ব্যক্তিচিত্তের

মোহময় প্রকাশ সত্ত্বেও দৃঢ় একরৈখিক চলমানতা, আর আলোচ্য কাব্যে তাযুগের পরিপ্রেক্ষিতে জটিল স্বরায়নের সূচনা করেছে। বিষ্ণুদে এখানে আরও

বেশি নৈর্ব্যক্তিক ও পটভূমি-সংলগ্ন তথ্য স্থান ও কালধর্মে বিপন্ন এবংবিশ্লেষণধর্মী হয়ে ওঠেন; ভাষা ও ছন্দ নির্মাণে স্বকীয়ত্ব অর্জনের সাফল্যওতুলনামূলকভাবে বেশি। তবে এই পরিপ্রেক্ষিত সচেতনতা শুধু পর্যবেক্ষণ ওসচেতন সময়বোধের স্বাক্ষরবহ মাত্র, কোনোরকম রাজনৈতিক শ্রেণীভুক্তি বাতসংগঠনে অগ্রসর নায়। চোরাবালিতে বিষ্ণু দে সামাজিক সম্পর্কের ভাঙনও অন্তঃসারশূন্যতা বাস্ত করেন এই ভাঙনের তীক্ষ্ণতা তাঁর কবিতার

কলাকৌশলকেও ভেঙে গড়তে চেয়েছে। সর্বোপরি একটি বস্তুবাদীউপস্থাপনার নিরিখ তৈরির দিকে কবির বিশেষ মনোনিবেশের সূচনা এইকাবোই লক্ষ করা যায়।

উক্ত বস্তুবাদী উপস্থাপনা বাস্তবের অধিকল উপস্থাপনা থেকে মুক্ত, আবারতা বাস্তবের নিছক প্রতিফলনও নয়। এর তাৎপর্য হচ্ছে ঘটনা ও বিষয়েরঅন্তস্তলে প্রবেশ করে শৈল্পিক সাধারণীকরণের পদ্ধতিতে একটি পৃথক বৈশিষ্ট্যপ্রতিভাত করা এবং যে কোনো বিরোধকে বাস্তবজীবনের স্ববিরোধিতা দিয়েসংঘাত-ক্ষুগ্ধতায় উপলব্ধি করা। এই সংঘাত-স্ববিরোধধৃত জীবনচিত্রের

একটি বজ্রগতি এই কাব্যের মূল সুরে প্রবিষ্ট হয়েছে। (বস্তুত চোরাবালিরপটভূমিতে রয়েছে আত্ম-আবিষ্কারের নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গির সঙ্গে বাস্তবতার সংঘাতও বহুমাত্রিক সংমিশ্রণ। এজন্য দেখা যায় একদিকে আত্ম আবিষ্কারের ভাষাছন্দের আবেগায়িত অথচ অস্থিসবল কংক্রিট রূপ, অন্যদিকে হালকা চালের

‘ভেরদ সোসিয়েতে মার্কা লঘু' কবিতায় সামাজিক অসঙ্গতিকে পরিহাসেরহলে নাগরিক গল্প, খণ্ডিত জীবনের টুকরো-টুকরো চিত্র। কাব্যটির আবহ তাইউর্বশী ও আর্টেমিসের তুলনায় উন্মুখর, ক্রমান্বয়ে জটিল ও বহুবস্কিম। তদুপরিসমকালীন বিদেশি কাব্যান্দোলনের নব নব নিরীক্ষার সঙ্গে বাংলা কবিতারদীর্ঘকালীন ঐতিহ্যের একটা স্বকীয় সমীকরণ সৃষ্টির প্রয়াস। আবহকেকরেছে আরও দুরূহতর।


ব্যঙ্গপ্রবণতা ও আমিত্বের হেত্বাভাস


তিরিশের কবিতা প্রথমেই চেয়েছে বাংলা কবিতার অতিতারল্য ওআবেগোচ্ছ্বাস থেকে মুক্তি। ১৯৩৮ সালে বুদ্ধদেব বসু এই মনোভাব প্রকাশকরে বলেছিলেন,

পঁচিশ বছর আগেকার বাঙালি কবিরা শিখিল ও তরল হওয়াটাকেই গৌরবের মনে।

করতেন, অকারণে বিশেষণের ছড়াছড়ি, প্রকৃতিবর্ণনায়বাড়াবাড়ি, ছন্দ-মিলেরঅভিপ্রকট চাতুর্য, এ-সব জিনিসেরই তখন বাজার দর ছিল চড়া। সর্বোপরি তখনকবিরা ছিলেন ভুল অর্থে আত্মকেন্দ্রিক, অর্থাৎ যে বিষয় নিয়ে লিখছেন তার দিক

লক্ষ্য না-রেখে নিজের দিকে তাকিয়ে লেখাই তাঁদের অভ্যেস ছিলো। সুতরাং তাঁদেরউৎকৃষ্ট রচনাও ভাববিলাসের উচ্ছ্বাস ছাড়িয়ে বেশি দূর উঠতে পারেনি, যদিবা কখনো

কবিস্বভাব ও কাব্যরূপ

ক্ষীণ কিছু বক্তব্য থাকতো, অজস্র ব্যঞ্জনাহীন কথার চাপে তা দম আটকে মারা যেত

কয়েক পক্তির মধ্যেই। এই সহজ, অতি সহজ বাক্যচ্ছটার বিরুদ্ধেই আধুনিক

কবির উদ্যোগ। কিছুকাল পূর্বে বাংলা কাব্যে যে অস্থিহীন নমনীয়তা পরিব্যাপ্ত ছিলো।

তা থেকে আমাদের কবিরা যে আজ মুক্ত, এ-কথা উদাহরণ সহযোগে প্রমাণ করা

বেশি শক্ত নয়। তার গায়ে আজ হাড়মাংস গজিয়েছে, তার রক্ত বইছে দ্রুত তালে।

অকারণ বাক্যভার আর নেই, নিজেকে অতিক্রম করে পারিপার্শ্বিক জগথকে দেখবার

চেষ্টা আজ সুস্পষ্ট। ২

'নিজেকে অতিক্রম করে পারিপার্শ্বিক জগৎকে অবলোকনের প্রয়াসে

তিরিশের কবিরা আত্মকেন্দ্রিকতাকে এক নতুন ভঙ্গিতে গ্রহণ করেছিলেন।কালধর্মে প্রতিনিয়ত কবির অবস্থান ও দৃষ্টিলোক প্রতিহত হচ্ছিল তৎকালীনবাস্তবতার চাপে, বিষ্ণু দে আত্মসচেতনতার সূত্রে। স্তবকে ইতিবাচকতায়বুঝে নিতে চাইলেন। যদিও এই আত্মসচেতনতা তখনো পর্যন্ত ছিল 'বিচ্ছিন্নপ্রফ্রকের মতো, আত্মসেচতনতা তখনো তাই যন্ত্রণার বিড়ম্বনা, বিরহীপ্রেমিকের মতো। কিন্তু তা ছিল সৃষ্টিময়। প্রগতির প্রথম ক্ষেপ, যদিচ হয়তোআত্মসচেনতা তখনো সেই সম্বন্ধস্বীকারের গভীরতায় পৌঁছয়নি।*** বিষ্ণুদে

