বাংলা ভাষা : ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্যঃ-
পৃথিবীর ৪র্থ ভাষা বাংলা (২০০৫ সনের হিসাব অনুসারে)। এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা আজকের দিনে প্রায় ২৩ কোটি। বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা বাংলা এদেশের প্রায় চোদ্দ কোটি মানুষের মুখের ভাষা এবং রাষ্ট্রীয় কাজেও ব্যবহৃত ভাষা। এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৭.৭৫ কোটি মানুষের এই ভাষা সেখানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এর বাইরেও ভারতের আসাম রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ, ত্রিপুরা রাজ্যের বলতে গেলে পুরো জনগোষ্ঠী, উড়িষ্যা, বিহার, দিল্লি এবং ভারতের অন্যান্য স্থানে (যেমন-আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে) অবস্থানকারী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনগোষ্ঠী বাংলায় কথা বলে বা এই ভাষা ব্যবহার করে। পাকিস্তানের করাচিসহ বিভিন্ন স্থানেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে।উপমহাদেশের বাইরে ব্রিটেন ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলাভাষীর সংখ্যা প্রায় ২,২৩,০০০। বর্তমান লন্ডনের অপ্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা (সিলেটি) সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা। আমেরিকা ক্যানাডায়, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য এবং জাপান মিলিয়ে আরও প্রায় ১,৫৬,০০০ বাংলাভাষী রয়েছে (২০০৪ সনের হিসাব মতে)।
ইতিহাসঃ--
পৃথিবীর বৃহত্তম ভাষাগোষ্ঠী ইন্দো-ইউরোপীয় থেকে হাজার হাজার বছরের বিবর্তন ও প্রাকৃতিক প্রভাবের কার্যকারণের মধ্য দিয়ে, ৭ম শতাব্দী থেকে বাংলা ভাষার পৃথকীকরণ তথা উদ্ভব ঘটে, যার ভগ্নিভাষা হিসেবে উল্লেখিত হয় অসমিয়াএবং উড়িয়া ভাষা। বংশতরু বিবেচনা করলে বাংলার অবস্থান নিম্নরূপে চিহ্নিত করা যায় (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অনুসরণে) নিম্ন চিত্র পাইঃ-
প্রাকৃত >অপভ্রংশ >প্রাচীন বাংলা > আধুনিক বাংলা ।
বাংলা ভাষার ইতিহাসকে মোটামুটি প্রধান তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে : প্রাচীন বাংলা (৬৫০-১২০০ খ্রিঃ), মধ্যযুগের বাংলা (১২০০-১৮০০ খ্রিঃ) এবং আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে)। প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসেবে ‘চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’ নামাঙ্কিত একটিমাত্র পুঁথি পাওয়া গেছে। নেপালের রাজদরবারে, পরে যার সংক্ষিপ্ত নাম হয় 'চর্যাপদ'। এটি ছিল বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধন-ভজনবিষয়ক আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের সংকলন ('বৌদ্ধগান ও দোহা') 'যার ভাষাকে বলা হয়েছে 'সান্ধ্য ভাষা’, ‘আলো-আঁধারির ভাষা'- যার কিছু বোঝা যায়, কিছু বোঝা যায় না।
মধ্যযুগের বাংলার আদিতম নিদর্শনও পাওয়া যায় মাত্র একটি আনুমানিক ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের আংশিক খণ্ডিত সেই পুঁথিটির নাম দেয়া হয়েছে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। এটি ভারত উপমহাদেশের অন্যতম লোকসাহিত্য ধারার পুরাণকথা, রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমের উপাখ্যানমূলক কাব্য। মধ্যযুগের বিস্তৃত সময়ে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ধারার সাহিত্যনির্ভর প্রচুর নিদর্শন পাওয়া যায় যাতে দেখা যায় বাংলা ভাষার প্রকৃতি ও শব্দসম্ভার ঋদ্ধ হয়েছে বাঙালি কবিদের ব্যাপক চর্চা ও মুসলমান ভাষা-সংস্কৃতির প্রভাবে। বলাবাহুল্য-এর সবই ছিল কাব্য।
বাংলা ভাষার উদ্ভবের পর থেকে দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তিতে এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে বিভিন্ন পর্যায় ও সূত্রের প্রভাবে—
