Hot Posts

6/recent/ticker-posts

গৃহদাহ উপন্যাস আলোচনা



---গৃহদাহ উপন্যাস আলোচনা
গৃহদাহ উপন্যাসের রচনাকাল
গৃহদাহ উপন্যাসের চরিত্র 
গৃহদাহ উপন্যাসের সমালোচনা 
গৃহদাহ উপন্যাসের রিভিউ 
গৃহদাহ উপন্যাস 
অচলা সুরেশ মহিম---
***বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 
****গৃহদাহ উপন্যাস  আলোচনা --
 
বাংলা উপন্যাসের ধারায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) জনপ্রিয়তম কথাশিল্পী।বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের এক জটিল সময়-সংক্রান্তিতে বাংলাসাহিত্যে, বিশেষত উপন্যাসে, শরতদের দীর্ঘ আবির্ভাব। বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তসমাজেরঅত্যাসন্ন গভন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে মানবিক মূল্যচেতনার ক্রম-ভঙ্গুরতা এবং ভয়াবহঅর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়খণ্ডে শরৎচন্দ্র আবেগশাসিত ও ভাবালুতালালিত যে-উপন্যাসধারানির্মাণ করেছেন, বাঙালি পাঠক সেখানে সহসাই পেয়ে গেল তার স্বপ্নময় ভালোলাগাজীবনের কথকতা। যে জীবন বাংলাদেশ থেকে ক্রমশ অপসৃত হয়ে যাচ্ছে, পাঠক সেজীবনকেই খুঁজে পেল শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে। বাস্তবে অনুপস্থিত কল্পনার এক সংসারবায়রচিত হতে দেখে বাঙালি পাঠক বিস্ময়কর একাত্মতায় অবগাহন করেছে শরৎ-সাহিত্যে।প্রসঙ্গত স্মরণীয় রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন—“শরৎচন্দ্রের দৃষ্টি ডুব দিয়েছে বাঙালিরহৃদযরহস্যে। সুখে দুঃখে মিলনে বিচ্ছেদে সংঘটিত বিচিত্র সৃষ্টির তিনি এমন করে পরিচয়দিয়েছেন বাঙালী যাতে আপনাকে প্রত্যক্ষ জানতে পেরেছে।" রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যইশনাক্ত করে দেয় শরৎ-সাহিত্যের জনপ্রিয়তার মৌলসূত্র।

শরত্চন্দ্র উপন্যাস রচনায় মননশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে ভাবাবেগকেই বেশি প্রাধান্যদিয়েছেন। মননশীলতা তাঁর উপন্যাসে, ভাবাবেগের কাছে পৌনঃপুনিকভাবে পরাভূতহয়েছে সর্বত্রই ভেঙে গেছে ঔপন্যাসিক-চরিত্রপুঞ্জের সব ধরনের বুদ্ধি ও সংযমের বাঁধ।ঔপন্যাসিক সিদ্ধির জন্য চরিত্রের এই ধরনের পরাভব, সন্দেহ নেই, অনুকূল নয়। উপর্যুক্তপ্রবণতাই বাংলা উপন্যাসের ধারায় শরৎচন্দ্রের সবচেয়ে বড় গুণ কিংবা বড় দোষ। তবে,তাঁর উপন্যাস যে পাঠকনন্দিত হয়েছে, তার পশ্চাতে এই ভাবালুতাময় জীবনই যে মুখ্যভূমিকা পালন করেছে, সে-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাঙালির আবেগজীবনের সরলঅকপট কথকতাই তাঁর উপন্যাসশিল্পের অনিঃশেষ বিশিষ্টতা।শরশ্চন্দ্রের উপন্যাসে ভূমিকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তজীবনের বিচিত্র সঙ্কট ও সমস্যা রূপলাভকরেছে। মধ্যবিত্তজীবন-রূপায়ণে বহির্বাস্তবতার পরিবর্তে, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে, প্রাধান্যপেয়েছে চরিত্রপুঞ্জের মনোজাগতিক বাস্তবতা। গল্পীসমাজ (১৯১৬) ব্যতীত শরওন্দ্রের অন্যসব উপন্যাসেই আমরা চরিত্রের মনোজাগতিক বাস্তবতার রূপায়ণ লক্ষ করি। তাঁরউপন্যাসে, সর্বত্রই অঙ্কিত হয়েছে, গ্রামীণ ভূ-সম্পত্তিকেন্দ্রিক জমিদারি ব্যবস্থার নানামাত্রিকঅসঙ্গতি ও অনন্বয়ের ছবি। অচ্যুত গোস্বামী যথার্থই বলেছেন—“বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যেবিরাট অংশ গ্রামের ভূ-সম্পত্তির মালিকানা থেকে উদ্ভূত হয়েছে শরৎচন্দ্র তাদের প্রতিনিধিএবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী।"২ জমিদারি ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা এবং তার প্রতি একসহজাত সহমর্মিতাবোধ শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্যে পৌনঃপুনিক শিল্পরূপ লাভ করেছে।প্রথম বিশ্বসমর-উত্তর সংক্ষুব্ধ কালের অধিবাসী হয়েও জীবনপ্রত্যয় ও শিল্পচেতনায়শরৎচন্দ্র ছিলেন দূরাগত অতীতের মানুষ। উপন্যাসের বিষয়াংশ-নির্বাচন কিংবা আঙ্গিকবিন্যাসে তিনি উনিশ শতকী আবহেই বিচরণ করেছেন। উপন্যাসের প্লট, দৃষ্টিকোণ,চরিত্রায়ণ এবং অন্তিম মীমাংসা সর্বত্রই আমরা তাঁর এই পশ্চাৎমুখী মানসতা লক্ষ করি।জমিদারি ব্যবস্থাকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা, একান্নবর্তী পরিবারকে টিকিয়ে রাখা,সহানুভূতিতে সিক্ত করেও নারীকে পুরুষের মুখাপেক্ষী করে রাখা, সর্বোপরি সনাতনরক্ষণশীল মানসতার কাছে ব্যক্তির সভা-বিসর্জন—এইসব নেতিবাদী প্রবণতার কারণেশরৎ-সাহিত্য বিশ শতকী আধুনিকতাকে অঙ্গীকার করতে সমর্থ হয়নি। বিশ শতকী শিল্পী

হয়েও উনিশ শতকী শিল্পাঞ্চলে বিচরণ করা, শগুন্দ্রের শিল্পিসত্তার পরাভব, সন্দেহ নেই। তবু তিনি কালজয়ী শিল্পী, বাঙালির আবেগ-জীবনের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কথাকার। শরত্চন্দ্রই অনুমান করি, বাঙালির প্রিয়তম কথাশিল্পী।


শরগুলের যে-সব উপন্যাস বিপুলভাবে পাঠকনন্দিত হয়েছে, গৃহদাহ (১৯২০) তার অন্যতম। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসধারায় গৃহদাহ একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। সূচনাসূত্রে শরত্চন্দ্রকে আমরা ভাবাবেগের শিল্প-ভাষ্যকার হিশেবে অভিহিত করেছি। বলাই বাহুল্য, সামগ্রিক বিচারে তা-ই হওয়া উচিত শরৎচন্দ্রের অভিধা। কিন্তু গৃহদাহ উপন্যাস সম্পর্কে এ কথা সর্বাংশে সত্য নয়। গৃহদাহ-ই শরত্চন্দ্রের একমাত্র উপন্যাস, যেখানে সাধিত হয়েছে হৃদয়াবেগের সঙ্গে মননের সীমিত সমন্বয়। এ কারণেই বলছিলাম, গৃহদাহ শরৎসাহিত্যের ধারায় এক ব্যতিক্রমী রচনা।

গৃহদাহ উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে একটি ত্রিভুজ প্রেমের প্লট। শরৎচন্দ্রের অন্য উপন্যাসের সঙ্গে গৃহদাহ-র মৌল পার্থক্য এই যে, এখানেই তিনি প্রেমকেন্দ্রিক প্লটের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ধরতে চেয়েছেন আধুনিক নর-নারীর দাম্পত্যজীবনের বহুভুজ সঙ্কট। আধুনিক মানুষের চিত্তজাগতিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতা, দাম্পত্য বিষয়ে পুরুষের আত্মজিজ্ঞাসা, নারীর আত্মস্বরূপ উন্মোচন—ইত্যাদি বিষয় এ-উপন্যাসে যেভাবে পাওয়া যায়, শরত্চন্দ্রের অন্য কোন উপন্যাসে তা পরিদৃষ্ট নয়। এ কারণে গৃহদাহ-কেই শরতন্ত্রের সবচেয়ে আধুনিক উপন্যাস হিশেবে আখ্যায়িত করা হয়।

গৃহদাহ উপন্যাস মূল্যায়ন-কালে রবীন্দ্রনাথের দু'টো রচনা আমাদের স্মৃতিতে জাগ্রত হয়—এক. ঘরে-বাইরে (১৯১৬) উপন্যাস, দুই. 'নষ্টনীড়' (১৯০১) ছোটগল্প। ঘরে বাইরে-র গৃহভঙ্গ-সমস্যা, দুই বন্ধু ও বন্ধু-পত্নীর হার্দ্য টানাপড়েন ও তার পরিণতি শরণ্ডন্দ্রকে যেমন প্রভাবিত করেছে, তেমনি প্রভাবিত করেছে 'নষ্টনীড়'-এর নীড় নষ্টের সমস্যা। তিনটি রচনার আভ্যন্তর স্বাক্ষর এবং প্লটগত সাদৃশ্য আমাদের এ অনুমানের মৌল ভিত্তি। তবু, ঘরে-বাইরে বা 'নষ্টনীড়'-এর সঙ্গে গৃহদাহ উপন্যাসের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা প্রশ্নাতীত। রবীন্দ্রনাথের উভয় রচনাতেই একটি পূর্ণাঙ্গ-স্বরূপের ‘গৃহ' বর্তমান। সন্দ্বীপের আবির্ভাবে নিখিলেশ-বিমলার গৃহকোণে উপ্ত হয়েছে জটিলতা আর সঙ্কটের বীজ, তবু শেষ পর্যন্ত তাদের ‘গৃহ' থেকেছে অক্ষুণ্ণ। অমলের আবির্ভাবে ভূপতি-চারুলতার ‘গৃহে' সঙ্কট দেখা দিলেও, তাদের গৃহ’টি ছিল সর্বদা পরিদৃশ্যমান। কিন্তু আলোচ্য উপন্যাসে, বাস্তব অর্থে কিংবা নিহিতার্থে, মহিম-অচলার ‘গৃহ’টি পাঠকের কাছে প্রত্যক্ষ হয় না। রবীন্দ্রনাথের যে-দুটি রচনা থেকে গৃহদাহ রচনার প্রেরণা লাভ করেছিলেন শরৎচন্দ্র, সেখানে ‘গৃহত্ব' সম্পর্কে সন্দেহের কোন সুযোগ নেই; কিন্তু পাঠকের কাছে সেই সন্দেহই প্রকট হয়ে ওঠে। গৃহদাহ উপন্যাসে। ৩ এখানে বিমলা বা চারুলতার মতো কোন ‘গৃহ' নেই অচলার ; তার জীবনে ‘গৃহ' চিরকাল স্বপ্নই থেকে গেছে। মহিম কিংবা সুরেশ তাকে প্রেম বা ভালবাসা দিতে চাইলেও, দিতে চায়নি 'গৃহ'—ফলে রাজপুর কিংবা কলকাতা কিংবা ডিহরী কোথাও গড়ে ওঠেনি অচলার কোন ‘গৃহ' কিংবা আশ্রয়।