র ভাষ্য,বিশ দশকের সুখী যদিচ ফাঁপা যুগে প্রায় ঠিক লগ্নেই, বিষিয়ে ওঠার কিছু আগেই;

স্নায়ু তখন এক পাহাড়ের চূড়ায়, বেঠোফোনের অন্তিম সঙ্গীতের আলোয়, নেতিবাচক

পুঙ্খানুপুঙ্খতার আর প্রবল নিরুদ্যমের মুখে। কিন্তু ফল তখনো তিক্ত নয়। অথচআমরা তখন প্রায় সেই তিমিরেই, আজ যে তিমিরে।এই তিমির ও ঔপনিবেশিক পঙ্গুত্বের রূপ বিষ্ণু দে-কে ভাবিত করেছে, যদিওতার সামাজিক-ঐতিহাসিক কার্যকারণ তখনো স্পষ্টতায় কবির চোখে ধরাপড়ে নি। ফলে চোরাবালি কাব্যে কবির আত্মসচেতনতা নানামুখী উৎসারণেসৃষ্টিময়তার প্রথম পদক্ষেপে প্রগলভ মূর্তি পেয়েছিল, যা লক্ষ করে ধূর্জটিপ্রসাদ

মুখোপাধ্যায় ১৯৩৯ সালে মন্তব্য করেছিলেন,বিষ্ণু দের রচনায় তার নিজস্বতা এতই উগ্রভাবে প্রকট যে তাকে অন্যের ভাবাশক্ত।... আমি জানি নিজস্বতা সবসময় কবিতার পক্ষেসদগুণ নাও হতে পারে।।বিষ্ণুর একাধিক কবিতায় সেটি ভঙ্গিমায় পরিণত হয়েছে। তার উল্লেখগুলি এতইগুপ্ত, জীবন থেকে এতই বহির্ভূত ও পুস্তকাশ্রিত যে বহু চেষ্টাতেও তাদের সিম্বলেরকোঠায় ওঠান যায় না। অথচ আত্মসচেতনতা আধুনিক কাব্যধর্মের প্রতিকূল। তবুআমি বলতে বাধ্য যে, বিষ্ণুর ব্যক্তিত্ব প্রধানতঃ আত্মসচেতন হলেও আত্মকেন্দ্রিকনয়। বিশ্লেষণবুদ্ধি তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

তাৎপর্য নিয়ে জীবনের প্রতি তাকানোর ভঙ্গি গড়েছে।


চোরাবালির “গার্হস্থ্যাশ্রম”, “কবিকিশোর”, “দ্বিধা-দম্পতি”, “প্রথমপার্টি”, “বেকার বিহঙ্গ”, “শিখণ্ডীর গান" প্রভৃতি কবিতায় স্তবক-বৈচিত্র্যে ওবিষয়ের দ্ব্যর্থকতায় ব্যঙ্গের নানামাত্রিক সূক্ষ্মতা পরিস্ফুট; এমনকি প্রথম

কাব্যের অ্যান্টি-রোমান্টিসিজম ও অন্তপ্রেরণার যেসব চাপ কবিকে ব্যতিব্যস্ত

রেখেছিল, সেগুলোও ব্যঙ্গের প্রবল প্রহারে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। এ ধরনের

অ্যান্টি-রোমান্টিক মনোভাবের আয়রনি রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিসিজমকেও

বিচূর্ণ করে :


ক. পঞ্চশরে দগ্ধ ক'রে করেছ এ কী সন্ন্যাসী

বিশ্বময় চলেছে তার ভোজ।

মরমিয়া সুগন্ধ তার বাতাসে ওঠে প্রশ্বাসি',

সুরেশ শুধু খায় দেখি গ্লুকোজ। (শিখণ্ডীর গান)

খ. বাসের এ কী শিংভাঙা গোঁ।

যন্ত্রের এই খামখেয়াল !

এদিকে আর পঁচিশ মিনিট

ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর। (টপ্পা-ঠুংরি)


গ. জনস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান, (ঐ)

ঘ. ইতিহ-ভাগ্য জড়াক না নাগপাশে

তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর


কোরো না অন্ধ বন্ধ জটায়ুপাখা। (বেকারবিহঙ্গ) ড. শহরের বুকে পাঁচতলায়

নেব সখী এক ছোট ফ্ল্যাট। ট্রাম বাস ভিড় নিত্য যায়

উচ্চ বৃক্ষ-চূড়ে দোঁহায়

ভিড়েতে থেকেও কী নিরালায় ....


ঘুঘুনি ও ঘুঘু রইব তায়,... (কবিকিশোর) “গার্হস্থ্যাশ্রম” কবিতার কতিপয় পৃথক পৃথক স্তবকবিন্যাসে কবি মধ্যবিত্ত নাগরিকের প্রেম-স্তরটি ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরেন—পূর্বরঙ্গ, জাতিস্মর, প্রলোভন, প্রতীপগতি, তামাদি, প্রকৃতি ও প্রেম ইত্যাদি সেইসব স্তর পরম্পরার নাম, যা একইসঙ্গে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যিক প্রেমধারণার পদাবলি-বাহিত ধারা ও রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত আয়রনির উপজীব্যে পর্যবসিত করে। উর্বশী ও আর্টেমিসে প্রেমের রোমাঞ্চ ও মোহ সম্পর্কে যে দ্বিধা ও সংশয় ছিল তা এখানে বিদ্রূপবাণে জর্জরিত। যেমন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্বরাগ সম্পর্কিত :

জেনে শুনে চোখ দিয়ে আমাকে কি টানো ?

