**ভাষা আন্দোলন এর গল্প
**ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক গল্প
*একুশের গল্প
জাতিস্মরেরা
জুলফিকার মতিন--
অসংখ্য ফুল ফুটেছে— অসংখ্য রক্তজবা — কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে চারদিক। এতো ফুলের সমারোহ? নয়ন জুড়িয়ে যায়। -না না, চোখে ভেসে ওঠে রক্তের ছোপ, কি লাল । কি টকটকে। এতো রক্ত কেন চারদিকে? মগজের মাঝে কে যেন বহিবাণ ছুঁড়ে মারে।
ওরা বসে ছিলো। চারজন। সবুজ, বিপ্লব, রাজা আর ছবি। তিনটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ওদের একজনের হাতে একটি চিঠি। লিখেছেন ফিলিপ। কদিন আগেই ঘুরে গেছে ওদের দেশ থেকে। সে যখন ছিলো তখনও ফুটেছিলো এই রক্তজবা আর পলাশ। ওর মনে তাই প্রশ্ন, এতো সবুজ দেশ। সুশ্যামল। বিস্তীর্ণ সমভূমি জুড়ে কি এক শ্যামশ্রী। কী সুন্দর নয়নাভিরাম। কিন্তু এই লাল ফুল? কোথা থেকে এতো রক্ত এসে লেগে আছে পাপড়িতে।
সে আরও লিখেছে, জনের রুপোলি রেখা জালের মতো ভাগ করে রেখেছে দেশটাকে। বৃক্ষ লতাপাতার সারির মধ্যে ভেসে ওঠা অনতি পরিস্ফুট গ্রামের রেখা। তার বুকে খেলে বেড়ানো নৌকায় জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ রাত। প্রকৃতি যে এতো মায়াময় – এতো অপার্থিব—আগে কখনও বুঝিনি :
চা এসে গেছে।
সবুজ বলে, —আজ কার খাওয়াবার কথা ?
অম্লান বদনে বিপ্লব বলে, – আমার।
ভেংচিয়ে ওঠে রাজা, – আমার? কাপয়সা এনেছিস?
বিপ্লব হাসে। ঠা ঠা করে।
বলে, – নেই তো আনবো কোত্থেকে ?
আসলে ওদের কারোরই পয়সা নেই।
**মৌন নয় গল্পটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবুজ এসেছে সবুক্ত গ্রাম থেকে। ফিলিপের চিঠিতে লেখা গ্রামের মতো গ্রাম থেকে। তিনশ ঘর পরিবার। হিন্দু, মুসলমান সব মিলে বাস। মন্দির আছে—কালীমন্দির। শিব লিঙ্গের মন্দিরও আছে। একটাই ছোট ঘর। আকারেও ছোট। গম্বুজের মতো উঠে গেছে। তবে বেশি দূরে যেতে পারেনি আকাশে। এসবই করেছিলেন জমিদার সূর্যকান্ত। নবাব সিরাজউদ্দৌলারআমলে রানী ভবানীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন স্বত্ব। তারও অনেক পরে, বঙ্গভঙ্গের আমলে হাজী ওয়ালীউল্লাহ বানান মসজিদ। সুতরাং বেশ কিছুদিন মন্দিরে কাসর ঘন্টা আর মসজিদের আজান ভালোই চলছিলো। কিন্তু গোলমাল বেঁধে গেলো পাকিস্তান আন্দোলনের সময়। তারপর তো হিন্দুস্তান হলো, পাকিস্তান হলো, কিন্তু গোলমাল থামলো না। সেই গোলমাল। এখনও চলছে। রক্তের হোলি খেলায় আরক্ত সবুজ গ্রাম থেকে সবুজ এখন নির্বাসিত।
রাজাদেরও শিকড় ছিলো গ্রামে। ওর বাবার ভিটেমাটি ছাড়াও ছিলো আড়াই বিঘা ভুঁই। চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ। ভাইবোন অনেক। কখনো কোনো দিকেই কোনো। সুবিধা হতো না। একদিন কি করে কি করে রাজার বাবা চলে এলো শহরে। প্রথমে গৃহভৃত্য। তারপর চায়ের দোকানের টেবিল বয়। তারপর রিক্সাচালক—এইসব। একদিন বিয়েও হলো তার। পাশাপাশি বস্তির ঘর। দিনরাত চোখাচোখি। দেখাশুনা। বাক্যালাপ। রাত্রিভর বুড়িগঙ্গার তীরে বসে থাকা। রাজার জন্ম শহরে। রাজা তাই শহরের ছেলে।