সঙ্গত কারণেই, এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে 'গৃহ’ই নেই—সেখানে গৃহ দাহ হলো কিভাবে? রাজপুরের পাঠশালা-সংলগ্ন গৃহ আর তাঁর ভস্মীভূত অবস্থাই হয়তো শরতন্দ্রকে উপন্যাসের নামকরণে প্রাণিত করেছে; কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মহিমের ওই মেটে বাড়িটা কখনোই হতে পারেনি মহিম-অচলার দাম্পত্যজীবনের গৃহ। মেটে-বাড়িকে যথার্থই গৃহ করে তুলতে মহিম কিংবা অচলা কেউ-ই সক্ষম হয়নি। ফলে এ ঘটনাটি

উপন্যাসের নামকরণের ক্ষেত্রে একেবারেই একটি বাহ্য অনুষঙ্গ কেন্দ্রীয় ভাব এবং অস্তিম

মীমাংসার (2) সঙ্গে এটি সে-অর্থে সম্পর্কিত নয়, যদিও এই ঘটনা এ-উপন্যাসের একটি

প্রধান বাক-পরিবর্তন উৎস।


বস্তুত, এ-উপন্যাসের পরিণতির প্রধান উপাদান প্রোথিত আছে অচলার সত্তার

কেন্দ্রমূলে। অচলার চিতজাগতিক দোলাচলবৃত্তি ও সিদ্ধান্তহীনতা নষ্ট করেছে তার

মনোভাবসামা, দগ্ধ করেছে তার অন্তর-আলয়। অচলা কাকে চায়– মহিমকে না

সুবেশকে— সে সম্পর্কে সে নিজেই নিশ্চিত নয়। অষ্টাদশ পরিচ্ছেদে সুরেশের কাছে

অচলার সংলাপে ধরা পড়েছে সিদ্ধান্তহীনভাজাত তার এই চিত্তদাহ—“সুরেশবাবু, আমাকে

তোমরা নিয়ে যাও—যাকে ভালোবাসিনে, তার ঘর করবার জন্যে আমাকে তোমরা ফেলে

রেখে দিয়ো না ...।" অচলার এই আহ্বান সুরেশকে প্ররোচিত করেছে, মনে করেছে

মহিমের কাছ থেকে চিরতরে ছিনিয়ে আনা যাবে অচলাকে–তার এই অবারণ উচ্ছ্বাস আরমূর্ধভাই অচলার অন্তরগৃহদাহে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।শরৎচন্দ্রের যে-সব উপন্যাসে মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণ প্রাধান্য বিস্তার করেছে, গৃহদাহ তারঅন্যতম। উপন্যাসে বিশেষ কোন নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করেই তিনি মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণেরজটিল পটভূমি নির্মাণ করেন। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিকে ইঙ্গিত করেই লিখেছেন—

"... মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণের দিক দিয়া গ্রন্থমধ্যে সর্বাপেক্ষা আলোচ্য বিষয় মহিম ও সুরেশের

প্রতি অচলার দোলাচল চিত্তবৃত্তি।"8 শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের অন্যতম ত্রুটি চরিত্রেরপরিপ্রেক্ষিতগত অস্পষ্টতা কিংবা অপূর্ণতা। ফলে উপন্যাসের অনেক চরিত্রেরই মনস্তাত্ত্বিকআচরণের কার্য-কারণ সম্পর্ক পাঠকের বোধের অগোচরে থেকে যায়। গৃহদাহ উপন্যাসসম্পর্কেও একথা গভীরভাবে সত্য।শরত্চন্দ্র মুখ্যত বহির্বাস্তবতার শিল্পী। অন্তর্বাস্তবতা বিশ্লেষণের চেয়ে বহির্বাস্তবতারবিবরণ প্রদানেই তিনি সমধিক আগ্রহী। কিন্তু গৃহদাহ উপন্যাসে এই গতানুগতিক পথে তিনিবিচরণ করেন নি। এখানে কাহিনীবৃত্তের মাঝেই মনস্তত্ত্ব ব্যবহারের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতিরস্বাক্ষর বর্তমান। তাই বহির্বাস্তবতার পরিবর্তে চরিত্রের মনোধর্ম আর মনস্তত্ত্বই এউপন্যাসে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। রাজপুরের অপরিচিত পরিবেশ, মহিমের অটল ঔদাসীন্য,মৃণাল সম্ভব জটিলতা, সুরেশের উচ্ছ্বাস আর আগ্রাসন, নিজের ইচ্ছার মতো করেকাহিনীকে পৌনঃপুনিক নিজের দিকে টেনে আনবার আত্যন্তিক প্রয়াস—এইসব ঘটনাদুর্ঘটনা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অচলাকে নিক্ষেপ করেছে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার উদ্ধারহীনঅতল আবর্তে। অচলাকে কেন্দ্র করেই এ-উপন্যাসে শরৎচন্দ্র বিস্তার করেছেন মনস্তত্ত্বেরজটিল জাল। অচলার রাগ-অনুরাগ, প্রেম-প্রেমহীনতা, একই সঙ্গে স্থিতধী ও উচ্ছৃঙ্খলপ্রকৃতির পুরুষের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, সিদ্ধান্তগ্রহণ ও সিদ্ধান্তহীনতা—সবকিছু মিলে সৃষ্টিহয়েছে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। সিদ্ধান্তহীনতা আর দোলাচলতাই অচলারমনস্তাত্ত্বিক জটিলতার কেন্দ্রীয় উৎস। একই পুরুষের প্রতি তীব্র আকর্ষণ-বিকর্ষণ অচলাকে

কখনো স্থির হতে দেয়নি। মহিমের অটল সংযম আর ঔদাসীন্য তাকে নিক্ষেপ করেছেসুরেশের উচ্ছ্বাস আর উচ্ছৃঙ্খলতার কাছে। কিন্তু সুরেশের উৎকট প্রেম আর শরীরী আকর্ষণতাকে আবার মহিমের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। মহিমের উত্তাপহীন আবেগবিচ্যুত প্রেমতাকে আবার নিয়ে গেছে সুরেশের কাছে। কিন্তু অবশেষে বুঝেছে উচ্ছ্বাস যে তাপ ছড়ায়,তাতে কখনো কখনো ভয়ঙ্করভাবে দক্ষও হতে হয়। এমনিভাবে অচলার দোলাচল, অন্তর

বাহিরের আকর্ষণ-বিকর্ষণ তাকে জটিল মনস্তত্ত্বের অন্ধকার আবর্তে নিক্ষেপ করেছে।

অচলার বিপরীতে সুরেশ কিংবা মহিমের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তেমন তীব্রভাবেউপন্যাসে প্রতিভাত হয়নি। সুরেশের কাছে প্রেমের ক্ষেত্রে হৃদয়ের চেয়ে শরীরই হয়ে

উঠেছে প্রধান। প্রেম ও শরীরকে কীভাবে একাত্ম করতে হয়, তা জানা ছিল না সুরেশের।ফলে অচলার দেহ পেয়েও দেহের প্রাণসত্তার স্পর্শ পায়নি সুরেশ। মহিমের মাঝেও তেমনকোন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার বাতাবরণ নির্মাণ করেননি ঔপন্যাসিক। সমর্পিত মৃণাল ছাড়ামহিমের মনের সন্ধান কেউ-ই পায়নি। তার মন আছে কিনা, কখনো কখনো তা নিয়েইসন্দেহ দেখা দেয়। অতএব, বোঝা যায়, সুরেশ বা মহিমনয়, অচলার মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণই

এ-উপন্যাসে ছিল শরগুন্দ্রের মৌল উদ্দেশ্য।

উপন্যাসের নামকরণ থেকে আমরা অনুমান করে নিতে পারি, অচলার জন্য ঔপন্যাসিক যে‘গৃহ’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, সে 'গৃহ' আর তৈরি হলো না, আগুনে পুড়ে শেষ হয়েগেল। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, অচলা কি কখনো গৃহের জন্য আকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছিল? অন্তরেরদোলাচলতাই তাকে গৃহী হতে দেয়নি। বস্তুত এই দোলাচলবৃত্তিই তার ট্র্যাজেডির মৌলকারণ। গৃহদাহ উপন্যাসে ট্র্যাজেডি ঘটেছে অচলার, সুরেশ বা মহিমের নয়। সমস্ত ঘটনারশেষে অচলাই বেঁচে থাকে যন্ত্রণাকে বুকে লালন করে, তপ্ত মরুভূমির মতো যন্ত্রণায় তারচিত্তই দগ্ধ হয়, পুড়ে যায় হৃদয়ের গৃহ—সেখানে তখন মহিম থাকে না, থাকে না সুরেশও।

তাই শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-উচ্চারিত মহৎ-চিত্তের অনিচ্ছাকৃত পাপের প্রতিক্রিয়া গৃহদাহকে ট্র্যাজিক মহিমা দান করেছে? –এই সিদ্ধান্ত প্রশ্ন-সাপেক্ষ থেকে যায়। কেননা, মহৎচিত্ত হিশেবে তিনি যাদের অভিধা দিয়েছেন, তাদের মাঝে মহত্ত্বের কোন লক্ষণই খুঁজেপাওয়া যায় না। মহিমের অটল গাম্ভীর্য আর নির্লিপ্তি, আধুনিক দৃষ্টিকোণে, মহত্ত্বের পরিচায়কহতে পারে না। মহিমই পারতো, তার সংযম আর আত্মত্যাগ দিয়ে অচলাকে গৃহের সন্ধানদিতে, কিন্তু তা সে করেনি—উদাসীনতা আর দুঃখবিলাস তাকে যথার্থ মহৎ-চিত্ত হতেদেয়নি। প্রথম থেকেই সে মীমাংসিত—তার চরিত্রে নেই কোন দ্বন্দ্ব, ট্র্যাজিক পরাভবে সেহয় না কখনো নীলকণ্ঠ। কেননা, এ কথা তো গভীরভাবে সত্য— দ্বন্দ্বহীন মীমাংসিতমানুষের কখনো ট্র্যাজেডি হয় না।

উপন্যাসের ট্র্যাজেডির মূলকেন্দ্রে সুরেশের অবস্থান। প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকেই,অচলার জীবনে সুরেশের প্রথম দস্যুতার মুহূর্ত থেকেই এ-উপন্যাসে ট্র্যাজেডির বীজমহীরুহ হতে আরম্ভ করে। সুরেশকে দেখার পরই অচলার চিত্তে দেখা দেয় দোলাচলবৃত্তি।

এ ক্ষেত্রে কার দায় বেশি মহিম না সুরেশের, না-কি অচলার নিজের—তা বিবেচনাসাপেক্ষ। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, গৃহদাহ উপন্যাসের ট্র্যাজিক পরিণতির বীজটিরোপিত হয়েছে অচলার দ্বারা। মহিমের ঘরে থেকে সুরেশের, সুরেশের সান্নিধ্যে থেকেমহিমের চিন্তা সে সরিয়ে দিতে পারেনি—এই চিত্ত-সঙ্কট থেকে সে নিস্তার পায়নি কাহিনীরশেষ পর্যন্ত। ৬ উপন্যাসের কাহিনী-বৃত্তে সুরেশ ইচ্ছাকৃত পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছে, তারচরিত্রেও কোন দ্বন্দ্ব নেই, মহিমের মতো সে-ও এক ধরনের মীমাংসিত চরিত্র। ফলে তারচরিত্রেও নেই কোন ট্র্যাজিক মহিমার স্পর্শ।

গৃহদাহ উপন্যাসের দ্বন্দ্ব ও ট্র্যাজেডি এককভাবে অচলার। তার ট্র্যাজেডিকে সম্পূর্ণকরতেই উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র স্ব স্ব ভূমিকা পালন করেছে মাত্র। সুরেশ আর মহিমেরমতো, এক্ষেত্রে, কম গুরুত্বপূর্ণ নয় মৃণাল কিংবা কেদারবাবু। এক অর্থে, কেদারবাবুইঅচলার ট্র্যাজেডির মৌল উৎস, কেননা তার স্বার্থের কাছেই অন্যেরা উপেক্ষিত হয়েছে—কখনো অচলা, কখনো মহিম, কখনো-বা সুরেশ। কারো স্বার্থচিন্তা, কারো উদ্দামতা, কারো