নাকি, তুমি অজানিতে ভরে যাও ডালি ? নাকি, আমি সংস্কৃত, প্রাকৃত ও পালি পড়েছি প্যারিসে গিয়ে তাই চোখে আনো

কৌতূহল নামে বস্তু, অলকা, বলো তো। (গার্হস্থ্যাশ্রম)


‘বেতাল' অংশে কবির শেষ : লেকে আজকাল সকলেই যায়

ভালো লাগেনিকো তোমার যাওয়া।

মিশে গেলে তুমি সাধারণে হায়! (ঐ)


প্রেমের অবক্ষয়িত রূপ আর তারই কংকাল জান্তব-প্রজননবৃত্তিকে কৰি কোনো রোমান্টিক আবহে ঢেকে রাখেন নি। অন্তত এই পর্বে বিষ্ণু দে আত্মপ্রহেলিকাময় জীবনযাপনে অভ্যস্ত আপাতভদ্র মানুষগুলোকে উন্মুক্ত করে দেখাতে চান, যাতে ব্যক্ত হচ্ছে বণিকসভ্যতার আত্মক্ষয় আর কালো বাষ্পে ঘেরা মধ্যবিত্তের বিকার ও তথাকথিত চিক্কন মসৃণতা। স্পষ্টত তাঁর ব্যঙ্গের লক্ষ্য ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাধীন ব্যক্তির জীবনে ক্রমবর্ধমান যৌনপ্রাধান্য, যৌনসর্বস্বতা— যা শেষাবধি যৌনবিকার।

ঘোড়সওয়ার। অবচেতনের ভাষা থেকে চেষ্টার অনুষঙ্গ---

"ঘোড়সওয়ার" কবিতাটি বিষয়ের বহুমাত্রিক স্তরবিন্যাসে, প্রতীকের নানাঅর্থমতায় এবং ছন্দের তীব্র আবেগে সুগঠিত। কবিতাটি রচনার সময়বিষ্ণু সে শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন এবং রবিকারের প্রকোপে প্রথম অংশ

দেখেন। বিষ্ণু সে এ সম্পর্কে নিজেই বলেছিলেন,

কোলরিজের তুলনা খান যদি স্বল্পকবিতা হয়, তবে মোড়সওয়ারও আমারস্বল্পকবিতা প্রদত ফুরের বিকারে সারারাত কাটিয়ে ভোরবেলায় প্রায় প্রলাপের মতোঘোড়সওভারের প্রথম অংশ লিখে ফেলি। ... সেইজন্য কবিতাটিতে একটি অন্যরকম

বিষ্ণু দে কথিত 'অন্যরকম আবহাওয়ার প্রসঙ্গ হচ্ছে কবিতাটির গঠন ওরচনাজিফায় অবচেতনের প্রবল চাপ, যা বিষ্ণু দে-র আত্মচেতন সক্রিয়মননের ক্ষেত্রে একটিবিপরীত ব্যাপার। "ঘোড়সওয়ার" কবিতাটি গ্রন্থস্থ

হওয়ার সময় কিছু পরিবর্তিত হলেও ঐ অবচেতনের চাপটিকে নানাভাবে

আবিষ্কার করা সম্ভব।

প্রথমত ঘোড়ার প্রতীকী তাৎপর্যের মধ্যে রয়েছে কবির বালকজীবনের

ঘোড়া সংক্রান্ত স্মৃতির জাগৃতি, “ কিছু বাস্তব ঘটনার প্রতিচ্ছায়া, যুং-এরব্যাখ্যা সম্বলিত মনস্তাত্ত্বিক গ্রন্থপাঠ” প্রভৃতি নানাস্তর। অর্থাৎ বাইরের ঘটনা,

জনশ্রুতি, অধীত অভিজ্ঞতা, সাহিত্যপাঠ-সব এসে যুক্ত হয়েছে বিষ্ণু দে-র

ব্যক্তিচিত্তের মুক্তিবাসনার সঙ্গে। কবিতাটির নানারকম ব্যাখ্যার প্রেক্ষাপটও

তৈরি হয়েছে ঐ ব্যক্তিচিত্তের মুক্তিবাসনার ক্ষেত্রে অবচেতনের চাপে মনস্তাত্ত্বিকপ্রতিমা ব্যবহারের সূত্রে। বহুবিধ ব্যাখ্যার মূলে প্রথমেই লক্ষণীয় সুধীন্দ্রনাথ

দত্তের অভিমত। ১৯৩৭ সালেই তিনি লিখেছিলেন,

....চোরাবালি আর ঘোড়সওয়ার শুধু রিরংসার রূপক

পুরুষ, ভক্ত ভগবানের সম্বন্ধারোপ সহজ ও শোভন।

নয়, তাদের উপরে প্রকৃতিকিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই মতকে অস্বীকার করেন,

. রিরংসার বাস্তবচিত্রের অভিযোগ বাঁচাবার জন্যে সুধীন্দ্র এর মধ্যে প্রকৃতি-পুরুষ।

ও ভক্ত-ভগবানের সম্বদ্ধারোপ করেছেন, মেলাতে পারলুম না।কারও মতে, কবিতাটিতে শ্রেণীসংগ্রামের প্রসঙ্গ বিদ্যমান, কারও মতে,

‘ব্যক্তির অধীর আবেগ ও সমষ্টির প্রবল শক্তি, প্রেম ও সমাজতত্ত্ব কবিতাটিরমধ্যে একাকার হয়ে গেছে। কারও সিদ্ধান্ত হচ্ছে,


কবিতার শুরু লিবিডোর পশ্চাদগতির ও বিচ্ছিন্নতার বাস্তবতায়, কিন্তু ক্রমশই পূর্ণতার

আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হতে থাকে। সেই পূর্ণতাই কবিতার ঈঙ্গিত, যে-পূর্ণতায়

জনসমুদ্রের জোয়ার কবির হৃদয়কেও উদ্বেলিত করে। সেই প্রাণাবেগ, যার ছোঁয়ায়

হৃদয়ের আধির চড়া—ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা—ঘুচে যায়।

"ঘোড়সওয়ারে"র একটি কেন্দ্রীয় আবেগ হচ্ছে, বন্ধ্যা, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির

সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব অর্জনের জন্য যৌনকামনার তীব্র মুহূর্তকে নিজের অস্তিত্বে

জাগ্রত রাখা :


ক. হে প্রিয় আমার প্রিয়তম মোর !

আযোজন কাঁপে কামনার ঘোর,

অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার ? (ঘোড়সওয়ার)

খ. আমার কামনা ছায়ামূর্তির বেশে

পায়ে পায়ে চলে তোমার শরীর ঘেঁষে।

কাঁপে তনুবায়ু কামনায় থরোথরো

কামনার টানে সংহত গ্লেসিআর। (ঐ)

গ. পায়ে পায়ে চলে তোমার শরীর ঘেঁষে

আমার কামনা প্রেতচ্ছায়ার বেশে। (ঐ)


যৌবনাবেগকে সৃষ্টিশীলতার শক্তিতে রূপান্তরের গভীর আকুলতাই কবিচিত্তকেতীব্রগতি দিয়েছে। যৌনশক্তি আর সৃজনশক্তি যেন একই কেন্দ্রের উচ্ছলন বারূপান্তর। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় পরবর্তী “টপ্পা-ঠুংরি" কবিতার 'ফাঁকালিবিডো'র ফ্রয়েডীয় স্বরূপ বদলে যায় য়ুং-এর 'সামূহিক অবচেতনার'

(Collective unconscious) পরিপ্রেক্ষিতে উর্বরতার প্রতীকে। কবিসত্তারসৃষ্টিশীল অংশ প্রতীক্ষারত অবস্থাকে নিয়ে যেতে চায় সমষ্টির আত্মাহুতিতে,