বিপ্লবের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। আর ওর নামটা নিজেরই দেয়া। ছিলো একটা আল গালিব আল তালিব আল আজহারো আল মোপাখখারো ইবনে তদোগুলো জাতীয় কিছু। এসব আর পছন্দ হয়নি বড় হয়ে। জোতদার বাবা ছেলেদেরকে লেখাপড়া শেখাতে কার্পণ্য। করেনি। তাদের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আমলা। এতোসব আমলা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের ভিড়ে বিপ্লবের মা চেয়েছিলেন, একটা ছেলে অন্তত পক্ষে আলেম হোক। বিয়েশাদী খতনা মৃত্যুকালের তওবা— জানাজা – ছেলে মওলানা হলে আর হতে হবে না। কেবল দিন দুনিয়ার কথা ভাবলে চলবে না। আখেরাতের দিকেও তাকাতে হবে। দোজাহানের মালিক আল্লাহর কাছে তো একদিন যেতে হবে। খুব ভালো কথা। এই পরিকল্পনা মাফিক বিপ্লবকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়েছিলো মাদ্রাসাতে। তখনও দাড়ি-গোঁফ গজায়নি—পাজামা আলখেল্লা পরে মাথায় টুপি দিয়ে ফুটফুটে বিপ্লব আমপানা : ছেরারা নিয়ে যখন মাদ্রাসায় যেতো আসতো, তখন তার একটা আলাদা আদর আপ্যায়নও বরাদ্দ হয়ে গিয়েছিলো বাড়িতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পীর ফকির আউলিয়া দরবেশ হয়ে লোকের আধ্যাত্মিক মুক্তির বিধি ব্যবস্থা দেয়ার সুযোগ সে নিতে পারেনি।
চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। ঝড় ওঠে তাল নারিকেল আর সুপুরির বনে। কথার ফুলঝুরিতে ফুটতে থাকে খই। পাহাড়ের দিকে নয় – সমভূমির দিকে নয়—সমুদ্রের দিকে নয়। কোন দিকে যাবে ওরা? তরুণ প্রাণের বহ্নিজ্বলা শিখায় অবিরাম অবিরাম পুড়তে থাকে ওরা।
ছবি বলে,—তাহলে আমি কে?
বিপ্লব বলে, তোমার পরিচয়, তুমি ছবি, তুমি শুধু ছবি।
তাইতো কতোদিনের পুরোনো ছবি। ভেসে ওঠে মনের মুকুরে। হাতে টিনের বার, কাঁধে পোটলা, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ। ইয়াহিয়ার এক্কাদেরা – আমার সেপাইরা লেফট রাইট করে বেড়াচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। মায়ের কোলে ছবি। এই এতেতুকুন মেয়ে। বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে দেখছে দগ্ধীভূত নগর, বন্দর, জনপদ। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের আর্ত চিৎকার সচকিত করে দিচ্ছে তার কচি কোমল কানের পর্দা। বোধে আসে না-অপাষ্ট স্মৃতির সুতোগুলো জোড়া লাগে না, কিন্তু ভোলাও যায় না।
ছবি বলে, না আমি শুধু ছবি না। আমি জীবন্ত মানুষ। তোমরা বলো মেয়েমানুষ। তর্ক জমে ওঠে।
সভ্যতার সেই আদিকাল থেকে পুরুষের হাতে নারীর লাঞ্ছনার বোঝা বহন করে ছবি উঠে দাঁড়ায়।
রাজা বলে, ছবি, ছবি তুমি যেও না। আমি তোমাকে মুক্তি দেবো । ছবি বলে,—আবারও সেই পুরুষের দম্ভ। তুমি আমাকে মুক্তি দেবার কে? জেনে রাখো আমার মুক্তিআমার কাছে।
ততোক্ষণে চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। কাপের ভেতর নতুন দৃশ্যপট।
কথা বন্ধ হয়ে গেছে বুড়ির। তার নাতির কোনো খবর নেই।
রৌদ্রদগ্ধ মাঠ। চূর্ণিত ধুলা—ইটের মতো ঢেলার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই ভ্রম জন্মে বুঝি তিরতিরে পানির প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে দিগন্তের পানে। বোবাচোখে সেদিকে চেয়ে থাকে।
জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ রাত। স্বপ্নের মতো সাদা থোকা থোকা তুলোর পেজা খেলা করে। বোবা দৃষ্টিতে সে সেদিকে চেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কান্নার ধ্বনি শুনতে পায়। অস্পষ্ট। বাষ্পরুদ্ধ। ক্রমাগত কেঁদেই চলে।
অনর্গল অশ্রু জমে জমে তার কানের কাছে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। সে মনে মনে জিজ্ঞেস
করে,—তুমি কে?