নির্দিা, কারো সনাতন সারল্য উপন্যাসটিকে ট্র্যাজেডির পথে নিয়ে গেলেও, অচলার

লালাচলই যে ত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, তা অনস্বীকার্য।


শবচন্দ্রের উপন্যাস মূল চরিত্রপ্রধান চরিত্রসৃষ্টির বিস্ময়কর নৈপুণ্য শরৎ-প্রতিভার অন্যতম

বৈশিষ্ট্য। গৃহদাহ উপন্যাস প্রসঙ্গেও একথা গভীরভাবে সত্য। শরৎচন্দ্রের চরিত্রায়ণ

কৌশলের প্রধান ভিত্তি ভাবালুতা ও আবেগ-নির্ভরতা গৃহদাহ উপন্যাসের চরিত্রপুঞ্জে সে

অর্থে পরিদৃষ্ট নয়। বরং এখানে চরিত্রায়ণে, সীমিত পরিমাণে, মননশীলতার ব্যবহার লক্ষ

করি। গৃহদাহ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তিনটি অচলা, মহিম এবং সুরেশ ; এদের সঙ্গে

আছে মৃগাল এবং কেদারবাবু কাহিনীবৃত্তে এ দু'জনের ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এসব

চরিত্রের মধ্যে অচলা ও মহিম অন্তর্মুখী ও জটিল চরিত্র; পক্ষান্তরে কেদারবাবু ও সুরেশ

জটিল-বহির্মুখী চরিত্র। মৃণালও বহির্মুখী চরিত্র, তবে তার মাঝে অন্তর্মুখী সত্তার ঝোকটাও

বর্তমান।

গৃহদাহ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অচলা। উপন্যাসের শুরুতে তার যে ছবি শরৎচন্দ্র

এঁকেছেন, তাতে তাকে অত্যন্ত সপ্রতিভ স্থিতপ্রাজ্ঞ আকর্ষণীয় চরিত্র বলে মনে হবে।সুরেশের দৃষ্টিকোণে অচলার অবয়ব-বর্ণনের মাঝেই ধরা পড়ে অচলার ব্যক্তিত্ব–“সুরেশদেখিল, মেয়েটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ছিপছিপে পাতলা গঠন। কপোল, চিবুক, ললাট—সমস্ত

মুখের ভৌলটিই অতিশয় সুশ্রী ও সুকুমার চোখ দুটির দৃষ্টিতে একটি স্থির-বুদ্ধির আতা"

(তৃতীয় পরিচ্ছেদ)। 

সুরেশের কথার প্রত্যুত্তরে ভাবী স্বামী সম্পর্কে তার অটল শ্রদ্ধাবোধ

প্রকাশ পেয়েছে নিম্নোক্ত মন্তব্যে –“... তিনি ত কখনই মিথ্যা বলেন না" (চতুর্থ পরিচ্ছেদ)।

মহিমের প্রতি অচলার এই শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকেনি। বিয়ের রাতে

শুভদৃষ্টির সময় মহিমের মুখের দিকে তাকিয়ে অচলারঅন্তর আনন্দে-মাধুর্যে পরিপূর্ণ হয়েউঠেছিল। বিয়ের সময় অচলার মনোভাবের পরিচয় দিতে গিয়ে ঔপন্যাসিক লিখেছেন—শুভদৃষ্টির সময় এই মুখ দেখিয়াই অচলার সমস্ত বক্ষ আনন্দে মাধুর্যে পরিপূর্ণ হইয়া গেল।

অন্তরের মধ্যে স্বামীর পদতলে মাথা পাতিয়া মনে মনে বলিল, প্রভু, আর আমি তয় করিনে।

তোমার সঙ্গে যেখানে যে অবস্থায় থাকিনে কেন, সেই আমার স্বর্গ ; আজ থেকে চিরদিন

তোমার কুটারই আমার রাজপ্রাসাদ। (চতুর্দশ পরিচ্ছেদ)

—কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহিমের কুটিরকে অচলা রাজপ্রাসাদ বানাতে পারেনি। সুরেশের উদ্দামআবির্ভাব, উচ্ছল আকাঙ্ক্ষা আর অনভিপ্রেত দস্যুতা অচলার স্বপ্নকে স্নান করে দিয়েছে।ডিহরীতে ঝড়-জলের রাতে সুরেশের সঙ্গে দেহমিলনের পরে অচলার জীবনে যে বিপর্যয়নেমে এসেছে, তা থেকে তার আর মুক্তি ঘটেনি। ধূসর, প্রাণহীন, বর্ণহীন, তপ্ত মরু-যন্ত্রণার

ফ্রাতে অচলার অস্তিত্ব বাধা পড়ে যায়—এটাই তার গভীর ট্র্যাজেডি।

অচলা-চরিত্রের অভিনবত্ব আর আধুনিকতার মৌল উৎস তার দোলাচল স্বভাব। মহিমএবং সুরেশের প্রতি সমান আকর্ষণ-বিকর্ষণ অচলা-চরিত্রকে করে তুলেছে বিশিষ্ট। এইআকর্ষণ-বিকর্ষণের পরিণতিতে অচলার জীবন ভরে উঠেছে অনন্ত শূন্যতায়। সুরেশেরশবদেহ সৎকারের পর মহিমের সঙ্গে অচলার কথোপকথনে ধরা পড়েছে অচলার এইঅন্তহীন একাকিত্ব ও অনন্ত শূন্যতার যন্ত্রণা—

মহিম আসিয়া দেখিল, সে কেরোসিনের আলোটা সম্মুখে রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে।

কহিল, এখন তুমি কি করবোআমি) বলিয়া অচলা তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কত কি যেন ভাবিতে লাগিল; শেষে বলিল,আমি ত ভেবে পাইনে। তুমি যা হুকুম করবে, আমি তাই করব।

এই বাকা ও ব্যবহারে সহিম বিস্মিত হইল, শঙ্কিত হইল। এমন করিয়া সে

একবারও চাহে নাই। এ দৃষ্টি যেমন সোজা, তেমনি স্বচ্ছ। ইহার ভিতর দিয়া তাহার বুকের

অনেকখানি যেন বড় দেখা গেল। সেখানে ভয় নাই, ভাবনা নাই, কামনা নাই, কল্পনা

নাই যতদূর দেখা যায়, ভবিষ্যতের আকাশ ধুমু করিতেছে। তাহার রচ নাই, মূর্তি নাই, পতি

নাই, প্রকৃতি নাই--একেবারে নির্বিকার, একেবারে একান্ত শূন্য। (চিত্বারিংশ পরিচ্ছেদ)


অচলার মতো মহিমও গৃহদাহ উপন্যাসের কেন্দ্রে অবস্থিত। উপন্যাসের আরম্ভ থেকে

সমাপ্তি পর্যন্ত মহিমকে পাঠক এক অবস্থাতেই দেখতে পায়। দ্বন্দ্বহীন মীমাংসিত চরিত্র

মহিম-অটল গান্ধীর্য আর আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার কারণে অচলার সঙ্গে তার দাম্পত্য

জীবনে দেখা দিয়েছে তীব্র সঙ্কট। এই সঙ্কট থেকে সে কখনো উত্তরণ প্রত্যাশা করেনি

পরিস্থিতির কাছে সে সমর্পণ করেছে নিজেকে। নিষ্প্রাণ পাথরের মতো কঠিন হৃদয় এক

গুরুষ হিশেবে নির্মিত হবার কারণে চরিত্রটি হারিয়ে ফেলে সব রকমের সম্ভাবনা এবং

স্থিতিস্থাপকতা। মহিমের উচ্ছ্বাসহীন সংযমী আচরণের কোন কার্য-কারণ ব্যাখ্যা উপন্যাসে

নেই, নেই তার পরিপ্রেক্ষিত-বর্ণনাও। এ কারণেই উপন্যাসে, মহিম-চরিত্র সমহিমায়

আবির্ভূত হতে পারেনি, সে হয়ে উঠতে পারেনি ব্যক্তিত্বময় স্বায়ত্তশাসিত কোন নায়কচরিত্র।

মহিমের বিপরীত চরিত্র সুরেশ। উদ্দামতা, উচ্ছলতা আর অসংযম-মানসতা তারপ্রধান চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য। ঘরে-বাইরে-র সন্দীপের ছায়া পড়েছে সুরেশ-চরিত্রে; কিন্তুসন্দীপের বাক্-চতুরতা, রসবোধ, সম্মোহন ক্ষমতা সুরেশে অনায়ত্ত। তার আবেগ,অভিমান, গায়ের জোর, অসংযম, অশ্রুসিক্ত আঁখি—সবই মোটা তুলিতে আঁকা। অসংযম

আর দায়িত্বহীন ক্রিয়া-কর্ম সুরেশকে কোনো মহৎ চরিত্র হয়ে উঠতে দেয়নি। সমগ্রউপন্যাসেই সুরেশের এই সংযমহীন অবিবেচক আচরণের বহু চিত্র আমরা লক্ষ করি।অচলাকে অপহরণের পরমুহূর্তে সুরেশের সংলাপে ধরা পড়েছে তার এই চিত্ত-দৈন্য—

আমি তোমাদের মত ব্রহ্মজ্ঞানী নই, আমি নাস্তিক। আমি পাপপুণ্যের ফাঁকা আওয়াজ করিনে,আমি নিরেট সত্যিকার সর্বনাশের কথাই ভাবি। তোমার রূপ আছে, চোখের জল আছে,মেয়েমানুষের যা-কিছু অস্ত্র-শস্ত্র তোমার তৃণে সে-সব প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত আছে, তোমারকোন পথেই বাঁধা পড়বে না। ... ময়ূর পুচ্ছ পাথায় খুঁজে দাঁড়কাক কখনো ময়ূর হয় না

অচলা। ও চাহনি আমি চিনি, কিন্তু সে তোমাকে সাজে না। যাকে সাজতো, সে মৃণাল, তুমিনও! তুমি অসূর্যম্পশ্যা হিন্দুর ঘরের কুলবধূ নও, এতটুকুতে তোমাদের জাত যাবে না।

(অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ)মৃণাল গৃহদাহ উপন্যাসে উপস্থিত হয়েছে ঔপন্যাসিকের মীমাংসা আর সিদ্ধান্তের বার্তানিয়ে। বহু ঘটনা আর ছিন্নগ্রন্থিকে জোড়া দিয়ে সমগ্রতা দান করা হয়েছে মৃণাল-চরিত্রের

মাধ্যমে। মৃণালের মুখ দিয়েই, উপন্যা । সমাপ্তিতে, শরৎচন্দ্র উচ্চারণ করেছেন অচলারশেষ আশ্রয় ও আশ্রমের ঠিকানামহিম বলিল, সুরেশের মৃত্যু হয়েছে। অচলা আমাকে একটা আশ্রমের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলমৃণাল, কিন্তু আমি তার জবাব দিতে পারিনি। তোমার কাছে হয়ত সে একটা উত্তর পেতেওপারে।মৃণাল তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া শুধু কহিল, পাবে বৈ কি, সেজদা। কিন্তু আমারসকল শিক্ষা তো তোমারি কাছে। আশ্রমই বল আর আশ্রয়ই বল, সে যে তার কোথায়, এখবর সেজদিকে আমি দিতে পারব, কিন্তু সে ত তোমারই দেওয়া হবে। (চতুশ্চত্বারিংশপরিচ্ছেদ)

- সৃষ্টি এবং পরণতি বা মৃণালের মতোই


করুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন কেমবিবার। উপন্যাসে এদের স্বপরি অবস্থা