অন্যদিকে কামনার অবদমনজনিত বিকার থেকেও পেতে চায় উদ্ধার।চোরাবালিতে পূর্ববর্তী অ্যান্টি-রোমান্টিসিজম পরিহার করে কবি প্রেমের

রতিবিলাস ও ভোগবাসনার বিকার-অবদমনস্পৃহাকে চিহ্নিত করতেচেয়েছেন। কামশক্তিকে দিতে চান সৃজনী আবেগের তুঙ্গ-মুহূর্ত, এ সূত্রেইঅশ্বারোহীকে আহ্বান করা হয়েছে। বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তিতে, ছয়মাত্রারগতিশীল মাত্রাবৃত্তে এবং অনুষঙ্গের পৌনঃপুনিকতায় কামনাময় নিজ্ঞান-লোক,সেই লোক থেকে সৃষ্টিসম্ভাবনায় উজ্জীবন এবং সচেতনমানবিক পূর্ণতারঅভিলাষ ব্যক্ত করেন আলোচ্য কবিতায়। ব্যক্তিরআত্মসত্তা নিঃসঙ্গতার

চোরাবালি থেকে উদ্ধারের মধ্য দিয়ে যে শক্তিতে হয়ে উঠবে চরিতার্থ,ঘোড়সওয়ার তারই প্রতীক। ঘোড়সওয়ার, হালকা হাওয়া — অনুষঙ্গদ্বয় তাঁর

পরবর্তী কবিতায় বহু গুরুত্ববহ অংশের যোগ্য প্রতিমায় রূপবদ্ধ হয়েছে।আলোচ্য কবিতাটি ছাড়াও প্রতীক্ষারত সত্তা ও সৃজনোন্মুখ অনুভূতিরপ্রকাশ ঘটেছে “সন্ধ্যা", "উভচর", "অপস্থার", "আত্মদান" ইত্যাদি

কবিতায়; এগুলোর অবয়বে অতীত স্মৃতি রোমন্থন কামনার পঙ্কিলতা, স্তব্ধ

প্রতীক্ষা, মুক্তির আবেগ প্রতিবিম্বিত হয়েছে—যা “ঘোড়সওয়ার" কবিতারই

সম্প্রসারণ। যেমন :


ক. অতীতের স্মৃতিগুলি হাত থেকে পড়ে ঝুঁকে,

এফেসাসী সুষুপ্তির এ জীবন গেল বুঝি চুকে,

সগরসস্তান সব জেগে ওঠে মনের গহ্বরে; (সন্ধ্যা)


খ. দিশাহারা চোখ, চরণ শ্রান্তিহীন

স্থিতি চাইনেকো, ঘুঘু নয় ওগো শ্যেন।

ঊর্ধ্বলোকের উদ্ধতগতি দাও,

হে মেরুচারিণী, তোমার চোখের নীল

কঠিন দীর্ঘ খড়গোদ্যত দিন

ঊর্ধ্বলোকের উদ্ধত গতি চরণ শ্রান্তিহীন। (উভচর)

তুষারভুঙ্গ চূড়ায় চূড়ায় ঘোরা !


অবচেতন কামনার প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয় গন্ধর্ব কিন্নর, উলূপী, যযাতিপ্রভৃতি পৌরাণিক পাত্রপাত্রী, যাদের অনুষঙ্গে রয়েছে যৌনাকাঙ্ক্ষা,

অমিতভোগ, দেহমিলনের অন্তহীন তৃষ্ণা, বাসনার অতৃপ্ত কামনা। প্রেমের এই

স্নায়ুপীড়া ও অবসাদগ্রস্ত রূপের মধ্যে যে পর্যাবসান, তা হচ্ছে আধুনিকমধ্যবিত্তের খণ্ডিত জীবনের যৌনবিকারের অর্থান্তর এবংতারই অন্তরালে

সংগুপ্ত রয়েছে কবির ব্যক্তিক জীবনের স্নায়ুর পীড়া, সৃষ্টিশীল রচনার নান্দনিকআবেগোত্থান এবং স্ববিরোধিতার সেই ক্ষেত্র—যেখানে তিনি আর দেশজবাস্তবতা আর বিশ্বসংস্কৃতির প্রতি সচেতনতাকে এক বিন্দুতে মেলাতে পারছেন

না। উভয়ের দ্বৈধতায় খণ্ডিত-কবিমানস মীমাংসার ক্ষেত্রে প্রথম উপজীব্যহিসেবে গ্রহণ করেছে প্রেমকে। প্রথম দু'টি কাব্যে এ-তাৎপর্যেই প্রেমবিষয়ক

ভাবনার অনুক্রমণ ঘটেছে। এর একদিকে মোহ-চাঞ্চল্য কামনা ওভোগাকাঙ্ক্ষার ব্যভিচার (যেমন “অপস্থার” কবিতা), প্রণয়ের সর্পিল গতি,উদগ্রতৃষ্ণা, অন্যদিকে দেখা যায় আত্মবিচ্ছিন্ন ফাঁপা নরনারীদের—ডলু,

সুরেশ, লিলি, অনিরুদ্ধ রায়দের মতো গৌড়জনের কৃত্রিম প্রেমের ব্যঙ্গাত্মক,অসংগতিমূলক প্রেমের আবহ। ভারতীয় প্রেমবাসনার ঐতিহ্য আর সমকালীন

কলকাতার মধ্যবিত্তের যৌন-বাস্তবতা—উভয়ের যোজনায় বিষ্ণু দে সেই

তাৎপর্য সঞ্চার করতে চাইলেন যে, এসবের ঊর্ধ্বে অন্যকিছু কামা। ভাবনার

নতুন পরিপ্রেক্ষিত যেমন চাচ্ছেন, তেমনি চান প্রাণধর্মের উজ্জীবন যে

উজ্জীবন কথনো ঘোড়সওয়ারের প্রতীকতায়, কখনো মহাশ্বেতার রূপকল্পে,

কখনো বা ঋষ্যশৃঙ্গের অনুষঙ্গে প্রবর্তনা লাভ করেছে। প্রেমবাসনায় প্রাণশক্তির

অন্তর্যোজনা বিশেষ একটি সূত্র, যেমন "পঞ্চমুখ" কবিতাংশ :


প্রেম যে আমার হল প্রতীক্ষায় প্রস্তুতিতে

দিন রাত্রি আজ চিরজাগা।

একদা আমারই হবে জয়।

বারবার বাতাসের হাতে লেগে লেগে,

পুঞ্জীভূত বাতাসের বেগে

বারে যাবে বিড়ম্বনা, মুক্তি পাবে মানস বলাকা। (পঞ্চমুখ, ৩)