ক) প্রাচীন বাংলার ভাষা-রূপের সঙ্গে অবশ্য কিছু সংস্কৃত প্রভাব প্রথম থেকেই যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ, খ্রিস্টীয় অব্দের প্রথম দিক থেকেই 'সংস্কৃত ভাষা’ ছিল প্রায় সমগ্র ভারতের সাংস্কৃতিক চর্চার ভাষা। ['পালি' বৌদ্ধদের কাছে ও ‘অর্ধমাগধী’ জৈনদের কাছে তাদের নিজ-নিজ ধর্মগত আলোচনা ও সংস্কৃতির বাহন ছিল।] প্রাচীন বাংলার যুগে বাংলাভাষী অনেকেই কাব্যাদি চর্চা করতেন সংস্কৃতে। ভারতের ‘ইন্দো-আর্য' ভাষা যখন ‘প্রাচীন স্তর’ ও ‘মধ্যস্তর’ উত্তীর্ণ হয়ে “আধুনিক স্তরে এসে পৌঁছায় তখন বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর প্রভাব সত্ত্বেও [পাল রাজত্বে (৭০১-১১০০ খ্রিঃ) গৌড় সাম্রাজ্যের পত্তন সত্ত্বেও সুপ্রসিদ্ধ বাঙালি কবিগণ (যথা- উমাপতিধর, গোবর্ধন আচার্য, জয়দেব মিশ্র প্রমুখ) সংস্কৃতেই কাব্য রচনা করেছেন। ফলে প্রাচীন যুগ থেকে তৎসম ও অন্যান্য প্রভাব বাংলায় এসেই গেছে।
খ) ১৩শ শতকের পর থেকে (বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনের পর থেকে) আরবি-ফারসি-তুর্কি ভাষার প্রভাব বাংলায় সাধারণভাবে (কথ্যভাষায়) পড়তে শুরু করে।
(গ) ১৪/১৫শ শতাব্দীতে মুসলিম শাসনামলে ফারসি রাজভাষা হওয়ার সুবাদে এবং ফারসি ভাষার বিশেষ মর্যাদার কারণে, সেইসাথে এই ভাষা-সম্পৃক্ত সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলায় স্থান পায় সুপ্রচুর বিভাষী শব্দাবলি।
ঘ) আবার একই সঙ্গে মুসলমান শাসকগণ ‘জবান-এ-বাংলা’র সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করার ফলে তৎকালীন পণ্ডিতদের-কথিত ‘গৌড় ভাষা’র শ্রীবৃদ্ধি ঘটে; অর্থাৎ তৎসম শব্দের ব্যবহার বাংলায় বেড়েও যায়।
(ঙ) ১৬শ শতকে পর্তুগিজদের আনীত শব্দাবলি বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করে (যেমন–আনারস, আতা, তামাক এই ধরনের শব্দ]। চ) মধ্যযুগে কথ্য ভাষা ছাড়াও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসি ও এর মাধ্যমে আসা শব্দ ও ভাষিক প্রভাব উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ছ) আবার ১৭শ শতকে বঙ্গদেশে বিদেশীদের আগমন বৃদ্ধির সাথে-সাথে পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজ ছাড়াও ফরাসি, ইংরেজি শব্দের প্রভাবও বাড়তে থাকে।
[ফরাসি : কার্তুজ, কুপন, ডিপো। ওলন্দাজ হরতন, ইস্কাপন, ইস্কুঙ্কুপ। ইংরেজি : টেবিল, চেয়ার, লাট, জাঁদরেল
জ) ১৭শ/১৮শ শতকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের প্রচেষ্টায় বাংলায় প্রথমবারের মতো গদ্য-ভাষার কার্যকর ব্যবহার শুরু হয়।
(ঝ) ১৮/১৯শ শতাব্দীতে ইংরেজ শাসনে, ইউরোপীয় শিক্ষার প্রভাবে ‘ইংরেজি ভাষা’ এবং তার মাধ্যমে অন্যান্য বিদেশী প্রভাব বাংলা ভাষায় যুক্ত হতে থাকে। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠার পর তার প্রধান উইলিয়াম কেরি ও তাঁর সহযোগী বাঙালি পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষা সৌষ্ঠবশীল গদ্যসাহিত্য রচনার পক্ষে উপযোগী হওয়ার দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়।
(ঞ) বিংশ শতকে ‘কথ্যভাষাই' লেখ্য সাহিত্যিক ভাষায় উন্নীত হয় প্রমথ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ এবং আরও অনেক প্রতিভাবান বাঙালির হাতে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ‘সাধুভাষা’র স্থান অনেকটাই দখল করে নেয় ‘চলিতভাষা'। কিন্তু সাধুভাষা-রূপের ব্যবহার বাংলা থেকে একেবারে উঠে যায় নি। বিশ শতকের সংবাদপত্রের ভাষায়, দলিল-দস্তাবেজের ভাষায়, সরকারি এবং গুরুতর/গাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয়ের ভাষায় ‘সাধুবাংলা'র প্রচলন অব্যাহত থাকে। চলিতভাষা 'কলিকাতা'-কেন্দ্রিক শিষ্টজনের মুখের ভাষার কাছাকাছি হওয়ায় বিশিষ্ট এবং প্রতিভাবান প্রচুরসংখ্যক বাঙালি ভাষা ও সাহিত্যে এবং এর উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করার ফলে বাংলা ভাষার প্রভূত উন্নতি ঘটেছে—যার ফলে বিংশ শতাব্দীতে এই ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে।
**তথ্যসংগ্রহঃ-
বাংলা ভাষা সাহিত্য উল্লেখ্য -(মুহম্মদ দানীউল হক)
0 মন্তব্যসমূহ