হলে হান চরিত্রসমূহের বিকাশ পরিণতি, কাহিনীর নতুন পরিবর্তন

অরি মীমাংসার ক্ষেত্রে তা পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

চুয়াল্লিশ পরিচ্ছেদের সমাহারে গড়ে উঠছে jete উপন্যাসের অবয়ব। এ-উপন্যাসের


অভিনব ও আধুনিক: শরতদের উপন্যাস -


গঠনশৈলীর দ্বিতীয় উদাহরণ বিরল। আলোচ্য উপন্যাসের ঘটনাংশ তিন পর্বে বিক।


প্রথম পর্ব পরিচ্ছেদ) থেকে পরিচ্ছেদ ১৯১

দ্বিতীয় পর্ব পরিদ ২০ থেকে পরিচ্ছেদ ৩৭; এবং

তৃতীয় পর্ব পরিচ্ছেদ ৩৮ থেকে পরিচ্ছেদ ৪৪।


প্রথম পর্বকে এই উপন্যাসের মূল কাহিনীর পরিপ্রেক্ষিত হিশেবে গ্রহণ করা । সুরেশ

ও মহিমের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, অচলার প্রতি সুরেশের আকর্ষণ ও প্রেম, মহিমের সঙ্গে অচলার

বিয়ে, অচলার প্রতি সুরেশের মোহ, মহিমের গ্রামের বাড়িতে সুরেশের আগমন ও মহিমের

গৃহদাহ–এইসব ঘটনা নিয়ে গড়ে উঠেছে আলোচ্য উপন্যাসের প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পূর্ব এ

উপন্যাসের বৃহত্তম পর্ব—এ-পর্বেই সংঘটিত হয়েছে উপন্যাসের প্রধান ঘটনাধারা। মহিমের

গ্রামের বাড়ি বাজপুর থেকে সুরেশের সঙ্গে অচলার কলকাতা-প্রত্যাবর্তন, নিমোনিয়া

আক্রান্ত মহিমের কলকাতায় আগমন, সুরেশের বাড়িতে মহিমের রোগমুক্তি, মহিম ও

সুরেশের প্রতি অচলার দোলাচল আকর্ষণ, রোগমুক্তির জন্য মহিমকে নিয়ে অচলার জব্বলপুর

যাত্রা, সুরেশের সঙ্গদান, অসুস্থ মহিমকে ট্রেনে রেখে সুরেশ ও অচলার যাত্রাভঙ্গ, ডিহরীতে

রামবাবুর বাড়িতে দু'জনের স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাস ও ঝড়-জলের এক রাতে সুরেশেরকামানলের কাছে অচলার আত্মসমর্পণ—এইসব ঘটনানিয়েই দ্বিতীয় পর্ব। তৃতীয় পর্বঅপেক্ষাকৃত ছোট। মাত্র সাতটি পরিচ্ছেদ নিয়ে গড়ে উঠলেও এ-পর্বেই ঘটে উপন্যাসেরপরিণামী-ঘটনাংশ। সেদিক থেকে এ-পর্বের গুরুত্বও অপরিসীম। অচলার সঙ্গেদেহমিলনের পর সুরেশের মোহমুক্তি, অচলাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্লেগ রোগীরসেবায় মাটুলিতে সুরেশের মৃত্যু, মুমূর্ষু সুরেশের শয্যাপাশে অচলা ও মহিমের উপস্থিতি,অচলার সীমাহীন একাকিত্ব ও অনন্ত শূন্যতা— এইসব ঘটনার সমাবেশ ঘটেছে তৃতীয় বাশেষ পর্বে। লক্ষণীয়, প্রথম থেকেই উপন্যাসের কাহিনী এক অনিবার্য ট্র্যাজিক পরিণতিরদিকে ধাবিত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের অন্য কোন উপন্যাসে এরূপ মেদহীন নিপুণ গঠনসৌকর্যপরিদৃষ্ট হয় না।গৃহদাহ উপন্যাসের গঠনবৈশিষ্ট্য আলোচনায় মৃণাল উপাখ্যান অনিবার্যভাবে উপস্থিতহয়। মৃণালের শাখাকাহিনীটি শরৎচন্দ্রের মৌল প্রতিপাদ্যকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তাকরেছে – শরৎ-মানসিকতা ও বিশ্বাস অনুযায়ী অচলার প্রকৃত আশ্রয় ও আশ্রম যে কোথায়,তা জানানোর জন্যও মৃণাল হয়ে পড়েছিল অনিবার্য। মৃণাল উপন্যাসে যেমন জট বাধিয়েছে,তেমনি কেন্দ্রীয় জট খুলে দিয়েছে সে-ই। উপন্যাসের জটিলতা-বিস্তার ও পরিণতি-সাধনেমৃণাল উপাখ্যান শরৎচন্দ্রের কাছে অনিবার্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। ঔপন্যাসিকের বিস্ময়করশিল্পনৈপুণ্য ও পরিমিতিবোধের কারণে শাখা কাহিনীটি দূরান্বিত না হয়ে উপন্যাসের মূলস্রোতের সঙ্গে ঐক্যসূত্রে হয়েছে প্রপিত। মৃণাল উপাখ্যান, যথার্থ অর্থেই, পরিস্থিতিরপ্রয়োজনীয় উপাদানে পরিণতি লাভ করেছে।

গৃহদাহ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র সহঙ্গ বিবৃতি বা বিশ্লেষণের পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন

বহুমাত্রিক SITUATION বা পরিস্থিতি-চিত্র। এইসব পরিস্থিতি-চিত্র শরৎচন্দ্রের প্রাগ্রসর

শিল্পবোধের পরিচায়ক। নিচে এমন কয়েকটি পরিস্থিতি-চিত্র উদ্ধৃত হলো-

ক. গাড়ি বাটীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। সহিস দ্বার খুলিয়া সরিয়া গেল, সুরেশ নিজে নামিয়াসযত্নে সাবধানে অচলার হাত ধরিয়া তাহাকে নিচে নামাইযা উভয়েই এক সঙ্গে চাহিয়া দেখিল,

ঠিক সমুখে মহিম দাঁড়াইয়া এবং সেই নিমিষের দৃষ্টিপাতেই এই দুটি নর-নারী একেবারে যেনপাথরে রূপান্তরিত হইয়া গেল। (নবম পরিচ্ছেদ)

খ. মহিম স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মিনিট দুই পরে আঁচলে চোখ মুছিয়া (অচলা| কহিল, আমার

লজ্জা করবার আর সময় নেই। দেখি তোমার ডান হাতটি। ... আমি আর ভাবতে পারিনে।

এইবার যা করবার তুমি করো।

মাত্র একটি ছত্র। বার, ভারিখ নাই, মৃণাল লিখিয়াছে—সেঞ্জাদা মশাই গো, করছ কি? পরশুথেকে তোমার পথ চেয়ে চেয়ে তোমার মৃণালের চোখ দুটি ক্ষয়ে গেল যে!বহুক্ষণ অবধি অচলার চোখের পাতা নড়িল না। (ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ)চরিত্রের অন্তর্বাস্তবতা উপস্থাপনে শরৎচন্দ্র এ-উপন্যাসে একই দৃশ্যের পৌনঃপুনিকব্যবহার করেছেন। উপন্যাসের প্রথম দিকে, নবম পরিচ্ছেদে আছে ঘোড়ার গাড়ির ছবি।ওই ছবিতে দেখা যায়, ঘোড়ার গাড়িতে অচলা ও সুরেশের প্রসন্ন প্রফুল্ল মুখচ্ছবি। কিন্তু

উপন্যাসের শেষ পর্বে, চল্লিশ পরিচ্ছেদে, সেই একই ঘোড়ার গাড়ির ছবি, কিন্তু সেখানে

অচলার হাতে চুম্বনের পরিবর্তে সুরেশের মুখে শুনি এই সংলাপ –

—আজকাল আমি কি তাবি জানো?

—এতকাল যা ভেবে এসেছি ঠিক তার উল্টো। তখন ভাবভূম কি করে তোমাকে পাবো; এখন

অহর্নিশি চিন্তা করি, কি উপায়ে তোমাকে মুক্তি দেব। তোমার তার যেন আমি আর বইতে পারিএই অচিন্ত্যপূর্ব একান্ত নিষ্ঠুর আঘাতের শুরুত্বে ক্ষণকালের জন্য অচলার সমস্ত দেহমনএকেবারে অসাড় হইয়া গেল। ... সহসা তাহার অশাক্ত অবশ ডান হাতখানি খপ্ করিয়া

সুরেশের ক্রোড়ের উপর পড়িতেই সে চমকিয়া চাহিল। অচলা ... কহিল, আর কি তুমি

আমাকে ভালবাস না? (চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ)

—একই চিত্র, অথচ দু'চিত্রের মাঝে কত ব্যবধান। অচলার জীবনের দুই বিপরীত প্রান্তদু'টি ছবির মাধ্যমে প্রতিভাত।

গৃহদাহ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র মানুষের জীবনের অন্তহীন শূন্যতা আর অতলান্ত নৈঃসঙ্গ্যউপস্থাপনে প্রায়ই ব্যবহার করেছেন প্রকৃতির খণ্ডচিত্র। প্রকৃতি-আশ্রয়ী চিত্রকল্প ব্যবহার করেতিনি তুলে ধরেছেন অচলার ভয়ানক নিঃসঙ্গতা ও নিরাশ্রয়তা

ক. শীতের সূর্য অপরাহ্ণবেলায় ঢলিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছিল, এবং তাহারই ঈষতপ্ত কিরণেশোন নদের পার্শ্ববর্তী সুদূর বিস্তীর্ণ বালু-মরু ধু-ধু করিতেছিল। এমনি সময়ে একটাবাঙলোবাটীর বারান্দায় রেলিং ধরিয়া অচলা সেইদিকে চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল।তাহার নিজের জীবনের সঙ্গে ওই দগ্ধ মরুখণ্ডের কোন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল কি না, সে অন্য কথা,কিন্তু ঐ দুটি অপলক চক্ষুর প্রতি পলকমাত্র দৃষ্টিপাত করিলেই বুঝা যাইতে পারিত যে, তেমনকরিয়া চাহিয়া থাকিলে দেখা কিছুই যায় না, কেবল সমস্ত সংসার একটা বিচিত্র ও বিরাট

ছায়াবাজীর মত প্রতীয়মান হয়। (একবিংশ পরিচ্ছেন।

খ. মেঘাবৃত্ত অপরাহ্ণ আকাশতলে নির্জন রাজপথ প্রতিষ্ঠানিত করিয়া গাড়ি দ্রুতবেগে ছুটিয়াছে,

তাহারই মধ্যে বসিয়া এই দুটি নরনারী একেবারে নির্বাক। ... সুরেশ নাই–সে একা। এই

একাকিত্ব যে কত বৃহৎ কিরূপ আকূল, তাহা বিদ্যুয়েগে তাহার মনের মধ্যে খেলিয়া গেল।

অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় যে তরণী বাহিয়া সে সংসারসমুদ্রে ভাসিযাছে, সে যে অনিবার্য মৃত্যুর

মধ্যেই তিল তিল কবিয়া ডুবিতেছে, ইহা তাহার চেয়ে বেশি কেহ আনে না, তথাপি সেইসুপরিচিত ভয়ঙ্কর আশ্রয় ছাড়িয়া আজ সে দিকচিহ্নহীন সমুদ্রে ভাসিতেছে ...। (চত্বারিংশ

পরিচ্ছেদ)


—প্রকৃতির উপাদানে এখানে যে চিত্রকল্পহয় নির্মিত হলো, তাতে প্রকাশিত হয়েছে তার

অন্তহীন শূন্যতা আর বেদনার কথা। ডিহরীতে রামবাবুর বাড়িতে সুরেশের সঙ্গেদেহমিলনের পর অচলার বিষণ্ণতা ও আত্মগ্লানি প্রকাশে রামবাবুর দৃষ্টিকোণে শরৎচন্দ্র নির্মাণকরেছেন এমনি এক অসামান্য চিত্রকল্প। প্রকৃতির উপাদান এ চিত্রকল্পেও অব্যর্থ হয়েব্যবহৃত হয়েছে। যেমন—“তাহার মুখ মড়ার মত সাদা, দুই চোখের কোলে গাঢ় কালিমাএবং কালো পাথরের গা দিয়া যেমন ঝরনার ধারা নামিয়া আসে, ঠিক তেমনি দুই চোখের

