Hot Posts

6/recent/ticker-posts

পলাশীর যুদ্ধ ও সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ

 


পলাশীর যুদ্ধ:-

ভারতবর্ষের ইতিহাসে আলিবর্দী খান একটি অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলী এবং জাতিতে তিনি ছিলেন

— তুর্কি বংশীয় । প্রথমে তিনি বিহারের শাসনকর্তা ছিলেন এবং পরে স্বীয় যোগ্যতায় ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে গিরিয়ার যুদ্ধে বাংলার নবাব সরফরাজ খানকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার নবাব হন।

মারাঠা বা বর্গী দমন তাঁর শাসনকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ।। ইংরেজদের সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন ও সজাগ ছিলেন এবং ইংরেজরাও তাঁকে যথেষ্ট সমীহ করে চলত। নবাব আলিবর্দী খানের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। ছিল আমেনা, মায়মুনা ও ঘষেটি নামে তিন কন্যাসন্তান। আমেনা ও মায়মুনার দুই পুত্র ছিল; কিন্তু ঘষেটি বেগমের কোনো পুত্র ছিল না।

চিত্র : নবাব আলিবর্দী খান আলিবর্দী খান আমেনার পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাই মৃত্যুর পূর্বেই তিনি সিরাজকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।

১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে সিরাজউদ্দৌলা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মির্জা মুহম্মদ হাসিম জয়নুদ্দীন খান। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে নবাব আলিবর্দী খানের মৃত্যুর পর মাত্র ২২ বছর বয়সে সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন। মসনদে আসীন হওয়ার পর থেকেই সিরাজ নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। কেননা তাঁর সিংহাসন আরোহণকে আলিবর্দী খানের অপর দুই কন্যা সহজে মেনে নিতে পারে নি; তাই বিশেষ করে তাঁর বড় খালা ঘষেটি বেগম সিরাজের এক খালাতো ভাই শরত জঙ্গকে মসনদে বসানোর জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এতে ইন্ধন যোগায় ঘষেটি বেগমের দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ অন্যদিকে নবাবের প্রধান সেনাপতি ও বখশী মীর জাফরের ভূমিকাও ছিল কুচক্রীর। এদের প্ররোচনা ও সমর্থনে উৎসাহিত চিত্র : নবাব সিরাজউদ্দৌলা হয়ে পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ সিরাজের প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করেন এবং তাঁর আনুগত্য মেনে নিতে অস্বীকার করেন।

সিরাজউদ্দৌলা মসনদে আরোহণ করার পর পরই উপলব্ধি করেন, ঘরের শত্রুকে দমন করতে না পারলে তাঁর মসনদ নিষ্কণ্টক হবে না।তিনি প্রথমে প্রশাসনে কতিপয় রদবদল করেন। বখশীর পদ থেকে মীর জাফরকে অপসারণ করে মীর । মদনকে ঐ পদে নিযুক্ত করেন। তাঁর পারিবারিক দেওয়ান মোহনলালকে সচিব পদে উন্নীত করেন এবং তাকে মহারাজা উপাধিসহ প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। মোহনলালের পিতৃব্য জানকিরামকে 'রায় রায়ান উপাধিসহ নিজের দেওয়ান নিযুক্ত করেন। এরপর নবাব শত্রুদের বিরুদ্ধে আঘাত হানেন। প্রথমে তিনি ঘষেটি বেগমের মতিঝিল প্রাসাদ অবরোধ করে ধনরত্নসহ তাঁকে নবাবের মনসুরগঞ্জ প্রাসাদে নিয়ে এসে কৌশলে নজরবন্দী রাখেন। তখন খালাত ভাই শওকত জঙ্গ বিদ্রোহ করলে তাকে দমনের উদ্দেশ্যে পূর্ণিয়া, অভিমুখে যাত্রা করেন এবং যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে পূর্ণিয়া দখল করেন।

সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে পারিবারিক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলেও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র নতুনভাবে শুরু হলো। একদিকে রাজদরবারের প্রভাবশালী দেশীয় রাজন্যবর্গ ও অপরদিকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। প্রতিনিয়ত তারা সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করায় পলাশীর যুদ্ধের পটভূমি তৈরি হতে থাকে।