মনে মনে জবাব পায়, – আমি ইতিহাস।
সে মনে মনে আবারও জিজ্ঞেস করে, – তুমি কি করছো? যেন শুনতে পায়, – আমি কাঁদছি।
আর কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রবৃত্তি হয় না বুড়ির। চিমসে শুকনো লাউয়ের ডগার মতো তার ঠোঁট দুটি কাঁপতে থাকে। সে যেন বলতে চায়,—ঠিক আছে, তুমি কাঁদো। যতো পারো কাঁদো। কেঁদে কেঁদে শখ মিটিয়ে নাও।
ইতিহাস কিন্তু তার কথা ঠিকই বুঝতে পারে। সে বলে, – তুমি কাঁদোনি ?
বুড়ির মনে হয় সে অনেক কেঁদেছে। কেঁদে কেঁদে সাগর বানিয়ে তাতে সে তার জীবন ভেলা ভাসিয়েছে। যে তরী অশ্রুর সাগরের উপর ভাসে তাকে আর কান্নার কথা জিজ্ঞেস করে কি লাভ? তাই সে চুপ করে থাকে।
খবরটা গ্রামে রটতে বিলম্ব হয়নি।
ফয়জুদ্দিনের দশ বছরের ছেলে বলে, —জব বন্ধ হয়ে গেছে ?
আল কামালের সত্তর বছরের দাদী খনখনে গলায় বলে,—জব বন্ধ হয়ে গেছে? রহিমের নতুন বিয়ে করা বউ বলে, – জব বন্ধ হয়ে গেছে ?
গুড়ের ব্যাপারী, গরুর পাইকার, আলু পটলের দোকানদার, পানের মহাজন সবাই বলে, —জব বন্ধ হয়ে গেছে।
গ্রামের ডাক্তার গ্রামের মতোই জৌলুসহীন – বিদ্যাবুদ্ধিহীন। সে এসে কেনো বল কিনারা
করতে পারে না।
সবুজ এখানে গ্রামের কৃষক। বুড়ি তার মা। অনেক কষ্টের সংসার। বর্গাদারী করে ভাগীদারী করে একবেলা আধবেলা খেয়ে প্রাণধারণ। কিন্তু সংসার দরিদ্রের হলেও সন্তানতো সন্ধানই। এক দুই তিন সংখ্যারও কোনো ব্যাপার নেই এখানে এরকম পাঁচটি সন্তানের একটিকে সে কি করে কি করে শহরে পাঠিয়েছে পড়তে। পোস্ট অফিস এখান থেকে অনেক দূরে। চিঠি বিলি করতে সপ্তাহে এক দিন করে আসে পিয়ন। সেই নির্দিষ্ট দিনে সবুজের একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলো ডাক পিয়ন। সেই চিঠিতে ছিলো আনন্দের বার্তা। তার শহরে পড়া ছেলে লিখেছে, আব্বা, চিঠিতে আমার সালাম নিও। মাকে দিও। দাদীকে দিত। পর লিখি যে আমি বাড়ি। আসছি আগামী.....
খুশিতে মন ভরে যায় সবুজের।
বউকে বলে, থোকা বাড়ি আসতেছে। বউ যেন বিশ্বাসই করতে পারে না, বাড়ি আসতেছে, সত্যি।
বুড়ি দাদী বলে বাড়ি আসতেছে?
বউ ফিরে জিপ্রেস করে – কহন?
তাইতো কখন? সেদিনই রাত্রিতে। রাত দুটোয় টেন। পোস্ট অফিস যতো দূরে তার তিন ডবল দূরে রেল স্টেশন। খেয়ে দেয়ে সাঁঝ রাত্রিতেই রওনা দিতে হলে। সেদিন রাখা বান্না ভালো হলো। ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ মারা হলো বাড়ির পিছনের পাগার থেকে। পুঁটি। জিয়াল। খলসে। খোকা আসছে। কাজে কাজেই খোকার মার আর স্মৃতি ধরে না। সেই
পুঁটি, জিয়াল, খলসে মাছের ঝোল খেয়ে আরও দুই ছেলেকে সঙ্গে করে সবুজ
রেল স্টেশনের দিকে। হাঁটতে হবে পাকা চার ঘন্টা। রাতের পথ। একটা উচ নিলো চেয়ে
চিত্তে। আর সঙ্গে নিলো লাঠি।
রাত দুটোর ট্রেন এলো রাত সাড়ে তিনটায়।
না খোকা নেই।
আসেনি।
এ রকম হতে থাকলো পর পর তিনদিন।
না এলো না।
খোকা এলো না।
ততোদিনে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে দিকবিদিক। গ্রামে খবরের কাগজ আসে না। রেডিও নেই। তবুও জানতে কারো বাকি থাকেনি। শহরে গোলাগুলি হয়েছে। ছাত্রদের উপর। মানুষের উপর। মারা গেছে সালাম, রফিক, বরকত। মারা গেছে আরও অনেকে।
-কিসের গুলি গোলা ?