কোল বাহিয়া অশ্রু করিতেছে"। (সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ)

গৃহদাহ উপন্যাসের গঠনশৈলী আলোচনায় এর ঘনীভূত নাট্যরস তথা নাটকীয়চমৎকারিত্বের কথাও বলা প্রয়োজন। ঘটনার বাঁকে বাঁকে আকস্মিকতা ও বৈপরীত্যের চমকসৃষ্টি করে শরত্চন্দ্র এ-উপন্যাসে নাটকীয় ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। উপন্যাসে পরিস্থিতি রচনারমধ্যেও ঘনীভূত আবেগ ও নাট্যোৎকণ্ঠা সৃষ্টিতে শরত্চন্দ্র অসাধারণ নাট্যক্ষমতার পরিচয়নিয়েছেন। গৃহদাহ উপন্যাসের নাট্যগুণ আলোচনা করতে গিয়ে অজিতকুমার ঘোষ যথার্থইলিখেছেন—“চরিত্রের আকস্মিক ও অভাবনীয় পরিবর্তন, বিষম আচরণ, আকর্ষণ-বিকর্ষণেরসহ-অবস্থান প্রভৃতির মধ্যেও শরত্চন্দ্র নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন। ... অচলা যাকেভালোবাসতে চেয়েছে তার সঙ্গে ঘর করতে পারেনি এবং যার সঙ্গে ঘর করতে চায়নিতাকেই ভালোবেসেছে। আনুগত্য ও অবসাদ, ঘৃণা ও আসক্তি একই সঙ্গে অচলার মধ্যেপরস্পরের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে শুধু কেবল তার অন্তরকেই ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছে।

এমনিভাবে বিষম প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বের এবং অন্তর ও বাহিরের বৈপরীত্যে শরৎচন্দ্রের চরিত্রগুলি

চমকপ্রদ ও নাট্যবেগসম্পন্ন হয়ে উঠেছে।”

বিষয়াংশ, ভাবপরিমণ্ডল এবং প্রকরণ-পরিচর্যার মতো ভাষা ব্যবহার এবং সংলাপনির্মাণেও, এ-উপন্যাসে, শরণ্ডন্দ্র বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। অন্যান্য উপন্যাসের মতোগৃহদাহ উপন্যাসেও বর্ণনার অংশে সাধুভাষা আর চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তিতে তিনি ব্যবহারকরেছেন চলিভাষা। শরৎচন্দ্রের সাধুভাষা, বলাইবাহুল্য, চলিভাষার অনেক কাছাকাছি।বাক্যের ক্রিয়াপদ ছাড়া শব্দব্যবহার ও বাগভঙ্গির দিক দিয়ে শরৎচন্দ্রের সাধুভাষাচলিতভাষার নামান্তর। সাধুভাষার ক্রিয়াপদ বাক্যের মধ্যে সাঙ্গীতিক তাল বিস্তার করেছেএবং সঞ্চার করেছে অপূর্ব সুষমা ও মাধুর্য।বিষয়ানুগ ভাষা এবং চরিত্রানুগ সংলাপ-নির্মাণে শরচন্দ্র ছিলেন পারঙ্গম শিল্পী। গৃহদাহউপন্যাসেও আমরা তাঁর এই শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় পাই। শরত্চন্দ্রের সাধারণ প্রবণতাঅনুযায়ী গৃহদাহ-এর ভাষাও সরল ও কোমল; কিন্তু বিষয়ের দাবিতে তিনি কখনো কখনো

সেখানে এনেছেন ভিন্নমাত্রা। যেমন সুরেশের উদ্দামতা ও বন্যতা প্রকাশে তাঁর ভিন্নধর্মী

ভাষা—“কয়েক মুহূর্ত এইভাবে থাকিয়া সুরেশ আর একবার অচলার দুই হাত বুকের উপরচাপিয়া ধরিয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিতে লাগিল, অচলা, একটিবার ভূমিকম্পের এই প্রচণ্ডহৃৎস্পন্দন নিজের দুটি হাতে অনুভব করে দেখ—কি ভীষণ তাণ্ডব এই বুকের ভেতরটায়তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। এ কি পৃথিবীর কোন ভূমিকম্পের চেয়ে ছোটা বলতে পার অচলা,পৃথিবীর কোন্ জাত, কোন্ ধর্ম, কোন মতামত আছে, যা এই বিপ্লবের মধ্যে পড়েও ডুবেরসাতলে তলিয়ে যাবে না" (ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)। এখানে ভূমিকম্প, তাণ্ডব, বিপ্লব, তোলপাড়,

রসাতল, তলিয়ে ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে শরত্চন্দ্র সুরেশের বিধ্বংসী প্রবৃত্তিলীলাকে মূর্ত

করে তুলেছেন। গৃহদাহ, বিষয়বস্তু চরিত্রায়ণ এবং প্রকরণ-পরিচর্যা—এই ত্রিবিধ দৃষ্টিকোণেই, শরণ্ডন্দ্রেরশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের ঔপন্যাসিক-শিল্পদৃষ্টিতে জীবন সম্পর্কে।

সমগ্রবোধের অভাব প্রত্যক্ষ করেছেন। ১১ শরত্চন্দ্র সম্পর্কে এ-কথা মেনে নিয়েও বলা যায়,গৃহদাহ উপন্যাসে শরণ্ডন্দ্র এ অভিযোগ থেকে অনেকটা মুক্ত। ভাবালুতা, অতিকথন,ভাষিক শৈথিল্য, শরৎচন্দ্রীয় মুদ্রাদোষ ইত্যাদি বিষয় এখানে অনুপস্থিত। প্লটের বাঁধুনির সঙ্গে

এ-উপন্যাসে যুক্ত হয়েছে সংযম, ঋজুতা, তীক্ষ্ণতা আর মননশীলতা।১২ গৃহদাহ, যথার্থঅর্থেই, বাংলা উপন্যাসের ধারায় একটি উজ্জ্বল নির্মাণ।


ভবতোষ চট্টোপাধ্যায় গৃহদাহ প্রসঙ্গে তাঁর শরৎ-সাহিত্যের স্বরূপ গ্রন্থে উল্লেখযোগ্যআলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনাটি নিম্নে উপস্থাপিত হলো—


উমা-অপর্ণা-রাধিকার মৃত্যু আমরা আর একবার প্রত্যক্ষ করি ‘গৃহদাহ' উপন্যাসের অচলাচরিত্রে। বৃদ্ধ রামবাবু অচলাকে ‘সতীলক্ষ্মী মা’ ব’লে সম্বোধন করেছেন, সান্ত্বনাদিয়ে বলেছেন(পরিচ্ছেদ ৩৭), যিনি সতী, স্বয়ং আদ্যাশক্তি, তিনিও একবার স্বামীর ঘর করতে বাপ-মাআত্মীয়-স্বজন সকলের সঙ্গেই ঝগড়া করে চলে গিয়েছিলেন। অচলার কাহিনী এই পুরাণআখ্যানের ব্যঙ্গানুকৃতিও নয়, নিষ্ঠুর পরিহাস। এই কাহিনীর মধ্য দিয়ে শরৎচন্দ্র দু'টি বাস্তবসত্যকে তুলে ধরেছেন। একটি, জৈবিক প্রবৃত্তির প্রবলতা, যার প্রকাশ আমরা কিরণময়ীর চরিত্রেদেখেছি। দ্বিতীয়টি শরৎসাহিত্যে আগে কখনও রূপায়িত হয়নি (যদিও ‘শুভদা'র ললনা-চরিত্রে

এর ক্ষীণ পূর্বাভাস আছে)–একটি নারী একই সঙ্গে, একই সময়ে দু'টি পুরুষকে ভালবাসতেপারে; অচলা ব্রাহ্মসমাজভুক্ত, এই যুক্তিতে এই দ্বিধাকে স্বাভাবিক নারীধর্মের ব্যত্যয় বললে ভুলহবে, ধর্মসম্প্রদায়নির্বিশেষে এটি একটি বাস্তব, মানবিক (অথবা, জৈবিক) সত্য।

‘চোখের বালি'তে বিনোদিনী প্রথমে মহেন্দ্রের প্রতি আসক্ত হয়েছে, এ আসক্তি একান্তইজৈবিক; সে পরে ঐকান্তিকভাবে ভালবেসেছে বিহারীকে তার প্রেমের একনিষ্ঠতায় কোনসংশয়ের অবকাশ নেই। অচলার প্রেমে এই একনিষ্ঠতা নেই, তার অন্তর্পোকে দ্বৈত আকর্ষণেরপ্রভাব আমরা লক্ষ করি কাহিনীর প্রায় সূচনা থেকেই। সুরেশ অচলার জীবনে এসেছে প্রচণ্ডঝড়ের অপ্রতিহত বেগে, মহিমের নির্মম গাভীর্যের প্রতিবাদ হিসেবে। সুরেশের আশু উদ্দেশ্যছিল এই ব্রাহ্মতরুণীর প্রভাব থেকে মহিমকে মুক্ত করা, অকৃত্রিম বন্ধুত্বই তাকে এই উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত করেছিল; কিন্তু প্রথম দর্শনেই সে অচলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, আচ্ছন্ন হয়েছে একসুখোন্মাদকর অনুভূতিতে, অনিবার্য গতিতে ক্ষীণ ধূমকেতু অগ্নিরেখায় প্রদীপ্ত হ'য়ে উঠেছে।

তার চরিত্রের রূপান্তর হয়েছে আশ্চর্য দ্রুততায়, তার অব্যবস্থিতচিতে সংঘাত ও সমন্বয়ে

সহাবস্থিত হয়েছে বিভিন্ন বিরোধী ঋণ–পরার্থপরতা ও শাঠ্য, অকৃত্রিম বন্ধুত্ব ও কৃতঘ্নতা,সরলতা ও সন্ধিক্ষতা, আসক্তি ও উদাসীনতা, অদম্য জীবনস্পৃহা ও বৈরাগ্য। অচলা তার দিকে

কখনো এগিয়ে এসেছে অন্ধ প্রবৃত্তির দুর্গম প্রভাবে, কখনো ঘৃণায় দূরে সরে গেছে; কিন্তুসুরেশের উন্মত্ত আকর্ষণ সে কোনদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেনি—এই আকর্ষণ শুধুমাত্র জৈবিকনয়, তার বলিষ্ঠ ও দ্রঢ়িষ্ঠ ব্যক্তিত্ব অচলার হৃদয়কেও গভীরভাবে নাড়া নিয়েছে। মহিমের প্রতিভার যেম ও শ্রদ্ধার গভীরতার পরিচয় পাই ছোট্ট একটিকথায়: কিন্তু তিনি ত কখনোই মিথ্যাবলেন না' (পরিচ্ছেদ ৪); তার অকুণ্ঠ আত্মনিবেদনে : 'আমি আর ভাবতে পারিনে। এইবার যাকরবার তুমি করো' (পরিচ্ছেদ ১০); তার নিবিড় ঐকাত্মবোধে: 'আজ থেকে চিরদিন তোমার

কুটীরই আমার রাজপ্রসাদ' (পরিচ্ছেদ ১৪); অভদৃষ্টির পরম মুহূর্তে তার হৃদয় প্রেম ও প্রত্যয়েএকা। কিন্তু এ কথা মনে করলে ভুল হবে যে তার প্রেম অনন্যনিষ্ঠ এই অনন্যনিষ্ঠতা চিড়খেয়েছে শুধু বইরের বিরুদ্ধ শক্তির আঘাতে পল্লীগ্রামের নির্জন নিরানন্দ পরিবেশ,বনজঙ্গলপরিবৃত ক্ষুদ্র দরিদ্র কদর্য কুটির, ব্রাহ্মকন্যার প্রতি সংকীর্ণ অসংস্কৃত পল্লীসমাজের

