Hot Posts

6/recent/ticker-posts

বেনেদেত্তো ক্রোচের নন্দনতত্ত্ব /শিল্পভাবনা শিল্পসাহিত্য নন্দনতত্ত্ব ক্রোচের প্রকাশতত্ত্ব

 


বেনেদেত্তো ক্রোচের নন্দনতত্ত্ব /শিল্পভাবনা শিল্পসাহিত্য নন্দনতত্ত্ব /ক্রোচের প্রকাশতত্ত্ব/ নন্দনতত্ত্বঃ-

সাহিত্য সমালোচক হিসাবে ক্রোচেকে বলা হয় প্রকাশ বাদের উদ্‌গাতা। তিনি শিল্পকে বিশ্লেষণ করেছেন গভীর তত্ত্বানুসন্ধানী দৃষ্টিতে। কখনওই দর্শন বা ইতিহাসের নিরিখে নয়। তাঁর প্রকাশবাদকে সামনে রেখেই শিল্পচিন্তা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

ক্রোচের জন্ম ১৮৬৬ সালে। রবীন্দ্রনাথ থেকে পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন তিনি। তাঁর জন্মস্থান ইতালির একটি শহরে। ক্রোচেকে অনেকেই বলেছেন হেগেলপন্থী দার্শনিক। কারণ তাঁর চিন্তা-চেতনায় নাকি হেগেলের দার্শনিক ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। কিন্তু তাঁর 'What is living and What is dead in Hegel's Philosophy' গ্রন্থটি পড়লেই জানা যায় তিনি সম্পূর্ণরূপে হেগেলপন্থী ছিলেন না।বেনেদেত্তো ক্রোচে অনেকগুলি গ্রন্থ লিখেছিলেন। তার মধ্যে যে গ্রন্থটি এখনও শিল্পতত্ত্বমহলে বিশেষভাবে আলোচিত, তা হল 'Aesthetic' (1902)। উল্লেখ্য এই শব্দটিরই বাংলা তরজুমা নন্দনতত্ত্ব, সৌন্দর্যতত্ত্ব' বা 'শিল্পতত্ত্ব'। কোনও কোনও দার্শনিক ক্রোচেকে নন্দনশাস্ত্রের আবিষ্কারক হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

***হেগেলের শিল্পভাবনা সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন 

ক্রোচের শিল্পতত্ত্ব মূলত প্রকাশবাদের উপর নির্ভরশীল। প্লেটোর মতো তিনিও ছিলেন... ভাববাদী দার্শনিক। ক্রোচে জ্ঞানকে দুভাগে ভাগ করেছেন

(১) "বোধিলব্দ' (Intuition Knowledge) ও 

(২)নৈয়ায়িক জ্ঞান ( Logical Knowledge)

 এই বিবিধ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম বা পদ্ধতিও আলাদা। বেধিলত জ্ঞান কল্পনার সাহায্যে অর্জিত হয়, আৰু নৈয়ায়িক জ্ঞান বুদ্ধির দ্বারা। বোধিলব্ধ জ্ঞান বাকি সব বিষয়ক, আর নৈয়ায়িক জ্ঞান বিশ্বসত্তা বিষয়ক। বোধিতে জ্ঞান হল এক একটা জিনিসের সঙ্গে অন্য জিনিসের সম্পর্ক বিষয়ে। যেমন বোধিলব্ধ জ্ঞান হবে রান, শ্যাম প্রত্যেকের ব্যক্তি সত্তা সম্পর্কে। নৈয়ায়িক জ্ঞান হবে এদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে, যে সম্পর্কের সূত্রে এরা অন্বিত শিল্প হল Intuition' বা 'বোধি। অর্থাৎ শিল্পে যে জ্ঞান আমরা লাভ করি তা কল্পনার মাধ্যমে। এবং সেটা ব্যক্তিসত্তা বিষয়ক। অন্যদিকে দর্শনশাস্ত্র বা বিজ্ঞানে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা হল নৈয়ায়িক বা যুক্তিলব্ধ। এই জ্ঞান আসে 'Intellect' বা বুদ্ধির মাধ্যমে।

ক্রোচের মতে শিল্পসৃষ্টিতে বুদ্ধিবৃত্তির ভূমিকা নেই। শিল্পসৃষ্টি হল বোধি। এই সম্পর্কে তিনি বুঝিয়েছেন আমাদের সাধারণ জীবনে আমরা নিত্য বোধির দ্বারা অর্থাৎ সহজ সগ্গার দ্বারা পরিচালিত হই।  তিনি বলেছেন...