- পুলিশের
-পাকিস্তান হলো তবু গুলি
কথাবার্তা চলে গ্রামের মাতার কালু সরকারের কাচারিতে। কেন গুলি করা হয়েছে তার কারণ চান তো সবাই হতবাক। হত। দেশে আর বাংলা ভাষা চলবে না। মায়ের পেট থেকে পাড় তার মুখ থেকে যে ভাষা শিখেছি, তার কোনো দাম থাকবে না।
এসময় একজন রহস্যময় লোক আসে। মুখে দাড়ি। বোঝাই যায় ইচ্ছে করে রাখেনি। পয়সা নেই কিংবা কাটার সময় পায়নি। কালো চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা। শীত বলে কি? তা কি করে হয়? এখনতো বসন্ত কাল। কোকিলের কুহু স্বর শোনা যাচ্ছে এদিক সেদিক। মৃদুম সমীরণে কি এক মাতাল সুবাস। সুতরাং বোঝাই যায় সে নিজেকে গোপন করে রাখতে চায়।
সে বলে, পাকিস্তান হলো তবু গুলি? জবাব পেতে চান এ প্রশ্নের ! আমি বলি, পাকিস্তান হলো বলেই তো গুলি। যারা পাকিস্তান কায়েম করেছে তারা তো ধর্মের নামে মানুষকে শোষণ করতে চায়। তারা সেই ধর্মের নামেই আপনাদের মুখের ভাষাকে বিষমীয় ভাষা বানিয়েছে। আপনাদের মুখের ভাষা চর্চা করলে ধর্ম যাবে তারা এই কথা বলছে। এর উদ্দেশ্য হলো এভাবে তারা আপনাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়-বিনষ্ট করতে চায়। আপনাদের ঐতিহ্য। যদি আপনাদের সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যায়, ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আপনাদের দাঁড়াবার আর কোনো জায়গা থাকবে না। শিকড় থেকে উপড়ে তুলবে, আপনাদেরকে দাস বানিয়ে রাখবে চিরকালের জন্য।
বিপ্লবকে এ বেশে দেখবে সবুজ তা আশা করেনি।
কিন্তু বিপ্লব বলে, আমি জানি তুমি এখানেই আছো। তুমি এখানে আছো চিরকালের অত্যাচারিতের প্রতীক হয়ে।
বলার সাথে সাথেই বিপ্লবের মুখে ফুটে ওঠে এক রহস্যময় হাসি। সে তার কাঁধের ঝোলা থেকে বের করে আনে একটি যাদুদণ্ড। ছুঁইয়ে দেয় সবুজের কপালে। সম্মোহিত সবুজ হাঁটতে থাকে তার পিছন পিছন। ওরা এসে উপস্থিত হয় নগরের বাইরে ডোমনীর কুটিরে। তখন জ্যোৎস্না রাত। কঙ্গুচিনার গন্ধে মাতোয়ারা আকাশ বাতাস। ডোমনী পড়ে আছে গুনজার মালা। চারদিকে ফুল ফুটেছে। তার সারা দেহে প্রকৃতির আভরণ তাকে করে তুলেছে মনোমুগ্ধকর।
রাজবাড়িতেও তখন মদিরাসক্ত রাত। পাত্র মিত্র অমাত্য মহাপাত্র নিয়ে বসে আছে রাজাধিরাজ। সভাকবির কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে ছন্দবদ্ধ পদ। আবেশে জড়িয়ে আছে সবাই। বসনভূষণ স্থলিত। দেবদাসীদের নৃত্যরতা ভঙ্গিমায় ফুটে উঠেছে শিল্পের অপূর্ব সুষমা। ফেনিল উম্মত্ততা সবাইকে টেনে নামিয়েছে পশুর পর্যায়ে।
হঠাৎ আর্ত চিৎকারে ঘটে ছন্দপতন। একটি প্রায় বিবস্ত্র নারী দেহ লাফিয়ে পড়ে তাদের উপর। আসলে যে সে আশ্রয় পাবার আশায় দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে এসেছে, নেশাগ্রস্ত মানুষদের আর কি তা বোঝার উপায় আছে। তারা মনে করে এটি বুঝি এক নতুন চিড়িয়া। সবাই মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়তে থাকে তার উপর।
ছবির নাম এখন মাধবী। দু'ধারী তলোয়ারের মতো দেহ। কিন্তু তা স্থিত। বিনম্র। ফুলের পরিচর্যা করে রাজবাগানে। প্রতিনিয়ত চেয়ে দেখে কিভাবে পুষ্প প্রস্ফুটিত হচ্ছে একটু একটুকরে। তার নিজেরও বেড়ে ওঠার গতি স্পন্দন শুনতে পায় তার মাঝে না। লোকভাষায়। গুনগুন করে। অনুচ্চ।