প্রতিকূলতা, মহিমের অটল ঔদাস্য এবং সর্বোপরি, মৃণালের উপস্থিতি। এ সবই নিঃসশেহে

তার বিস্বাদ, বিরূপতা, বিতৃষ্ণা ও অবসাদ বাড়িয়ে দিয়েছে; কিন্তু যা সূর্যালোকের মতোই স্পষ্ট

তা তার চিত্তে দুটি বিপরীত ধারার সমান্তর উপস্থিতি।মহিমের অবিচলিত গান্তীর্যের অবরুদ্ধদরজায় সে বারবার মাথা ঠুকেছে ব্যর্থ প্রত্যাশায়, প্রেমিক ও স্বামীর নির্বিকার ঔদাসীন্য তাকেপীড়িত করেছে; তবু মহিমের স্থিতপ্রজ্ঞার মহিমা সে উপলব্ধি করেছে গভীর শ্রদ্ধায় ও নিভৃতবেদনায়। সুরেশের উন্মুক্ত কামনার অনাবৃত চেহারা দেখে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ত্রাসে ওঘৃণায়; কিন্তু সুরেশের সন্তাপ ও ব্যাকুলতা ভূকম্পনের মতোই দুর্দম, শরীর ও মনের প্রত্যেকটিরন্ধে অচলা আস্বাদন করেছে তার জীবন্ত, আগ্রাসী স্পন্দন; এবং পরিশেষে এই বঞ্চিত,

হতভাগ্য, নিঃস্বার্থ মানুষটির জন্য সে অনুভব করেছে এক গভীর অনুকম্পা ও মমতা, যার আরএক নাম প্রেম। সুরেশের সঙ্গে অচলার পরিচয়ের প্রায় সূচনা থেকেই আমরা প্রত্যক্ষ করি এইআকর্ষণ-বিকর্ষণের দ্বন্দ্ব: কৌতুক ও মৃদু শঙ্কার সঙ্গে আমরা লক্ষ করি, কেদারবাবুর অভ্যর্থনাসাদর ও সানন্দ, এবং ভাবী স্বামীর কৃতঘ্ন বন্ধুর প্রতি অচলার ভদ্রতায় স্বাভাবিক সৌজন্যেরঅতিরিক্ত কোন হৃদয়বৃত্তির সন্ধান পাই আমরা। সুরেশ মহিমের 'কপট আচরণ’ ও ‘পাষণ্ডেরমত ব্যবহার'-এর কঠোর নিন্দা করেছে (পরিচ্ছেদ ৪)—যদিও পরে সে অনুতপ্ত হ'য়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে—এবং যাবার সময় শুনেছে অচলার আশ্বাসবাণী : কিন্তু তাঁর সঙ্গেই যেআসতে হবে, এর ত কোন মানে নেই। পরের দিন সে আবার একাই এসেছে কেদারবাবুরবাড়ি (মহিম সকালের ট্রেনে অচলাকে না জানিয়েই দেশে চলে গেছে); 'পাষাণ’, ‘নিষ্ঠুর' বন্ধুরপ্রতি সুরেশের গভীর মমত্ব এবং তার অনুতাপের আন্তরিকতায় অচলা শ্রদ্ধা, সমবেদনা ওআবেগে উদ্‌গত অশ্রু গোপন করেছে। এরপর প্রতিদিনই সুরেশ এসেছে অচলার কাছে, এবংএকদিন তার সংযমের বাঁধ ভেঙে গেছে: প্রবল হাতে অচলাকে আকর্ষণ করে শরীর ও হৃদয়ের

সমস্ত উত্তাপ দিয়ে সে প্রকাশ করেছে তার গোপন ঈদার ব্যাকুলতা। অচলা স্বাভাবিক; সে

সদানন্দময়ী, স্বামীর প্রৌঢ়ত্ব নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে জন্মজন্মান্তরের সম্বন্ধ' (পরিচ্ছেদ ১৪) এই সহজ প্রত্যয়ে সে নৈসর্গিক নিয়মকে অতিক্রম করেগেছে। তার বহুবিধ গুণের মধ্যে সাব্বিতার দিকটিই সবচেয়ে উজ্জ্বল রঙে আঁকা হয়েছে; কিন্তু

একটি সূক্ষ্ম সংশয়ের অবকাশও রেখেছেন লেখক, একটি অর্ধোচ্চারিত প্রশ্ন জাগিয়েছেন পাঠকের

মনে : মহিমের প্রতি তার মনোভাব কি শুধুই ঐকান্তিকপ্রীতি? তার পরিহাসপ্রিয়তার মধ্যে

একটি প্রচ্ছন্ন বেদনার রাগিণী আমরা শুনতে পাই, এই নিভৃত বেদনা তার অজ্ঞাতসারে চাপাদীর্ঘশ্বাসের মতো বেরিয়ে এসেছে একটি ইঙ্গিতময় সংলাপে (পরিচ্ছেদ ১৪)। অচলা প্রশ্নকরেছে, মহিমের সঙ্গে মৃণালের বিয়ের প্রস্তাব হয়েছিল কিনা; অন্যমনস্কভাবে মৃণাল জবাব

দিয়েছে, 'তা বটে'। 'তবে হল না কেন? হলেই ও বেশ হত'-অচলার এই উক্তি তাকে

মুহূর্তের জন্য বিচলিত করেছে, কানের ভিতর দিয়ে আঘাত করেছে মর্মমূলে, চমকে উঠে স্থির

দৃষ্টিতে অচলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছে: 'এ-সব কি তুমি খুঁজে বেড়ান্ড সেঙ্গসি? তুমি

কি মনে কর, ছেলেবেলার সব ভালবাসার শেষ ফল এই? না, মানুষ বিয়ে দেবার মালিক ?"

ক্ষণিকের এই আত্মবিবৃতি সে কাটিয়ে উঠেছে সচেতন প্রয়াসে, অন্তর্গীন বিশ্বাসের জোরেআবার সুপ্রতিষ্ঠ হয়েছে সনাতন নারী-ধর্মে। মৃণালের পাতিব্রত্য আমাদের মুগ্ধ করে, কিন্তুসেই সঙ্গে আমরা উপলব্ধি করি, মৃণাল ও অন্নন্দাদিদি সমগোত্রীয় নয়, মৃণালের মধ্যে আমরাখুঁজে পাই দেবদাসের পার্বতীকে। কিন্তু এই পার্বতী-সপ্তা সংগুপ্ত থেকেছে তার অন্তরের গোপনপ্রকোষ্ঠে, স্ববিরোধ ও দ্বিধা কখনও তার চিত্তকে দীর্ণ করেনি। যে সহজ সংস্কারের কবচ

মৃণালের শুচিতাকে রক্ষা করেছে, সেই আশ্রয় অচলার নেই; এর কারণ শুধু এই নয় যে, সেব্রাহ্মমহিলা, এর মূল কারণ তার স্বাতন্ত্র্যবোধ। মানসী-প্রতিমাগুলিতে আমরা দেখেছি অপর্ণা

উমা-রাধিকার আত্মবিলুপ্তি, আত্মেন্দ্রিয়-প্রীতিইচ্ছার বিনাশ। প্রথমে ব্যাধতীত হরিণীর মতোএই উন্মুক্ত প্রেমিকের হাত থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করেছে, তারপর ‘মূর্ছিত মায়ামুগ্ধের’ মতোচেয়ে থেকেছে; সুরেশকে সে প্রত্যাখ্যান করেছে শান্ত দৃঢ়তায়, কিন্তু সিঁড়িতে সুরেশের পায়েরশব্দ মিলিয়ে যাবার পর তার দুই চোখ বেয়ে নেমেছে অশ্রুর ধারা (পরিচ্ছেদ ৮)। এরপর ঘটনাএগিয়ে অমোঘ পরিণামের দিকে, সে পরিণাম অবিশ্বাস্য, নিদারণ, অথচ নির্মমভাবেবাস্তব। সুরেশের প্রবল ব্যক্তিত্বকে সমৃদ্ধ করেছে তার বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি এবং আর্থিকপ্রাচুর্য—যে প্রাচুর্য মহিমের দৈন্যের কাঠামোটিকে আরও প্রকট ক'রে তুলেছে এবং কাহিনীর

শোকাবহ পরিণতিকে ত্বরান্বিত করেছে। এক ঝড়ের রাত্রে—এই ঝড় জৈবিক প্রবৃত্তির মতোই

নৈর্ব্যক্তিক–অচলা সুরেশের শয়নকক্ষে প্রবেশ করেছে, নিঃশব্দে, স্বেচ্ছায়, পিছনে না তাকিয়ে।

তার আত্মদহন যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই আত্ম-সমর্পণ। নারীর মূল্য' প্রবন্ধে শরৎচন্দ্রদ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর কথা এবং তিব্বতী রমণীদের বহু-স্বামিত্বের প্রথার উল্লেখ করেছেন; বহুস্বামিত্ব দূরে থাক, দ্বিচারিণী রমণী ভারতীয় সমাজে শ্লাঘনীয় নয়। সাব্বিতা ও একনিষ্ঠ প্রেমেরঅনেক উজ্জ্বল ছবি শরৎচন্দ্র আমাদের উপহার দিয়েছেন; কিন্তু একটি নারী যে একই সঙ্গেএকাধিক পুরুষের প্রতি আসক্ত হ'তে পারে এই বাস্তব সত্যকেও তিনি অস্বীকার করেন নি।

‘গৃহদাহ' উপন্যাসে অচলার বিপরীত চরিত্র মৃণাল। সে একাধারে দরিদ্র অনন্দা ও উমা,এবং তার সম্পর্কে সুরেশের মন্তব্য—সহমরণের দিনে যে সব সতী হাসতে হাসতে পুড়েমরতো, মৃণাল তাদেরই জাত (পরিচ্ছেদ ২৪) – এই বৈপরীত্যের দিকটি স্পষ্টভাবে তুলেধরেছে। মৃণালের পাতিব্রত্য নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই আধুনিক সমাজে নারীত্বের সার্থকতাশুধু পুরুষের সঙ্গে একাত্মতায় নয়; পুরুষকে তার প্রয়োজন, কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে তার স্বতন্ত্র

সত্তা আছে; বিবাহও প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন, জন্মজন্মান্তরের বন্ধন নয়। তীব্র অভিমান ওক্ষোভে মহিম অভিযোগ করেছে (পরিচ্ছেদ ১৮), অচলার কাছে বিয়ে একটা ব্যবসা মাত্র,‘ভাগের কারবারে সুবিধে হলো না টের পেয়ে দোকান তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। এঅভিযোগ নিষ্ঠুর—অচলাকে সে কোনদিনই বুঝবার চেষ্টা করেনি – কিন্তু এর মধ্যে একটিপ্রচ্ছন্ন সত্য আছে। অচলা পাতিব্রত্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বারবার মহিমের সঙ্গে একাত্মহবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু দুজনের মধ্যে ব্যবধান কখনোই দূর হয়নি; যে প্রাচীর নিঃশব্দে মাথাতুলে দাঁড়িয়েছে, তাতে মহিমের ভূমিকা স্পষ্ট, কিন্তু এই অন্তরায় অচলার স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের,অন্তরায়। সুরেশের সঙ্গেও সে একাত্ম হ'তে পারেনি—দ্বিধা, গ্লানি, অনুস্মৃতি, সংস্কার ওসামাজিক বিধানের চাপ সূক্ষ্ম ও স্থূলভাবে কাজ করেছে, কিন্তু এখানেও একটি অনতিক্রমণীয়অন্তরায় তার স্বাতন্ত্র্যবোধ। অভয়া সাধ্বী স্ত্রী হ'য়েও উৎপীড়ক, কদাচারী স্বামীকে ছেড়ে চ'লেএসেছে; কিন্তু তার নারীত্ব সার্থক হয়েছে শুধু তার চরিত্রের বলিষ্ঠতার জন্য নয়, তারস্বাস্থ্যবোধের বিলুপ্তিতে। তার তপস্যা আত্মবিলুপ্তির তপস্যা-সমাজের প্রচলিত নিয়মে সে