পলাশীর যুদ্ধের কারণ


পলাশীর যুদ্ধের বেশকিছু কারণ বিদ্যমান ছিল। এ কারণগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো

প্রথমত, সিরাজ যখন মসনদে বসেন তখন প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকগণ উপঢৌকনসহ তাঁকে অভিনন্দন জানায়, কিন্তু ইংরেজ বণিকরা তা করে নি। এ স্বীকৃত রীতি উপেক্ষা করায় নবাবের প্রতি অসম্মান করা হয়। এতে সিরাজ অপমানিত বোধ করেন এবং ক্ষুব্ধ হন।

দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ইংরেজরা ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে অবাধে 'দস্তক' ব্যবহার শুরু করলে এদেশীয় ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নবাব বাণিজ্য শর্ত মেনে চলার নির্দেশ প্রদান করলে ইংরেজরা তা অমান্য করে। ফলে নবাব ইংরেজদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন

তৃতীয়ত, ইংরেজরা নবাব আলীবর্দী খানের সময় বাণিজ্য করার অনুমতি পেলেও দুর্গ নির্মাণ করার অনুমতি পায় নি। কিন্তু সিরাজের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজরা কলকাতায় এবং ফরাসিরা চন্দনগরে দুর্গ নির্মাণ শুরু করলে সিরাজ তাদের দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করতে আদেশ দেন। এ আদেশ ফরাসিরা মান্য করলেও ইংরেজরা তা অমান্য করে। এজন্য নবাব তাদের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।

চতুর্থত, ইংরেজরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে সন্ধির যাবতীয় শর্ত ভঙ্গ করে জনসাধারণের ওপর অত্যাচার ন্তু শুরু করে ও নবাবকে কর প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

পঞ্চমত, বড় খালা ঘষেটি বেগম ও পূর্ণিয়ার শাসক শওকত জঙ্গ নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন করেন। এতে নবাব ইংরেজদের ওপর অসন্তুষ্ট হন।

ষষ্ঠত, ঘষেটি বেগমের পক্ষ অবলম্বনকারী রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস ও তার পরিবার প্রচুর ধনদৌলতসহ কলকাতায় পালিয়ে গিয়ে ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করে। কৃষ্ণদাসকে নবাব সরাসরি তাঁর নিকট সমর্পণের জন্য নারায়ণ দাসকে দূত হিসেবে ইংরেজদের কাছে পাঠান। কিন্তু ইংরেজ গভ: ডেক নবাবের দূতকে কলকাতা থেকে অপমানিত করে বের করে দেন ও কৃষ্ণদাসকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেন। ইংরেজদের এসব আচরণে নবাব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।

১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব ইংরেজদের ধৃষ্টতায় অতিষ্ঠ হয়ে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ৪ জুন এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে নবাব কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করেন। নবাবের এ অতর্কিত আক্রমণে ভীত হয়ে গভর্নর ড্রেক ও তার সঙ্গীরা ফোর্ট উইলিয়াম ছেড়ে 'ফুলতা' নামক স্থানে আশ্রয় নেয়। ফলে সহজেই নবাব কলকাতা দখল করেন ও আলিবর্দী খানের নামানুসারে এর নাম রাখেন 'আলীনগর' || ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন মি. হলওয়েল ও তার সঙ্গীরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। আত্মসমর্পণের পর কোনো ইংরেজের ওপর অত্যাচার করা হয় নি। অথচ হলওয়েল মুক্তি পেয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালায় যে, নবাবের আদেশে ১৪৬ জন ইংরেজ বন্দীকে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪.১০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট ছোট একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল। জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে এদের মধ্যে ১২৩ জন শ্বাসবন্ধ হয়ে মারা যায়। বাকি ২৩ জন কোনো রকমে বেঁচে যায়। হলওয়েল কর্তৃক প্রচারিত এ কাহিনী ইতিহাসে অন্ধকূপ হত্যা' নামে পরিচিত। অন্ধকূপ হত্যা' কাহিনীর পেছনে কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। ইংরেজদেরকে নবাবের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করাই ছিল এ কল্পিত কাহিনীর উদ্দেশ্য। নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা অধিকার করার পর সেনাপতি মানিক চাঁদকে কলকাতা রক্ষার দায়িত্বে রেখে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ফিরে যান। ইতোমধ্যে অন্ধকূপ হত্যা কাহিনী এবং নবাব কর্তৃক কলকাতা দখলের সংবাদ মাদ্রাজে পৌঁছলে ইংরেজ সেনাপতি ওয়াটসন ও রবার্ট ক্লাইভ মানিক চাদের নামমাত্র প্রতিরোধ ভেঙে কলকাতা পুনরায় দখল করেন। নবাব চারদিকে ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল লক্ষ করে ইংরেজদের সাথে এ অবস্থায় এক অপমানজনক সন্ধি করতে বাধ্য হন। এ সন্ধিই বিখ্যাত 'আলীনগরের সন্ধি' নামে খ্যাত।।এ সন্ধির শর্তানুসারে নবাব দিল্লির সম্রাট কর্তৃক ইংরেজদের প্রদত্ত সকল বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি প্রদান, টাকশাল নির্মাণ এবং দুর্গ সংস্কার করার অনুমতি প্রদান করতে বাধ্য হন।