অনেকদিন ধরেই রাজশ্যালকের কুদৃষ্টি পড়েছে তার উপর। আজকে এই জো রাতে সে এসেছিলো ফুল বাগানে। ভালো লাগে তার এই পূর্ণিমার আলো। এতো জোন) স্নান নয়--চারপাশের আকাশ – দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতি সারা শরীরে জাল মাখা— এ যেন আত্যার অবগাহন। সমস্ত সঙ্কীর্ণতা— সমস্ত ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি। কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গ হলো তার। পৃথিবীর কলুষ নখ দাঁত বের করে ছুটে এলো তার দিকে। ব্যাঘ্রের কণার নিচে হরিনী শাধকের যা হয় -এ তার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়।
ছবি চিৎকার করতে থাকে। তারস্বরে। তীব্রভাবে। তার চিৎকারে নেশাগুরাও কিছুটা ধাতস্থ হতে থাকে।
রাজাধিরাজ প্রশ্ন করে,—তুমি কে?
-আমি আপনার অনুগৃহীতা,--রাজারাধিরাজ আপনি আমাকে বাঁচান।
-কেন কি হয়েছে তোমার?
—রাজাধিরাজ, মহানুভব রাজশ্যালক আমাকে লাঞ্ছিত করেছেন।
শাস্তি রাজশ্যালকের?
ধর্ষণ করলে সামান্য মনস্তাপেই সে পাপ স্থাপন হয়ে যায়।
ঠাঠা করে হাসে রাজশ্যালক, রাজাধিরাজ এই চণ্ডাল কন্যার অপবাস যে কতো
ভয়ঙ্কর আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না। ওর শাস্তি নিশ্চিত নরক বস।
—লাঞ্ছিত করেছেন, চোখ ভাসিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে রাজাধিরাজ, রাজপুরোহিত কি পুরোহিত উঠে দাঁড়ায়, জনি স্থাপ। ব্রাহ্মণ কোনো উত্তাল বন্যাকে
-কি ওর অপরাধ?- জানতে চান রাজাধিরাজ
ও গান গায় অসুর ভাষা।
- অসুর ভাষায়?— চমকে ওঠে রাজপুরোহিত-দেবভাষায় নয় :
-অসুর ভাষায়, দেবভাষায় নয়। চমকে ওঠে পাত্র মিত্র অমাত্য মহাপাত্র। নেশা যেন ছুটে যেতে চায়। ছবি বলে,— ই্যা রাজাধিরাজ আমি লোকভাষায় গান করি। আমার মুখের অ
দেবভাষা যে আমার জন্য নিষিদ্ধ। - নিষিদ্ধ হবে নাতো কি হবে? দেবভাষার জারিজুরি বুঝে ফেললে তো আমার বাসে
শেষ—নেশার ঘোরে কথাগুলো বলেই ফেলে রাজপুরোহিত।
অসুর ভাষা মানে তো বাংলা ভাষা। লোকভাষা মানেতো বাংলা এই ভাষায় গান লেখে? কে এই বাংলা ভাষায় মনের কথা বলে। মাতো মানতিক জিনিস। ভয়াবহ বিস্ফোরক পদার্থ। ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না। সীমা পরিসীমা নিশ্চয় যায় না যা তার প্রবৃদ্ধি ঘটতে দেয়া যেতে পারে না কিছুতেই।
করে। তার নিজেরও বেড়ে ওঠার গতি স্পন্দন শুনতে পায় তার মাঝে না। লোকভাষায়। গুনগুন করে। অনুচ্চ।
অনেকদিন ধরেই রাজশ্যালকের কুদৃষ্টি পড়েছে তার উপর। আজকে এই জো রাতে সে এসেছিলো ফুল বাগানে। ভালো লাগে তার এই পূর্ণিমার আলো। এতো জোন) স্নান নয়--চারপাশের আকাশ – দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতি সারা শরীরে জাল মাখা— এ যেন আত্যার অবগাহন। সমস্ত সঙ্কীর্ণতা— সমস্ত ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি। কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গ হলো তার। পৃথিবীর কলুষ নখ দাঁত বের করে ছুটে এলো তার দিকে। ব্যাঘ্রের কণার নিচে হরিনী শাধকের যা হয় -এ তার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়।
ছবি চিৎকার করতে থাকে। তারস্বরে। তীব্রভাবে। তার চিৎকারে নেশাগুরাও কিছুটা ধাতস্থ হতে থাকে।
রাজাধিরাজ প্রশ্ন করে,—তুমি কে?