কলঙ্কিনী হ'লেও সতী-সাথিনী-অন্নপূর্ণার সঙ্গেই তার স্বজাতীয়ত্ব। অচলা নিজের পৃথকঅস্তিত্বকে কোনদিনই তুলতে পারেনি সুরেশের মৃত্যুর পর সে মহিমের কাছে পথের নির্দেশচেয়েছে ('ভূমি যা হুকুম করবে, আমি করব'), কিন্তু তার দৃষ্টিতে নির্বিকার শূন্যতা, তার ভাষানিঃসীম হতাশার অভিব্যক্তি মাত্র।


গৃহদাহ উপন্যাসে অচলা-মহিম-সুরেশের ত্রিভুজ প্রেমের সঙ্কট আলোচনা-সূত্রেবরুনকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর শরত্চন্দ্র : পুনর্বিচার গ্রন্থে লিখেছেন—


মহিম-অচলা-সুরেশের জীবনের এই কাহিনী ঘটনার অচ্ছেদ্য শৃঙ্খলে বাঁধা। এই শৃঙ্খলে কিছুসূত্র যোজনা করেছেন মৃণাল, কিছু কেদারবাবু। প্রধান তিন চরিত্রের মানসিকতা, তুলভ্রান্তি,সংশয়-উপলব্ধি ঘটনার টানাপোড়েনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গল্পকে নিয়ে গেছে অনিবার্য ট্র্যাজেডিরদিকে। ভুল কি কেবল অচলা করেছে? অল্পবিস্তর ভুল তিনজনেই করেছে।সাংসারিক বা ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কে মহিমের অনভিজ্ঞতা তার প্রথম ত্রুটি। আরসেক্ষেত্রে এক ধরনের নিষ্ক্রিয় অসন্তুষ্ট ভাব দ্বিতীয় ত্রুটি। মহিমের অসহিষ্ণু অতি-সংবতস্বার্থপর মনোভাব তৃতীয় ত্রুটি। তার আত্মকেন্দ্রিক দুর্গের ভিতরে সে কোনোদিন কাউকে প্রবেশকরতে দেয়নি। হয়ত মহিম এটাকেই তার গর্বস্থল বলে ভেবেছে, কিন্তু এই পথেই এসেছেতার সর্বনাশ। 'মহিমের প্রতি অচলার সকলের চেয়ে বড় অভিমান এই ছিল যে স্ত্রী হইয়াও সেএকটি দিনের জন্যও স্বামীর দুঃখ-দুশ্চিন্তার অংশ গ্রহণ করিতে পারে নাই। এই লইয়া সুরেশওবন্ধুর সহিত ছেলে-বেলা হইতে অনেক বিবাদ করিয়াছে, কিন্তু কোন ফল হয় নাই। কৃপণেরধনের মত মহিম সেই বস্তুটিকে সমস্ত সংসার হইতে চিরদিন এমনি একান্ত করিয়া আগলাইয়াফিরিয়াছে যে, তাহাকে দুঃখে দুঃসময়ে কাহারও সাহায্য করা দূরে থাক, কি যে তাহার অভাব,কোথায় যে তাহার ব্যথা, ইহাই কোনদিন ঠাহর করিতে পারে নাই।সুতরাং বাড়ী যখন পুড়িয়া গেল, তখন পিতৃপিতামহের ভস্মীভূত গৃহস্তূপের প্রতি চাহিয়ামহিমের বুকে যে কি শেল বিধিল, তাহার মুখ দেখিয়া অচলা তাহা অনুমান করিতে পারিল না।তাই সেদিন স্টেশনের উপরে স্বামীর অবিচলিত শান্ত মুখের প্রতি বারম্বার চাহিয়া সমস্তপথটা শুধু এই কথাই ভাবিতে ভাবিতে আসিয়াছিল, সহিষ্ণুতার ওই মিথ্যা মুখোশের অন্তরালেতাহার মুখের সত্যকার চেহারাটা না জানি কিরূপ!' (পরিচ্ছেদ ২৩)এই সংযত আত্মকেন্দ্রিক মহিম মাত্র একবারই তার দুর্ভেদ্য আত্ম-দুর্গের বাইরেএসেছিল—যখন রোগমুক্তির পর জব্বলপুর যাত্রার আয়োজন চলছিল। মাত্র একবারই সেবলেছিল, 'অচলা, ভেতরে ভেতরে আমি বড় দুর্বল, বড় অসুস্থ।' মহিমের এই আকুলআবেদনে অচলার প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক—'যে মুখ ফুটিয়া কখনো কিছু চাহে না, কখনো

নিজের দুঃখ অভাব ব্যক্ত করে না, তাহারই মুখের এই আকুল ভিক্ষা ঠিক যেন শূলের মতআঘাত করিয়া অচলার হৃদয়ে যত স্নেহ, যত করুণা, যত মাধুর্য এতদিন রুদ্ধ হইয়া ছিল, সমস্তএক সঙ্গে এক মুহূর্তে মুখ খুলিয়া দিল। সে নিজেকে আর ধরিয়া রাখিতে না পারিয়া পাছেঅসম্ভব কিছু একটা কবিয়া বসে এই ভয়ে চক্ষের জল চাপিতে চাপিতে একেবারে ছুটিয়া বাহিরহইয়া গেল। মহিম হতবুদ্ধির মত অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিস্ময়ে ব্যথায় সেই উন্মুক্ত স্থানের দিকেনির্নিমেষে চাহিয়া থাকিয়া আবার ধীরে ধীরে শুইয়া পড়িল।' (পরিচ্ছেদ ২৬)

অচলা ও মহিম এখানেই খুব কাছাকাছি এসেছিল। মহিম একটু অগ্রসর ও তৎপর হলে

এখানেই অচলার সঙ্গে তার যথার্থ মিলন ঘটতে পারত। মহিম সেই আগ্রহ দেখায়নি; অচলার

প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারেনি। তারই দোষে অচলা ভার কাছ থেকে আবার দূরে চলে গেল।


সুরেশ মহিমের বিপরীত চরিত্র। স্পষ্টতই সে ভার প্রচণ্ড অস্থিরতা, ভাব-প্রবণতা,

অসত্যম আর মোহের শিকার। সে অধিকার বাসনায় তাড়িত। সে প্রবৃত্তির বশীভূত। আর

একথাও স্বীকার্য, সে-ই এ কাহিনীর নিয়ন্তা। সুরেশের অস্থিরতা ও ভাবপ্রবণতা সুরেশ

চরিত্রের শিল্পসঙ্গতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। 'সুরেশের একদিকে গায়ের জোর ছিল

যেমন অসাধারণ, অন্যদিকে অন্তরটা ছিল তেমনি কোমল, তেমনি স্নেহশীল।' এবং অস্থির,

অসংযত। অচলার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই আমরা তা জেনেছি। ব্রাহ্ম যুবতীর মোহ থেকে বন্ধুকে

বাঁচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সুরেশ পটলডাঙ্গায় কেদারবাবুর বাসায় গিয়েছিল। অচলাকে দেখেই

বদলে গেল মতটা, আর সে মোহমুগ্ধ হল। তার উক্তি: “আজ আমি আমার বন্ধুকে বাঁচাবার

সংকল্প করেই শুধু এসেছিলুম—সে বিপদে না পড়ে, এ ছিল আমার একমাত্র উদ্দেশ্য; কিন্তু

এখন দেখছি, তাকে বাঁচানোর চেয়ে আপনাকে বাঁচানো আমার ঢের বেশি কর্তব্য।' (পরিচ্ছেদ

৪)। মহিমের সম্পর্কে বিরুদ্ধ কথা বলতেও যেমন তার বাধে না, তেমনি পরমুহূর্তে অনুতপ্ত

হয়ে মহিমের কাছে ক্ষমা চাইবার সংকল্প-ঘোষণাতেও তার বাধে না। প্রথম সাক্ষাতেই

অচলার কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়ে সুরেশ যখন দুটি হাত জোড় করে, তখন অচলা হাত ধরেবাধা দেয়। সেই স্পর্শে সুরেশের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। সুরেশ যে অস্থিরতা,ভাবপ্রবণতা আর মোহের শিকার, তার প্রথম পরিচয় এখানে পাই। 'বাহিরে আসিয়া যেননেশার মত তার সমস্ত দেহমন চলিতে লাগিল।' (পরিচ্ছেদ ৫)। নিজেকে সে বার বার

শুধিয়েছে—–এ বিস্ময় কিসের জন্য ? কিসে তাকে আজ এতখানি অভিভূত করেছে ? এ প্রশ্নের

সত্য উত্তর সুরেশ জানে না, আমরা জানি–সুরেশ মোহের শিকার, সে অস্থিরতা ও অসংযমের

কাছে পরাভূত।

প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকে পর পর পাঁচদিন সুরেশ অচলাদের বাড়ি গিয়েছে। বন্ধুর প্রতিকর্তব্য, অচলার প্রতি কর্তব্য : এই সব অসার যুক্তি দিয়েছে সে, নিজেকে ও সবাইকে ভোলাতেচেয়েছে, পারেনি। পঞ্চম দিনের সাক্ষাতেই সুরেশ-চরিত্রের দুর্বলতা ধরা পড়েছে। প্রমাণ

হয়েছে যে, মোহ আর অসংযমের কাছে সে সম্পূর্ণ পরাভূত। উপন্যাসের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদেই উদ্বৃত্ত

সুরেশ অচলাকে প্রবলবেগে আকর্ষণ করেছে, আলিঙ্গন করেছে। ব্রাহ্ম-বিদ্বেষী সুরেশ ব্রাহ্ম

বাড়িতে খেতে রাজি হয়েছে। অচলার কাছে তার আকস্মিক পরিবর্তনকে ভূমিকম্প বলে ব্যাখ্যা

করেছে।

এখানে স্বীকার করতেই হয়, সুরেশ-চরিত্রচিত্রণে শিল্পসঙ্গতি রক্ষিত হয়নি। জীবনেরআকস্মিকতাকে শিল্পে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, এখানে তা নেই। সামান্যপরিচয়ের পরই সুরেশ অচলাকে গ্রাস করতে চেয়েছে, অথচ প্রথম থেকেই অচলা সুরেশসম্পর্কে ‘ব্যাধতীত হরিণী’ আর ‘সুরেশ যেন ভাহাকে ছোঁ মারিয়া ধরিতে চায়'।—অচলা ভীত হইয়া উঠিল। সুরেশের মুখের উপর কি একপ্রকার শুষ্ক পাণ্ডুরতা

কপালের শির দুটো রক্তে স্ফীত, চোখ দুটো জ্বল জ্বল করিতেছে—যেন কি একটা সে ছোঁ

মারিয়া ধরিতে চায়।একে এই গরম, তাহাতে এত বেলা পর্যন্ত স্নানাহার নাই—গত রাত্রে এতটুকু ঘুমাইতেপারে নাই—তাহার পায়ের নীচের মাটিটা পর্যন্ত যেন আকথাৎ দুলিয়া উঠিল। আরক্ত দুই

চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল, ব্রাহ্মদের ঘৃণা করি কিনা, সে জবাব ব্রাহ্মদের দেব, কিন্তু

আপনি আমার কাছে তাদের অনেক অনেক উপরে তাহার উনাদ ভঙ্গীতে অচলা হয়ে

কাঠ হইয়া উঠিল। কোনমতে প্রসঙ্গটা চাপা দিবার জন্য সতয়ে কহিতে গেল,

বেয়ারাটা কিন্তু সে অঙ্কট মৃদু স্বর সুরেশের উত্তপ্ত উচ্চ কণ্ঠে ঢাকা পড়িয়া গেল। সে

অমনি তীব্রস্বরে কহিতে লাগিল, দুটো দিনের পরিচয়। তা বটে। কিন্তু জানো অচলা, দিন,

ঘণ্টা, মিনিট দিয়ে মহিমকে মাপা যায় কিন্তু সুরেশকে যায় না। সে স্থানকালের

অতীত। ভূমি ভূমিকম্প দেখেছ যা পৃথিবীকে গ্রাস করে অচলা ব্যাধতীত হরিণীর মত

চক্ষের পলকে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আপনার স্নানের যোগাড় বলিয়া পা বাড়াইতেই