মহাশ্বেতা, ওফেলিয়া, ক্রেসিডা শিল্প-এষণায় নৈরাত্মপন্থা---


সংস্কৃত কবি বাণভট রচিত কাদম্বরী কাব্যে মহাশ্বেতা চরিত্রটি ব্যক্তিত্বেরদৃঢ়তার প্রতীক। বিষ্ণু দে "মহাশ্বেতা" কবিতায় সংস্কৃত কাব্যের অতিরেকশৃঙ্গাররসের বিপরীতে তার প্রেম-সন্ন্যাসকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে শুভ্র,সৌন্দর্যমণ্ডিত করে বর্ণনা করেন, যার সাযুজ্য রয়েছে কবির প্রথম কাব্যেবর্ণিত কুমারী আর্টেমিসের শুভ্র পবিত্রতার সঙ্গে। কৃত্রিম প্রণয় ও অতিরেককামনার বিকারগ্রস্ত অবস্থার সঙ্গে বৈপরীত্য সৃষ্টির জন্যই বিষ্ণু দেসচেতনভাবে প্রেম-তপস্যার প্রতীক হিসেবে মহাশ্বেতা অনুষঙ্গটি ব্যবহার

করে। মহাশ্বেতার দেহসৌন্দর্য বর্ণনায় কবি দেহারতির ঊর্ধ্বে একটি অমলিন

পবিত্রতার বিভামণ্ডিত যৌবন ও চিরঅশ্রুময়ীর লাবণ্য ও মুক্তিবাসনার স্পৃহা

গড়ে তোলেন। দৃষ্টান্ত :


অমর লোকের ইশারা তোমার চোখে,

ক্রান্তিবলয় মিলায় সুমেরুলোকে।

আজ কি আমাকে ভুলেছ মহাশ্বেতা ?

অমৃতের ঝারি মদির ওষ্ঠাধরে

স্মৃতি-বিস্মৃতি শরতের ধারা ঝরে।

ভাস্বর তব তনুতে অমৃত জ্যোতি,

প্রাণ-সূর্যের একান্ত সংহতি (মহাশ্বেতা)


প্রাণ-সূর্যের প্রত্যাশী কবির পশ্চাতে বিরাজমান 'মরণ চাঁদের

আলো/দিগন্তফণা, তুহিন, পাণ্ডু, কালো। লক্ষণীয় "ঘোড়সওয়ার" কবিতায়বিঘ্নিত উদগ্রীব হৃদয়ের প্রতীক্ষারত অবস্থার সঙ্গে মহাশ্বেতার তপস্যাকাতর

আবহের সাদৃশ্য সমান্তরাল (উভয় কবিতাই ১৯৩৫ সালে রচিত)। উভয়কবিতায় চাঁদের আলো প্রযুক্ত হয়েছে খরসূর্যের বৈপরীত্যে এবং দেহকামনার

পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধারের কামনাও দুই কবিতায় একইরকম :


ক. চাঁদের আলোয় চাঁচর বালির চড়া।

এখানে কখনো বাসর হয় না গড়া?

সূর্য তোমার ললাটে তিলক হানে। (ঘোড়সওয়ার)

খ. ভাস্বর তব তনুতে অমৃত জ্যোতি

প্রাণ-সূর্যের একান্ত সংহতি।

পশ্চাতে ধায় মরণ-চাঁদের আলো। (মহাশ্বেতা)


কবিতাটি প্রথমে পত্রিকায় প্রকাশকালে ('পরিচয়', বৈশাখ ১৩৪৩) নাম ছিল

“জিজীবিষা”। চার স্তবকবিশিষ্ট মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত “মহাশ্বেতা” কবিতার

দিক থেকে শিল্পরচনার এষণা ও বারংবার মৃত্যু থেকে, কামবাসনা থেকে

বেঁচে-ওঠার আকাঙ্ক্ষার ভাষ্য।

“ওফেলিয়া” ও “ক্রেসিডা" কবিতাদ্বয় বিষ্ণু দে-র তৎকালীন

কাব্যাদর্শেরও সূচক; অর্থাৎ শুধু বক্তব্য নয়, এতে বলয়িত হয়েছে তাঁর

রূপরীতির নিরীক্ষাধর্মী পরিচর্যা। প্রেমের ক্ষেত্রে বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত

এই দুই ইয়োরোপীয় নারী একদিকে আর্টেমিস ও মহাশ্বেতার বিপরীধর্মী

অবস্থান হিসেবে, আরেকদিকে এলিয়ট কথিত objective correlativeরূপে প্রযুক্ত হয়েছে। ওফেলিয়ার প্রেমিক হ্যামলেটের জবানিতে “ওফেলিয়া”

কবিতায় বিষ্ণু দে আধুনিক বোধের প্রতিতুলিত অনুষঙ্গটি নির্মাণ করেন।প্রসঙ্গত সুধীন্দ্রনাথের অভিমত বিবেচনাযোগ্য,ওফেলিয়া যদিচ গীতিকবিতার শ্রেণীভুক্ত, তবু তার ভাববিস্তার একখানি পঞ্চাঙ্কনাটকের উপযোগী, এবং তাতে কবি শুধু প্রেমিকা সাধারণের সুদীর্ঘ জীবনকাহিনীরসার-সংগ্রহ করেন নি, সঙ্গে সঙ্গে এটাও দেখিয়েছেন যে, ঐ-রূপকথার বিয়োগান্ত


শরিগতির জন্যে কোনও পক্ষ অপরাধী নয়, সমাজবাসী জীবমাত্রেই প্রাক্তন পাতকেরউত্তরাধিকারী বলেন, ট্রাজেডি এখানে অবশ্যয়ানী।চোরাবালির প্রেম-সম্পর্কিত ব্যঙ্গ বা ব্যক্তিক বিক্ষেপ, ভাবনাবেদনা এখানেহ্যামলেটের প্রতীকতায় নৈর্ব্যক্তিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। হ্যামলেটের

চিত্তবিক্ষেপের সূত্রে কবিতার স্তবকবিন্যাস গড়ে ওঠে কখনো ভিন্ন-ভিন্নঅনুষঙ্গের অসংলগ্নতাকে আশ্রয় করে, কখনো বা প্রতিতুলিত প্রতিমার দ্বারা

আবার সংযোগও রচিত হয়। এই রীতিটির দুরূহ ভঙ্গি পাঠককে দ্বিধাগ্রস্তকরতে পারে, যেমন বুদ্ধদেব বসুর জিজ্ঞাসা ছিল '... ও দু'টি কবিতায় কেনযে এক স্তবকের পর আর এক স্তবক আসছে, সেটা আমার কাছে সবসময়স্পষ্ট নয়। একদিকে হ্যামলেটের মানসিক বৈকল্য তথা মনস্তাত্ত্বিক আবহ,অন্যদিকে কবিচিত্তের মধ্যে বিরাজিত দু'টি পরস্পরবিরোধী ভাবেরদোলাচল—প্রেমের নীলাভ রহস্যময়তা ও উজ্জ্বলতার পাশে অবিশ্বাস,সংশয়ের কালো মেঘের যে বুননক্রিয়া, ‘আশ্বিনের গাঁথা গানে'র পাশেইব্যক্ত হয় তুষার শীতল রাত্রির নিঃসঙ্গ মূর্তিরচনা যা স্তবকগুলোকেআপাতভাবে নিঃসম্পর্কিত কিন্তু অভ্যন্তরে দ্বৈধতায়-যন্ত্রণায় আবদ্ধ করে