-আমি আপনার অনুগৃহীতা,--রাজারাধিরাজ আপনি আমাকে বাঁচান।
-কেন কি হয়েছে তোমার?
—রাজাধিরাজ, মহানুভব রাজশ্যালক আমাকে লাঞ্ছিত করেছেন।
শাস্তি রাজশ্যালকের?
ধর্ষণ করলে সামান্য মনস্তাপেই সে পাপ স্থাপন হয়ে যায়।
ঠাঠা করে হাসে রাজশ্যালক, রাজাধিরাজ এই চণ্ডাল কন্যার অপবাস যে কতো
ভয়ঙ্কর আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না। ওর শাস্তি নিশ্চিত নরক বস।
—লাঞ্ছিত করেছেন, চোখ ভাসিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে রাজাধিরাজ, রাজপুরোহিত কি পুরোহিত উঠে দাঁড়ায়, জনি স্থাপ। ব্রাহ্মণ কোনো উত্তাল বন্যাকে
-কি ওর অপরাধ?- জানতে চান রাজাধিরাজ
ও গান গায় অসুর ভাষা।
- অসুর ভাষায়?— চমকে ওঠে রাজপুরোহিত-দেবভাষায় নয় :
-অসুর ভাষায়, দেবভাষায় নয়। চমকে ওঠে পাত্র মিত্র অমাত্য মহাপাত্র। নেশা যেন ছুটে যেতে চায়। ছবি বলে,— ই্যা রাজাধিরাজ আমি লোকভাষায় গান করি। আমার মুখের অসুর ভাষা!
দেবভাষা যে আমার জন্য নিষিদ্ধ। - নিষিদ্ধ হবে নাতো কি হবে? দেবভাষার জারিজুরি বুঝে ফেললে তো আমার বাসে
শেষ—নেশার ঘোরে কথাগুলো বলেই ফেলে রাজপুরোহিত।
অসুর ভাষা মানে তো বাংলা ভাষা। লোকভাষা মানেতো বাংলা এই ভাষায় গান লেখে? কে এই বাংলা ভাষায় মনের কথা বলে। মাতো মানতিক জিনিস। ভয়াবহ বিস্ফোরক পদার্থ। ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না। সীমা পরিসীমা নিশ্চয় যায় না যা তার প্রবৃদ্ধি ঘটতে দেয়া যেতে পারে না কিছুতেই।
মনে ছিলো না তখন। তারপরতো মেডিকেল কলেজ পেরোতে না পেরোতেই খুলি। আল এবং গুলি। এবং এবং এবং
ফুলিতে গুলি খেয়ে তখনই মুখ থুবড়ে পড়ে দিয়েছিলো। আর নারীর লাশের কি হয়, আপনাদের তো অজানা নেই। এতোদিন হয়ে গেলো এই এতোদিন, এখনো বুড়ি কথা বলে না। তার মুখে কোনো ভাষানেই—বাক্যস্ফূর্তি নেই। সবুজ বিপ্লব, রাজা ও ছবি এই চারজন বুড়িকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ায় পথে প্রান্তরে—শহরে বন্দরে লোকালয়ে জনপদে। সেই লাশটি তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে। ত শরীরের মধ্যেকার সেই জীবন্ত মানুষটিকে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে। নেই জীনন্ত মানুষটিকে তাদের চাই।
ডিসেম্বর, ১৯৯৮
0 মন্তব্যসমূহ