  in ordinary life, constant appeal is made to intuitive Knowledge। 

**সাহিত্যের রুপ রতি সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লি


ক্রোচের এই সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে বিষয়টি এইভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। যেমন একটি মুখের ছবিতে যে লাল রং থাকে, সেটাকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন লাল রং। কিন্তু সেটা ছবিটার একটি বিশিষ্ট উপাদান রূপে আমরা দেখি। এখানে ছবিটা বোধি আর লাল রং তার উপাদান। ওই লাল রংটা পদার্থবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণে একটা ধারণা (Concept)। কিন্তু শিল্পীর কাছে সেটি শিল্পের একটি উপাদান। শিল্পে উত্থাপিত মুখচ্ছবির বৈশিষ্ট। তাতে দ্যোতিত হচ্ছে, সেটি একটি বোধির অংশ উপাদান। সমগ্ৰ শিল্পটা তার উপাদানের গুণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

মানুষের সমস্ত কর্ণের মধ্যে রয়েছে তার প্রকাশ কামনা। সাহিত্যেও সেই প্রকাশ বাসনা মুর্তীমান। এই প্রকাশ সম্পর্কে বরীন্দ্রনাথ বলেছেন, জ্ঞানের প্রকাশ বিজ্ঞানে-দর্শনে, কিন্তু ভাবের প্রকাশ সাহিত্যে।


ক্রোচের নন্দনতত্ত্বের মূল কথা প্রকাশ বা Expression"। তার অর্থ এই নয় অহেতুক আবেগ বা উত্তেজনাকে প্রকাশ করা। আবেগও থাকবে, আবার ধানিও থাকবে, তবেই সার্থক প্রকাশ ঘটবে। কোচ বলতে চেয়েছেন সপ্রাণ অনুভূতির কথা। তার মতে প্রকাশ যেমন বাচনিক হবে, তেমনি অবাচনিকও হতে পারে। অর্থাৎ ভাষা ছাড়াও বর্ণ, রেখা, মুদ্রা, সুর সহযোগে কোনও অভিব্যক্তিকে ব্যক্ত করাই প্রকাশ

ক্রোচে মনে করেছেন কোনও শিল্পীর সৃষ্ট শিল্প আসলে শিল্পীর মনে প্রতিনিয়ত যে "Image'-এর সৃষ্টি হচ্ছে তারই অত ইমেনের প্রকাশ। তাঁর বঁটা ঠিক কোনও মানুষের ব্যক্তিগত আবেগ বা অনুভূতির প্রকাশ কখনওই শ্রেষ্ঠ শিয় হতে পারে না।প্রকাশবাদের দ্বিতীয় পর্বে তিনি কিন্তু শুধু 'Expression'-এর মধ্যে তাঁর ভাবনাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি এখানে প্রকাশ বলতে বুঝিয়েছেন, বিশুদ্ধ প্রকাশ বা "Pure Intuition' কে।প্রকাশ বলতে তিনি এখানে বোঝাচ্ছেন যা আমাদের মনের মধ্যেই উপলব্ধ হয়। এর বহিপ্রকাশের দরকার নেই। তিনি এখানে প্রকাশের উপকরণকে গৌণ করে দেখেছেন। কারণ শিল্পের পরিপূর্ণ রূপ শিল্পীর মনোলোকে থাকে বলে। শিল্পের সৃষ্টি শিল্পীর চেতনায়, তাই শিল্প উপলব্ধিজাত।কোচে কথিত 'মহাজাগতিক বাস্তব 'কে তাই অনেকে অবাস্তব বলে মনে করেছেন। অবশ্য ক্রোচেও এর সদুত্তর দিতে পারেননি।

নান্দনিক ভাবনার ক্রোচের অবদানগুলি নিম্নরুপঃ--,


১. ক্রোচের নন্দনতত্ত্বের মূল আলোচ্য বিষয় স্বজ্ঞা বা জ্ঞান ও তার প্রকাশ। স্বজ্ঞাকে তিনি প্রাতিভানিক জ্ঞান বলেছেন। সংবেদন, উপলব্ধি ও অনুষঙ্গ থেকে স্বজ্ঞাকে তিনি পৃথক করেছেন। তিনি বলেছেন যে, স্বজ্ঞা হল বাস্তব ও অবাস্তবের মাঝখান থেকে উঠে আসা প্রকাশধর্মী জ্ঞান। এই স্বজ্ঞা যখন বাহারূপের মধ্যে দিয়েপ্রকাশিত হয় তখনই' সৃষ্টি হয় শিল্প। কিন্তু পরবর্তীকালে কোডে তাঁর মত পরিবর্তিত করে বলেছিলেন যে, মানসলোকে বিশুদ্ধ স্বজ্ঞার প্রভাবেই সৃষ্টি হয় শিল্প। 

২. তিনি টেকনিককে গুরুত্ব দেননি। কারণ টেকনিকের সঙ্গে শিল্প সাহিত্যের কোনও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক নেই বলে তিনি মনে করেছিলেন।