রাখে। দৃষ্টান্ত :


ক. তুমি যেন এক পরদায় ঢাকা বাড়ি,

আমি অঘ্রান-শিশিরে সিক্ত হাওয়া

বিনিদ্র তাই দিনরাত ঘুরি ফিরি।

ঝোড়ো হাওয়া ছোঁড়ে কালো কালো বুনো মেঘ

আমি যে তোমাকে ভালবাসি, সে কি তাই শুধু ওফেলিয়া

চৈতি পূর্ণিমাকে।


খ. রাত্রি রয়েছে পাশে

তুষার শীতল কঠিনোজ্জ্বল ক্ষুরধার তরবারি

রাত্রি ও আমি একা।

?

(ওফেলিয়া)


আশ্বিনে গাঁথা গান যে আমার কুচি কুচি করে ছিড়ে

ভাসালে নিথর জলে। (ঐ)


বিষ্ণু দে-র হ্যামলেট নিঃসঙ্গ, প্রখর আত্মজ্ঞানসম্পন্ন, পীড়িত স্নায়ুবিকারে

বিদ্রি – আধুনিক যুগের নায়ক-সদৃশ। তার মূল্যবোধ বিনষ্ট-প্রায়, সত্তা তার

বিষ্ণু দে-র কবিশ্বভাব ও কাবাকপ


বিপর্যন্ত। হ্যামলেট চেয়েছিল ওফেলিয়ার প্রেমের নীলশিখায় 'জীবনের কৃষ্ণ

যবনিকা' ছিন্ন করবে। কিন্তু ওফেলিয়ার মৃত্যু তার সার্বিক পরাজয় ঘটায়।

বস্তুত বিষ্ণু দে সমগ্রজীবনের অবিশ্বাসকে ওফেলিয়ার প্রতি অবিশ্বাসের সূত্র

হিসেবে বিবেচনা করেন, অর্থাৎ ওফেলিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা (আসলেই কি সে

বিশ্বাসঘাতকিনী?) আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক থাকে না, তা হয়ে ওঠে জীবনের,

কালের ও মূল্যবোধ বিনষ্টির সংলগ্ন। প্রেমের শক্তিতে উজ্জীবনের সম্ভাবনা

ট্র্যাজিক আয়রনির আঘাতে বিচূর্ণ হয়ে যায়। কারণ রেশমি মেঘের আড়ালেই

থাকে বজ্রের যাওয়া-আসা, ফলে 'অমরাবতীর দৈবপ্রাচীর চুরমার হল মর্ত্য্য

লোকেই’। ওফেলিয়ার প্রেম-প্রসঙ্গের প্রতিতুলিত চিত্রকল্পরূপে কবি ব্যবহার

করেন দেবযানী ও প্রসার্পিনার অনুষঙ্গ :


দেবযানী। সাঁঝে তোমার প্রণাম


ক্লিষ্ট আমার দিবসের ক্ষমা বাজে

মাঝে

শাপমোচনের সুরভি সুরের পাঁকে পাঁকে এই সাধনা আমার।

(ওফেলিয়া)

পৌরাণিক কাহিনীতে" কচকে বারংবার মৃতসঞ্জীবনী প্রদানের মাধ্যমে

দেবযানী পুনর্জীবিত করেছিল— যেমন গ্রীক মিথে আর্টেমিস বাঁচিয়েছিলপ্রেমিক হিপোলিট্সকে। কচ চেয়েছিল মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যার গুপ্তরহস্য অধিগত

করতে। কবি ওফেলিয়ার প্রেমকামনা সূত্রে ভারতীয় দেবযানীর প্রসঙ্গ উত্থাপনকরেন 'অবজেকটিভ কোরিলেটিভ'-এর প্রযোজনায়। তেমনি ব্যবহৃত হয়গ্রীক পাতালকন্যা প্রসার্পিনার ইমেজ—ঐ প্রতিতুলিত আবেগের যাথার্থ্যসম্পাদনের জন্য; প্রসার্পিনা ফ্রয়েডীয় অবচেতন কামনার প্রতীকী-অর্থবহপ্রতিমা। পাতালরাজ কর্তৃক অপহৃত প্রসার্পিনা পৃথিবীতে যখন অবস্থান করে

তখনই ফুলফসল জন্মায়, পাতালে থাকাকালীন পৃথিবী হয়ে পড়ে শস্যফুল

শূন্য, বন্ধ্যা; কাজেই পাতালবাসিনী প্রসার্পিনা রুদ্ধ বাসনা, অবদমিত কামনারপ্রতীক— এই অর্থেই বিষ্ণু দে ব্যবহার করেন;


প্ৰসাৰ্পিনা কুসুমে ছায়, বৈতরণী পাশে

ছড়ায় আহা ! কোমল নীল ঘুমের আবাহন। (ওফেলিয়া)

কবির আধুনিক নায়কসত্তা সংকট-পীড়নে জীবনের ভারসাম্য ও বিশ্বাস

থেকে ভ্রষ্ট; এই ভ্রষ্টতা বিদ্যমান প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই প্রসার্পিনার উল্লেখেপ্রেমের রুদ্ধরতি-বাসনার রূপ ফুটে ওঠে। কিন্তু কবির প্রার্থনা—ঊর্ধ্বগতি ও

উজ্জীবনী শক্তি লাভ করা। চোরাবালি কাব্যে বিষ্ণু দে সম-আবেগসম্পন্নচিত্রকল্পের সংশ্লেষণে অন্বিষ্ট-আবেগের উন্মোচন ঘটিয়েছেন। সেই অন্বিষ্ট

আবেগটি হলো, 'ধূমকেতু এই বিরাটদাহন বিশ্ব'কে শেক্সপীয়রের নায়িকারসার্বভৌম প্রতীকী তাৎপর্যে বর্তমান কালের স্রষ্টরূপের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা।সমালোচক তাই বলেন, 'আশা ও নিরাশা, প্রেম ও বেদনা সেক্সপীয়রেরসার্বভৌম আবেদন ও কবির ব্যক্তিগত ভাবনাচেতনা সমন্বিত হয়ে একঅভিনব সিদ্ধির শিখরে পৌঁছেছে। তবে একই কবিতায় এজাতীয় নানা