কিন্তু উচ্চাভিলাষী ক্লাইভ এরপরও নবাবের ওপর সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির স্বার্থ, সংরক্ষণের জন্য তিনি সিরাজকে সিংহাসনচ্যূত করার লক্ষ্যে কতিপয় স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতালোভী কুচক্রী, দেশদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী দলের সাথে গোপনে যত্নযন্ত্র শুরু করলেন।

পলাশীর যুদ্ধের ঘটনা

ইউরোপে ইতোমধ্যে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের মধ্যে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু হলে সে সূত্র ধরে নবাবের নিষেধ সত্ত্বেও ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ফ্লাইভ ফরাসি বাণিজ্য কুঠি চন্দনগর দখল করে নেয়। ফলে আত্মরক্ষার্থে ফরাসিরা মুর্শিদাবাদে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইংরেজদের এ অশোভন উদ্ধত আচরণের জবাব দেওয়ার জন্য সিরাজ দাক্ষিণাত্যের ক্ষুরাসি সেনাপতি রুসীর সাথে পত্রালাপ করেন।। দূরদর্শী ক্লাইভ নবাবের এ কাজের উদ্দেশ্য অনুধাবন করে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে সিরাজের পরিবর্তে তার মনোনীত প্রার্থী প্রধান সেনাপতি আলীবর্দী খানের ভগ্নিপতি মীরজাফরকে সিংহাসনে বসানোর জন্য। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এ সব ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিলেন ধনকুবের জগৎশেঠ, সেনাপতি মীরজাফর ও বাহদুর্গত, আস্থাভাজন উমিটান, দেওয়ান রাজবল্লব প্রমুখ। নবাবির বিনিময়ে ইংরেজদের পৌনে দু কোটি টাকাপ্রদানের অঙ্গীকারে ক্লাইভের সাথে মীরজাফর আলী খান এক গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ গোপন চুক্তির কথা উমিচাদ ফাঁস করার ভয় দেখালে চিত্র: মীরজাফর ক্লাইভ তাঁকে প্রচুর অর্থ প্রদানের অঙ্গীকারসহ একটি জাল চুক্তিপত্র তৈরি করেন। এ জাল চুক্তিপত্রে ওয়াটসন স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করলে ক্লাইভ নিজেই তাতে স্বাক্ষর করেন।

ইতোমধ্যে ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে সন্ধি ভঙ্গের মিথ্যা অজুহাতে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইংরেজদের দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপে নবাব আগে থেকেই সচেতন ছিলেন। - এজন্য তিনি ৫০টি কামানসহ ৫০ হাজার পদাতিক ও ১৮ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী মুর্শিদাবাদের ২৩ মাইল দক্ষিণে ভাগীরথী নদীর তীরে মোতায়েনের আদেশ দিলেন। অন্যদিকে, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন ক্লাইভ ৮টি কামানসহ ১,০০০ জন ইউরোপীয় ও ২,০০০ জন দেশীয় সৈন্যসহ পলাশীর আম্রকাননে অবস্থান নিলেন। বাংলার ভাগ্য ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে নির্ধারণ হয়ে যায়। ইংরেজদের সৈন্যবাহিনী যখন দেশপ্রেমিক মীরমদন ও মোহন লালের আক্রমণে প্রায় পর্যুদস্ত তখন মীর জাফর যুদ্ধক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলেন। মীরমদন এসময় হঠাৎ গোলার আঘাতে নিহত হলে চিত্র : লর্ড ক্লাইভ মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন।