৩. ক্রোচের শিল্প সত্য, আনন্দ বা অনুভূতির সমার্থক। তিনি বলেছেন যে, শিল্পের সঙ্গে Intuition, Imagination, Expression, Fancy, Beauty সবই সমার্থক।

৪.তিনি বাহ্য প্রকাশকে মানেননি। যার সাহিত্যের রূপ বিভাজনও স্বীকার, করেননি। কাব্য, নাটক, মহাকাব্য ইত্যাদি সাহিত্য শিল্পের বাহারূপ। তাই তিনি সাহিত্যের এইসব বাপত্তে বা স্বতন্ত্র মর্তিকে অস্বীকার করেছেন।

৫. শিল্পের মধ্যে শিল্পীর ব্যক্তি জীবনের ছায়াপাত ঘটানোর বিরোধী ছিলেনতিনি। তবে তিনি বলেছেন যে, শিল্পীরা ঈশ্বরের কারুশালা থেকে রং-রস চুরি করেপ্রতিমা গড়েন। তাই শিল্পীরা রসোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন। এ কারণেই ক্রোচে শিল্পকে বলেছেন 'Super World'-এর বস্তু।

৬. ক্রোচে সৌন্দর্যের সত্যতা যাচাই করেননি। অর্থাৎ সৌন্দর্যকে তিনি সত্য বামিথ্যা কিছুই বলেননি।


তাঁর প্রকাশতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। যেমন—


ক. ক্রোচে শিল্পীদের বলেছেন যে তাঁরা যথার্থ বাস্তবের চিত্রকর। তিনিই আবার ধ্যানলোকেই শিল্পের প্রকাশকে সীমাবদ্ধ রাখার পরমার্শ দিয়েছেন। এ ছাড়া মহাজাগতিক বাস্তব (Supremely Real) তাঁর বিশ্লেষণে এসেছে। কিন্তু এটা সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এর দ্বারা শিল্প সৃজন করা যায় না।

খ.তার মতে পৃথিবীর সমস্ত কাজ ও ভাবনায় শিল্পীর সংযোগ আবশ্যিক। তিনিযদি পাপীও হন, তবুও শিল্পীর পাপ-পূণা সম্পর্কে একটি বোধ থাকবে। তার প্রভাব

পড়বে শিল্পে। এই জন্যেই অনেকে জীবন ও সাহিত্যকে এক সঙ্গে মেলাতে ব্যর্থহয়েছেন। রবীন্দ্র দর্শনও এই কথার সমর্থন করে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "কবিরে পাবে

না তার জীবনচরিতে।'


গ. শেষ পর্যায়ে ক্রোচে মনে করেছিলেন যে, বাহ্যরূপ নয়, তাঁর শিল্পীরা হবেন ধ্যানলোকের। অর্থাৎ অন্তরের ভাবরূপ নির্মাণ দক্ষ। লেখকের আবেগ-অনুভূতি সর্বজ্ঞজনবোধ্য হওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেছেন, 'যিনি কবিতা বোঝেন, তিনি সরাসরি লেখকের হৃদয়ে প্রবেশ করে নিজের অন্তরে লেখকের হৃৎস্পন্দন অনুভব করেন।।।

ঘ. ক্রোচে শিল্পী ছিলেন না। ছিলেন শিল্পতত্ত্ববিদ। তাই তিনি শিল্পের মূল রহস্যগুলি ধরতে পারেননি। তিনি বুঝতে পারেননি শুধু উপাদান নয় শিল্পের রূপও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। বাহারূপের প্রকাশ মাধ্যম বলে শিল্প গতিকে নৃত্যে পরিণত করে, সুরকে সঙ্গীত, আর শব্দকে কাব্য ।

ঙ. শিল্পের সার্থকতার প্রশ্নে ক্রোচের মতে সুন্দর হল 'Perfect'। কিন্তু প্রকাশকে কীভাবে Perfect করা যায় তার উত্তর দেননি তিনি।

চ. শিল্পকর্ম শুধুমাত্র মানসিক ব্যাপার হলে সমালোচনা গুরুত্ব হারায়। অর্থাৎ সমালোচক কীভাবে মানসিক বিষয়ের সমালোচনা করবেন, কীভাবেই বা শিল্পীর স্বাতন্ত্রতা নির্ণীত হবে এর কোনও ব্যাখ্যা করেননি তিনি।

ছ. বাহ্য প্রকাশই শিল্পীকে পরিচিত করায় তাঁর পাখিতা, নান্দনিক ভাবনা ইত্যাদির সঙ্গে। শিল্পের বাহারূপ না থাকলে কীভাবেই বা পাঠকবর্গ শিল্পীর লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হবে, তার ব্যাখ্যা তিনি কিন্তু দেননি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