বিরুদ্ধভাবের সমন্বয়রীতি সম্পর্কে বিপরীত মত পোষণ করেন অমলেন্দু বসু,

“ক্রেসিডা" কবিতা প্রসঙ্গে বলেছেন,


বিষ্ণু দের ক্রেসিডাতে আমার বিচারে প্রকরণগুলি উপস্থিত। কিন্তু তারা এত হ্রস্ব, এতক্ষীণ (প্রায় অদৃশ্য), সংযোগ সম্পর্কে তাদের ভাবানুষঙ্গে প্রবহমানতার ও সঙ্গতিরঅভাব যে আলাদা অংশগুলি আলাদাই রয়ে গেছে। কবির সৃজনীপ্রতিভা কোনোসুঠাম প্যাটার্নে রূপায়িত হয়নি।সুঠাম প্যাটার্ন গঠন মূল অর্থেই কবির কাম্য নয়, তাঁর লক্ষ্য চিত্তের বিচ্ছিন্নতাও আর্তির পারম্পর্যহীন রূপটির প্রতীকায়ন।

অনুরূপ রীতির প্রকাশ ঘটেছে “ক্রেসিডা” শীর্ষক কবিতায়। ক্রেসিডাওপ্রেমের ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, প্রেমিক ট্রয়লাসের প্রতি সে একনিষ্ঠথাকে নি। ক্রেসিডা-ট্রয়লাসের আদি প্রণয়কাহিনী বোক্কাচিও, চসর, স্কচ কবিহেনরিসন ও শেক্সপীয়র স্ব-স্ব যুগ ও কবিমানস অনুযায়ী রূপান্বিত করেছেন।বিষ্ণু দে-র ‘প্রণয়-সংক্রান্ত ভাবনা-বেদনা প্রবর্ধমান বলেই উক্ত মহাকবিদের

প্রত্যেককে পৃথকভাবে তাঁর অসম্পূর্ণ লেগেছে। ফলে তিনি চসর, হেনরিসনও শেক্সপীয়রেকে তাঁদের ভিন্নতা সত্ত্বেও যেমন একসঙ্গে ব্যবহার করেন,তেমনি নিজস্বতায় এক ধরনের নান্দনিক সম্পূর্ণতা প্রদানকরেন—যাতে

মধ্যযুগের রেনেসাঁসের প্রেক্ষাপট থেকে আধুনিক মানসতায় উত্তরণ ঘটে যায়।বিষ্ণু দে ট্রয়লাসের ভাষ্যে একালের নায়কের অন্তর্বেদনা, নিঃসঙ্গতা,যন্ত্রণাজর্জর আত্মখণ্ডায়নের অনুভূতি প্রবিষ্ট করান, তাঁর এই ‘নায়ক কল্পনায়ফুটে উঠেছে একালের জটিলতার মাঝে প্রহত নায়কের জীবনবিস্ময়— জিগীষা নয়, জিজীবিষা। ১ এটাই এলিয়ট-কথিত সেই রীতিযেখানে নৈর্ব্যক্তিকভাবে জটিল জীবনাভিজ্ঞতা ও অভীপ্সাকে কালের পটেধারণ করা হয়, যে-পন্থাকে তিনি অভিহিত করেছেন mythical way বলে,

'It is, I seriously believe a step towards making the modern

world possible for art. বর্তমানতা ও বাস্তবতাকে শিল্পিত করবার এটাএকটা শিল্পপদ্ধতিও বটে।

“ক্রেসিডা” কবিতায় ট্রয়লাসকে ভুলে গিয়ে ক্রেসিডা ডায়মিডিসের প্রতিপ্রধাসত হয়ে পাশ করেছিল, ফলে মধ্যযুগীয় নীতিবোধে তাকে প্রায়স্তিত্তেরকাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে বিশেষত রবার্ট হেনরিসনের 'The Testament

of Cressied' কবিতায় ক্রেসিডা কুন্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছিল। মধ্যযুগীয়পরিপ্রেক্ষিতে ইয়োরোপে বিশ্বাসঘাতিনী হিসেবে তাকে অভিযুক্ত করার এইমানসিকতা তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোরই প্রকাশক। বিষ্ণু েট্রালাসের প্রেমের বিপর্যয়কে দেখেন নারীর বিচারিণী ভূমিকার মধ্যে নয়,

ট্রাযুদ্ধের মত বৃহৎ বিপর্যয়ের সঙ্গে যুক্ত করে। কবির দৃষ্টিলোকে বর্তমান

কালের সংকটান্ত পরিস্থিতি ট্রয়লাসের অনুষঙ্গের প্রতিসাম্যে বাঙ্ময় হয়ে

ওঠে। ট্রয়যুদ্ধ ও কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গন আলাদা হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানের প্রতি

সম-সংবেদনা জ্ঞাপন করতে থাকে :


হেলেনের প্রেমে আকাশে বাতাসে ঝঞ্ঝার করতাল।

দ্যুলোকে ভূলোকে দিশাহারা দেবদেবী।

কাল রজনীতে ঝড় হয়ে গেছে রজনীগন্ধা-বনে।

বৈশাখী মেঘ মেদুর হয়েছে সুদূর গগনকোণে।

কুরুক্ষেত্রে উড়েছে হাজার রথচক্রের ধূলি।

স্বপ্ন-গোধূলি ডুবে গেল খর-রক্তের কোলাহলে। (ক্রেসিডা)


আলোচ্য কবিতায় পটভূমির বৃহৎ আয়তনে যেমন রয়েছে ঝড়ের সর্বনাশ,বিশৃঙ্খলা-বিপর্যয়, তেমনি ব্যক্তিজীবনের চিত্তেও বাতাসের হাহাকার, পূর্বপ্রণয়ের অনন্ত-স্মৃতির জ্বালা। খর-রক্তের কোলাহল' ব্যক্তির স্বপ্ন ও প্রেমকেঢেকে দিয়েছে। এইসব বিপর্যয়কর পটভূমির চিত্রায়ণে-কালের ও ব্যক্তির,

বিষ্ণু দে ব্যবহার করেন মেঘের ইমেজ; কবিতাটির দু'টি অংশে রং-বদলকারী

দ্রুতগমনশীল মেঘের দৃশ্য রয়েছে :


ক. লাল মেঘে ঠেলে নীল মেঘ, নীলে ধোঁয়া মেঘেদের ভিড়।

মেঘে মেঘে আজ কালো কল্কির দিন হল একাকার।

(ক্রেসিডা)


থ, পাহাড়ের নীল একাকার হল ধূসর মেঘের স্রোতে

পাঁচ পাহাড়ের নীল।বাতাসেরা সব বাসায় পালাল মেঘের মুষ্টি হতে। (ঐ)