সুরেশ সহসা সম্মুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া অচলার ডান হাত ধরিয়া টান দিল। সে উপুড় হইয়া

সুরেশের গায়ের উপর আসিয়া পড়িল। (পরিচ্ছেদ)


সুরেশের এই ব্যবহার আকস্মিক, অতর্কিত, আতিশয্য-দুষ্ট। লেখক সুরেশের এই কাজের

কৈফিয়ত দিয়েছেন, গরম, অনেক বেলা পর্যন্ত স্নানাহার না করা, গত রাকের অনিদ্রা।

প্রেমাবেগের এই কৈফিয়ত হাস্যকর। আসলে সুরেশ অস্থিরমতি, অসংযমী, মোহস্ত। এরই

সম্বন্ধে অচলার আগ্রহ। মহিমের পাশে সুরেশ কতটা 'মহৎ' সেটা প্রমাণের জন্য লেখক অপেক্ষা

করেননি। অচলা কিছু না ভেবেই সুরেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।


উপন্যাসের মূল বক্তব্য: ভালবাসার উপর জোর খাটে না। ছলে বলে কৌশলে আর যাই

লভ্য হোক, প্রেম নয়। সুরেশ তা বুঝেছে সর্বনাশের পর। তখন আর ফেরার উপায় নেই। বন্ধ

পরিচ্ছেদে যে মোহের জ্বলন্ত উদ্‌গীরণ, চল্লিশ পরিচ্ছেদে তার সম্পূর্ণ অবসান। অথচ এর মধ্যে

সুরেশ কখনই অচলাকে নিজের করে পায়নি। অচলাকে লাভ করবার জন্য কোনও উপায়ই

মোহগ্রস্ত অবস্থায় যার ঘৃণ্য মনে হয় নি, সেই সুরেশ ওই বাঞ্ছিতা যুবতীর উপর অধিকার

প্রতিষ্ঠা করেই তার ভুল বুঝেছে। অচলার মন তো সে পায়নি। অনুশোচনায় দগ্ধ সুরেশের

তখন একমাত্র চিন্তা কেমন করে বন্দিনী অচলাকে সে মুক্তি দেবে। অনেক মূল্যের বিনিময়ে

তার ওই করুণ উপলব্ধি। তার পর সুরেশের কাছে বেঁচে থাকার কোনো সার্থকতা নেই। পরের

করুণা ভিক্ষা করে সে বেঁচে থাকতে চায়নি বলেই মৃত্যুকে বরণ করেছে। 'মন ছাড়া যে দেহ,

তার বোঝা এমন অসহ্য ভারী, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।' (পরিচ্ছেদ ৪০)। এই পরিচ্ছেদ

থেকে পূর্বে উদ্ধৃত সুরেশের উক্তি প্রমাণ করে, সুরেশ অচলাকে মুক্তি দিতে চাইছে। এই ভূতের

বোঝা বয়ে বেড়াবার শক্তি তার আর নেই।


অচলা-চরিত্র এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। অচলা জীবনে সার্থকতা পেল না কেন ?অচলার অভিমান নিজেকে এবং অপরকে বোধের আলোতে দেখবার পথে একটি বাধা। আপনহৃদয়ের দাবি কি, তা-ও সে মুক্ত মনে জানার চেষ্টা করেনি। এই আঠারো বছরের যুবতীকে

উপন্যাসের সূচনায় যখন দেখি, তখন লক্ষ্য করি মহিম ও সুরেশের দুই বিপরীত মেরুপ্রতিম

পুরুষকে আকর্ষণের ক্ষমতা তার আছে। তার ট্র্যাজিক রূপটি লেখক নানা চিত্রকল্পের মাধ্যমেফুটিয়ে তুলেছেন। শোণ নদের বিস্তীর্ণ দগ্ধ মরুখণ্ড, দিকচক্রহীন সমুদ্রে ভাসমান অসহায় প্রাণী,কালো পাথরের গা দিয়ে নেমে আসা ঝরনার ধারার মতো দু চোখের কোল বেয়ে নেমে

আসা অশ্রু-ধৌত বিষাদ-প্রতিমা, বৈরাগ্যের নিঃশব্দ রূপ, উপদ্রুত অবমানিত ক্ষত-বিক্ষতনারী-হৃদয়ের স্বচ্ছ ঋজু ভয়ভাবনাহীন দৃষ্টি : অচলার সম্পর্কে এইসব ছবি তার ভয়ঙ্করএকাকিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে।

অচলা-চরিত্র নির্মাণে শরৎচন্দ্র তাঁর অভ্যস্ত ছকের বাইরে যেতে পারেনি। করুণা,

সমবেদনায় সে ক্ষুধার্ত বা অসুস্থ সুরেশের সেবা করে, রোগা মানুষ মহিমের বিপদাশঙ্কায়

ব্যাকুল হয়। লৌকিক সম্ভ্রমের খাতিরে রামবাবুর অনুরোধে অনিচ্ছায় সুরেশের শয্যাসঙ্গিনী হয়,

সুরেশের নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানে ভেঙে পড়ে আবার তারই সহানুভুতিতে ব্যাকুল হয়। অচলার তুল

যেসব ঘটনা মাধ্যমে দেখানো হয়েছে সেগুলি অচলা-চরিত্রের করুণা বা সহানুভূতিকে

উদ্‌ঘাটিত করেছে, তার ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেনি। অচলার অনুতাপের পিছনে কোন নৈতিক

মানদণ্ড সক্রিয়, একথাও বলা যায় না। রামবাবুর নিঠুর ব্যবহারের পিছনে একটা নৈষ্ঠিক

বিচারবুদ্ধি সক্রিয়, যদিচ মহিমের মাধ্যমে শরত্চন্দ্র তার বিরুদ্ধে উপন্যাস শেষে প্রশ্ন তুলেছেন,

কিন্তু অচলার কার্যকলাপের পিছনে কোন নৈতিক বিচার বা মানদণ্ড ছিল? ছিল না বলে তার

ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, কিন্তু তার ট্র্যাজেডি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।


অচলার ট্র্যাজেডি কোথায়? অনেকে বলেন, তার দোলাচলচিতায়। অচলার এই

দোলাচলবৃত্তি উপন্যাসে প্রমাণিত হয়নি। অচলা ঘটনা-তাড়িত, আকস্মিকতা লাঞ্ছিত। অচলার

জীবনে মহিমের প্রয়োজন কতটা, সুরেশের ভূমিকা কতটা, তা প্রমাণের জন্য যে অবকাশ

প্রয়োজন ছিল, তা লেখক দেননি। বিশেষত শেষোক্তের মূল্য কতটা তা স্পষ্ট হয়নি। সুরেশের

প্রতি অচলার করুণা ও সহানুভূতি ছিল, তা ধাপে দাপে প্রেমে পরিণতি লাভ করেনি। মৃণালের

সঙ্গে তুলনায় অচলার ঈর্ষা থেকে সুরেশের প্রতি তার ভালবাসা প্রমাণ হয় না। মহিমের সম্বন্ধে

তার শ্রদ্ধা, সুরেশের সম্বন্ধে তার আকর্ষণ কি জাতীয় শ্রদ্ধার পিছনে কি গভীর অনুরাগ

ক্রিয়াশীল? তা যদি হয় সে অনুরাগের ইতিহাস আমাদের জানা নেই। আকর্ষণের পিছনে যদি

অন্ধ আবেগ ক্রিয়াশীল হয় তবে বার বার সুরেশের মহত্ত্ব প্রমাণের প্রয়াস কেন? আসলে

সুরেশের মতো অচলাও অস্থির। অচলা নিজেও জানে না সে কি চায়, কাকে চায়। অচলা

কখনো ভেবেছে সে ভালবাসে মহিমকে, কখনো সুরেশকে। আসলে সে স্বামিত্বের আদর্শকে

আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল; কিন্তু আদর্শের সঙ্গে সংসারের পাত্রকে সে মিলিয়ে নিতে পারেনি।

এইজন্যই তাকে দণ্ড পেতে হয়েছে। উপন্যাসের শেষে শরৎচন্দ্র এই বক্তব্যকে স্পষ্ট করে

তুলেছেন অচলা-মহিমের কথোপকথনে—


সুরেশের শবদেহ সৎকারের পর অনেকদিন বাদে অচলা আর মহিম মুখোমুখি।

মহিম কহিল, এখন তুমি কি করবে?


আমি? বলিয়া অচলা তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কত কি যেন ভাবিতে লাগিল; শেষে

বলিল, আমি ত ভেবে পাইনে। তুমি যা হুকুম করবে, আমি তাই করব।


এই অপ্রত্যাশিত বাক্য ও ব্যবহারে মহিম বিস্মিত হইল, শঙ্কিত হইল। এমন করিয়া সে

একবারও চাহে নাই। এ দৃষ্টি যেমন সোজা তেমনি স্বচ্ছ, ইহার ভিতর দিয়া তাহার

বুকের অনেকখানি যে বড় স্পষ্ট দেখা গেল। সেখানে ভয় নাই, ভাবনা নাই, কামনা

নাই, কল্পনা নাই – যতদূর দেখা যায়, ভবিষ্যতের আকাশ ধু ধু করিতেছে। তাহার বঙ

নাই, মূর্তি নাই, গতি নাই, প্রকৃতি নাই–একেবারে নির্বিকার, একেবারে একান্ত শূন্য।

(পরিচ্ছেদ ৪৩)

অচলার এই ভয়ঙ্কর একাকিত্ব, দুঃসহ শূন্যতা, অসাধারণ বৈরাগ্যকে মহিম বুঝতেইপারেনি। শরত্চন্দ্র এখানেই অচলার ট্রাজেডিকে স্পষ্ট করে তুলেছেন। আপাতদৃষ্টে অচলামহিমের সঙ্গে কথা বলছে, আসলে সে যাকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করেছে, সে আর কেউ।বোধ করি তার স্বামী-আদর্শ, বোধ করি তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। অচলা তাকেআর কোনদিন ফিরে পাবে না। একুশ বছর বয়সেই তার জীবন থেকে মুছে গেল সব রঙ,ধ্বনি, সঙ্গীত, রইল কেবল ধু ধু আকাশ। এটাই অচলার জীবনে ট্রাজেডি।

তথ্যনির্দেশ


১. উদ্ধৃত, সমরেশ মজুমদার বাংলা উপন্যাসের পঁচিশ বছর (কলকাতা: রত্নাবলী, ১৯৮৬), পৃ. ৩০

অচ্যুত গোস্বামী, বাংলা উপন্যাসের কালান্তর (কলকাতা: পাঠভবন, ১৯৫৭), পৃ. ১৬৫


প্রসূন মুখোপাধ্যায় (সম্পাদক), শরওন্দ্রের গৃহদাহ (কলকাতা: রত্নাবলী, ১৯৯৬), পৃ. ১৯২


৪. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের যারা (কলকাতা: মডার্ন বুক এজেন্সী প্রাই


লিমিটেড, ষষ্ঠ সংস্করণ ১৩৮০), পৃ. ২৫৭


৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৯


৬. প্রসূন মুখোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮২


৭. পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৬-১৭


অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, শরওন্দ্র গুনর্বিচার (কলকাতা: গ্রাইমা পাবলিকেশন্‌স, ১৯৮৮), পৃ.

১. অজিতকুমার ঘোষ, জীবনশিল্পী শরত্চন্দ্র (কলকাতা: সাহিত্যলোক, ১৯৮৪), পৃ.


১০৫


১০. পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৯


১১. সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা উপন্যাসের কালান্তর (কলকাতা: সাহিত্যশ্রী, ১৯৭৬), পৃ. ২৬০

১২. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৪-৮৫


ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষ

বাংলা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