নবাব মীরমদনের মৃত্যু সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে তাৎক্ষণিক ডেকে পাঠান এবং বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অনুরোধ করেন। পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার মিথ্যা শপথ করেন বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর। এদিকে মোহনলাল ও সিনফ্রের বাহিনী যখন নবাবের বিজয়কে সুনিশ্চিতের পথে নিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে মীরজাফরের পরামর্শে নবাব যুদ্ধ বিরতির আদেশ নিয়ে অনুরদর্শিতার পরিচয় দেন।

যুদ্ধ বিরতির ফলে নবাব বাহিনী যখন রাত্রিতে বিশ্রামরত তখন মীরজাফরের ইঙ্গিতে ইংরেজ বাহিনী রণক্লান্ত নবাব শিবির আক্রমণ করে সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ফলে নবাব পরাজিত হন।

নবাব পুনরায় মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং অবশেষে স্ত্রী লুতফুননেসা ও কন্যাকে নিয়ে নৌকাযোগে পলায়নের চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজমহলের পথে ভগবান গোলায় ধৃত ও বন্দী হন। তাঁদের মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয়। পরে মীরজাফরের পুত্র মীরনের আদেশে মোহাম্মদী বেগ নরারকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। আর এভাবেই দেশপ্রেমের পরাজয় হলো, আর বিশ্বাসঘাতকদের জয় হলো পলাশীর

প্রান্তরে । প্রশস্ত হলো ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিজয়ের পথ।

নবাবের পতনের কারণ


পলাশীর যুদ্ধ মূলত বিরাট ও ভয়াবহ যুদ্ধ ছিল না। ছিল একটি খণ্ড যুদ্ধ। কেননা এ যুদ্ধের পরিস্থিতি ও গুরুত্ব বিচার করলে এ যুদ্ধকে কখনই বিরাট যুদ্ধরূপে চিহ্নিত করা যায় না। এ যুদ্ধে নবাব বাহিনীর পরাজয়ের - পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ লক্ষ করা যায়-

প্রথমত, মীরজাফর ও তার সহযোগীদের বিশ্বাসঘাতকতাই ছিল নবাবের পরাজয়ের প্রধান কারণ। প্রধান সেনাপতি হিসেবে বিজয়ের মুহূর্তে তিনি সবাধকে ভুল পরামর্শ দেন ও যুদ্ধক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন।

দ্বিতীয়ত, নবাবের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অভাব এবং মাতামহের অত্যধিক স্নেহপ্রাচুর্যের মধ্যে লালিত-পালিত হওয়ায় সিরাজের চরিত্রে কঠোরতা ও দৃঢ়তার অভাব ছিল। ফলে সংকট মুহূর্তে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন এবং ষড়যন্ত্রের খবর পাওয়া সত্ত্বেও দুর্বলতার কারণে তিনি কারও বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহসী হন নি।

তৃতীয়ত, পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে সুনিশ্চিত বিজয়কে উপেক্ষা করে নবাবের যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা তাঁর সমরনীতির অপরিপকৃতার ও পরনির্ভরশীলতার পরিচয় বহন করে, যা তাঁর পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।

চতুর্থত, ফরাসিরা তাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাঁকে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার পরেও তিনি তাতে কর্ণপাত করেন নি। নবাব আলিবর্দী খানও মৃত্যুর আগে সিরাজকে ইংরেজদের শক্তি বৃদ্ধি সম্পর্কে সতর্ক করে যান। মূলত নবাবের মধ্যে চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব দেখা দিয়েছিল।

পঞ্চমত, নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিতেও কর্মচারী, সভাসন, সেনাপতি, ব্যবসায়ী, ধনকুবের ও সৈন্যরা দ্বিধাবোধ করে নি।

ষষ্ঠত, রবার্ট ক্লাইভ সূক্ষ্ম কূটনীতি, উন্নত রণকৌশল এবং রণসম্ভারে নবাব অপেক্ষা অনেক বেশি পারদর্শী ছিলেন। ফলে ক্লাইভের নিকট নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় নিশ্চিত ছিল।

পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব

ভারতবর্ষের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ একটি বেদনাবহুল খণ্ড যুদ্ধ হলেও এ যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের পাশাপাশি বিশেষ করে ইংরেজদের অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এ যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম-

প্রথমত, পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার অকাল মৃত্যু হলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য দীর্ঘদিনের জন্য অস্তমিত হয়।

দ্বিতীয়ত, মীরজাফর এ যুদ্ধের ফলে নামেমাত্র নবাব হলেন কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা রয়ে গেল ইংরেজদের হাতেই।

তৃতীয়ত, ভারতবর্ষে পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজদের সার্বভৌমত্ব স্থাপিত না হলেও তারা নতুন নবাবের কাছ থেকে নগদ এক কোটি টাকা এবং চব্বিশ পরগনার বিশাল জমিদারি লাভ করেন। ফলে ইংরেজদের বাংলার রাজনীতিতে যখন তখন হস্তক্ষেপের পথ সুগম হয়।


চতুর্থত, ইংরেজরা এ যুদ্ধের ফলে বাংলায় একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে আর এদেশীয় বণিকদের সমাধি রচিত হয়।

পঞ্চমত, ইংরেজরা এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে বাংলাসহ দাক্ষিণাত্যে প্রভাব বিস্তার করে ফরাসি বণিকদের বিতাড়িত করে এবং একচেটিয়াভাবে ভারতবর্ষের সম্পদ আহরণ ও ইংল্যান্ডে প্রেরণের ফলে এদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। ষষ্ঠত, ইংরেজদের সামরিক শক্তি ও প্রতিপত্তি সম্পর্কে এ যুদ্ধের ফলে জনগণের মনে উচ্চ ধারণার সৃষ্টি হয়।

এবং সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। সপ্তমত, পলাশীর যুদ্ধের পর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ভারতবর্ষের সামাজিক- সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সাধিত হয়। মূলত ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখেই ভারতবর্ষের মধ্যযুগ শেষেআধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল।

ঐতিহাসিক আর.সি. মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, “পলাশীর যুদ্ধ বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। কালক্রমে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের বক্সারের যুদ্ধে তারা নবাব মীর কাসিম ও ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে পরাজিত করে সমগ্র ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করে। " ]

সর্বোপরি, পলাশীর যুদ্ধের ফলে ইংরেজ কর্মকর্তারা বিপুল ধনসম্পদের মালিক হয়; যা পরবর্তীতে তাদের ভারতবর্ষব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনে সহায়ক হয়েছিল।

পলাশীর যুদ্ধ (The Battle of Plassey)

তারিখ: ২৩ জুন, ১৭৫

ভাগীরথী নদীর তীর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

* পক্ষসমূহঃ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা 

*সিরাজউদ্দৌলাকে সমর্থন করে। ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

ও প্রধান সেনাপতি: ব্রিটিশদের পক্ষে রবার্ট ক্লাইড ও বাংলার পক্ষে মোহনলাল

* বাংলার সেনাবাহিনীর ভ্যানগার্ড ছিলেন-মীর মদন

* বাংলার পক্ষে যুদ্ধ করা ফরাসি সেনাপতি: সিন ফ্রে

* সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকা করা সেনাসদস্য। মীর জাফর

(অশ্বারোহী), রায় দুর্লভ, খুদা-ইয়ার-লুৎফ খান।

* সিরাজের পক্ষে লড়ে যাওয়া সেনা সদস্য মীর মদন, মোহন লাল, নবে সিং হাজারী ও বাহাদুর খান

* সেনা সংখ্যা: ব্রিটিশদের পক্ষে ১০০০ ইউরোপীয় ও ২১০০ ভারতীয় সেনা।

অপরদিকে বাংলার পক্ষে ৫০,০০০ সেনা থাকলে ওযুদ্ধে অংশ নেয় ৫,০০০ সেনা । * যুদ্ধের কারণ: নবাবকে কোম্পানির কর না দেয়া, কোম্পানি কর্তৃক দত্তকের অপব্যবহার।

তথ্য সংগ্রহ :-

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস (১৭৫৭-১৯৭১) : প্রথম পত্র

বেসিক ভিউ--মোঃ নাঈম ইসলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