এই বিপর্যয় ব্যক্তিপ্রেমকে হেলেনের প্রেমের ধ্বংসের সঙ্গে বিজড়িত করে এবংকালের সত্যকে মেনে নেয় অমোঘ বলে, কেননা, 'সময়ের থলি, শতছিদ্র কীটকাটে’, তাই ট্রয়লাস ক্রেসিডার প্রেমকে মৃতবৎ জেনে পরিত্যাগ করে সম্মুখদিকে এগিয়ে যায় ও উজ্জীবনে উদ্বুদ্ধ হয়।কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে বিষ্ণু দে ট্রয়লাসের পরাজয়কে তুচ্ছ করে তাকে করে

সব জাগতিক শোকের অকিঞ্চিৎকরতার ঊর্ধ্বে। নিজেকেবর্মে ঢেকে ফেলেন,যেখানে ক্রেসিডার বা ব্যর্থ হয় আঘাত হানতে-বর্শা তোমার হয়ে গেল বান

পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিজয়ী ট্রয়লাস যখন জয়গানে অভ্যর্থিত হতে থাকে, তখন

সেখানে কৃষ্ঠরোগ্যস্তা ক্রেসিডা তার বিগত-সৌন্দর্য নিয়ে পরাজিতের

ভূমিকায় দাঁড়ানো। কবি এই ট্র্যাজিক পরিহাসের মধ্যে জীবনেরপরিক্রমণকে, 'জিজীবিষু পরিভ্রমণকে ব্যক্ত করেন ‘বাদী, বিবাদী ওঅনুবাদীভাবের নাটকীয় প্রতিসাম্য ঘটিয়ে এবং প্রাক্তনকে বাদ দিয়ে নতুনউত্তরণের লক্ষ্যে যাত্রার বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে, যদিও ‘স্মরণেতোমার হানে আজো তরবারি।

“ওফেলিয়া” ও “ক্রেসিডা" কবিতার আরেকটি অভিনব রীতি হচ্ছে

লিরিক আবেগকে ক্লাসিক রূপবন্ধের কাঠিন্যে সংযত করা। উর্বশী ওআর্টেমিস-এর কবিতায় লিরিক-চেতনার প্রকাশ লক্ষ করা গেছে, ভারতীয়

লিরিক কাব্য-পরম্পরার সংযোগে নিজেকে সন্নিহিত করেই কবি অগ্রসরহয়েছেন। প্রথাগত লিরিকে আধুনিক আত্মসচেতনতা ও আততি প্রকাশেরই-বিপ্রতীপ ভঙ্গিটি লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ উক্তিকরেছিলেন, ‘বাঁধা নিয়মেসুঠাম ভঙ্গিতে স্রোতের ধারা চলছে না, *। লিরিক ব্যবহারের আগ্রহ

নৈরাত্ম্যপন্থী কবিদের কাব্যরচনাকে সঞ্চালিত করলে সেখানে পরিণামতকঠিন-তরলের দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে। “ক্রেসিডা”র লিরিকতা ধ্রুপদী যাথার্থ্যসংহত অথচ গতিবান, এমনকি আবর্ত-সংকুল। লিরিকের শিখিলতা,আবেগ ও অতিকথনকে পরিমিত করার উদ্দেশ্যে বিষ্ণু দে বিভিন্ন মিথউল্লেখ অথবা কাব্য-প্রসিদ্ধির অবতারণায় ক্লাসিক বন্ধনকে অপরিহার্যতাদেন। বিষ্ণু দে-র কবিতায় লিরিক ও ক্লাসিকের স্বরূপ আলোচনা প্রসঙ্গেরঞ্জিৎ সিংহ বলেন,

পিরিকতার মেজাজ সত্ত্বেও লিরিকতার অন্তর্বাহী অতিকথন, আবেগোঞ্জাস ইত্যাদিকে

বিষ্ণু সে যে কেন বরদাস্ত করতে পারেন নি, তা শুধু প্রমাণ করে, তিনি সর্বান্তঃকরণ

ধ্রুপদী মাধার্থ্যের অনুরাগী। অনুরাগী বলেই কথোপকথনের ভঙ্গি তথা গদ্য-পদ্যের

নির্বিরোধ তাঁর প্রকরণগত অভিপ্রায়ের অন্তর্ভুক্ত। বিষ্ণু দে যে শেষণীয়বীয় গতিময়

নৈরাত্ম্যতার উত্তরসাধক তাঁর চিত্রকল্পনাদি সেই পরিচয় বহন করে।এই গতিময় নৈরাত্মপন্থা বিষ্ণু দে-র পরবর্তী দীর্ঘ আঙ্গিকের মহাকাব্যিকফর্মে আত্মসংগতি লাভ করেছে। একেই আমরা বলতে চাই আধুনিকতারক্লাসিক্যাল রূপবক্ষন।

আলোচ্য কাব্যের "মহাশ্বেতা” কবিতায় উক্ত নৈরাত্মপন্থার গতিময়তা

(dynamme classicism) সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে। বাণভটেরকাদম্বরীর প্রধান পার্শ্বচরিত্র মহাশ্বেতার রূপবর্ণনায় যে সৌম্য, পবিত্রভাব ও

বিভা রয়েছে, সেই মহাশ্বেতার ধ্রুপদী অনুষঙ্গ কবির ব্যক্তিচিত্তেরসৌন্দর্যভাবনার সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তোলে। অর্থাৎ বিষ্ণু দে-র কবিতায়চিত্রকল্পের ভিত্তির ওপরেই ধ্রুপদরীতি স্থিতিশীল হয়েছে—পুরাণ বামধ্যযুগীয় পন্থায় রূপকের দ্বৈতস্তরে নয়। পৌরাণিকঅনুষঙ্গের পটভূমিকায়

লিরিকতার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা যেমন কবির রীতির ক্ষেত্রে আয়াসসাধ্য,তেমনি সে-সঙ্গে দেখা যায় বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ লিরিক রচয়িতারবীন্দ্রনাথকে বৈপরীত্যে আত্মস্থ করার নিহিত তাগিদ। এ করণকৌশলটিমূলত এলিয়ট থেকে আহৃত। কবিতার অন্তর্গত কাঠামোতে অনুভূতির ঐক্য,চিত্রকল্পের সংশ্লেষণ, উল্লেখ-উদ্ধৃতির সুপ্রচুর প্রয়োগ ও ধ্রুপদ-কাঠিন্য সৃষ্টিরমধ্য দিয়ে বিষ্ণু দে এলিয়টের প্রকরণরীতির বৈশিষ্ট্যাদি আত্মসাৎ করেছেন।তবে আলোচ্য পর্বে এলিয়টের অখণ্ড অনুভূতি সৃষ্টির ঐক্যবোধটি বিষ্ণু দেতখনো আয়ত্ত করতে পারেন নি। বরং বিষয়ের পরম্পরা প্রায়শ বিচ্ছিন্ন,খণ্ডিত ও দুর্বোধ্যই থেকে গেছে, তবে এসব ত্রুটি ঢেকে যায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দেরস্বচ্ছন্দ গতিপ্রবাহ সৃষ্টির অভিনবত্বে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